somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গাঁয়ের পথে কুয়াশার রাতে

২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




এখন সময় রাত সাড়ে তিনটা। মাঘ মাসের প্রচন্ড শীতের রাত। গ্রামের ঠিক মাঝখান দিয়ে সিএন্ডবি’র বড় রাস্তাটা ঐ গ্রাম থেকে এসে এই গ্রামকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়ে সোজা গঞ্জে গিয়ে থেমেছে। শীতের এই গহীন রাতে হর্ন বাজিয়ে মাঝে মাঝে দ্ইু একটা দুর পাল্লার বাস গঞ্জের দিকে ছুটে যায়। সেই হর্নের আওয়াজ গাঁয়ের অনেক দুর পর্যন্ত শোনা যায়।

এই মাত্র তেতুল তলার হাটে এসে একটা বাস থামলো। বাস থেকে নামলো বখতিয়ার। কিছুক্ষন এদিক ওদিক তাকিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কিছু একটা ভাবছে। এখান থেকেও প্রায় মাইল দেড়েক পর বখতিয়ারের বাড়ি। হেটে হেটেই যেতে হবে। দিনের বেলা হলে হয়তো টমটম বা ইজিবাইক পাওয়া যেতো। কিন্তু কৃষ্ণ পক্ষের এই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে জন-মানবহীন এবং নির্জন রাস্তা পেরিয়ে বাড়ি পৌছাতে হবে। এ কথা ভেবে মনে একটু ভয় ভয়ও লাগছে। সাথে শুধু মাত্র মোবাইলের টর্চ লাইট ভরসা। সেই টর্চ দিয়ে বড় জোর সামনের হাত দুয়েক পথ ভালো করে দেখা যাবে। তার মধ্যে আজকে এতোই ঘন কুয়াশা পড়েছে তাতে তিন চার হাত দুরের কিছুও ঠাওর করা যায় না।

বখতিয়ার মনে মনে একবার ময়েজ আলীর কথা ভেবেছে। ময়েজ আলী এ গ্রামের চৌকিদার। তার আবার মোবাইলও নাই। থাকলে একটা কল করে তাকে ডাকা যেতো। ময়েজ আলী সারারাত ফুরুউউউত করে হঠাৎ হঠাৎ বাঁশি বাজাতো আর ও--ও----ই-----ই বলে মুখ দিয়ে আওয়াজ করতো। আজকে বাঁশির শব্দ বা গলার আওয়াজ কোনটাই শোনা যাচ্ছে না।

প্রায় মিনিট দশেক হাটখোলায় দাড়িয়ে থেকে পূব দিকে যে ইটের রাস্তাটা মালো পাড়ার দিকে নেমে গেছে সেই পথে পা-বাড়ালো বখতিয়ার। কাঁধে সাইড ব্যাগ ঝোলানো আর এক হাতে একটা বাজারের ব্যাগ। সে ব্যাগের ভিতর ঢাকা থেকে কেনা কিছু কাপড় আর ফেরীঘাট থেকে এক ডজন কমলা কিনেছিলো তাই। অন্য হাতে মোবাইলের টর্চ লাইট।

প্রায় দশ মিনিট হাটার পর শংকর বাবুর বাড়ির সামনের বড় পুকুরটা চোখে পড়তেই গা ছমছম করে উঠলো। পুকুরের দক্ষিন পাশেই এ গ্রামের চিতাখোলা। এই চিতায় গ্রামের অনেক হিন্দুদের পোড়াতে দেখেছে সে। এইতো গতবারও হরিচরণ বাবু মরার পর এই চিতায় তাকে পোড়ানো হয়েছিলো। পুকুরের ওপাড়ে দাড়িয়ে সে দেখেছে সেই দাহ করার দৃশ্য।

বেঁচে থাকতে বখতিয়ারের বাবা বলতো এই চিতা খোলার সামনে দিয়ে আমাবস্যার রাতে কেউ হেটে যেতে পারতো না। অপঘাতে যারা মারা যেতো তাদের পোড়ালেও তাদের আত্নারা রাতের বেলায় চিতাখোলায় চলে আসে। সামনে যাকে পায় তাকে ভয় দেখায়। একদিন তার বাবাও দেখেছিলো একটা ধুতি পরা কঙ্কাল হাত ইশারা করে ডাকছে। এসব মনে করে ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। দিনেমানে এ পথ দিয়ে কতশত বার বখতিয়ার হেটেছে অথচ কোন দিন তার এমন মনে হয়নি। আজ এই গভীর রজনীতে এখানে এসে চমকে উঠার পর এসব মনে করে তার পা আর চলছে না ।

তার পরও মনে সাহস নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো। বিড়বিড় করে একটা গান গাইতে চেষ্টা করছে বখতিয়ার। কিন্তু আশ্চর্য, কোন গান গলা দিয়ে বের হচ্ছে না। বখতিয়ার এরকম একটু আধটু ভয় লাগা পথ আগে দুই এক লাইন গান ধরে হাটা দিলেই সেই পথে তার আর ভয় লাগতো না। সেই টেকনিকটাও আজ কাজ করছে না।

হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন তার পিছনে পিছনে হাটছে। দুই একবার পেছন ফিরে তাকিয়েছে অথচ কেউ নাই। এতো শীতেও তার শরীরে ঘাম দেয়া শুরু করেছে। গলার মাফলার আর কানটুপি খুলে ব্যাগে রেখে দিয়েছে। বুকটাও ভিষন ধুক ধুক করছে। গাছের পাতা থেকে শিশির ঝড়ে তলার শুকনো পাতার উপর টপাস টপাস করে পড়ছে তাতেও মাঝে মধ্যেই চমকে উঠতে হচ্ছে। পথ মনে হয় আজ আর শেষ হচ্ছে না। মনে মনে ময়েজ আলীকেও গালি দিচ্ছে। -শালার ব্যাটা তুইও কি আজ মরে গেলি?

চিতাখোলা পার হয়ে মেম্বারের বাড়ির পর জেলে পাড়া। তারপর জেলে পাড়া থেকে পশ্চিম দিকে আর একটু এগিয়ে গিয়ে ছোট একটা খেঁয়া ঘাট পার হলেই তার বাড়ি। বখতিয়ার এই মাত্র জেলে পাড়ায় এসে পৌছেছে। জেলে পাড়া থেকে খেঁয়া ঘাট পর্যন্ত পথটুকু মারাত্নক বিদঘুটে। এই পথে দু’টো কবরস্থান আর একটা বড়সড় বাঁশ বাগান আছে।

আজ সকালেই মা মোবাইলে কল করেছিলো বখতিয়ারকে। হালিমাকে কাল হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। হালিমা বখতিয়ারের বৌ। প্রথমবার বাচ্চা হবে। বাড়িতে এক মা আর বৌ ছাড়া কেউ নেই। ফ্যাক্টরি থেকে তিন দিনের ছুটি নিয়ে আজকের কাজ শেষ করেই বাসে উঠেছিলো। পথের সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে হয়তো রাত আটটা সাড়ে আটটার মধ্যেই তেতুলতলার হাটে নামতে পারতো। কিন্তু ফেরী ঘাটে চার পাঁচ ঘন্টার জ্যামে বসে থাকতে হয়েছে। তাই আজকের এই শীতের রাতে শীত যতটা না কাবু করতে পারছে তার চাইতে অজানা ভয়ে শরীরটা একদম চলছে না। বখতিয়ার তার ঘনিষ্ট বন্ধু হাশিমকে একবার মোবাইলে কল দিতে চেয়েছিলো কিন্তু নিশ্চই এতো রাতে হাশিম বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।

জেলে পাড়া পার হয়ে খালেক বড় মিয়ার বাড়ি। বাড়ির উঠানে একটা বাঁশের মাথায় লাইট জ্বালানো দেখা যাচ্ছে। ঘন কুয়াশার কারনে লাইটের আলো আবছা আবছা আর টিমটিমে দেখাচ্ছে। তারপরও চারি ধারটা আলোকিত হয়ে আছে। খালেক মিয়ার উঠান ভরা ধানের পালা। শত শত মন ধান ফি বছর খালেক মিয়া জমি বর্গা দিয়েই পায়।

খালেক বড় মিয়ার বাড়ির সামনে দিয়ে জোর গতিতে সামনের দিকে হাটা শুরু করলো বখতিয়ার । অল্প সময়েই খালেকের বাড়ির লাইটের আলো চোখের আড়াল হয়ে আবারো কুয়াশায় ঢাকা আধার রাতের পথ সামনে ঠেলে উঠলো।

হাটতে হাটতে কখন সেই বড় কবরস্থানের মাঝ দিয়ে হাটছে টেরই পেলোনা বখতিয়ার । হঠাৎ করে বড় সাইজের একটা শেয়াল দৌড় দিয়ে রাস্তার এপার থেকে ওপাওে চলে গেলো। আবারো চমকে উঠতে হলো। এখন বুজতে পারলো সে কবরস্থানের পথে এসে পড়েছে। শেয়ালের খুব উৎপাত এই কবরস্থানে বহু বছর ধরে। দিনের বেলা মরা মানুষ কবর দিয়ে চলে গেলে রাতে শেয়ালের দল কবর খুড়ে লাশ খেয়ে ফেলে। ধনী লোকেরা লোহার নেট দিয়ে কবর পুরনো হওয়া পর্যন্ত ঢেকে রাখলেও গরীব লোকেরা বাঁশের বেড়া দিয়ে রাখে। তাতে খুব একটা লাভ হয় না। কবরের এক পাশ দিয়ে সুড়ঙ্গ করে শেয়াল ডুকে যায়।

একটু সামনে এগিয়ে আসার পর চোখে পড়লো এক খন্ড সাধা কাফনের কাপড় । নিশ্চিত এটা কোন কবর থেকে শেয়ালেরা বের করে ফেলেছে। বুকটা দড়ফর করছে, মাথাটাও শুণ্য শুণ্য লাগছে। ভয়ে চোখেও ঝাপসা ঝাপসা লাগছে। কিন্তু যাই হোক না কেন সাহস হারালে চলবে না। হাটার গাতি বাড়িয়ে দিলো বখতিয়ার । হঠাৎ পায়ে তলায় কিছু একটা ধাক্কার মতো লাগলো। কি এটা? ওমা এটা তো একটা মানুষের হাত। নিশ্চয়ই কোন শিয়াল কবর থেকে লাশের হাত ছিন্ন করে টেনে নিয়ে এসেছে।

এবার ডানে বায়ে কোন দিক না তাকিয়ে এক দৌড় । প্রায় চার পাচ মিনিট দৌড়ে এসে সেই ভয়ানক বাঁশ বাগানটার ধারটায় এসে হাপিয়ে হাপিয়ে হাটছে। বাঁশ বাগানের এই পথটুকু দিনের বেলায়ও ভিষন অন্ধকার হয়ে থাকে আর এমন কুয়াশার রাতে সেটা কতোটা ভৌতিক রুপ ধারন করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হে মাবুদ কোন কুক্ষনে রওনা হয়েছিলাম আজ, মনে মনে ভাবছে বখতিয়ার ।

বাঁশ বাগানের ঠিক শেষ প্রান্তে প্রকান্ড এক গাব গাছ আছে। প্রায় পাঁচ বছর আগে এই গাব গাছে মালো পাড়ার ‘নিতাই’ গলায় দড়ি দিয়েছিলো। তারপর থেকে গ্রামের দুই একজন লোক মাঝে মাঝে নিতাই’কে গাছে বসে থাকতে দেখেছে। মনে মনে বখতিয়ার ভাবছে -শালার ময়েজ আলী কিভাবে এই গ্রামে রাত জেগে চৌকি দেয়। ব্যাটার নিশ্চয়ই কোন ভয় ডর নাই।

সামনের এই পথ টুকু কোন মতে পার হলেই খেঁয়াঘাট । আর খেঁয়া পার হলেই বাড়ি। হে আল্লাহ এই পথটুক নির্বিঘ্নে যেতে পারলেই হয়। ডানে বায়ে কোন দিকে তাকাবে না। আবার হাটা শুরু করলো। কিন্তু গাব গাছটার কাছে আসতেই ফড়ফড় মড়মড় করে উঠলো। আসলে দু’টো বাদুর গাব গাছে বসে ছিলো। মানুষের আওয়াজ পেয়েই উড়ে গেল। অথচ এবার ভয় পেয়ে বখতিয়ার আবারো দৌড়াতে শুরু করলো।

এক দৌড়ে খেঁয়া ঘাট। ঘাটের কাছে আসতেই দুরের মসজিদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসছে শুনতে পেলো বখতিয়ার। মনে হয় কোন এক জমের পুরী পাড়ি দিয়ে এই মাত্র লোকালয়ের দেখা পেয়েছে। খেঁয়া ঘাটে এসে দেখে নৌকার পাটাতনে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে ময়েজ আলী চৌকিদার।

-ময়েজ মামু,তুমি ঘুমাইতাছো? শালার পুত আমি আইজকাই মেম্বাররে জানামু। তুমি কিসের চৌকিদার? আগে আমারে পার করো।

ময়েজ আলীর বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজে বখতিয়ারের দুঃস্বপ্নের মতো ফেলে আসা দেড় মাইল পথ আড়াল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।


ঢাকা, ০৫ পৌষ ১৪৩০।
ছবিঃ অন্তরার্জাল
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:৩৪
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×