১৯৭১ সালে চুয়ান্ন বছর আগে বাস্তবে দেখা ছিটেফোঁটা স্মৃতি নিয়ে লেখা আজকের এই গল্প :
কতইবা হবে বয়স তখন...! এই ছয় থেকে সাত । শিক্ষক বাবার সচেতন মানসিকতায় তখনকার দিনে কমবয়সে ক্লাস থ্রি তে পড়া গ্রামীণ আবহে বেড়ে উঠা এক দুরন্ত কিশোর । মা-বাবার চোখ এড়িয়ে নিতান্তই ছুটে চলা । চোখের সামনে যা দেখি- মনের সেলুলয়েডে তা গেঁথে যায় কিংবা বলা চলে ফুল এইচডি শটে তা অটোমেটিক সেভ হয়ে যায় অযুত-নিযুত জিবি ধারণ ক্ষমতার মগজের এই স্মৃতিকোষে ।
কিছু দৃশ্যপট :
গ্রামের মাঝখানে একমাত্র পুকুর যার নাম স্থানীয় ভাষায় ‘বড়দিঘী’ নামে পরিচিত ।প্রতিদিন যথারীতি শাপলাফুল তোলার জন্য পুকুরে আমরা চার-পাঁচজন কিশোর হাঁসের আদলে দিঘির পানিতে পায়চারি করছি । এমনসময় বাড়ি থেকে খবর আসে আমাদেরকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাওয়ার জন্য । যথারীতি বাড়িতে যেতেই বুঝতে পারি, দুপুরের মধ্যে আমাদেরকে বাড়িঘর ছেড়ে দুরে কোথাও চলে যেতে হবে । প্রচন্ড খুশি মনে বেমালুম খাওয়া-দাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে কখন রওয়ানা দিব বলে আমাদের কিশোর মন উথাল-পাথাল করতে থাকে । খাবারের জন্য মায়ের বেশ কবার তাড়ার পরও খাবার খেতে অস্বীকার করতে থাকি । অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আমরা সবাই বাড়ি ছেড়ে অজানা গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হচ্ছি । গরুর গাড়িতে বোঝাই কিছুদিন চলার মতো চাল-ডাল, লবন-তেল সাংসারিক খাবারদাবার ও অন্যান্য সামগ্রী । আমাদের পরিবারের( বাপ-চাচারা চার-পাঁচ ভাইয়ের )পঞ্চাশ-ষাটটা গরু ১৫/২০ জন নারীপূরুষ মিলে পায়ে হেটে বাস্তুবাড়িঘরত্যাগী এক কাফেলা পায়ে হেটে চলছে অজানা কোন গন্তব্যে । আমার একটা আদরের পোষমানা ধবল রংয়ের বিড়াল ছোট বস্তায় পুরে যেই পিঠের মধ্যে নিয়েছি অমনি জানপ্রাণ নিয়ে তা শব্দ করে নড়াচড়া শুরু করলে বাবার ধমক খেয়ে বস্তার মুখ খুলে দিতেই একলাফে বিড়ালটি জঙ্গলে পালিয়ে যায় । এতক্ষনে, ৪/৫ কিলো: পায়ে হাটার পর তীব্র ক্ষুধা অনুভব করতে থাকি । শেষ বিকেলে সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে মুক্তাঞ্চলের সর্দার পাড়ায় আমার বাবার এক শুভাকাংখী বন্ধু রহিম্বুল্লাহ চাচার বাড়িতে আশ্রয় নেই ।আজো মনে আছে, সন্ধ্যার অব্যবহিত ঠিক পরেই শুকনো মরিচপোড়া আর লবণ দিয়ে মায়ের হাতের সেই ভাতের অমোঘ স্বাদ এখনো ভুলতে পারিনি… ! সেই বাড়িতে আমরা দুই মাসের মতো ছিলাম । মনে পড়ে, সেখানে জোৎস্না স্নাত রাতের বেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের পদচারনা, তাদের শলাপরামর্শ, বিশাল অঙ্গনে অনেক মানুষের পদচারনায় রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতারে ঘন ঘন গাওয়া আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, চরমপত্র ও খবর শোনা ।
একটি বিশেষ স্মৃতি :
পাকসেনাদের ছোড়া বোমার শব্দ । আমরা দুপুর বেলায় উচু ভিটের এক মসজিদের ধারে ২০/৩০ জন সবাই শুয়ে জান বাঁচানোর চেষ্টায় লিপ্ত ।মসজিদ সংলগ্ন ছোট্ট পুকুর । সৈন্যদের বোমা ছোড়ার সময় একটি শব্দ পেলেই আমার বয়স্ক এক দাদু প্রতিবার আল্লাহু আকবার বলে পুকুরে ঝাঁপ দেন ।তীব্র বেগে বোমা কাছাকাছি পড়ে বিস্ফোরণ হয়ে বোমার ছাড়া (গোলা) আশে পাশেই পড়তে থাকে । কিছুক্ষণ পর অর্থাৎ ১০/১৫ মিনিট বাদে আবারও বোমা ছোড়ার সময় একটি শব্দ পেলেই আমার সেই বয়স্ক দাদু প্রতিবারই পুকুরে ঝাঁপ দিতে থাকে । এই অবস্থা দীর্ঘ সময় বা কমপক্ষে ঘন্টাখানিক চলতে থাকে এবং এত ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থাতেও এই দৃশ্য অবলোকন করে আমরা শিশু-কিশোরেরা সেই সময় হাসি আটকাতে পারিনি । সেই সময় বেশ কিছু গরু-ছাগলের মৃত্যুসহ ওই এলাকার এক ব্যবসায়ীর বৃদ্ধা মা বোমার আঘাতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন । তখনকার সময়ে কেন জানি মৃত্যুকে এত কাছাকাছি দেখার পরও মনের সাহস একটুও হারাইনি কিংবা একটিবারের জন্যও মনে হয়নিযে, আমাদের জন্য মৃত্যু এত কাছাকাছি অবস্থান করছে ! এই ঘটনা মনে এখনও শরীরে শিহরণ জাগায় ….!
==========

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




