somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

৯৯.৯% কষ্টের জীবন

১৬ ই মার্চ, ২০০৯ রাত ১১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ধরা যাক, মেয়েটির নাম নিশি। সে নানাবাড়ি থাকত মায়ের সাথে। তার মা স্কুলের শিক্ষিকা আর বাবার দোকান ছিল একটু দূরের শহরে। বাবা মাঝেমধ্যে আসত, মামারাই তার সব। মফস্বল এলাকা হলেও কিভাবে কিভাবে যেন নিশিকে নাঁচের নেশায় পেল। মামাদের আগ্রহ আর নিজের চেষ্টা সব মিলে সে ভাল নাঁচতে শিখল। স্কুলের মেডেল তো পেতই, এলাকায় কালচারাল ফাংশন হলেও ডাক আসে। নিশির বয়স যখন বার তখন তার জীবনে দুটি আনন্দের ঘটনা ঘটে। এক, সে পঞ্চম শ্রেনীর বৃত্তি পরীক্ষায় পুরো জেলার ভিতর ট্যালেন্টপুলে তৃতীয় স্থান অধিকার করে। দুই, তার একমাত্র ভাই নাঈমের জন্ম হয়। দিনগুলো খুব সুন্দর কাটছিল।

মেয়েদের মনে হয় ছোট্ট বেলাটা খুব সুখের কাটে। যত বড় হয় চারপাশটা তাদের জন্য তত কঠিন হতে থাকে। নিশি যেন একটু বেশী তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল। শরীরটা খুব বাড়ন্ত ছিল। পড়ে ক্লাশ সিক্সে কিন্তু দেখলে মনে হয় এইট বা নাইনের ছাত্রী। ছোট্ট মফস্বল শহর, তার উপর এত এত গুন মেয়ের!! সবাই প্রায় একনামে চিনত। তাতে বোধহয় কোন সমস্যাও ছিল না। কিন্তু আল্লাহ যাকে দেয় তাকে মনে হয় সব কিছু উজাড় করে দেয়। নিশি দেখতে মারাত্মক রকমের সুন্দরী। আর সব সমস্যাটা সেখানেই। এত সুন্দর একটা মেয়ে নাচানাচি করবে আর এলাকার সুপুত্রদের সুনজরে পরবেনা তা কিভাবে হয়?

সুতরাং যা হবার তাই হল। নিশির নাচের উপর খড়গ নেমে আসল। মা-বাবা কড়াভাবে নিষেধ জারি করলেন। কিন্তু নাচ ততদিনে নেশায় চেপে বসেছে, মামারাও সাথে ছিল। ফলে লুকিয়ে লুকিয়ে নাচ একটু আধটু চলতে থাকল। পড়াশুনা অল্পতেই ভাল হয়, মেয়ের মেধা আছে। একটা কিছু নিয়ে তো তার থাকতে হবে। নিশির এক মামা বিতর্ক করতেন, তার হাত ধরেই নিশি বিতর্ক প্রতিযোগীতায় নাম লেখাল। ধীরে ধীরে সেখানেও সে ভাল করল।

ক্লাস সেভেন এর বার্ষিক পরীক্ষার পর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে অনেকদিন পর নাচল নিশি। এলাকার নামকরা গুন্ডা রিকি এরপর থেকেই ওর পিছনে লাগে। ঐ বয়স টা বোধহয় সব মেয়েদের জন্যই ডেঞ্জেরাস। একটা ফাড়াঁ আসবেই। নিশি নিজেও হাল্কা প্রশ্রয় দিয়েছিল কিনা কে জানে? পরের বছরটা নিশির পরিবারের জন্য রীতিমত আতঙ্কের ছিল। যখন তখন তুলে নেয়ার হুমকি, বিয়ের প্রস্তাব। নিশির মা দুচোখে অন্ধকার দেখেন। কত স্বপ্ন তার এই মেয়েকে নিয়ে। মেয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে ইংলিশে অনার্স পড়বে, আরো কত কি! লোকের কথায় কান দিয়ে মা মেয়েকে খুব মারেন আর ঘরে আটকে রাখেন। অথচ নিশির দোষ টা ছিল কি? অতিমাত্রায় সুন্দরী এটাই তো তার দোষ। কিন্তু নিশি ছিল খুব জেদী। বিনাদোষে আটকে রাখা সে মেনে নিল না, বাসা থেকে বের হল আর জীবনের সবথেকে বড় ভুল টা করল সেখানেই।

তিন দিন পর নিশিকে পাওয়া গেল সেন্সলেস অবস্থায়। সেদিন ই তারা ঢাকা চলে আসে। নিশির এক খালার বাসাতে ওঠে তারা। পরদিন খবর আসে নিশির বাবার দোকান সহ মার্কেট এর চার-পাঁচ টা দোকান কারা যেন পুড়িয়ে দিয়েছে। বাড়ি ফিরে যাবার পথ তাদের চিরদিনের মত বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও মেয়েকে যে ফিরে পেয়েছে এতেই তারা খুশী। সবকিছু আবার শূন্য থেকে শুরু হয়। নিশি অগ্রনী গার্লস স্কুলে ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়। মা আবার স্বপ্ন দেখে মেয়েকে নিয়ে, মেয়ে বিসিএস দেবে, কত বড় চাকরী করবে! কিন্তু কপালে তো থাকতে হবে।

তখন দিলওয়ালে দুলহানিয়া, কুচ কুচ হোতা হায় এর যুগ। একদিন বাড়িওয়ালী এসে নিশির মাকে বলে, আপনার মেয়েটা তো খুব সুন্দর – দেখতে একদম কাজলের মত। ওকে আমার ছেলের জন্য নিব। আত্মীয়-স্বজনরা বলে, এই মেয়ে যেখানে যাবে সেখানেই মানুষের চোখ পরবে। একে বিয়ে দিয়ে দেয়াই ভাল। তাছাড়া ছেলের ফ্যামিলি ভাল। ঢাকা শহরে ছয়তলা বাড়ি আছে, ছেলে পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করে। অতি উত্তম প্রস্তাব! মায়ের কিন্তু প্রবল অনীহা। সে নিজে সেই যুগের বিএড করা টীচার, মেয়েকে নিয়ে তার আরো কতশত স্বপ্ন। তবু সবাই ধরে বেধে নিশিকে পর করে দিল।

পড়ালেখা না হয় নাইবা হল। বিয়ের পর এই কিশোরী মেয়েটা কিছুটা সুখ তো পেতে পারত। কিন্তু কপালে যে সুখ লেখা নেই। বাঘের খাঁচা থেকে সিংহের খাঁচায় এসে পরে নিশি। বিয়ের রাতেই বুঝতে পারে তার স্বামী সোহেল নেশাগ্রস্ত। আর ধীরে ধীরে এটাও জানতে পারে তাকে আনা হয়েছে সোহেলের নেশা ছাড়াতে! অনিন্দ্য সুন্দর বউ যদি ছেলেকে ফেন্সিডিলের বোতল ছাড়াতে পারে এই আশায়! এটা যে কতবড় ভুল আর ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত তা শুধু ঐ অসহায় বউটি হারে হারে বুঝতে পারে, আর কেউ না। বুকের কষ্ট বুকে চেপে মরে, মা-বাবা কাউকে কিছু জানায় না নিশি। হয়ত অভিমান, হয়ত জেদ। আর কত ভোগাবে তাদের? তার জন্য বাড়িছাড়া হয়েছে, নিঃস্ব হয়েছে। এখন মেয়ে বিয়ে দিয়ে একটু ভারমুক্ত হয়েছে বেচারীরা। আবার তাদের ঘাড়ে চেপে বসা কেন? নিশি ভাবে তার জীবন তো গেছেই, এখন ছোট ভাইটার জীবন অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেয়া যাবে না।

নিশি চেষ্টা করে, প্রানপন চেষ্টা করে সোহেল কে নেশা থেকে মুক্ত করতে। শুভাকাঙ্খীদের সুপরামর্শে নিশি এই অল্প বয়সে মা হয়, পৃথিবীর আলো দেখাতে নিয়ে আসে আরেকটি অভাগী মেয়ে শিশুকে। এটা আরকটা মারাত্মক ভুল। নেশাখোর মানুষের কাছে স্ত্রী মা হল কি মারা গেল তাতে কিছুই আসে যায় না। জাগতিক কোন মায়া-মমতা-সৌন্দর্য তাদের স্পর্শ করে না, তারা বাস করে একটা ঘোরের মধ্যে – সেখানে আছে শুধু পাশকিবকতা আর নির্মমতা। দিন যায় আর রাত আসে। নিশির উপর নির্যাতন আর অত্যাচার বাড়তেই থাকে। কাহাঁতক আর সহ্য করা যায়। একসময় নিশির মামা-খালারা জানতে পারে, মাকে জানানো হয় আরো অনেক পরে। কিন্তু তাদের আর কিবা করার আছে? একটু স্বান্তনা, মাথায় হাত রাখা, চোখের জলে ভাসানো – ব্যস এইটুকুনই।

সাতটা বছর কেটে গেছে। নিশি বুঝতে পারে এই নরক থেকে মুক্তি পেতে হলে নিজেকেই কিছু একটা করতে হবে। নিশির মেয়ে একটু একটু করে বড় হয়। আর নিশি লুকিয়ে লুকিয়ে এসএসসি শেষ করে, একটা ইণ্টেরিয়র ডিজাইনের কোর্সে ভর্তি হয়। একসময় বাবা-মার কাছে চলে আসে। ডিভোর্সের প্রস্তুতি চলে। কিন্তু শ্বশুর বাড়ীর লোকজন তাদের বউমাকে ফিরিয়ে নিতে চায়। কিছুতেই ডিভোর্স হতে দেবে না। নিশির বাবার বয়স হয়েছে। মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে এক ভোরবেলায় বাসের চাকায় পিস্ট হয়ে সব দায়-দায়িত্ব মুক্ত হন। নিশির ভাই নাঈম মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ে। সামনে একটা উত্তাল সমুদ্র। এই সমুদ্র নিশিকে পাড়ি দিতে হবে সম্পূর্ন একা একা।


বাস্তব মনে হয় সিনেমার থেকেও নির্মম। সিনেমা হলে নিশির সাথে হয়ত কোন নায়কের দেখা হত, তারপর একটা সুন্দর সমাপ্তি থাকত। কিন্তু বাস্তব বলেই নিশির সাথে যাদের দেখা হয়েছে তারা সবাই খলনায়ক, আর এই কাহিনীর কোন সমাপ্তিও নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০০৯ রাত ১১:৫৮
৫০টি মন্তব্য ৪৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×