‘আমার তনু খুবই শান্ত স্বভাবের মেয়ে ছিল। কারো সঙ্গে ওর বিবাদ ছিল না। যেমন ধার্মিক, তেমনি ছিল সংস্কৃতিমনা। এলাকার সবাই ওকে পছন্দ করত। ও যাদের বাড়িতে প্রাইভেট পড়াত সেখানকার সবাই ওকে মেয়ের মতো দেখতো। তাহলে কেন ওকে এই অল্প বয়সে চলে যেতে হল। কেনই বা খুনি ধরা পড়ছে না। আমি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই। তিনি যেন সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন, তনুর খুনিদের গ্রেফতারে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। যেভাবেই হোক আমি মেয়ের খুনিদের গ্রেফতার ও সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’
গতকাল বুধবার কুমিল্লার সেনানিবাস পর্ষদ বালিকা বিদ্যালয় সংলগ্ন কোয়ার্টারের বাসায় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তনুর মা আনোয়ারা খাতুন এসব কথা বলেন। এ সময় তনুর বাবা ইয়ার হোসেন ও ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন রুবেল পাশে বসা ছিলেন। এদিকে ঘটনাস্থলে এ প্রতিবেদকসহ উপস্থিত সাংবাদিকদের কুমিল্লা সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শওকত আলম বলেন, ‘তনু সেনা পরিবারের সদস্য। তার মৃত্যুতে আমরাও শোকাভিভূত। সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য চান তনুর হত্যাকারী ধরা পড়ুক। আর এ জন্য আমরা তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে সর্বোচ্চ সহায়তা করছি। আমাদের কাছ থেকে যখন যেভাবে সহায়তা চাওয়া হচ্ছে আমরা সেটা করছি।’
তনুর লাশের প্রথম দফা ময়না তদন্তের রিপোর্ট পুলিশের হাতে এসে পৌঁছেছে। একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, ময়না তদন্তে ধর্ষণের কোন আলামত পাওয়া যায়নি। তবে মাথার পেছনে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মুখেও আচড়ের দাগ পাওয়া গেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, খুনিরা অত্যন্ত কৌশলী। তাদের মতে, অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে তনুকে হত্যা করা হয়েছে। খুনি তনুর পরিচিত কেউ। শিগগিরই ধরা পড়বে বলেও আশা তাদের।
তনুর বাবা ইয়ার হোসেনও এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করলেন, তার মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে তার কাছে মনে হয়নি। কারণ, তিনি যখন প্রথম লাশটি দেখতে পান তখন তনুর কাপড় স্বাভাবিক ছিল। মনে হয়েছে কেউ তাকে শুইয়ে রেখেছে। তখন তনুর চোখ ছিল খোলা ও লাল। আর নাক ও মাথার পিছনে ছিল থেতলানো। পাশে পড়ে থাকা ওড়না ছিল ভেজা। এসময় মিলিটারি পুলিশের সহায়তায় তাকে সিএমএইচে নেয়া হয়।
গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, সেনানিবাসের সীমানা প্রচীরের ১০ গজ ভেতরে কালভার্টের পাশে জঙ্গলের মধ্যে লাশটি পড়ে ছিল। এই স্থানটি তনুর বাসা থেকে ৩/৪ মিনিট দুরত্বে। ওই এলাকায় দুই হাজার ২০০ ফুট এলাকায় সেনানিবাসের কোন সীমানা প্রাচীর নেই। সেখানে বাইরে থেকে নির্বিঘ্নে আসা-যাওয়া সম্ভব। বাইরে হত্যার পর সেখানে নিয়ে লাশ ফেলা সম্ভব। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, ঘটনাস্থলেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে সেনানিবাসের একটি বাসায় প্রাইভেট পড়িয়ে বের হয়ে যায় তনু। এরপর তিনি কোথায় গেলেন? এ নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। খুনিরা যদি তার পরিচিত হয় তাহলে তার সঙ্গে গল্প করতে করতেও আসতে পারে। ঘটনাস্থলটি ফাঁকা হওয়ায় সুযোগ বুঝে সেখানে তাকে হত্যা করা হতে পারে।
সাংস্কৃতিকমনা তনু সবার সঙ্গেই খোলামেলাভাবে মিশতেন। ফলে অনেকেই তার ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করেছেন। এমনই একজন ফয়সাল রাব্বী। একটি ওষুধ কোম্পানির এই প্রতিনিধির সঙ্গে দুই দিন আগেও তনুর ঝগড়া হয়। গত ১৮ মার্চ তনু ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের এক আনন্দ আয়োজনে লাউয়াছড়া গিয়েছিলেন। সেখানে যেতেই আপত্তি ছিল রাব্বীর। ১৯ মার্চ রাতে বাসায় ফিরে আসে সে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রনি নামেও তনুর এক বন্ধু ছিল। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি কাউসার, আরিফসহ আরো কয়েকজন বন্ধুকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তবে তাদের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা হত্যার ব্যাপারে তেমন কোন তথ্য পাননি।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই দিন তনু বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই মাকে জানিয়ে যায় তাকে এগিয়ে আনতে মায়ের যেতে হবে না। প্রাইভেট পড়ানো শেষে সে কোথাও যাবে বলে জানিয়েছিল। এখন প্রশ্ন হল- তনু কোথায় গিয়েছিল, কার সঙ্গে দেখা করেছে? সে বিষয়টি মায়ের কাছে কেন চেপে গেল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা। তারা বলছেন, এর উত্তর মিললেই হয়ত ধরা পড়বে খুনি। উন্মোচন হবে হত্যা রহস্যের।