শাহাবুদ্দিন শুভ : সম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করলে চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনা উদ্বেগজনক বিষয় হিসেবে উঠে আসে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি, চিকিৎসকদের মারধরের অভিযোগে সারা দেশের সব হাসপাতালে 'কমপ্লিট শাটডাউনে'র ঘোষণা দিয়ে চিকিৎসকরা তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। এতে দেশের চিকিৎসক, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও রোগীদের মধ্যকার টানাপোড়েনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে
বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের ঘটনা বা অভিযোগের ফলে নির্দিষ্ট হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগ কিংবা পুরো হাসপাতালেই চিকিৎসা সেবা বন্ধ হতে দেখা যায়। তবে পুরো দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় 'কমপ্লিট শাটডাউন' এবারই প্রথম দেখা গেছে। এই পদক্ষেপ চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও গ্রহণকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করছে। এর ফলে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থায় একটি বিপর্যয়কর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।শনিবার (৩১ আগস্ট) রাত ১২টার দিকে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে ঢাকা মেডিকেল এর নিউরো সার্জারি বিভাগের তিন চিকিৎসককে মারধরের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার-বিচার, নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করাসহ চার দফা দাবিতে সারা দেশে সব ধরনের চিকিৎসাকেন্দ্রে সেবা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা এই কর্মসূচিকে বলছেন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’। রোববার বেলা দুইটার পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্লকের সামনে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচি ঘোষণা করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের আবাসিক সার্জন আবদুল আহাদ। তিনি চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়দের পক্ষে কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
অপরদিকে সারাদেশে চিকিৎসকদের ডাকা শাটডাউন তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম। এ ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। এর প্রেক্ষিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের আশ্বাসে আগামীকাল সোমবার রাত ৮টা পর্যন্ত কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি স্থগিত করেছেন চিকিৎসকরা।
আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও গ্রহণকারীদের মধ্যে এধরণের ঘটনা ঘটছে আসুন তা একটু দেখে নেই :
অতিরিক্ত রোগীর চাপ: বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা অধিক, কিন্তু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর সংখ্যা সীমিত। এর ফলে রোগীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়, যা তাদের হতাশ করে এবং কখনও কখনও তা দেসহিংসতায় রূপ নেয়।
মৃত্যুর জন্য দায়ী করা: রোগীর মৃত্যু হলে অনেক সময় রোগীর পরিবার বা আত্মীয়রা চিকিৎসকদের অবহেলা বা ভুলের জন্য দায়ী করে। এর ফলে উত্তেজিত জনতা চিকিৎসকদের ওপর হামলা করে।
স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর দুর্বলতা: দেশের অনেক স্থানে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। এতে সেবা প্রদানে বাধা সৃষ্টি হয়, এবং রোগীরা চিকিৎসকদের ওপর রাগান্বিত হয়।
কখনও ভুল বোঝাবুঝি: ভুল বোঝাবুঝির কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, যা সহিংসতায় রূপ নিতে পারে।
প্রভাব:
চিকিৎসা পেশায় অনীহা: এই ধরনের হামলা চিকিৎসকদের মধ্যে ভীতি ও হতাশা সৃষ্টি করছে, যা তাদের মনোবল ও পেশাদারিত্বে প্রভাব ফেলছে।
চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থা সংকট: রোগীরা চিকিৎসকদের ওপর আস্থা হারাতে পারে, যা পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
প্রশাসনিক ব্যবস্থা: প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে এই ধরনের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপযুক্ত আইন প্রয়োগ ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
সম্ভাব্য সমাধান:
মিডিয়া ও সামাজিক সংযোগ: গণমাধ্যম এবং সামাজিক সংযোগের মাধ্যমে চিকিৎসক এবং রোগীদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সামাজিক মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো যেতে পারে, যাতে রোগীরা বুঝতে পারেন যে চিকিৎসকদের ওপর হামলা শুধু একটি ব্যক্তিগত ঘটনা নয়, এটি পুরো সমাজের জন্য ক্ষতিকর।
আইনের প্রয়োগ: আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় দ্রুত তদন্ত এবং শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এই ধরনের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা যেতে পারে।
সচেতনতা বৃদ্ধি: রোগী ও তাদের পরিবারকে স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন করা এবং সঠিকভাবে চিকিৎসা সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করা।
চিকিৎসা অবকাঠামোর উন্নয়ন: হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম, ওষুধ এবং জনবল সরবরাহ নিশ্চিত করা, যাতে চিকিৎসকরা সঠিকভাবে সেবা দিতে পারেন।
চিকিৎসকদের প্রতি সম্মান বৃদ্ধি: চিকিৎসকদের কাজের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সমাজে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলা।
চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো শুধু স্বাস্থ্যসেবার জন্যই নয়, পুরো সমাজের জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এ ধরনের ঘটনাগুলো দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর আস্থা হ্রাস করছে এবং এটি দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যসেবার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এর ফলে চিকিৎসকরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধাগ্রস্ত হতে পারেন, যা সমাজের সব স্তরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
এ সংকট মোকাবিলায় সরকার, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংস্থা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রতিটি পক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা নির্ধারণ করে এবং সেগুলোর কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশেষ করে, সারা দেশে চিকিৎসা সেবা বন্ধ করার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। এ ধরনের পদক্ষেপ সাধারণ জনগণের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে এবং এ কারণে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে।
যদি কোনো চিকিৎসক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার শিকার হন, তবে প্রথমেই আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এর পাশাপাশি, স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। অন্যদিকে, যদি সেবা গ্রহণকারীরা মনে করেন যে তাদের চিকিৎসা সেবা ঠিকমতো হয়নি বা চিকিৎসায় অবহেলা হয়েছে, তাহলে তাদেরও আইনানুগ পথে সমাধান খুঁজে নেওয়া উচিত। মারধর, শারীরিক লাঞ্ছনা বা ভাঙচুর করে কোনো সমস্যার কার্যকর সমাধান পাওয়া সম্ভব নয়; বরং এতে সমস্যার সমাধান আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে ।
প্যারিস, ফ্রান্স, ১লা সেপ্টেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:০৪