লাশের মিছিল আর কতদিন?
আহমেদ ফয়েজ
সমগ্র আয়োজন এবং সমগ্র দৃষ্টি এখন ঢাকার সাভারে সাভারকে কেন্দ্র করে। বিবর্তনের জন্য সাভার ট্রাজেডি নিয়ে যখন লেখাটি প্রস্তুত করছি তখন সাভারে ধ্বসে পরা রানা প্লাজার তল থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে ২৮১টি এবং হস্তান্তর করা হয়েছে ২৫৬টি। আরো শত শত মানুষ ও শত শত লাশ চাপা পরে আছে ইট-সুরকির তলে। লাশের সারি দেখতে ছুটে চলেছে মানুষ অধর চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের বারান্দা থেকে বারান্দায়।
ফেসবুক সহ বিভিন্ন গণমাধ্যম একটু পর পরই এমন সব ছবি আপলোড করছে যেগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা ১৩৪৯ এর ম¤œত্তর এর বিভৎসতাকে হার মানায়। নিথর হয়ে আসে হৃৎপিন্ড। ২৮১টি মানুষের (২৬ মে ২০১৩ দুপুর ১টা পর্যন্ত) অকালে প্রাণ হারানোর পর মিডিয়াতে প্রকাশিত হচ্ছে যে, “বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভারে রানা প্লাজা নামের যে বহুতল ভবনটি ধসে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সেই ভবনটি অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে নোটিশ দেয়ার পরও লোকজন সরিয়ে নেয়া হয়নি। এই বহুতল ভবনটি নির্মাণ করা হয় ২০০৯ সালে। এর মালিক শাসক দল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন সাভার পৌর যুবলীগের আহ্বায়ক সোহেল রানা।
এই ভবনটি যেমন সরকারী খাস জমির ওপর অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। তেমনি ভবন নির্মাণে নেয়া হয়নি কোনো অনুমোদন।” ডয়চে ভেলে।
রাজউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নূরুল হুদাও এখন বলছেন, তাঁরা সাভারে রানা প্লাজা নামের বহুতল ভবন নির্মাণের কোনো অনুমোদন দেননি। সাভার পৌর মেয়র রেফায়েত উল্লাহও বলেন, সাভার পৌর এলাকায় ৬ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণে পৌরসভার অনুমোদন হলেই চলে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি তলার ভবন করতে হলে রাজউকের অনুমোদন লাগে। সোহেল রানা ৬ তলার অনুমোদন নিয়ে অবৈধভাবে ১০ তলা বানিয়েছেন। পৌর মেয়র আরও বরেন, ভবনটিতে ফাটল দেখা দেয়ার পর তাঁরা ভবনটি খালি করার নোটিশ দেন ২ দিন আগে।
সাভার মডেল থানার ওসি জনাব আসাদুজ্জামান মহোদয়ও এখন কথা বলছেন। তিনি বলেন, মঙ্গলবার সকালে ফাটল দেখা দেয়ার পরপরই ওই ভবনে থাকা চারটি গার্মেন্ট কারখানা ও ব্যাংক বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু অতি আশ্চর্যের বিষয় বুধবার সকালে কারখানায় আবার কাজ শুরু হয়।
ভবন মেরামত না করেই উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় ক্ষমতার জোরে সোহেল রানা মাইকিং করে বুধবার সকালেই ভবনটিতে সবাইকে ফিরে আসতে বলেন।
ফিরে আসতে তাদের হয়েছিল। কারণ তাদের অনেক ভয়, আবার অনেক প্রয়োজনও। তাদের কেউ কেউ সন্তানের জন্য একটু দুধ কেনার স্বপ্নে ফিরে এসেছেন, মায়ের জন্য কিছু ঔষধ কেনার জন্য এখানে শত ভয় ও শঙ্কা নিয়েও ফিরে এসেছেন কেউবা ফিরে এসেছেন তার ভাঙ্গা সংসারটিকে জোরা লাগানোর জন্য, বোনটি নিশ্চয়ই তার ছোট ভাইটির স্কুলের ফি পরিশোধের জন্য।
রাজউকের চেয়ারম্যানকে এখন পাওয়া যায় ডয়চে ভেলের মাইক্রোফোনের সামনে কিংবা সাভার পৌর মেয়র সাহেবকেও। কিন্তু তারা কেউ জানতেন না ঢাকা শহরের অদুরে ৬ তলার অনুমোদন নিয়ে ৯ তলা বিশিষ্ট একটি অতি ক্ষুদ্র ইমরত ঢাকা আরিচা সরকে নরবরে অবস্থায় দাড়িয়ে আছে। তাদের কেউই (এখন পর্যন্ত পাওয়া ২৮১টি মৃত দেহের) খবর জানতো না। তাদের কেউই কল্পনাও করতে পারেনি যে এই ইমারতটি ভেঙ্গে যেতে পারে।
মডেল থানার ওসি সাহেবও জানতেন না তার নিষেধাজ্ঞা মানা হবে না। কারণ ইমারত মালিক রানা সাহেব সরকার দলেরই একজন অতি সভ্য নেতা। তার নিষেধাজ্ঞা শুনে রানা সাহেব কোটি টাকার দালান কর্মহীন ভাবে রেখে দেবেন।
গত কয়েক বছরে নীমতলী দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ১২৪ জন, মিরসরাইয়ে ৪৮ জন, তারজীন ফ্যাশনে ১৫৮ জন, চট্রগ্রাম ফ্লাইওভার এ ২৫ জন।
গতকাল একজন বিদেশীকে নিয়ে ঢাকা শহরের কয়েকটি এলাকা দেখানোর ক্ষেত্রে সাহায্য করছিলাম। আমাদের টেক্সিওয়ালার মনটা খারাপ। সে চিৎকার করে বার বার বলছিল, “ভাই শ্রমিকেরাই সব সময় মারা যায়। একটা গার্মেন্টস এর ফ্লোর ইনচার্জ এর পর্যন্ত কিছু হয় না। জিএম এর কিছু হয় না। কেবল মারা যায় শ্রমিকেরা। তাজরীন ফ্যাশনে যে শত শত মানুষ মারা গেল তাদের কিছু হয়েছে?” বিদেশী বন্ধুটি জানতে চাইল ড্রাইভার কি বলছে। আমি তাকে ড্রাইভারের মনের কষ্ট বর্ণনা করলাম।
আসলেই তো কিছু হয় না। বিরোধী দল প্রধান সাভার পরিদর্শন করতে গেলেন। তার প্রটুকল দিতে গিয়ে বেঘাত ঘটল উদ্ধার তৎপরতায়। তিনি ফিরে এসে তার লোকদের দ্বারা সংবাদ সম্মেলন করিয়ে ঘোষণা করলেন যে এটা হত্যাকা-, গণহত্যা। হতাহতদের প্রত্যেককে কুড়ি লক্ষ টাকা অনুদান দিতে হবে সরকারের তরফ থেকে।
সরকার দলের প্রধান বলছেন বিরোধী দল পরিদর্শনের নামে উদ্ধার কাজে বেঘাত সৃষ্টি করছে। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে যথাযত পদক্ষেপ নিচ্ছি। রানা তাদের দলের কেউ না। আবার বলছেন সে যে দলেরই হোক না কেন তাকে বিচার করা হবে। অন্যদিকে ফেসবুকের কল্যাণে আমরা দেখছি সাভারের সাংসদ মুরাদ জং এর সাথে জনাব রানার ছবি সংবলিত পোস্টার। লেখা আছে তিনি যুবলীগের আহবায়ক।
অন্যদিকে উদ্ধার কাজে যারা আছেন তাদের কাছ থেকে বার বার এই সংবাদ আসছে- অন্য সবকিছুর চেয়ে সাভারের রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে আহতদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে এই ঔষধগুলো দরকার (এগুলি কিনে এনাম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ অথবা সাভারে স্থাপিত গণজাগরণ মঞ্চের ফিল্ড হাসপাতালে হস্তান্তর করুন।)
Inj. Ceftriaxone- ১ মিলিগ্রাম ১৮০ টাকা. ২ মিলিগ্রাম ৩০০ টাকা
Inj. Ketorolac- ৫৫ টাকা
Inj. Omeprazole- ৭০ টাকা
Inj. TT- ৬০ টাকা।
Inj. TIG- ১০২৩ টাকা
IV Saline- ২৫০ মি.লি ৪৭ টাকা, ৫০০ মি.লি ৭০ টাকা।
IV Hartman Solution- ৬০ টাকা।
Thread Silk- অপারেশনে প্রয়োজন ১০ মিটারের রোলের দাম ৫০ টাকা
Oxygen Spray- মূল দাম ৭৫০ (সাভারের কথা বললে ৬৫০টাকা)
ব্যান্ডেজ, তুলা, গজ ডেটল।
আর এনাম মেডিকেল কলেজে পানির স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। আপনারা যারা পানি নিয়ে যাচ্ছেন, তারা সাভারের রানা প্লাজার সামনে পানি নিয়ে ভীড় না করে এনাম মেডিকেলে পানি দিয়ে আসুন।
এয়ার ফ্রেশনার এবং অক্সিজেন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করুন। কারণ এগুলো অত্যন্ত দাহ্য, তাই এয়ার ফ্রেশনারের পরিবর্তে গোলাপ জল ব্যবহার করুন। উদ্ধার করে আনার পর অক্সিজেন দিন, ভবনের ভেতর পাইপ দিয়ে অক্সিজেন দেয়া অনেকসময় বিপদজনক হতে পারে।
মিডিয়াকর্মীদের কাছে অনুরোধঃ লাইভ কাভারেজ করতে গিয়ে উদ্ধার কাজে বিঘœ ঘটাবেন না।
চর্ট লাইট দিলে অবশ্যই সাথে ব্যাটারি, অথবা চার্জার দিবেন।
রক্ত, খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে, কিন্তু স্টকের ঔষুধ শেষ হয়ে আসছে। দয়া করে প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে সাহায্য করুন। অপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ভীড় করবেন না।
গণজাগরণ ফিল্ড হাসপাতালে যোগাযোগ: সঙ্গীতা ইমাম- ০১৭১১৬৪৬৮৭৭, বাঁধন- ০১৬৭৪৭৭৪৬৩৩।
উপরের এই প্রয়োজন তালিকাটি কিন্তু সাভার থেকেই এসেছে। দেশের সাধারণ মানুষ ঝাপিয়ে পরেছে সাভরে। যার যা আছে তা দিয়ে সাহায্য করছে সবাই। সেনাবাহিনী সহ সরকারের কোন বাহিনীর কাছেই এসব নেই। দেশে একটি দালান ধ্বসে পরলে কিভাবে উদ্ধার করতে হবে তার সরঞ্জামাদি সরকারের কোন বাহিনীর কাছেই নেই। তাই সাধারণ মানুষ একটি পল্টনে প্রেস ক্লাবের উল্টা পাশ থেকে কিংবা লাজ ফার্মা থেকে অক্সিজেন কিনে নিয়ে দৌড়াচ্ছে সাভারে। আমার কয়েকজন বন্ধু জিজ্ঞাস করছে প্রয়োজনের তালিকাটা কোথায়?
আমরা কাদের কথা শুনব? উদ্ধার কাজে যে সাধারণ বালকটি একাই তিরিশোর্ধ তাজা প্রাণ নিজের জীবন বাজি রেখে উদ্ধার করেছে তার নাকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিরোধী দলীন নেত্রীর পোষ্যদের? ২৮১ টি প্রাণের মূল্য কি পরিশোদ হয় বিশ লক্ষ টাকা দিয়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে বিরোধী দলের প্রতি আপনার তীক্ষè মন্তব্য এবং রানার বিচার হবে এই আশ্বাস কি আমরা বিশ্বাস করব?
বলা হচ্ছে ঢাকা শহরে প্রায় ছয় হাজার দালান ঝুঁকি পূর্ণ অবস্থায় আছে। মাঝে মাঝে প্রিন্টিং ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সেগুলো তুলে ধরে। রানা প্লাজার মতোই অকেজো ঘোষণা করে। কিন্তু সেই পৌর মেয়র কিংবা মডেল থানার ওসির মতো চুপ করে আছে রাষ্ট্র। সরকার।
আর কয় শত লাশ চান আপনারা। আর কয়টি লাশের মিছিল প্রয়োজন আপনাদের?
আলোচিত ব্লগ
লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?
মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন
অভিনেতা
বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়
প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন
চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)
সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন
তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?
আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন