আগের অধ্যায় গুলি এখানে পাবেন
আকাশে হালকা মেঘ দেখে আমি চিন্তাও করতে পারিনি যে আজকে সারাদিন বৃষ্টি পড়বে। সকালে যখন কলেজের উদ্দেশ্যে বের হলাম তখন আকাশের দিকে তাকাতে ভুল করিনি। হালকা মেঘ ছিল মাঝে মাঝে সূর্যটাও উকি মারছিল মেঘে ফাকে ফাকে। কিছুক্ষনের মধ্যে যে বৃষ্টি আসবে সে আমি কেন আমার সাথে আরো যে কয়জন ছিল তারাও ভাবেনি।
কলেজের কাছেই আসতে প্রকৃতি মাতা উদার হয়ে নিজের পানির ঝাপরি খুলে দিলেন, মানে বৃষ্টি শুরু হল।
কলেজে পৌছাতেই দেখলাম আমার মাথা আর কাধের কিছু অংশ সম্পূর্ন ভিজে গেছে।
“ভিজের গেছ দেখছি, এই নাও রুমাল,” একটা হাত আমার দিকে রুমাল বাড়িয়ে দিল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম মাশফিয়া দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় হালকা উদ্বিগ্নভাব ফুটে এসেছে।
তার হাত থেকে রুমাল নিয়ে আমি মাথা মুছতে লাগলাম।
“ছাতা আনোনি কেন?”
“আকাশ দেখে মনেতো হয় নি আজকে বৃষ্টি হবে,” আমি মাশফিয়ের প্রশ্নে জবাব দিলাম।
মাশফিয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চুল মুছতে মুছতে তার দিকে জিজ্ঞাশার দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলে উঠল, “জানি না তোমাকে কেন যেন কিউট লাগছে।”
“হুম ধন্যবাদ রুমালে জন্য,”এই বলে আমি আমার ক্লাসরুমের ভিতর ঢুকলাম। মাশফিয়ার দিকে দ্বিতীয়বার তাকালাম না।
খালি কেউ নেই।
আজকে একটু তাড়াতাড়ি মনে হয় এসে পড়েছি। কি আর করা, আমি আমার চিরাচরিত জায়গায় গিয়ে বসলাম। আজকে পড়ার মত কোনো বই আনা হয় নাই আমার তাই। চুপচাপ বসে আছি, আর আমার থেকে বেশ কয়েকহাত দুরে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। এখন ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে।
“বৃষ্টি আসলেই মনটা উদাস করে দেয়, তাই না? ”
আমি প্রশ্ন শুনেই হচকচিয়ে গেলাম। দেখলাম সুমনা দাঁড়িয়ে আছে।
“এত জোরে বৃষ্টি পড়ছে যে ছাতা নিয়েও কোনো লাভ হল না।”
সুমনার এই কথা শুনে তারদিকে ভালো করে তাকালাম আসলে সে কিছুটা ভিজে গেছে। গুড় চুল কপালে লেপ্টে আছে। সে তার কামিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে মাথা মুছতে লাগল। রুমালটাকে দেখে মনে হল এই ধরনের রুমাল আমি আগে কোথাও দেখেছি।
“কি হল এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?” সুমনা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেশ করে উঠল।
“পুরো ঝড়ো কাকের মত লাগছে তোমাকে,” আমি হেসে বলে উঠলাম।
“হো হো হো, শুনে মজা পেলাম,” এই বলে সে চলে গেল। তারপর নিজের বেঞ্চে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ফিজিক্স ল্যাবের অ্যাসাইনমেন্ট কি করেছ?”
“হ্যা।”
আমার এই প্রশ্ন শুনে সুমনা অবাক হল।
“তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আমি বাড়ির কাজ করার মত সিরিয়াস না।”
আমার এইকথা শুনে সুমনা মাথা ঝাকালো।
রাগে আমার ভ্রুটা নেচে উঠল। যদিও সুমনা সামনে দিকে বসে থাকায় সেটা দেখতে পেল না। সে তার অ্যাসাইনমেন্টের খাতা নিয়ে আমার দিকে এসে বলল, “আমার কিছুটা বাকী আছে, একটু দেখতে দিবে?”
আমি কিছু না বলে ব্যাগ থেকে আমার অ্যাসাইনমেন্ট খাতা বের করে সুমনার দিকে দিলাম। সে খাতা নিয়ে আমার পাশে বসে পড়ল তারপর লিখতে শুরু করল। আমিও কিছু না বলে আবার জানালার দিকে তাকালাম।
তুমুল বেগে বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতা হাতে নিয়ে অল্প কয়েকজনকে কলেজে আসতে দেখা গেল। মনে হচ্ছে আজকে তেমন কেউ আসবে না।মনে মনে আফসোস হতে লাগল, আরেকটু দেরী করে বের হলে হয়তো আজকে কলজে মিস দেয়ার একটা অজুহাত পেয়ে যেতাম। জানালার দিকে তাকিয়ে আরো অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তখনই ‘হ্যাচ্চো’ করে একটা শব্দ হল।
“কি ব্যাপার ঠান্ডা লেগে গেল নাকি?” আমি জিজ্ঞেশ করে উঠলাম।
“না, না এমনি হাচিটা এসে পড়ল,” সুমনা তাড়াতাড়ি বলে উঠল।
আমি মুচকি হেসে আবার জানালার দিকে তাকালাম।
একটু পরেই সে, “শেষ” বলে খাতাটা বন্ধ করল তারপর বলে উঠল, “ধন্যবাদ।”
আমি কিছু বললাম না। অ্যাসাইনমেন্ট খাতা আমি ব্যাগে ঢোকালাম।
সুমনা আমার পশে বসে রইল, তারপর আবার বলে উঠল, “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আতা কে সাহায্য করব।”
“এটা তোমার ব্যাপার, তুমি যেতা ভালো মনে কর সেটাই কর,” আমি বললাম।
“তুমি কি থাকবে?”
“না।”
সুমনা এবার চুপ করে গেল। তারপর হালকাভাবে গলা খাকারি দিয়ে বলল, “আমি জানি না তুমি কারনে রাজী হচ্ছ না তবে একটা বলে রাখি সবসময় সবার বেলাই একই কাহীনি ঘটে না। কেউ কেউ খুবই ভাগ্যবান আবার কেউ কেউ খুবই দুর্ভাগা। তাই বলে যে থেমে থাকতে হবে সেটা কোনো কথা না। সামনে এগিয়ে যেতে হবে,” তারপর একটু থেমে, “নিজের উদাহরণ দিয়ে অন্যকে থামানো কোনো মানে হয়, আমি তাই মনে করি।”
আমি সুমনার দিকে তাকালাম।
“অন্তত নিজের বেলার কথা বলি, এই তো প্রায় মাস খানেক হয়ে গেল আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে আমার ব্রেক-আপ হল। সে আমার চিটীং করেছিল, সে বিদেশে গিয়ে অন্য মেয়ের সাথে রিলেশন করে,” সুমনা এবার বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “তাই বলে যে দুনিয়ার সব ছেলে যে খারাপ তা নয়। হয়তো বা আমি সামনে গেলে আরেকজন ভালো ছেলে পাবো। তাই বলে একটা ছেলে আমার সাথে চিটীং করল সেই কারনে আমি সব ছেলেকে ওই কাতারে ফেলে দিব সেটা তো হয় না।”
তারপর সুমনা বেঞ্চ থেকে উঠে গেল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি চাই তুমি আমাকে সাহায্য কর, কেন যেন মনে হচ্ছে আমি একা কিছু করতে গেলে সব গোলমাল লেগে যাবে তুমি যদি থাক তাহলে সেটা অনেক গোছানো ভাবে করা যাবে।”
আমি কিছু বললাম না।
সুমনাও আর কিছু না বলে সামনে চলে গেল। আমি আবার জানালার দিকে তাকালাম।
বৃষ্টির দিন হলে যা হয়, আজকে কলেজে তেমন কেউ আসেনি। যারা এসেছে, তারা পুরো কাকভেজা হয়ে এসেছে। ব্যাতিক্রম শুধু নুশরাত আর রুপা। তাদের গায়ে বৃষ্টি তেমন ছুতে পারে নি। জিজ্ঞেশ করেছিলাম। তাদের উত্তর, তার নাকি নিজদের গাড়ীতে করে এসেছে।
মাত্র পনেরজনের মত এসেছে। তার মধ্যে ছেলেদের পরিমান বেশী। কম ছাত্র-ছাত্রী আসার কারনে এই প্রথম বারের মত আমাকে সামনের দিকে বসতে হল। হিসেবে সবার পিছনে বসলেও আসলে সেটাকে পিছনের বেঞ্চ বলা যায় না। কি আর করা বসতে হল সামনের দিকে।
সুমনা আমার দুই বেঞ্চ সামনে বসে আছে। সে তো খোলা চুল, রাবার ব্যান্ড দিয়ে পনিটেইলের মত করে রেখেছে। দুই কপালের দুই পাশ দিয়ে কিছু চুল বের হয়ে আছে। সত্যি কথা তাকে দেই অবস্থায় অনে সুন্দর দেখাচ্ছে।
সে যাই হোক আমি ক্লাসের দিকে তেমন মনোযোগ দিলাম না।
দেখতে দেখতে দুইটা পিরিয়ড শেষ। আমি কড়িডোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এখন বৃষ্টি নেই তবে আকাশ কালো হয়ে আছে, যে কোনো সময় ঝপ করে আবার বৃষ্টি আসতে পারে। আমি হাটতে লাগলাম। তখনই আমার সামনে এসে পড়ল কবি আতা।
আমি তাকে এড়িয়ে যাবার চিন্তা করছিলাম তখনই সে বলে উঠল, “রানা শোন, একটা কথা আছে।”
ইচ্ছা না থাকলেও বললাম, “কি কথা?”
“এখানে তো বলা যাবে না চল একটা নির্জন জায়গায় কথা বলি।”
“আছে নাকি নির্জন জায়গা?” আমি সন্দেহ প্রকাশ করলাম। কারন কলেজটা ছোট। এখানে তেমন নির্জন জায়গা পাওয়া যাবে সেটা আশা করা বৃথা।
সে বলল, “আয়।”
কি আর করা, আমি তার পিছে পিছে হাটতে লাগলাম। দেখা যাক কোথায় নিয়ে যায় আমাকে সে।
আতা আমাকে লাইব্রেরী থেকে একটু দূরে একটা জায়গায় নিয়ে গেল। বলতে গেলে জায়গাটা নিরিবিলি। আতা আমার দিকে তাকিয় বলল, “গতকাল সুমনার সাথ বলেছিলাম।”
“জানি, সুমনা বলেছে আমাকে।”
“তাহলে তো বুঝতে পারছিস আমার অবস্থা,” আতা করুন গলায় বলল, “সত্যি কথা আমি ওই মেয়েকে অনেক পছন্দ করি।”
“পছন্দ না ভালোবাসা?” আমি জিজ্ঞেশ করলাম।
“আসলে আমি শিউর না, তাকে দেখতে আমার অনেক ভাল লাগে, এইজন্যে আমি বলছি তার সাথে আমার শুধু ভালভাবে একটা লাইন করিয়ে দে পরে আমি বাকী সব ম্যানেজ করব।”
“তাহলে তুই নিজে যাস না কেন?”
আমার এই প্রশ্ন শুনে আতে বিশাল এক দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলে উঠল, “আরে বাপ তোরা তো জানিস আমার রেপুটেশন কি রকম, এছাড়া শুনেছি সে নাকি কবিতা তেমন একটা পছন্দ করে ন। আর অদের ক্লাসে আমাকে অনেকেই হাফ-পাগল বলে ডাকে।”
খারাপ কিছু তো বলে নি, আমি মনে মনে বললাম।
“যদিও কথা কিছুটা সত্যি,” আতা বলতে লাগল। “আমি আবার হাফ-পাগল কিনা।”
আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। কোনো পাগল যদি বলে সে পাগল না তাহলে মানা যায় সে পাগল, কিন্তু যে পাগল নিজেকে পাগল বলে স্বীকার করে তাহলে তাকে কি বলা যায়?
“কি বলিস তুই, রাজী আমাকে সাহায্য করার জন্য?”
“আচ্ছা দেখি,” এই বলে আমি লাইব্রেরীর দিকে পা বাড়ালাম। আতা আমার দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকলেও পরে সেটা দূর হয়ে গেল।
লাইব্রেরীতে বসে আছি। আজকে বই পড়তে তেমন ইচ্ছা হচ্ছে না। চুপচাপ বসে আছি। এমন এসে পড়ল নুশরাত। সে আমাকে দেখেই আমার পাশে এসে বসল।
“কি চিন্তা করছেন?” বসে জিজ্ঞেশ করল সে।
“না এমনিই, বসে আছি।”
“কিছু তো হলেও চিন্তা করছ?”
“তোমাকে বলতে হবে নাকি?”
“সেটা তোমার ইচ্ছে, তা কি ঠিক করেছ আতার ব্যাপারে?” নুশরাত সরাসরি জিজ্ঞেশ করল।
“ভাবছি থাকব, তবে দূরে দূরে। একেবারে জড়িয়ে পড়ব না এই ব্যাপারে,” আমি জবাব দিলাম।
“আমার মতে এই ব্যাপারে না যাওয়াই ভালো।”
নুশরাতের এই কথা শুনে আমি অবাক হলাম।
সে আমার চেহারায় প্রশ্ন দেখে বলে উঠল, “এই সব ব্যাপারে না জড়ানোই ভাল কিন্তু সুমনা যেভাবে উত্তেজিত হয়ে আছে তাতে আমি তাকে না করতে পারছি না।”
“তোমার কথা জানিয়ে দাও,” আমি বলে উঠলাম, “ আমি নিশ্চিত সে শুনবে তোমার কথা।”
নুশরাত কিছু বলল না, চুপ করে রইল। আমিও চুপ করে রইলাম। কেন যেন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে একটু বাড়াবড়ি হয়ে যাচ্ছে। সুমনা রাজী, রুপাও মনে হয় রাজী আর রাতুলতো এক পায়ে খাড়া হয়ে আছে। নির্জনতো সবসময় সুমনার পিছনে আছে। আর সজল তার প্রেমিকার হাতে ছ্যাক খেয়ে মনে হয় দেবদাস হয়ে গেছে। বাকী আমরা দুজন এর বিপক্ষে আছি।
“আমার মনে হয় সুমনা সাথে তোমার থাকা উচিত,” আমি বলে উঠলাম, “কারন মেয়েটা একটু ঢিলা টাইপের।”
আমার এই কথা শুনে মুচকি হেসে উঠল নুশরাত।
“তুমি থাক, তুমি থাকলেও তো হবে।” নুশরাত বলল।
“না, সেটা অসম্ভব,” আমি বললাম।
“তাহলে তুমি থাকছ নাকি?” নুশরাত আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেশ করল।
“বললাম না দূরে দূরে আছি।”
আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছিল, তাই সেটা করে ফেললাম, “আচ্ছা তুমি কি কারনে মনে করলে এই ব্যাপারে না যাওয়াই ভালো। আতার ব্যাপারটা তো তেমন কিছু না। সেটা আমি ম্যানেজ করতে পারব।”
আমার কথা শুনে নুশরাত একটা বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ আতা কোনো ব্যাপার না, ওরে দুইটা চড় থাপড় মারলে ঠিক হয়ে যাবে।”
নুশরাতের এই কথা শুনে কিছুটা মায়া লাগল আতার উপর।
“আসল সমস্যা হচ্ছে,” নুশরাত বলতে লাগল, “ ও মেয়েকে পছন্দ করেছে তাকে নিয়ে। সেই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সমস্যা। ওই মেয়ের কারনে আমি এখনো দ্বিধায় আছি, সুমনার আতাকে সাহায্য করা উচিত কিনা।”
এই বলে সে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
নুশরাতের এই কথা আমাকে চিন্তা ফেলে দিল।