somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতিচারণঃ ওপরওয়ালা

০৯ ই অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



চাকরিজীবনে আমার কিছু অম্লমধুর অভিজ্ঞতার কথা শুনুন। চাকরিতে ঢোকার মাত্র কয়েক মাস পরে আমাদের এক কলিগ বললেন, ‘হেনা সাহেব, আপনারা ইয়ংম্যান। অফিস ডেকোরাম মানতে চান না। কিন্তু এটা তো সরকারি অফিস। নিয়ম কানুন মেনে না চললে আপনার সমস্যা হতে পারে।’

আর একজন বললেন, ‘ভাই, চাকরি মানে চাকরের কাজ। চাকরের কোন স্বাধীনতা থাকেনা। ওপরওয়ালা যা বলবে, বিনা প্রশ্নে তা মেনে চলতে হবে। সরকারি অফিসে দুটো অলিখিত রুল আছে। রুল নাম্বার ওয়ান-বস ইজ অলওয়েজ রাইট। রুল নাম্বার টু-ইফ ইউ থিংক দ্যাট বস ইজ নট রাইট, দেন প্লিজ সি রুল নাম্বার ওয়ান। চাকরি করতে চাইলে হাংকি পাংকি ছেড়ে রেগুলার হোন। না হলে কিন্তু খবর আছে।’

আর একজন সিনিয়র বড়ভাই মোস্তাইন বিল্লাহ সাহেব বললেন, ‘হেনা সাহেব, এদের কথা শুনে বিভ্রান্ত হবেন না। এই ডিপার্টমেন্টে নতুন যারা আসে, তাদেরকে এরা এভাবেই ভয় দেখায়। ওপরওয়ালারা নিজেরাই অফিস ডেকোরাম মানেনা। চাকরি যখন করছেন, তখন আস্তে ধীরে সবই বুঝতে পারবেন। আপনি তরতাজা শিক্ষিত যুবক। এদের কথা শুনে ঘাবড়াবেন কেন?’

এইরকম ভয় ভীতি আর সাহসের যোগানের মধ্যে কয়েক বছর কেটে গেল। তেমন কোন বিপদ আপদের দেখা পেলাম না। তবে এ্যাকাউন্টেন্ট হওয়ার পর আমার ঘাড়ের আশেপাশে বিপদের ঘণ্টা বাজতে লাগলো। অফিসারদের টি এ, ডি এ, বিল এবং ঠিকাদারদের বিলে নানারকম অনিয়ম। বরাদ্দকৃত বাজেটের অতিরিক্ত খরচ। ভুয়া ওভারটাইম বিল। উপযুক্ত বিল ভাউচারের অভাব। বিল পাস না করে আটকে দিলে ওপরওয়ালাদের ধমক আর ঠিকাদারদের হাত কচলানো প্রলোভন। আমি কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে এ্যাজ পার রুলস এ্যান্ড রেগুলেশনস কাজ করে যেতে লাগলাম।

প্রথম ধাক্কাটা এলো বদলী অর্ডারের মাধ্যমে। আমি বদলী হয়ে চলে গেলাম নতুন কর্মস্থলে। সেখানেও কম বেশি একই অবস্থা। আমিও আপোষহীন নেত্রীদের মতো অনড়। দুই বছরের মধ্যে সাত বার বদলী হলাম। মোস্তাইন বিল্লাহ সাহেবের সাথে দেখা করে বললাম, ‘বড়ভাই, আর তো পারি না।’
বিল্লাহ সাহেব হেসে বললেন, ‘এই বয়সে পারি না বললে চলবে? হেনা সাহেব, একটা কথা মনে রাখবেন। কুকুর যখন শেয়ালকে তাড়া করে, তখন শেয়াল একাই হাঁপায়না, কুকুরও হাঁপায়।’

আমি বিল্লাহ ভাইয়ের কথায় অনুপ্রানিত হয়ে পূর্ণ উদ্যমে মাথা উঁচু করে চাকরি করে যেতে থাকলাম। এরপর শুরু হল নানারকম শো কজ। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পারমিশন ছাড়া ছুটির সময় আমি স্টেশন (কর্মস্থল থেকে পাঁচ মাইল পর্যন্ত) ত্যাগ করলাম কেন? ট্রেনিং থেকে ফিরে কর্মস্থলে যোগদানের জন্য আমার দুই দিন ট্রানজিট পাওয়ার কথা, আমি তিন দিন ভোগ করলাম কেন? বাড়ি থেকে ছুটির দরখাস্ত পাঠানোর নিয়ম নেই, আমি তা’ পাঠালাম কেন? দরখাস্তে ডায়রিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, অথচ মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি কেন? আমাকে সিভিল সার্জেনের কাছে রেফার করা হল। চিঠি চালাচালি হতে হতে আমার ডায়রিয়া ভালো হয়ে গেল। সিভিল সার্জেন রিপোর্ট দিলেন, আমি সুস্থ। ওপরওয়ালাদের কাছে আমি মিথ্যেবাদী হয়ে গেলাম। পরদিন অফিসে গিয়ে ‘এবারকার মতো আপনাকে সতর্ক করিয়া দেওয়া হইল’ মর্মে একখানা চিঠি এবং আবার পাণ্ডব বিবর্জিত স্থানে বদলীর অর্ডার পেয়ে গেলাম। ওপরওয়ালাদের মনে কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!

ছুটির আবেদন করলে সরাসরি নাকচ। ইনক্রিমেন্ট, টাইম স্কেল, এরিয়ার বিল ইত্যাদি পাওনার ব্যাপারে প্রশাসনিক আদেশ জারির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা। প্রমোশনের ব্যাপারে অহেতুক গড়িমসি। এ সি আর যাচ্ছে তাই। সার্ভিস বই লালে লাল। এরকম নানা অত্যাচারে আমি জর্জরিত। তবে বিল্লাহ ভাইয়ের কথা একটুও ভুল ছিলনা। ওপরওয়ালাদের কাছে আমার উপস্থিতি ছিল মূর্তিমান আতংক। যত দ্রুত সম্ভব আমাকে বিদায় করতে পারলেই তারা বাঁচে।

এভাবে পঁচিশ বছর চাকরি করার পর ২০০৬ সালে পূর্ণ পেনশন ও গ্র্যাচুইটি নিয়ে আমি স্বেচ্ছা অবসরে গেলে আমার ওপরওয়ালারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ২০০৫ সালের শেষের দিকে আমার একটা হালকা হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল। তা নাহলে হয়তো আমার জন্য তাদেরকে আরও কিছুদিন ভুগতে হতো। এই পঁচিশ বছরে, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমি যতবার বদলী হয়েছি তার চেয়ে বেশি বার বদলী হওয়া লোক অন্ততঃ আমার ডিপার্টমেন্টে কেউ নেই। মন্দের ভালো একজন অফিসার আমার স্বেচ্ছা অবসরের কাগজপত্র প্রসেসিংয়ের সময় বলেছিলেন, ‘হেনা সাহেব, আপনি কেন স্বেচ্ছা অবসরে যাচ্ছেন তা’ আমি জানি। ওপরওয়ালাদের সাথে একটু মানিয়ে চললে আপনাকে এত হেনস্থা হতে হতোনা। আরও ছয় সাত বছর চাকরি করতে পারতেন।’

আমার বয়স তখন পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে। তবু পঁচিশ বছরের যুবকের মতো আমি সিনা টান করে বলেছিলাম, ‘এইসব মেরুদণ্ডহীন ওপরওয়ালাদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাবান একজন ওপরওয়ালা আছেন। তিনিই আমার সহায়। আপনার উপদেশ আপনার নিজের পকেটেই রেখে দিন। আমার কোন প্রয়োজন নাই।’
*********************************************************************************************************************
রি-পোস্ট
ছবিঃ নেট
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:২৪
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×