মৃন্ময়ীর কাছ থেকে ‘অমিতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম’ কথা শুনে নভো ভেতর ভেতরে চমকে উঠে। তবে তা সে প্রকাশ না করে মৃনের পাশাপাশি টিএসসি থেকে বাংলা একাডেমির ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করে। পাশাপাশি হাঁটলেও দুজনেই এ মুহূর্তে চুপ রয়েছে।
হঠাৎ নভো নিরবতা ভেঙে বেশ নিচু স্বরে মৃনের দিকে না তাকিয়ে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, ‘তা অমিতের জন্য কে অপেক্ষা করছিল? লাবণ্য নাকি কেটি’।
চকিতে মৃন নভোর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করে। এরপর উত্তর দিতে গিয়েও কি মনে করে যেন থেমে যায়। যেন ছলকে উঠা দুধের হাড়ি থেকে গরম দুধ উছলে পড়তে গিয়েও শেষ মুহূর্তে আর পড়ে না। মৃন বোঝার চেষ্টা করে নভো কেন এভাবে বলল। লাবণ্য না কেটি। লাবণ্য না কেটি। ‘শেষের কবিতা’ কলেজে থাকতে মৃন ভালোভাবেই পড়েছে। মনে মনে বেশ কয়বার নাম দুটো আউড়িয়ে চলে নিজের অজান্তেই। লাবণ্য-যে পানিতে মনের সুখে সাঁতার কাটা যায়, কিন্তু পানি পান করা যায় না। কেটি-যে পানিতে সাঁতার কাটা যায় না, তবে যখন ইচ্ছা তখন পান করা যায়। মৃন নভোর কথার অর্থ বুঝতে পেরে ভেতরে ভেতরে ঘামতে শুরু করে। কী উত্তর দিবে ভেবে কূল-কিনারা পায় না?
মৃনের চুপ থাকা দেখে এবার নভো আবার সরাসরি না তাকিয়ে মুচকি হেসে নিজেই উত্তর দেয়, ‘লাবণ্য-কেটিতে কাজ নেই। তুমি বরং মৃন্ময়ী হয়েই থাক। আর অমিতের বদলে সেখানে অপুকে বসিয়ে দিয়ে অপেক্ষা...’।
মৃন সাথে সাথে তীব্র প্রতিবাদ করে, ‘আমার বয়েই গেছে অপুর জন্য অপেক্ষা করতে। বরং অপু-তপুরাই আমার জন্য পথ চেয়ে থাকুক’।
নভো মৃনের এই ভঙ্গিমা দেখে স্বভাব বিরুদ্ধ হো হো করে হেসে উঠে। এরপর সরাসরি মৃনের মুখের দিকে তাকিয়ে, ‘এটা কিন্তু তুমি ভুল বললে। ‘সমাপ্তি’তে দেখ নি, শেষে অপুর জন্য মৃন্ময়ীর সে কী অপেক্ষার যাতনা। শেষ ঘটনাটার কথাও নিশ্চয় মনে আছে’।--বলেই নভো এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
মৃনের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে নভো কোন ঘটনার কথা বলছে।
নভো এবার অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলে-
- তুমি উত্তরায় থাক বুঝি।
-হুম।
-এতদূর থেকে আসো। কষ্ট হয় না।
-না না, আজকে ড্রাইভার সমস্যায় পড়াতে বাসে আসতে হল। উবারে আসতে চাইলাম কিন্তু ক্যাম্পাসের বাস দেখে উঠে পড়লাম।
-ও, তোমার বাসায় কে কে আছে?
নভো একটু চিন্তা করে ,’আচ্ছা, আমি আবার তোমাকে বেশি বেশি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছি না তো’।
-নাহহ, তুমি-আমি একই বিভাগে একই শ্রেণিতে পড়ি। এত ফরমাল হলে চলে। তবে, বাব্বা, তুমি যে ভাব নিয়ে ক্লাসে থাক। ক্লাসের কাউকে পাত্তা দেও না।
-আরে নাহ, আমি সবার সাথে ফ্রি না। সমমনা না হলে কেন যেন জমে না। এই যেমন তোমার সাথে এখন কথা বলছি। বললে না তোমার বাসায়...।
-ও হ্যাঁ, বাবা-মা, দিদা ও আমি। এই নিয়ে আমাদের পরিবার।
-মানে, তোমার কোনো ভাই-বোন নেই।
-না
-শুনেছি, একমাত্র সন্তান হলে খুব জিদ্দি হয়।
-ঠিক শুনেছ। তবে সবাই হয় কিনা জানি না। তবে আমার খুব রাগ ও জেদ। ভুলেও আমার সাথে এমন কিছু কর না যাতে তোমাকে আমার রাগ-জেদ দেখাতে হয়। বলেই মৃন একটু থেমে নিরব হয়ে গেল।
নভো মৃনের শেষ কথাটা বোঝার চেষ্টা করে। তার চিন্তার ফাঁকেই মৃন এবার বলল উঠে
- আচ্ছা, তুমিও তো উত্তরা থেকেই আসছ। তোমার বাসাও কি উত্তরায়।
-নাহ, ওখানে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় কয়দিনের জন্য রয়েছি। ক্যাম্পাসের আশেপাশেই থাকার যায়গা খুঁজছি।
-কেন, হল-এ তো থাকতে পার?
-হল-এ সিটের আবেদন করেছি। তুমি তো বোঝই প্রথম বর্ষে হল-এ সিট পাওয়া অসম্ভব। আর আমার তেমন ইচ্ছেও নেই এই মূহুর্তে। মাঝে কয়েকদিন হলের গণরুমে ছিলাম। কদাচিৎ ফরজ নামাজ পড়া এই আমি দু-রাকাত নফল নামাজ পড়ে, ডোঙ্গা পীরের দরবারে ১০০ টাকা দেওয়ার মনস্থ করে গণরূম ছেড়ে এসেছি। আপাতত তাই হলমুখো হওয়ার চান্স নেই।
নভোর এই অদ্ভুত ভঙ্গিমায় কথা বলা দেখে মৃন খলখল করে হেসে উঠে। ভাবে, এত মজা করে কেউ কথা বলতে পারে। গোমড়ামুখোর দেখছি রস-কসও রয়েছে। কিন্তু মুচকি হেসে মুখে বলে-
-এভাবে কেন পালালে?
-আরে বল না, একরূমে এতগুলো সিপাইসালার নওজোয়ান। কেউ ডিংডং গান শুনছে, কেউ তাস খেলছে, কেউ গল্পের বই পড়ছে, কেউ রাজা-উজির মারছে, কেউ মুঠোফোনে ফিসফাস করে চুমম...বলেই জিভ কেটে নভো থেমে গিয়ে মৃনের দিকে বোকাবোকাভাবে তাকিয়ে বলে, এত এত কাজবার। গণরূমে না থাকলে তুমি বুঝবে না। তবে আমি সে কারণে পালায় নি। তার অন্য কারণ ছিল।
মৃন ফুটপাতের দিকে তাকিয়ে বলে
-মুঠোফোনে ফিসফাস করে চুমম.........কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেলে। তুমিও কি...?
নভো তাড়াতাড়ি ড্যামেজ কন্ট্রোল করে
-আরে, নাহহ...আমি ওরকম নাকি!
-তা তুমি কী রকম?-মৃন শয়তানী মালেকা হামেরিয়া হাসিতে জিজ্ঞেস করে। ব্যাপারটা এমন যেন, আজকে চান্দু চিপায় পাইছি। ক্লাসের মধ্যে বিরাট সাধু সেজে থাক। ঠোঙ্গা কুড়াও।
-আমি আমিই। আমি আবার কী রকম? যেমন দেখ তেমন...। তবে আমি ওরকম না...। আমি বাবা-মাকে ফোন দেই। নভোর সহজ স্বীকারোক্তি।
নভোর দিলখোলা কথা ও সারল্যে মৃন বেশ মজা পাচ্ছে। মৃন হাসতে হাসতে বলে, ‘এবার বল কী কারণে হল ছেড়ে পালালে’।
নভো ক্রিকেটের বল থ্রো করার মতো একটি ভঙ্গি করে থেমে কপট গাম্ভীর্যে বলে চলে
-ব্যাপারটা যদিও হাস্যকর। প্রথম যে দিন গণরূমে ঘুমালাম সে দিনই টের পেলাম যে আমি একা না আমার অনেক ভাই-বেরাদরও আমার সাথে সাথে লেপ্টে রয়েছে। প্রথমে টের পাই নি। রাত তিনটায় অজানা কারণে ঘুম ভেঙে দেখি, পাশের জনও উঠে মোবাইলের আলো জ্বেলে কি যেন খুঁজছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দোস্ত, এত রাতে এভাবে কি খুঁজছ’। সাথে সাথে ওর উত্তর ছিল, ‘হালার পো’রা এতটায় হারামী, খালি পিছলে যায়। সব কয়টার কলজা যদি না টেনে ছিঁড়ছি তো আমিও কুদ্দুসের পোলা নয়।’ আমার উদ্দেশ্যে এবার বলে, ’তুমিও খোঁজ। তোমার দিক থেকেও জঙ্গী স্টাইলে আক্রমণ আসছে মনে হচ্ছে। একযোগে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতারা বিশাল বাহিনি নিয়ে অ্যাটাক করে রাতের আধাঁরে’। তাৎক্ষণিক আমি বুঝে যাই কুদ্দুসের পোলা কিসের কথা বলছে। এরপর শুরু হয় আমাদের যৌথ বাহিনির পাল্টা সাঁড়াশি আক্রমণ। আমাদের মতো অনেকেই মোবাইলের আলোয় মাঝে মাঝেই গোপন শত্রু খোঁজায় ব্যস্ত। তিন দিনে আমি একাই শ-খানেক শত্রু নাশ করলাম। কিন্তু মোটা-পাতলু-কচি-ভুতি নানা আকৃতির খতরনক শত্রুর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে চতুর্থ দিনে পরাজয় স্বীকার করে তল্পিতল্পা নিয়ে উত্তরায় ঐ আত্মীয়ের বাসায়।
নভোর কথা বলার ঢঙে মৃনের উচ্ছল হাসি আর থামতেই চায় না। মৃনের নিটোল সে হাসি নভো ভালোভাবেই লক্ষ করে। বুকে আফ্রিকান জংলিরা ড্রাম বাজালেও বাপ-দাদা থেকে পাওয়া স্বভাবটার কারণে মুখে খুব বেশি প্রকাশ করে না। নভোকে কে যেন বলে, নভো বেটা, এত দ্রুত নীলনভো গগন নাকি মৃনে বিলীন হলে হবে না। আকাশটা আগে ভালো করে চক্কর দাও, পেঁজা মেঘের ভেলায় কিছুদিন ভেসে থাক, এরপর কোনো এক কালবৈশাখের বজ্রপাতে হাজার ভোল্টের সেই কাঙ্ক্ষিত বাত্তি গুড়ুম করে জ্বালিয়ে দাও।
এদিকে মৃন ভেবে পায় না, এই সেই ছেলে যে কিনা ক্লাসে ঋষি-মুণির মত ধ্যান করে আর ক্লাস শেষে বাইরে গিয়ে গম্ভীরমুখে ঠোঙ্গা কুড়িয়ে পরিবেশ উদ্ধার করে। মনে মনে বলে, কদবেল। হঠাৎ ঠোঙ্গার কথা মনে হতেই মৃন জিজ্ঞেস করে—
-প্রতিদিন দেখি ঠোঙ্গা কুড়াও। এই অভ্যাস কীভাবে তৈরি হল?
-বাবা। উনি রাজশাহী কলেজের শিক্ষক। উনাকে ছোট থেকে দেখতাম চারপাশের এইসব ছোটখাট কাজগুলো করতেন এবং আমাকেও উদ্বুদ্ধ করতেন। ছোটবেলা এ জন্য উনি আমাকে পুরষ্কারও দিতেন। একবার নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে অনেক কাগজের প্যাকেট পড়ে থাকতে দেখে বাবার মন খুব খারাপ হয়ে যায়। শেষে উনি নিজেই তা কুড়াতে শুরু করেন। আমাকে বলেন, প্রতিটির জন্য ১ টাকা পাবি। আমার উৎসাহ দেখে কে? সেই যে শুরু হয়েছে।
-ইম্প্রেসিভ। নিশ্চয় সাহসটুকুও বাবা থেকে পেয়েছ। তখন ফার্মগেটে যেভাবে পরিস্থিতি সামলালে...।
মৃনের কথা শুনে নভো ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসি দেয়।
ইতোমধ্যে তারা দোয়েল চত্তরে এসে পড়েছে। নভো রাজহাঁসের সূর্য দেখার মতো করে হাতের কবজিটা ঘুরিয়ে হাতঘড়িতে সময়টা দেখে, ‘এই সেরেছে। একটু পরেই হাসিনা ম্যাডামের ক্লাস। দ্রুত চল। এমনিতে প্রথম কয়েকটা ক্লাস মিস করেছি’। বলেই দ্রুত লম্বা লম্বা পদক্ষেপে রাস্তা পার হতে থাকে।
নভো সামনে, মৃন পেছনে। হঠাৎ মৃন লক্ষ করে ঢাকা মেডিকেলের দিক থেকে একটি প্রাইভেট কার অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছুটে আসছে। গাড়িটিকে অস্বাভাবিক গতিতে কাছাকাছি আসতে দেখেই মৃন আতঙ্কে চিৎকার করে ডেকে উঠে নননভো...কিন্তু...? (অসমাপ্ত)
আগের পর্বগুলো-
নভোনীল-পর্ব-০১ লিখেছেন ব্লগার রিম সাবরিনা জাহান সরকার
নভোনীল-পর্ব-০২ লিখেছেন ব্লগার পদ্মপুকুর
নভোনীল-পর্ব-০৩ লিখেছেন ব্লগার মেঘশুভ্রনীল
নভোনীল-পর্ব-০৪ লিখেছেন ব্লগার খায়রুল আহসান
ছবিঃ লেখক।
*********************************************************************************************
আখেনাটেন-জুন/২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ২:৩৪