সংবিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসঙ্গতি: (১৩)
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি: শুভঙ্করের ফাঁকি: (৬)
পুনরাবৃত্তি: সংবিধানের প্রস্তাবনায় ও দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে মোট ১৮টি ধারায় মূলনীতিগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। এই মূলনীতিগুলিতে এত অসঙ্গতি ও ফাঁকি বিদ্যমান যে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখেও শেষ করা যাবে না। আমি বিদগ্ধ পাঠকদের শুধু মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য খুব সংক্ষেপে আলোকপাত করবো।
ধারা ৮ থেকে ২৫ এতে মোট ১৮টি ধারা আছে। এই ধারাগুলি পড়লে মনে হবে আপনি পৃথিবীর কোন দেশে না বরং স্বর্গে বসবাস করছেন। কি নাই এই ধারাগুলিতে? বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবিধান যত ভাল ভাল কথা আছে তা চয়ন, সংকলন, সংগ্রহ, ও আহরণ করে তা এই সংবিধানে রেখে দেয়া হয়েছে।
রেখে দেয়া হয়েছে বলছি কেন? কারণ আসলেই এইগুলি রেখে দেয়ার জন্য লেখা হয়েছে। এইগুলি বাস্তবায়ন বা প্রয়োগ করার জন্য সংবিধানে লেখা হয় নাই। সংবিধানের ৮ ধারায় পরিষ্কার ভাবে বলে দেয়া হয়েছে, " .... তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না৷"
যেসব আইন, বিধি, বা নীতিমালা আদালতের মাধ্যমে বলবৎ যোগ্য হবে না তা প্রকৃত পক্ষে কথামালা ছাড়া আর কিছু না।
এই লেখার শুরুতেই খুব ছোট ছোট কিছু অসঙ্গতির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এর মূল কারণ ছিল সংবিধান প্রণেতা ও শাসক দলের নেতৃবৃন্দের মনস্তত্ব, মানসিক প্রবণতা, চিন্তাধারা এবং মনোগত বদ্ধমূল ধারণা যাতে সহজেই বুঝতে পারা যায়। তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারলে তাদের মনের ভিতর লোকানো উদ্দেশ্যটা বুঝতে সুবিধা হবে। আর লোকানো উদ্দেশ্য বুঝতে পারলে সংবিধান সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করা সহজ হবে। সংবিধান প্রণয়নের আসল উদ্দেশ্যটা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হলে সঠিক ভাবে সংবিধান বিশ্লেষণ কখনই সম্ভব হবে না। কোন আইনকে ক্রিটিক্যালি বিশ্লেষণ করতে হলে আইনের শুরুতে যে "উদ্দেশ্য ক্লজ" থাকে তা অনুধাবন করতে হয়। "উদ্দেশ্য ক্লজ" থেকে পুরা আইনটির স্কিম অথবা আইনটি থেকে কি লক্ষ্য অর্জন করতে চাওয়া হয়েছে তা বুঝা যায়।
৮ থেকে ২৫ ধারায় বর্ণিত নীতিমালাসমূহের শুধু শিরোনামগুলো পড়লেই বুঝা যায় যে কত ভাল ভাল কথার সন্নিবেশ করা হয়েছে। শিরোনামগুলো হচ্ছে, মূলনীতিসমূহ, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, মালিকানার নীতি, কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি, মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা, পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, সুযোগের সমতা, অধিকার ও কর্তব্যরূপে কর্ম, নাগরিক ও সরকারী কর্মচারীদের কর্তব্য, নির্বাহী বিভাগ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, জাতীয় সংস্কৃতি, উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, জাতীয় স্মৃতিনিদর্শন, প্রভৃতি, আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন।
তবে এইসব ভাল কথা শুনার পর কেউ যাতে অতিউৎসাহিত হয়ে না পরে তাই শুরুতেই বলে দেয়া হয়েছে যে, " .... তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না৷"
সংবিধান প্রণেতা ও শাসক দলের নেতৃবৃন্দের মনস্তত্ব ও উদ্দেশ্য ছিল, যেহেতু এই সব ভাল ভাল কথা বা নীতিমালা বাস্তবায়ন করার কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা নাই তাই পৃথিবীতে যত ভাল কথা আছে, তা যতই পরস্পর বিরোধী হউক না কেন, তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে কোন বাধা নাই। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। প্রথমত যখনই কেউ কোন ভাল কথা বলবে অথবা কোন বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করবে তখন বলা যাবে এটা আমাদের সংবিধানে আছে। দ্বিতীয়ত, এর মাধ্যমে যেকোন ধরণের মতবাদের বা বিশ্বাসের মানুষের সাথে প্রবঞ্চনা ছলনা, প্রতারণা, শঠতা, কপটতা, ও কৌশল করা যাবে।
আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার জন্য উদাহরণ হিসাবে দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত যেকোন একটি ধারা নিয়ে আলোচনা করা যাক। যেমন, সংবিধানের ১৮ ধারায় পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন নিয়ে খুব ভাল কথা বলা হয়েছে। যেসব দেশের সংবিধানে পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন নিয়ে একটি শব্দও নাই সেসব দেশে এই বিষয়ে অনেক কঠোর আইন আছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে এই বিষয়ে নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও কিছু নামকাওয়াস্তে আইন থাকলেও কোন কঠোর আইন নাই এবং প্রয়োগ নাই। এই ধরণের আইন কত কঠোর হতে পারে তা বুঝার জন্য উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ইন্ডিয়ার বিখ্যাত অভিনেতা সালমান খান একটি বিরল প্রজাতির হরিণ শিকার করাতে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল।
মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে হলে সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির শুভঙ্করের ফাঁকি থেকে বের হতে হবে। মূলনীতির আলোচনা এখানেই শেষ। আগামীতে আলোচনা করা হবে সংবিধানের তৃতীয় ভাগ, মৌলিক অধিকার নামক প্রহসন নিয়ে।
জনরাষ্ট্র ভাবনা-১৭