১৯৩১ সালের ১৪ মার্চ। মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বাই)-এর ম্যাজেস্টিক থিয়েটারে মুক্তি পেল উপমহাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘আলম আরা’। ছবিটি ছিল একটি ফিচার ফিল্ম। দর্শকরা অবাক হয়ে দেখলো ছবির পাত্র পাত্রীরা একে অন্যের সাথে কথা বলছে। আলম আরা মুক্তির আগে ছিল নির্বাক ছবির যুগ। সে যুগের চলচ্চিত্রে অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিব্যক্তি, দেহ ভাষা, ইশারা ইঙ্গিত ইত্যাদির মাধ্যমে মুকাভিনয় করে ছবির কাহিনী উপস্থাপন করা হতো। সংগীত ও আবহ সংগীতের কোন প্রচলন ছিল না। কোন কোন নির্বাক ছবির ক্ষেত্রে যাত্রা পালার আদলে এক ধরনের আবহ সংগীতের ব্যবস্থা ছিল। সে যুগের প্রচলিত কিছু বাদ্যযন্ত্র নিয়ে থিয়েটারের বিশাল পর্দার নিচে কিছু বাদ্যযন্ত্রী বসে থাকতেন। সিনেমা শুরু হলে তারা বিভিন্ন দৃশ্য অনুযায়ী বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে এক ধরণের আবহ সংগীত সৃষ্টি করতেন। এতে দৃশ্য গুলোর আবেদন দর্শকদের কাছে বৃদ্ধি পেত। কিন্তু ছবিতে গানের কোন প্রচলন ছিল না।
আলম আরা ছবির একটি দৃশ্য
আলম আরা ছিল উপমহাদেশের প্রথম ছবি, যা সিনেমার অভিনেতা অভিনেত্রীদের মুখে শুধু সংলাপই নয়, সংগীতও সংযোজন করেছিল। আজ থেকে ছিয়াশী বছর আগে এরকম চলচ্চিত্র ছিল দর্শকদের কাছে এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল সিনেমা হলে। তখন এই সবাক চলচ্চিত্রটি এত বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল যে দর্শক নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশকে লাঠিচার্জ পর্যন্ত করতে হয়েছিল। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পরবর্তী ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত হাউসফুল ছিল, যা সেই যুগে ছিল অকল্পনীয়।
১৯৩১ সালে পত্রিকায় প্রকাশিত আলম আরা ছবির বিজ্ঞাপন
জোসেফ ডেভিড-এর লেখা এক পার্সি নাটকের ভিত্তিতে কুমারপুর রাজ্যের রাজকুমার ও এক বেদুইন (জিপসি) বালিকার মধ্যে গড়ে ওঠা প্রেমকাহিনী নিয়ে এই ছবির গল্প। গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিলেন কুমারপুর রাজ্যের রাজা এবং তার দুই স্ত্রী দিলবাহার ও নওবাহার। এই দুই রানী পরস্পরের প্রতি ভীষণ ঈর্ষাপরায়ণ ছিলেন। এদিকে রাজা ছিলেন নিঃসন্তান। একবার এক দরবেশ ভবিষ্যৎবাণী করেন যে, রাজার বংশধরের জন্ম হবে তার স্ত্রী নওবাহারের গর্ভে। এতে দিলবাহার আরও ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন। দরবেশের ভবিষ্যৎবাণী ফলে যায় এবং রাজকুমারের জন্ম হয়। সন্তান ধারনে অক্ষম দিলবাহার রাজার কাছে উপেক্ষিত হওয়ায় মনঃকষ্টে ভুগছিলেন। তিনি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাজ্যের সেনাধ্যক্ষ আদিলের (অভিনেতা ছিলেন পৃথ্বীরাজ কাপুর) সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে তিনি কৌশলে আদিলকে বন্দী করেন এবং আদিলের কন্যা আলম আরাকে (অভিনেত্রী ছিলেন জুবাইদা) রাজ্য থেকে বহিস্কার করেন। বহিষ্কৃত আলম আরা জিপসিদের খপ্পরে পড়ে এবং তাদের সাথে দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে থাকে। অবশেষে ঘটনাক্রমে অনেকদিন পর সে কুমারপুর রাজ্যের রাজপ্রাসাদে ফিরে আসে। নওবাহারের পুত্র সুদর্শন রাজকুমারের (অভিনেতা ছিলেন মাস্টার ভিথাল) সাথে তার পরিচয় হয়। তারা একে অন্যের প্রেমে পড়ে এবং প্রেমের পরিণতিতে তাদের বিয়ে হয়। পরিশেষে আলম আরার পিতা আদিলকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং দিলবাহারের শাস্তি হয়।
সংক্ষেপে এই ছিল আলম আরা ছবির কাহিনী। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন মাস্টার ভিথাল, জুবাইদা, জিল্লো, সুশীলা, পৃথ্বীরাজ কাপুর, এলিজার, ওয়াজির মোহাম্মদ খান, জগদীশ শেঠী ও এল ভি প্রসাদ। ছবিটির পরিচালক ছিলেন আরদেশির ইরানী। অন্যান্য তথ্যঃ-
প্রযোজনাঃ ইমপেরিয়াল মুভিটোন
চিত্রনাট্যঃ জোসেফ ডেভিড ও মুন্সী জহির
সংগীতঃ ফিরোজ শাহ এম, মিস্ত্রি ও বি, ইরানী
সিনেমাটোগ্রাফিঃ উইলফোর্ড ডেমিং ও আদি এম, ইরানী
সম্পাদনাঃ এজরা মীর
ছবির দৈর্ঘ্যঃ ১২৪ মিনিট
ভাষাঃ উর্দু ও হিন্দি
আলম আরা ছবিতে মাস্টার ভিথাল ও জুবাইদা
আলম আরা ছবির গান গুলিও ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। বিশেষ করে ছবির ‘দে দে খুদা কে নাম পর’ গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়। এটি ছিল ভারতীয় সিনেমার প্রথম গান। গেয়েছিলেন ওয়াজির মোহাম্মদ খান, যিনি ছবিতে দরবেশের ভুমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন। গানটি শুধু হারমোনিয়াম ও তবলা সহযোগে শুটিং চলাকালে লাইভ রেকর্ড করা হয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সেই সময় ডাবিং ও প্লে ব্যাক করার প্রযুক্তি না থাকায় শুটিং চলাকালেই সংলাপ ও গান লাইভ রেকর্ড করা হয়েছিল। একই কারণে সেই সময় অভিনেতা অভিনেত্রীদেরকে গানও গাইতে হতো। অর্থাৎ তাদেরকে গানেও পারদর্শী হতে হতো। আলম আরা ছবির অন্যান্য গানগুলো গেয়েছিলেন জুবাইদা ও জিল্লো। মোট সাতটি গান ছিল ছবিতে। ১) দে দে খুদা কে নাম পর ২) বদলা দিল আয়েগা ইয়া রব ৩) রুঠা হ্যায় আসমা ৪) তেরি কাতিল নিগাহোঁ নে ৫) দে দিল কো আরাম আয়ে ৬) ভর ভর কে জাম পিলা ৭) দারাস বিনা মারে হ্যায়।
আলম আরা ছবির একটি দৃশ্য
সেই সময় সাউন্ডপ্রুফ স্টুডিও না থাকায় এবং লাইভ রেকর্ডিং-এর কারণে আলম আরা ছবির অধিকাংশ শুটিং করা হয়েছিল রাতের বেলা। কারণ দিনের বেলা স্টুডিওর বাইরে থেকে আসা অবাঞ্ছিত শব্দের কারণে ধারণকৃত শব্দের মান খারাপ হয়ে যেত। অভিনেতা অভিনেত্রীদের আশে পাশে আউট অফ ফোকাস অবস্থায় মাইক্রোফোন লুকিয়ে রেখে সরাসরি ছবি ও শব্দ ধারণ করা হয়েছিল। টোনার সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করে পরিচালক আরদেশির ইরানী এই ছবির সাউন্ড রেকর্ডিং-এর কাজ করেন। টোনার সিঙ্গেল সিস্টেম ক্যামেরায় সরাসরি শব্দ ও ছবি ধারণ করে শুটিং করা হয়।
আলম আরা ছবির রেকর্ডিং-এ ব্যস্ত পরিচালক আরদেশির ইরানী
আলম আরা ছবিটি ভারতীয় সিনেমায় ফিল্মি মিউজিকের সূচনা করে, যা ছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মতো। বিখ্যাত চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগাল বলেছেন, এটি শুধুমাত্র একটি মুভি ছিল না। সংলাপ ও সংগীতের সমন্বয়ে ভারতীয় সিনেমার নতুন যুগের মাইল ফলক ছিল আলম আরা। চলচ্চিত্রে সংগীতের অসামান্য প্রভাব ও জনপ্রিয়তার কারণে মুম্বাইতে পরবর্তীকালে আলম আরার অনুকরণে অনেক সংগীত প্রধান চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।
আলম আরা ছবির কোন প্রিন্ট এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কোন স্টুডিও আর্কাইভ, পাবলিক আর্কাইভ বা ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে ছবিটির হদিশ পাওয়া যায়নি। পুনে ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ অফ ইন্ডিয়ার (NFAI) তথ্য অনুযায়ী দীর্ঘদিন খোঁজাখুঁজির পর ১৯৬৭ সালে ছবিটির একটি মাত্র কপি (এবং সম্ভবত সর্বশেষ কপি) পাওয়া গেলেও ২০০৩ সালের এক অগ্নিকান্ডে সেটি পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়, যদিও ধারনা করা হয় যে আলম আরা ছবির কোন প্রিন্ট কখনোই NFAI-এর সংগ্রহে ছিল না। ছবিটির এ্যান্টিক ভ্যালুর কারণে দুর্নীতি হয়ে থাকতে পারে বলে অনুমান করা হয়। NFAI-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক পি কে নায়ারের মতে, আলম আরা ছবির প্রিন্ট পুড়ে ধংস হয়ে যাওয়ার তথ্যটি সঠিক নয়।
এ ব্যাপারে নানারকম বিতর্ক থাকলেও এটা হয়তো সত্যি যে, ছবিটি আর এ পৃথিবীতে নাই। উপমহাদেশের প্রথম সংগীত সমৃদ্ধ সবাক চলচ্চিত্র ‘আলম আরা’ চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে।
*****************************************************************************************************************************
তথ্যসূত্র ও ছবিঃ উইকিপিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৮:৩২