somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রম্যরচনাঃ বাচ্চা ভয়ংকর

৩০ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ৮:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কোন এক অজ্ঞাত কারণে বাচ্চা কাচ্চাদের সাথে আমার বনিবনা বেশ ভালো। চকোলেট ও আইসক্রিমের প্রতি এই বুড়ো বয়সেও আমার তীব্র আকর্ষণ এর একটা কারণ হতে পারে। আমার নিজের দুটো বাচ্চা এখন আর বাচ্চা নেই। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, আর একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে দিয়ে চাকরি করছে। তাই আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশিদের বাচ্চা কাচ্চাই আমার ভরসা।

তো এদের মধ্যে ঢাকা নিবাসী আমার এক শ্যালিকার দুটো বাচ্চার কথা বলি। তারা পাঁচ ও সাত বছরের দুই বোন একদিন তাদের মগবাজারের সরকারি ফ্ল্যাটের দোতলায় সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ বসে খেলা করছিল। আমি ঢাকায় গেলে কখনো কখনো এদের বাসায় থাকি। আমার ভায়রাভাই একজন সরকারি কর্মকর্তা। সেদিন ছিল শুক্রবার। ছুটির দিন। বেলা সাড়ে দশটার দিকে মগবাজার পৌঁছে ফ্ল্যাটের বাইরে ল্যান্ডিং-এ বসে বাচ্চাদের খেলতে দেখে আমি আনন্দের সাথে বললাম, ‘হ্যালো আম্মারা, আপনারা কেমন আছেন?’
ওরা খেলতে খেলতে মাথা না তুলেই বললো, ‘ভালো।’

আমি ওদের পাশে ধপ করে বসে পড়লাম। তারপর সাইড ব্যাগ খুলে চারটা চকোলেট, দুটো চিপস্ আর দুটো ম্যাঙ্গো ফ্রুটি বের করে ওদের হাতে ধরিয়ে দিতেই ওদের সাথে আমার পুরনো বন্ধুত্ব চাঙ্গা হয়ে উঠলো। ওরা দু’বোন আমার চকোলেট প্রীতির কথা জানে। তাই একটা চকোলেট আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ‘এটা তুমি খাও।’
দেখলাম, ওদের ফ্ল্যাটের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আমি চকোলেট খেতে খেতে বললাম, ‘আপনারা বাইরে বসে খেলছেন কেন? এ সময় না আপনাদের কার্টুন দেখার কথা!’
বড় বোনটি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, ‘আব্বু ছুটির দিনেও বাসায় বসে অফিসের কাজ করে। আমাদেরকে কার্টুন দেখতে দেয় না।’
আমি কলিং বেল টেপার জন্য উঠে দাঁড়ালে ছোট বোনটি মুখভর্তি চকোলেট নিয়ে থড়বড় করে বললো, ‘টলিং (কলিং) বেল টিপো না খালু। আব্বু আম্মু দু’জনেই লেগে (রেগে) যাবে।’
‘কেন, রেগে যাবে কেন?’
বড় বোনটি বললো, ‘অফিসের কাজ করছে যে! আমাদেরকে বলেছে কেউ যেন কলিং বেল না টিপে।’
‘ও, আচ্ছা।’
আধা ঘণ্টা পর অফিসের কাজ শেষ হলো। আমার শ্যালিকা ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ‘আম্মুরা এসো’ বলে আমার দিকে চোখ পড়তেই ভুত দেখার মতো চমকে গেল। থতমত খেয়ে কোনমতে বললো, ‘দু দু দুলাভাই, আপনি?’

চাকরি জীবনে আমার এক কলিগের ছয় বছর বয়সী ছেলের কথা বলি। কলিগ ভদ্রলোক ভীষণ রাশভারি স্বভাবের মানুষ। বাসায় বা অফিসে সব সময় গম্ভীর মুখে থাকেন। কথাবার্তা প্রায় বলেন না বললেই চলে। ফলে বাচ্চার সাথে তার কোন বন্ধুত্ব নেই। কিন্তু একদিনের দেখাতেই বাচ্চাটির সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কীভাবে জানেন?
আমার বাসায় একটা ছোট খাটো ম্যারেজ ডে’র অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানে অফিস কলিগদের কয়েকজনকে কাপল্ ওয়াইজ দাওয়াত দিয়েছিলাম। রাশভারি ভদ্রলোক বাচ্চাটিকে সাথে নিয়ে এসেছিলেন। কেক কাটাকুটি শেষ হলে ডাইনিং-এ বসে খাওয়া দাওয়ার সময় বাচ্চাটি ‘এটা খাবো না’, ‘ওটা খাবো না’ বলে তার মাকে খুব বিরক্ত করছিল। আমি ফ্রিজ খুলে একটা আইসক্রিম আর একটা চকোলেট এনে ওর হাতে দিলে সে মহাখুশি। জিব দিয়ে আইসক্রিম চাটতে চাটতে সে টুপ করে আমার কোলে বসে পড়লো। আমি ওকে আদর করতে করতে বললাম, ‘তোমাকে কে বেশি আদর করে? আব্বু না আম্মু?’
বাচ্চার সোজা সাপটা জবাব, ‘কেউ না।’
বাচ্চার বাবা মা বিব্রত। আমরাও বাচ্চার চটপটে জবাব শুনে একটু থমকে গেছি। পরিবেশ হালকা করার জন্য অন্য একজন কলিগের স্ত্রী হাসতে হাসতে বললেন, ‘ও, বুঝেছি। তোমার আব্বু আম্মু তোমার ছোট বোনটিকে বেশি আদর করে, তাই না?’
‘না।’ বাচ্চাটি চিৎকার করে বললো, ‘আব্বু শুধু আম্মুকে আদর করে।’

আমার ছয়জন ভাড়াটিয়ার মধ্যে একজনের থ্রি মেম্বার ফ্যামিলী। স্বামী, স্ত্রী ও পাঁচ বছরের একটি ভয়ানক বাচ্চা। বাচ্চাটি প্রায়ই তার মায়ের কষ্ট করে বেঁটে রাখা রান্নার মশলাগুলো তিন তলার জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়। আর শুধু মশলা নয়, জানালা বা বারান্দার গ্রিল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলা যাবে এমন প্রায় সব জিনিষই সে ছুঁড়ে ফেলে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকজনের গায়ে পড়ে মাঝে মাঝে এ নিয়ে ভীষণ হাউ কাউ হয়।

একদিন বাচ্চাটি তার বাবার মোবাইল ফোন গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দিল। পাকা রাস্তার ওপর পড়ে মোবাইলের দফা রফা। আমার পরিবার গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকে। ওর বাবার হাতে ‘দুম’, ‘দুম’ করে মার খেয়ে বাচ্চার আকাশ পাতাল চিৎকার আমরা গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকেই শুনতে পেলাম। আমার ও আমার মিসেসের খুব কষ্ট হলো। বাচ্চাটিকে ওর বাবার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমি অস্ট্রেলিয়া থেকে আমার এক আত্মীয়ের পাঠানো প্রায় আধা হাত লম্বা একটা চকোলেট নিয়ে ধুপ ধাপ করে তিন তলায় উঠে ওর বাবার উদ্দেশ্যে রাগতঃ স্বরে বললাম, ‘ছোট বাচ্চা। একটা ভুল না হয় করেই ফেলেছে। তাই বলে এভাবে মারতে হবে?’
বাচ্চাটিকে ওর বাবার কবল থেকে মুক্ত করে আমি কোলে তুলে নিলাম। আদর করে চকোলেটটা ওর হাতে দিয়ে বললাম, ‘তুমি তো ভালো ছেলে। এই কাজ আর কখনো করো না, কেমন?’
ভালো ছেলে চকোলেটটা হাতে নিয়ে লাফিয়ে কোল থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে বারান্দার গ্রিল দিয়ে সেটা বাইরে ফেলে দিল। আমি নিচে গিয়ে দেখি, রাস্তার পাশে স্ল্যাববিহীন নর্দমার নোংরা পানিতে পড়ে চকোলেটটা একবার ডুবছে, আর একবার ভাসছে।

কিছুদিন থেকে আমার বড় ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি চলছে। প্রস্তুতির অংশ হিসাবে তার ঘরের পুরনো ফার্নিচার বদলে নতুন ফার্নিচার কেনা হচ্ছে। চার পাল্লার (দরজার) একটা চমৎকার আলমারি কেনা হয়েছে। বাড়ির সবার পছন্দ। মোবাইলের যুগে এই যৎসামান্য খবরও কী আর চাপা থাকে? আত্মীয়স্বজন যে যখন আসছে, সেই দেখে বলছে, ফ্যান্টাসটিক! কিন্তু আমার সম্বন্ধীর (স্ত্রীর বড় ভাইয়ের) আট বছরের ছোট মেয়েটি আলমারি দেখে কী বললো, জানেন?
চার পাল্লা আলমারির দুটো অংশ থাকে। এক অংশে সেলফ, অন্য অংশে হ্যাঙ্গার ও ড্রয়ার। মেয়েটি তার আঙ্গুল দিয়ে দুই অংশ দেখিয়ে বললো, ‘একটা ভাইয়ার জন্য, আর একটা ভাবীর জন্য। বেবীর জন্য কই? বেবীর কাপড় চোপড় রাখতে হবে না?’
********************************************************************************************************************
রি-পোস্ট
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ৮:৩৮
২৮টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×