ডাক্তার ও পুলিশের মধ্যে কিছু চমকপ্রদ মিল আছে। এই দুই পেশার মানুষ সাধারণতঃ তাদের ক্লায়েন্টের সামনে হাসে না। মুখ গম্ভীর করে রাখে। এরা তাদের ক্লায়েন্টদের সাথে রহস্য করতে ভালোবাসে। যেমন ধরুন, আপনি কোন মামলার আসামী হয়েছেন। পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করতে এসেছে। আপনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার ভাই,আপনারা
আমার বাড়িতে কেন?’ পুলিশ মুখ গম্ভীর করে বলবে, ‘থানায় গেলেই জানতে পারবেন।’ বলার সময় পুলিশের চোখে মুখে একটা রহস্য রহস্য ভাব থাকবে, যা দেখে আপনি ভীত বা বিভ্রান্ত হবেন। বাস্তবে আপনি কখনো আসামী না হয়ে থাকলে আমার কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য স্বেচ্ছায় আসামী হয়ে পুলিশকে বাসায় আমন্ত্রন করার দরকার নেই। বাংলাদেশের সিনেমা বা নাটক দেখলেই চলবে।
ঠিক একইভাবে পেশাব, পায়খানা ও রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট ডাক্তারের সামনে হাজির করার পর ডাক্তার সাহেব যখন আপনার প্রেসক্রিপশন লিখছেন তখন আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন যে, ‘আমার কী হয়েছে ডাক্তার সাহেব?’, তাহলে তিনি গম্ভীর মুখে বলবেন, ‘আপনার এত কিছু জানার দরকার নাই। ওষুধ দিলাম, ঠিকমতো খাবেন। ঠিক আছে?’
অবশ্য পুলিশ ও ডাক্তারদের মধ্যে সবাই এমন গম্ভীর ও রহস্যপ্রিয় নন, কিছু ব্যতিক্রম আছে। যেমন, আমার এক আত্মীয় পুলিশ ইন্সপেক্টর তার অধীনস্থ এস,আই ও কনস্টেবলদের প্রায়ই নানারকম ধাঁধা বলে উত্তর জানতে চান এবং তারা উত্তর দিতে না পারলে নিজে উত্তর বলে দিয়ে হা হা করে হেসে লুটোপুটি খান। আবার আমাদের শহরে একজন মেডিসিনের ডাক্তারকে দেখেছি রোগীদেরকে জোক বলতে। জোক শুনে রোগযন্ত্রণায় কাতর রোগীদের মুখে হাসি না ফুটলেও ডাক্তার সাহেব নিজে হো হো করে হেসে সেটা পুষিয়ে দেন। তো এগুলো হলো ব্যতিক্রম।
এই দুই পেশার মানুষের মধ্যে আরও যেসব মিল পাওয়া যায়, সেগুলো এরকমঃ
* পুলিশের হাতের লেখা কোর্টের পেশকার ও উকিল মুহুরী ছাড়া অন্যেরা বুঝতে পারেনা। ডাক্তারের হাতের লেখা ওষুধের দোকানদার ছাড়া কেউ বোঝে না (কিছু ব্যতিক্রম বাদে)।
* এই দুই পেশার লোকের কাছে ফ্রি সার্ভিস বলে কিছু নেই (কিছু ব্যতিক্রম বাদে)।
* এই দুই পেশার লোকেরই বদ্ধমূল ধারণা যে, তাদের সামনে যে লোকটি বসে বা দাঁড়িয়ে আছে তার অবশ্যই কোন না কোন সমস্যা আছে (এ ক্ষেত্রে কোন ব্যতিক্রম নেই)।
* এই দুই পেশার লোকই তাদের ক্লায়েন্টদের সাথে রসিকতা করা পছন্দ করে না (এ ক্ষেত্রেও কোন ব্যতিক্রম নেই)।
কিছুদিন আগে একটা কাজে আমি থানায় গিয়েছিলাম। থানায় ঢোকার মুখে দেখলাম, দু’জন মহিলা পুলিশ সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। আমাকে দেখেই তারা হাসি থামিয়ে মুখ গম্ভীর করে ফেললো এবং এমনভাবে আমার দিকে তাকালো যেন আমি এইমাত্র স্ত্রীকে খুন করে থানায় আত্মসমর্পণ করতে এসেছি। আমি রিটায়ার করা বুড়ো মানুষ। এই বয়সে পুলিশ দেখলে ভয় ডর বেড়ে যায়। তাই হাসি হাসি মুখ করে বললাম, ‘মায়েরা ভালো আছেন?’
মায়েরা আমার গতিরোধ করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ‘কে আপনি? এখানে কী চাই?’
আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘কিছু চাই না। ওসি সাহেবের সাথে দেখা করতে এসেছি।’
এক মা ধমক দিয়ে বললো, ‘ওসি সাহেবের কাছে কী দরকার?’
আমি বললাম, ‘উনি আমার স্ত্রীর ভাই। একটু পারিবারিক কথা আছে।’
আর এক মা আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত উকুন বাছার মতো পরখ করে দেখে বললো, ‘পাগল নাকি?’
আলসেমীর কারণে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দাড়ি গোঁফ না ছাঁটায় আমাকে পাগলের মতো দেখাচ্ছিল কী না কে জানে! চেহারায় হয়তো খানিকটা ওরকম ভাব ছিল। না হলে মহিলা পুলিশের কাছে সুস্থ মানুষকে পাগল মনে হবে কেন?
এ তো গেল পুলিশের কথা। এবার একটু ডাক্তারের কথা শুনুন। চার বছর আগে আমার একটা মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছিল। তারপর থেকেই শরীরের নাট বল্টুগুলো মাঝে মাঝে ঢিলে হয়ে যায়। ফলে প্রায়ই আমাকে ডাক্তারের কাছে ছুটতে হয়। কিন্তু বার বার গিয়েও তাদের সাথে আমার সখ্যতা হয় না।
গত কিছুদিন থেকে বাঁ চোখে একটু ঝাপসা দেখছিলাম। চোখ দেখাবো দেখাবো করে একটু দেরিই হয়ে গেল। চোখের ডাক্তার ইয়ং ম্যান। সম্ভবতঃ চল্লিশ পার হননি। চেহারায় রাগী রাগী ভাব। বললেন, ‘কী হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘কী জানি, হয়তো ছানি।’ আমার অজান্তেই উত্তরটা সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার সংলাপের মতো হয়ে গেল। ডাক্তার সাহেব স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর গম্ভীর মুখে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এবং ব্লাড প্রেশার মেপে বললেন, ‘রেটিনোপ্যাথী।’
আমি বললাম, ‘রেটিনোপ্যাথী? আমি তো এ্যালোপ্যাথী হোমিওপ্যাথীর নাম শুনেছি। রেটিনোপ্যাথীর নাম তো কখনো শুনিনি!’
ডাক্তার সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, ‘আপনি কী আমার সাথে রসিকতা করছেন?’
আমি জিবে কামড় দিয়ে বললাম, ‘ছিঃ ছিঃ, রসিকতা করবো কেন?’
‘শুনুন।’ ডাক্তার সাহেব ভয়ানক গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘রেটিনোপ্যাথী কোন চিকিৎসা পদ্ধতি নয়। এটা আপনার রোগের নাম। হাই ব্লাড প্রেশারের কারণে আপনার বাঁ চোখে রক্তক্ষরণ হয়ে ঝাপসা দেখছেন।’
‘আমার প্রেশার কত?’
‘দুশো কুড়ি বাই একশো। এত হাই প্রেশার নিয়ে রোগীরা সাধারণতঃ রেগে থাকে। আর আপনি আমার সাথে রসিকতা করছেন? আজব লোক তো আপনি!’
আমি মাথা চুলকে বললাম, ‘এক্সকিউজ মি! বুঝতে পারিনি।’
আমার ওপর রাগ করেই কী না কে জানে, ডাক্তার সাহেব কোন চিকিৎসাই দিলেন না। পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল লিখে প্যাডের একটা পাতা ছিঁড়ে তিনি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি একজন মেডিসিন বা কার্ডিয়াক ফিজিশিয়ানকে দেখিয়ে আগে ব্লাড প্রেশার কন্ট্রোলে আনুন। তারপর রেটিনোপ্যাথী চিকিৎসার জন্য ঢাকার ফার্মগেটে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে যাবেন। রাজশাহীতে এ রোগের চিকিৎসা নাই।’
দেখুন, কী হ্যাপা হলো! তাই বলছিলাম কী, ভুলেও কখনো পুলিশ ও ডাক্তারের সাথে রসিকতা করবেন না।
*****************************************************************************************************************
রি-পোস্ট।
ছবিঃ নেট।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:২৭