বাদল আমার দিকে তাকিয়ে হাসি-হাসি মুখে বলল, খুবই মজা লাগছে। গুড অ্যাডভেঞ্চার। ডেডবডি নিয়ে ঘুরছি। কবর দেয়ার জায়গা পাচ্ছি না। সাে ইন্টারেস্টিং। সাে মাচ ফান—
দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আঙুল-কাটা জগলু ভাইয়ের ডানহাত মতি মিয়ার ডেডবডি নিয়ে আমরা মােটামুটি ভালাে ঝামেলাতেই পড়ে গেলাম। রাত একটা থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি যে দুই হাত সামনে কী হচ্ছে দেখা যায় না। আমরা ঢাকার দিকে ফিরে আসছি। শেষ চেষ্টা হিসেবে আজিমপুর গােরস্তানে ট্রাই করব এরকম পরিকল্পনা।
নিশিরাতে সাধারণ শব্দও কানে অন্যরকম শােনায়। গাড়ির চাকার শব্দ, বাতাসের শব্দ এবং বৃষ্টির শব্দ—সব মিলেমিশে একাকার হয়ে কেমন
ভৌতিক আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। মাঝেমধ্যেই মনে হচ্ছে সাদা চাদরে মুড়ি দেওয়া মতি মিয়া কাশছে। বুড়াে মানুষের খকখক কাশির মতাে কাশি।
বাদল চমকে উঠে বলল, ভাইজান, কে কাশে?
মাইক্রোবাসের ড্রাইভার নিয়ামত আলি চাপাগলায় বলল, আয়াতুল কুরসি পড়েন। আইজ আমাদের খবর আছে।
বাদল আমার কাছে ঘেঁষে এসে ফিসফিস করে বলল, মতি মিয়া কাশছে নাকি?
আমি উদাস গলায় বললাম, বুঝতে পারছি না। ঠাণ্ডা লেগে কাশিরােগ হতে পারে তবে লাশদের ঠাণ্ডা লাগে এ-রকম আগে শুনি নাই।
বাদল বলল, চলাে, আমরা উনাদের পাজেরাে গাড়িতে চলে যাই।
নিয়ামত আলি বলল, আপনেরা পাজেরাে গাড়িতে যাইবেন আর আমি একলা থাকুম এইখানে? ভূতের থাপ্পড় একা খামু? মাফ চাই !
বলতে বলতে ব্রেক চেপে সে গাড়ি থামিয়ে দিল। মনসুর সাহেবের গাড়ি অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। সেটাও ফিরে এল। মনসুর সাহেব গাড়ির উইন্ডােগ্লাস নামিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, কী হয়েছে?
আমাদের ড্রাইভার বলল, লাশ জিন্দা হয়ে গেছে। কাশতেছে।
মনসুর সাহেব বললেন, কি বল এইসব?
বাদল সঙ্গে সঙ্গে বলল, ঘটনা সত্য। একবার হাঁচি দিয়েছে, আমি স্পষ্ট শুনেছি।
নিয়ামত আলি বলল, সে ভূতে-পাওয়া লাশ নিয়ে যাবে না। লাশ এইখানে নামিয়ে দিতে হবে। লাশ নামানাের সময়ও সে হাত দিয়ে ধরবে না।
আমি মনসুর সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার, কী করা যায়?
উনি চুপ করে রইলেন। মিতু বলল, সব ঝামেলা আপনি তৈরি করেছেন। কী করা যায় সেটাও আপনি ঠিক করবেন।
আমি বললাম, তুমি আমার অবস্থায় হলে কী করতে?
মিতু বলল, আপনার অবস্থা আমার কখনাে হতাে না।
লাশ এখানে ফেলে রেখে যাব কি না, সেটা বলাে।
আপনার যা ইচ্ছা করুন, আমি আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করব; তারপর বাবাকে নিয়ে চলে যাব।
নিয়ামত আলি বলল, বাহাসের সময় নাই। এই জিনিস রাস্তার ধারে ফেলায়া আমরা চইল্যা যাব। সােজা কথা। সােজা হিসাব।
মৃত মানুষের ওজন বাড়ে কথাটা সত্যি। হালকা-পাতলা মতি মিয়াকে নড়ানােই মুশকিল। টানাটানির কাজ আমাকেই করতে হচ্ছে। কেউ ধরবে না। বাদলও না। মনসুর সাহেব পাঁচ-ব্যাটারির একটা টর্চ জ্বালিয়ে ধরে আছেন।
নিয়ামত আলি শেষ কথা বলে দিয়েছে, তাকে এক লাখ টাকা দিলেও সে লাশ হাত দিয়ে ধরবে না। দুই লাখ দিলেও না।
অনেক ঝামেলা করে ডেডবডি নামালাম এবং কাদায় পা হড়কে গড়িয়ে পানিভরতি গর্তে পড়ে গেলাম। লাশের গা থেকে কাপড় খুলে | গেছে। তার বীভৎস মুখ বের হয়ে আছে। লাশের চোখের পাতা রিগর | মর্টিস হবার আগেই বন্ধ করতে হয়, নয়তাে লাশ বিকট ভঙ্গিতে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। মতি মিয়ার চোখ কেউ বন্ধ করেনি বলে তার চোখ ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে।
তাকে নিয়ে পানিতে নামার পর একটা ঘটনা ঘটল। ডেডবডি পানিতে ভেসে উঠল। এমনভাবে ভাসল, যেন সে বসে আছে এবং আমাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ছে। চারদিকেই ঘন শালবন। বাতাস লেগে গাছের পাতায় শিসের মতাে শব্দ হলাে। সবার কাছে মনে হলাে মাথা দোলাতে দোলাতে মতি মিয়া শিস দিচ্ছে।
মিতু আতঙ্কিত গলায় বলল, হিমু সাহেব, আপনি এখনাে গর্তে বসে আছেন কেন? উঠে আসুন তাে! আমি আপনার পায়ে পড়ি। প্লিজ উঠে আসুন।
আমি বললাম, উঠে আসতে পারছি না। ব্যাটা আমার শার্ট ধরে আছে।
মিতু বলল, এসব আপনি কী বলছেন?
আমি বললাম, ঠাট্টা করছি। মৃত মানুষ শার্ট ধরবে কীভাবে? নামার সময় তার আঙুলের ভেতর শার্ট ঢুকে গেছে।
নিয়ামত আলি বলল, আমি পরিষ্কার দেখছি ভাইজান উঠতে ধরছিল, লাশটা খপ কইরা উনার শার্ট ধরছে। আইজ আমরার খবর আছে। পড়েন সবাই, আয়াতুল কুরসি পড়েন।
মানুষের স্বভাব হচ্ছে, সে একবার ভয় পেলে ভয় পেতেই থাকে। ভয় পাওয়াটা তার জন্য ধারাবাহিক ব্যাপার হয়ে যায়। নিয়ামত গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল, কেউ দয়া করে পেছনে তাকাবেন না। পিছনে তাকাইলে ধরা খাবেন।
বাদল ভীত গলায় বলল, কেন?
নিয়ামত আলি চাপাগলায় বলল, হারামজাদা এখন খাড়া হয়েছে।
বাদল বলল, কে খাড়া হয়েছে?
নিয়ামত ফিসফিস করে বলল, বুঝেন না কেন? মতি মিয়ার লাশ খাড়া হইছে। আয়াতুল কুরসি পড়েন। হারামজাদা মনে হয় গাড়ির পেছনে পেছনে দৌড় দিবে। দৌড় দিয়া আমাদের ধরতে পারলে খবর আছে।
গাড়ির দ্রুতগতিতে চলার অনেক বর্ণনা আছে। যেমন উল্কার গতিতে চলছে, গাড়ি ঝড়ের গতিতে চলছে। নিয়ামত বর্ণনার কাছাকাছি গতিতেই গাড়ি চালাচ্ছে। বিপজ্জনকভাবে সে মনসুর সাহেবের পাজেরােকে ওভারটেক করে এগিয়ে গিয়ে তৃপ্তির ভঙ্গিতে বলল, এখন ধরলে পাজেরােওয়ালারে ধরবে। আমরা রক্ষা পাইছি।
সে অবিশ্যি রক্ষা পেল না, পাজেরের ড্রাইভার তাকে ওভারটেক করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিয়ামত আলি পাজেরাে ওভারটেক করল। ঝড়ের গতি বাড়ছে। আমাদের দুই গাড়ির ওভারটেকের খেলা চলছে।
এর মধ্যে খালুসাহেবের টেলিফোন এসেছে। তিনি বাদলের সঙ্গে কথা বলতে চান। আমি বাদলের হাতে মােবাইল সেট ধরিয়ে দিলাম। বাদল ফিসফিস করে বলল, বাবা, এখন কথা বলতে পারব না। আমরা খুব বিপদে আছি। আমাদের তাড়া করছে?
কে তাড়া করছে?
মতি মিয়া। মতি মিয়া হচ্ছে ডেডবডি, যাকে আমরা কবর দিতে নিয়ে যাচ্ছিলাম। সে জীবিত হয়ে গেছে! সে আমাদের তাড়া করছে। ধমকাচ্ছ কেন বাবা? নাও, হিমু ভাইজানের সঙ্গে কথা বলাে।
আমি মধুর গলায় বললাম, হ্যালাে! খালুজান ভালাে আছেন? খালার শরীর ভাল?
খালুজান আকাশ ফাটিয়ে গর্জন করলেন, তুমি আমার ছেলেকে কী করেছ?
কিছু করিনি তাে খালুজান।
সে এইসব কী আবােল-তাবােল বলছে। মরা লাশ তাড়া করেছে।
মনে হয় চোখের ধান্দা। আমাদের ড্রাইভার নেয়ামতও সেরকম বলছে। আপনি কি ড্রাইভার নেয়ামতের সঙ্গে কথা বলবেন?
চুপ! স্টুপিড। তুমি শুধু ঢাকায় এসে উপস্থিত হও। দেখাে, তােমাকে কী করি।
এত উত্তেজিত হবেন না খালুসাহেব। অতিরিক্ত উত্তেজনায় স্ট্রোকফ্রোক হয়ে যেতে পারে।
চুপ! স্টুপিড।
একই গালি বারবার কেন দিচ্ছেন খালুজান? অন্য কোনাে গালি দেন। একই গালি বারবার দিলে গালির পাওয়ার কমে যায়।
খালুজান বললেন, তােমাদের এখানে তােমরা দুজন ছাড়া আর কে আছে?
নিয়ামত আলি আছে। আমাদের ড্রাইভার।
দেখি, তার হাতে টেলিফোনটা দাও।
আমি বললাম, খালুজান, তার হাতে টেলিফোন দেওয়া যাবে না। সে যে-গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে, এখন যদি তার হাতে টেলিফোন দিই সে অ্যাক্সিডেন্ট করবে। আমি বরং তার কানের কাছে টেলিফোনটা ধরি, আপনার যা বলার বলেন।
আমি নিয়ামতের কানের কাছে টেলিফোন ধরলাম। নিয়ামত বলল, বিত্তান্ত সবই সত্য। আপনে মুরুব্বি, আপনের সঙ্গে মিথ্যা বইলা কোনাে ফায়দা আছে? খামাখা ধমকাইতেছেন ক্যান? আমি ড্রাইভার নিয়ামত। আমি ধমকের ধার ধারি না। স্টুপিড গালি কইলাম দিবেন না। আমি জান হাতে নিয়া গাড়ি চালাইতাছি। আমি বইসা বইসা...' ছিড়তাছি না । বুঝছেন মুরুব্বি?
ঝড়ের গতি কমে এসেছে। আমরা ঢাকার কাছাকাছি চলে এসেছি। বাদলের ভয়টা মনে হয় কমেছে। সে আমার কাঁধে মাথা রেখে আরামে ঘুমুচ্ছে।
- আঙুল কাটা জগলু
- হুমায়ূন আহমেদ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১১:১১