আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-১)
তোমারে কহিব লজ্জাকাহিনী, লজ্জা নাহিকো তায়-
তোমার আভায় মলিন লজ্জা পলকে মিলায়ে যায়।
পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমি একা একা দাদার বাড়ির চারপাশটা দেখতে বেরোলাম। লোকে বলে সরকার বাড়ি মধুপুর গ্রামের সবচেয়ে বড় বাড়ি। কথাটা ভুল মনে হলো না। বাড়ির সম্মুখে চারচালা বিশাল বৈঠকঘর। পাশে টিনের চালা আর বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা টিউবওয়েল। প্রতিবেশি প্রায় সবাই এই টিউবওয়েল থেকে খাবার পানি নেয়। বৈঠকঘরের সামনে পায়ে হাঁটা রাস্তার দক্ষিণ দিকে লিচু গাছের নিচে একটা বড় সড় পুকুর। এটি ছাড়াও গ্রামের উত্তর পাড়ায় দাদাজানের আরো একটি পুকুর আছে, যার নাম পদ্মপুকুর। এই পুকুরের টলটলে স্বচ্ছ পানির কথা আমরা মায়ের কাছে বহুবার শুনেছি। বাড়ির পশ্চিম দিকে লম্বা টানা গোয়ালঘর। হাল টানা তিন জোড়া বলদ, ষাঁড়, দুধেল গাই, বকনা বাছুর ছাড়াও দুটো মোষ রয়েছে সেখানে। পাশে বিরাট বিরাট আউড়ের পালা। বাড়ির পূর্বদিকে কলার বাগান এবং লাউ কুমড়ার জাংলা পার হয়ে সামান্য হেঁটে গেলে উঁচু ভিটার ওপর সারি সারি অনেকগুলো পানের বরজ। বাড়ির উত্তর দিকেও দাদাজানের পানের বরজ। লোকে বলে মধুপুরের লোক পান বেঁচে ধান কেনে। পানের পাতায় পাতায় টাকা। এ অঞ্চলে যার যত পানের বরজ, সে তত ধনী। মাটির গুনে এই এলাকায় পানের আবাদ খুব ভালো হয়।
দাদাজানকে অবশ্য পান বেঁচে ধান কিনতে হয়না। তাঁর আলাদা ধানী জমি রয়েছে। সেই জমিতে যে ধান হয়, তাতে কামলা কিষাণ চাকর বাকর নিয়ে সরকার বাড়ির সদস্যদের সারা বছর চলে যায়। এই গাঁয়ে দাদাজানের অনেকগুলো পানের বরজ। সেসব বরজের পান বিক্রির উপযুক্ত হলে কামলারা পান ভেঙ্গে এনে বাড়ির বিশাল বৈঠকখানায় স্তূপ করে। তারপর তারা দক্ষ হাতে পান গুছিয়ে টুকরি বোঝাই করে সেগুলো মাথায় নিয়ে চাচাদের সাথে হাটে চলে যায়। এভাবে সপ্তাহে তিনদিন তিন হাটে পান বিক্রি করা হয়।
আমি ঘুরে ফিরে এসব দেখে এসে বাড়ির বাইরে একটা বাঁশের বেঞ্চে বসে ভাবছি, দাদাজানই কী এই গ্রামে সবচেয়ে ধনী লোক? হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। এই গ্রামে দবিরউদ্দিন পরামানিক নামে আরো একজন বিত্তশালী গৃহস্থের কথা আমরা শুনেছি। তবে গ্রামের অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র। বিষয় সম্পত্তির দিক থেকে এ গাঁয়ে দাদাজানের অবস্থান সম্পর্কে আমরা বাবা মার কাছ থেকে কোনদিন কিছু শুনিনি। গ্রাম সম্পর্কে আগ্রহ না থাকায় আমরা ভাই বোনরাও শুনতে চাইনি কখনো। তবে এবার গ্রামে আসার পর এই অল্প সময়ের মধ্যে অন্তত এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে মধুপুরে সরকার বাড়ির একটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান আছে।
‘কী দেখছেন মেজভাই?’
পেছন ফিরে দেখি, আলেয়া কয়লার গুঁড়ো দিয়ে দাঁত মাজছে। আমি বললাম, ‘ছিঃ, তোকে কী জঘন্য দেখাচ্ছে! যা ভাগ, তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে এসে তারপর আমার সাথে কথা বলবি।’
আলেয়া ছুটে পালিয়ে গেল। তবে কিছুক্ষণ পরে আবার ফিরে এল সে। এবার ওকে দেখে আমি অবাক। হাতমুখ ধুয়ে চোখে কাজল পরেছে। লালচে ফর্সা গালে হাল্কা পাউডারের প্রলেপ মেয়েটাকে যেন দুধে আলতায় রাঙিয়ে দিয়েছে। সুগন্ধী তেল মেখে আঁচড়ানো পুরু গোছার কালো কুচকুচে চুল পায়ের হাঁটু পর্যন্ত ছড়ানো। এই এতটুকু মেয়ের এত চুল! আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। মায়ের কাছে শুনেছি আলেয়ার মায়েরও নাকি এমন চুল ছিল। নতুন বিয়ে হয়ে আসার পর গাঁয়ের বউ ঝি’রা নাকি বড় চাচীমার চুল দেখার জন্য সরকার বাড়িতে এসে ভিড় জমাতো।
আমি চোখের পলক না ফেলে ওকে দেখছি দেখে লজ্জা পেল আলেয়া। মাথা নিচু করে বললো, ‘আপনাকে নাস্তা খেতে ডাকছে।’
বাড়ির ভেতরে এসে দেখি আমি ছাড়া আর সবার নাস্তা খাওয়া হয়ে গেছে। বড় চাচীমা তাঁর ঘরে মাদুর বিছিয়ে আমাকে খেতে দিয়ে সামনে বসে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। আলেয়া পাশে বসে হাতপাখা দিয়ে আমাকে বাতাস করছিল। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে সে বললো, ‘মা আপনার জন্যে কাঁদছে।’
আমি বললাম, ‘কেন, আমার কী হয়েছে?’
বড় চাচীমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে উঠে চলে গেলেন। আলেয়া বললো, ‘না, আপনার কিছু হয়নি। আপনার জন্মের পর বড়মা খুব অসুস্থ ছিলেন। সেই সময় মা আপনাকে তিন মাস কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে তো। তাই আপনাকে দেখে কাঁদছে।’
এরকম একটা কথা আমি শুনেছিলাম। আমার জন্মের পর মা মরণাপন্ন অবস্থায় তিন মাস শয্যাশায়ী ছিলেন। সে সময় বড় চাচীমাই আমার দেখাশোনা করেছেন। কিন্তু এত বছর পরেও বড় চাচীমা সে কথা মনে করে কাঁদছেন? আশ্চর্য! এ জগতে মাতৃস্নেহ সত্যিই এক বিরল অনুভূতি। কোন কিছুর সাথেই এর তুলনা চলে না।
নাস্তা খেয়ে আমি আলেয়ার সাথে উত্তর পাড়ার পদ্মপুকুর দেখতে গেলাম। পথে ওর বয়সী একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আলেয়া, কে রে?’
আলেয়া বেশ মুড নিয়ে বললো, ‘আমার মেজভাই। রাজশাহী থেকে এসেছে। তোদের মতো মূর্খ নয়। কলেজে পড়ে।’
মেয়েটি আমাকে সালাম দিয়ে আলেয়াকে বললো, ‘তুই যে দু’বার ফেল করে এখনো ক্লাস সিক্সে আছিস, লজ্জা করেনা?’
মেয়েটি চলে গেলে আমি আলেয়াকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘কী রে আলেয়া, মেয়েটা কী বলে গেল? তুই নাকি দু’বার ফেল করেছিস। সত্যি?’
‘ধুর, ধুর! এদের কথা বিশ্বাস করবেন না মেজভাই। এরা খুব মিথ্যে কথা বলে।’
‘তাহলে তুই ফেল করিসনি বলছিস?’
আলেয়া হাঁটতে হাঁটতে মাথা নিচু করে বললো, ‘একবার জ্বরের জন্য একটা পরীক্ষা দিয়ে আর দিতে পারিনি। পরের বার নানীর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে পরীক্ষার কথা মনে ছিল না। একে কী ফেল করা বলে, আপনিই বলেন?’
‘ও, আচ্ছা!’ বলে আমি এমন একটা ভাব দেখালাম যে ঠিকই তো, এটাকে ফেল করা বলা ঠিক না। যেখানে পরীক্ষাই দেওয়া হয়নি, সেখানে আবার পাশ ফেল কিসের?
আলেয়া বিজয়ের হাসি হেসে বললো, ‘এখন বুঝতে পারছেন তো মেজভাই, এরা কেমন মিথ্যুক?’
‘হাঁ, বুঝতে পারছি।’ আমি বহু কষ্টে হাসি চেপে রেখে বললাম, ‘তা’ এই মেয়েটা কে? তোর স্কুলে পড়ে নাকি?’
‘আরে না, এরা করবে পড়াশুনা? গণ্ডমূর্খের গুষ্টি। এই গ্রামেই থাকে, আমার সই। কিন্তু আজ থেকে ওর সাথে আমার সইয়ের সম্পর্ক শেষ।’
পদ্মপুকুরের আশেপাশে তেমন বাড়িঘর নাই। পুকুর থেকে একটু দূরে দু’একটা কুঁড়েঘর দেখা যায়। সরকারদের জমির ওপর এই কুঁড়েঘরগুলিতে সরকার বাড়ির কামলা কিষাণরাই থাকে। পুকুরের চার পাশ ঘিরে খেজুর গাছ। পুকুরের পূর্ব পশ্চিম দু’দিকেই পানের বরজ। দক্ষিণে বাঁশের ঝাড়। উত্তরে শান বাঁধানো ঘাট। আমি আর আলেয়া সেই ঘাটের ওপর বসে গল্প করছি। গল্পের কোন মাথা মুণ্ডু নাই।
‘মেজভাই, আপনি সাঁতার জানেন?’
‘উঁ হুঁ’
‘শহরের ছেলেমেয়েরা সাঁতার জানবে কী করে? ওখানে পুকুর কোথায়? ওখানে তো শুনেছি বাড়ির পাশে পুকুরের বদলে পচা ড্রেন থাকে, তাই না মেজভাই?’
আমি হাসবো না কাঁদবো! বললাম, ‘তুই সব জানিস, না? শহরে গেছিস কখনো?’
‘হাঁ, গেছি তো! ছোটবেলায় আব্বার সাথে আপনাদের বাড়ি গেছি। তখন আপনি খুব ফর্সা ছিলেন। এখন কালো হয়ে গেছেন।’
আমি বললাম, ‘ঠিক বলেছিস। আমারও মনে আছে, তখন তুই খুব কালো ছিলি। এখন ফর্সা হয়ে গেছিস।’
‘যান! আপনিও মর্জ্জিনার মতো খুব মিথ্যে কথা বলতে পারেন।’
‘মর্জ্জিনাটা কে?’
আলেয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, ‘ওই যে বললো না, আমি নাকি দু’বার ফেল করেছি। রাতকানা আবাগীর বেটি! ওর মা এমনই রাতকানা যে রাতের বেলা মর্জ্জিনার বাবাকে নিজের বাবা মনে করে ভাত খেতে ডাকে। কী লজ্জার কথা, বলেন!’
আমি সায় দিয়ে বললাম, ‘ঠিকই তো। ভীষণ লজ্জার কথা। তবে তোর ভাষাটা......।’
বড়ভাই প্রায় সমবয়সী দুই চাচার সাথে সারাদিন বৈঠকঘরে বসে তাস খেলেন। বড় চাচা জমি জমা, পানের বরজ, কামলা-কিষাণ আর হাট বাজার নিয়ে ব্যস্ত। আব্বা ঘরে বসে সারাদিন কানের কাছে রেডিও ধরে দেশের খবর শোনেন। চাচীমারা বাড়ির হাজারটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত। মা মনের আনন্দে গাঁয়ের বাড়ি বাড়ি ঘুরে মিলিটারিদের অত্যাচারের গল্প শোনান। তাঁর শ্রোতার অভাব নাই। মহিলারা হাঁ করে মায়ের গল্প শোনে। আর আমি আলেয়ার সাথে ঘুরে ঘুরে গাঁয়ে দেখার যোগ্য অযোগ্য সবই অবাক হবার ভান করে দেখে বেড়াই। আমরা ঘুরে বেড়াই পানের বরজে, ধানের ক্ষেতে, আম বাগানে, খাল বিলের পাড়ে, আখ আর পাটের ক্ষেতে। গাছ থেকে পেয়ারা বা বরই পেড়ে খেতে খেতে আমরা দু’জন ধান ক্ষেতের সরু আইল ধরে হেঁটে বেড়াই। তখনকার দিনে আলেয়ার বয়সী গ্রামের মেয়েরা রীতিমতো বিয়ের উপযুক্ত। তার ওপর সে অসামান্যা সুন্দরী। এমন একটা মেয়ে যখন খুশি যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়ায়। তার এই চঞ্চল স্বভাব আমরা আসার আগে থেকেই ছিল। এ নিয়ে তখনকার রক্ষণশীল গ্রাম্য সমাজে আড়ালে আবডালে যে কথা হতো না তা’ বলা যাবে না। কিন্তু সরকারের নাতনি বলে কথা। সামনা সামনি কেউ কিছু বলতে সাহস পেত না।
বাড়িতে আমার সব কাজ আলেয়ার। গোসলের জন্য চাপকল থেকে পানি তুলে বালতি ভরে রাখা, গামছা লুঙ্গি কাচা, খেতে বসলে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করা, বিছানার চাদর পাল্টানো, কাপড় চোপড় আলনায় গুছিয়ে রাখা আর সন্ধ্যের পর বারান্দায় বসে ‘আমি যা দেখি, আপনি তা দেখেন’ এই জাতীয় গেঁয়ো ধাঁধাঁ বলে আমার মাথা গুলিয়ে দেওয়া। কোন জিনিসের দিক থেকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে জিনিসটি আমি দেখতে পাচ্ছি কী না সেটা জানতে চাওয়াই হলো এই ধাঁধাঁর মাজেজা। আমি বলতে পারলে আলেয়া চুপ, না পারলে ওর সে কী হাসি আর হাত তালি! বড় চাচীমা সস্নেহে সব দেখেন আর আমার কিছু দরকার হলেই ডাক দেন, ‘আলেয়া’। এ বাড়িতে আসার পর কিভাবে কিভাবে যেন আমার সবরকম দেখভাল গিয়ে পড়লো আলেয়ার হাতে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বাড়ির কারো এ ব্যাপারে কোন প্রতিক্রিয়া নাই। যেন আমার দেখভাল তো আলেয়াই করবে-এমন একটা ব্যাপার। প্রথম প্রথম আমি একটু অস্বস্তি বোধ করলেও পরের দিকে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।
************************************************
আত্মজৈবনিক উপন্যাসঃ স্বপ্ন বাসর (পর্ব-৩)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১০:৩১