(১)
আর আধঘন্টা পুলিশ আসতে দেরি করলে হয়তো আর বাচাঁনো যেতো না দুইজনের কাউকেই । ভাগ্যিস পুলিশ এসে উদ্ধার করে কোমরে দড়ি দিয়েছিলো। গ্রাম বাসির মার সামাল দেয়া খুবই কঠিন। যার হাতে যা ছিলো তাই দিয়ে মেরেছে। কদম আলীর মাথা কেটে গিয়ে দরদর করে রক্ত ঝড়ছে। সে রক্তে গাল বেয়ে পরনের জামাও ভিজে জবজব করছে। আর কালামের পা নিশ্চিত ভেঙ্গে ফেলেছে। পায়ে ভর দিয়ে হাটতেই পারছেনা। কোন রকম একজন কনষ্টেবলের ঘাড়ে হাত দিয়ে হেটে হেটে পুলিশের ভ্যানে গিয়ে বসেছে। একজন পুলিশের লোক দুজনেরই কোমরে দড়ি ধরে সামনের বেঞ্চে বসে আছে।
কদম আলী আর কালাম গত রাতে সুশান্ত বাবুর গোয়ালে ভোর রাতে ঢুকে দু’টো ষাড় চুরি করে সুপারির বাগানের ভিতর দিয়ে যাবার সময় কালুর বাপের হাতে ধরা পড়েছিলো। কালুর বাপ সারা রাত বিলে একহাতে টর্চলাইট আর এক হাতে কোচ/বর্ষা নিয়ে মাছ ধরে বাড়ি ফেরার সময় দুজনকে দেখ ফেলে চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে ফেলেছিলো। তারপরই সেই রাম ধোলাই খাওয়া।
কদম আলী গরু চুরির মামলায় জেল খেটে এসে গ্রামের ভিটা মাটি সব বিক্রি করে দিয়ে হিলট্রাকে চলে গেছে আর এ গ্রামে ফেরেনি। আর কালাম ঢাকায় চলে আসে। গ্রামে আর মুখ দেখানোর উপায় ছিলোনা। গরু চোরের খেতাব পেয়ে গ্রামে থাকা আসলেই মুশকিল।
ঢাকায় এসে এক মাজারে মাস খানেক ছিলো। পাশেই আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল হওয়ায় দুরপাল্লার যাত্রিদের ব্যাগ চুরি, মোবাইল চুরি, পকেটকাটার কাজও করতো। পুরোনো ট্রেনিং তো আছেই। কিন্তু কপালে সেটাও সইলোনা বেশিদিন। একদিন পকেটমারতে গিয়ে আবারো ধরা পড়লো কালাম। কিল-ঘুসি, চড়-থাপ্পড় খেয়ে কোন মতে দৌড়ে পালিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা হয়েছিলো। কালাম বসে বসে ভাবছে; -নাহ এভাবে আর হয়না।
গফুর ড্রাইভারের সাথে চুক্তি করে লোকাল বাসের হেলপারের চাকরি নিয়ে ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিলো। মাস ছয়েক পর হেলেনাকে বিয়ে করে সংসারও শুরু করেছে। বছর ঘুরতে না ঘুরতে কালাম হেলপার থেকে পাক্কা ড্রাইভার। এখন সে গাজীপুর টু সায়দাবাদ রুটের বাস চালায়। মালিকের জমা, হেলপারের বেতন এবং রাস্তার চাঁদা দিয়েও ডেইলি এক দেড় হাজার টাকা প্রতিদিন ইনকাম।
গত এক বছর যে গাড়িটি ভাড়া নিয়ে চালাতো সেই গাড়ির মালিক মারা যাবার পর একদিন ইচ্ছে করে রোড ডিভাইডারের উপর তুলে দিয়ে একপাশ ভেঙ্গে ফেলে কালাম। তারপর গাড়ির মালিকের ছেলের কাছ থেকে তিন ভাগের একভাগ দাম দিয়ে কিনে নিয়েছিলো কালাম।
সেই গাড়ির ইনকাম দিয়ে এখন কালামের তিনটা বাস আর দু’টো লেগুনা এবং পাচঁখান রিক্সার মালিক। রেলওয়ের একটা অবৈধ যায়গায় টিনশেড তুলে ভাড়া দেয়াও আছে। মহল্লার ছিচকে নেতা, পাতি নেতাদের সাথে ওঠা বসা, ওয়ার্ড কমিশনারের সাথে ঘোড়াঘুরি আর সালিশ দরবারে কোথায় নেই কালাম। শুক্কুরবারে মসজিদে ইমাম সাহেব ‘মারহাবা কালাম ভাই দুই হাজার টাকা দান করেছেন জোরসে বলেন আলহামদুলিল্লাহ’ মুসল্লিদের বলতে বলেন।
বাস টার্মিনালের আশপাশের ফুটপাত আর ভ্রাম্যমান দোকানের চাঁদা তোলার ইজারাটাও কমিশনারের কাছ থেকে বাগিয়ে নিয়েছে। প্রতিদিন সবাইকে দেয়ার পরও ত্রিশ হাজার টাকার মতো থাকে কালামের। জন পাঁচেক স্থানীয় নেতাও সেই টাকার ভাগ পায়। এখন কালাম মোটামুটি এলাকার অতি পরিচিত মুখ। মসজিদ কমিটির সদস্য পদও গত মাসে পেয়ে গেছে।
একবার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের সময় ঐ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নমিনেশন নিয়ে ব্যাপক গ্রুপিং। সাবেক কমিশনার বজলু মিয়াই আবার নমিনেশন পাবার সম্ভাবনা খুব বেশি কারন তিনি বিপুল জনপ্রিয় ছিলো ঐ ওয়ার্ডে। সেইবার দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হন বজলু মিয়া। প্রতিপক্ষ গ্রুপের প্রার্থীই নমিনেশন পেয়ে নির্বাচিত হয়ে যায়। কালামের হাত থেকে চলে যায় চাঁদা তোলা বাস টার্মিনালের ইজারা সহ অনেক ইনকামের সোর্স। তারপরও কালামের সহায় সম্পত্তিতে কোন প্রভাব পড়েনি বরং সম্পত্তির তালিকা আরো বড়ো হয়েছে। বাস, লেগুনা আর রিক্সার সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি শহরের ভালো একটা এলাকায় পাঁচ কাঠার প্লট কিনেছে কালাম।
সিটি কর্পোরেশন থেকে এবার বাস টার্মিনাল ইজারার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হবার পরই বিরাট লবিং শুরু করেছে কালাম তবে তার প্রতিপক্ষ বর্তমান কমিশনার কিসলু। তাকে সামলাতে পারলে নিশ্চিত বাস টার্মিনালের ইজারাটা পেয়ে যাবে। কিন্তু তাকে ঠেকানো যাবেনা। তাছাড়া দুইজন গানম্যান কিসলুর বডিগার্ড তাই অন্য পথে হাটার চিন্তা করছে কালাম।
(২)
প্রায় দেড় যুগ ধরে নিজ গ্রামের সাথে কোন যোগাযোগ ছিলোনা কালামের। এই মুহুর্তে তার ওস্তাদ বাদল মন্ডলকে দরকার ছিলো। একসাথে কতো ডাকাতি করতে গিয়েছে সুন্দরবনে। সাক্ষাৎ আজরাইল। বুকে নল ঠেকিয়ে চোখের সামনে কতোজনকে গুলি করে মারতে দেখেছে। একবার ওস্তাদকে খবর দিলে কেমন হয়, বসে বসে ভাবছে । ওস্তাদ কি বেঁচে আছে? থাকলেও ওসব কি আর পারবে এখনো? নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়।
ওস্তাদ বাদল মন্ডল গত তিনদিন ধরে কালামের বাসায় ছিলো। আজকে রাতের শেষ গাড়ীতেই গ্রামে চলে গেছে। কালাম ফজরের নামাজ মসজিদে আদায় করে ইমাম সাহেবের সাথে বসে মসজিদ উন্নয়নের জন্য এক লাখ টাকা দান করার নিয়তের কথা আলাপ করছে। এমস সময় মুযাজ্জিন সাহেব ছুটতে ছুটতে মসজিদের এসে ইমাম সাহেবকে বলছে;
- হুজুর, একটু আগে পুলিশ আইসা কাউন্সিলরের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে মহল্লার ক্লাব রুম থিকা। মাইকে শোক সংবাদ ঘোষনা করতে কইছে সেক্রেটারী সাব।
দুই জনেই সমস্বরে বলে উঠলো; - ইন্না লিল্লাহ.. ..রজেউন।
কালাম এখন গরীবের বন্ধু। ঢাকায় চারটা বাড়ি, এক ডজন দুরপাল্লার বাস, দশটা ট্রাক, বাসটার্মিনালের পার্মানেন্ট ইজারাদার, মসজিদ কমিটির সভাপতি সহ বিপুল অর্থ বৈভবের মালিক। হজ্ব ওমরাহ সবই পালন করা হয়ে গেছে। গায়ে সবসময় ফিনফিনে সাদা পানজাবী আর রংকরা চাপ দারি। এলাকার কাউন্সিলর এখন তার কাছে শিশু। কিন্তু কালাম কোন দিনই এলাকার কাউন্সিলর হওয়ার জন্য ইচ্ছেই করেনি। তার স্বপ্ন আরো বড়ো। শিল্পপতি হবার স্বপ্ন। এজন্য একটা গার্মেন্টস কেনার জন্য কথা মোটামুটি ফাইনাল। ব্যাংকের লোনটা মঞ্জুর হয়ে গেলেই নামের আগে শিল্পপতির খেতাব অটোমেটিক এসে যাবে।
(৩)
শিল্পপতি হবার পর তার ব্যবসার পরিধি আরো বেড়েছে। শিল্পপতিদের সংগঠনের সদদস্য পদও পেয়ে গেছে। আমদানীকারকের লাইসেন্স করে ভারত থেকে নিত্য পন্য আমদানী করছে। এজন্য চট্রগ্রামের খাতুন গঞ্জে বিরাট গুদাম ভাড়া করা আছে। সর্বশেষ একটা বেসরকারী ব্যাংকের শেয়ার কিনে ডিরেক্টরশীপ পেয়ে গেছে। কতো লোক এখন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে।
কালাম তার নামের আগে আলহাজ্ব আর পরে চৌধুরী লাগিয়ে নিয়েছে। আর দামি গাড়ী কিনেছে সেই কবে। দুই হাজার চৌদ্দ সালের জাতীয় নির্বাচনে যখন সরকার আর বিরোধীদলের তুমুল আন্দোলন চলছে। তখন প্রতিদিন রাজপথে জ্বালাও পোড়াও হচ্ছে। পোট্রোল বোমায় কালামের দু’টো গাড়ি পুড়ে ছাই। বিরোধী দল গুলো নির্বাচন বর্জন করেছে। কিন্তু সরকারি দল তার অবস্থানে অনড় থেকে মনোনয়ন ফরম বিক্রিও শুরু করে দিয়েছে। আলহাজ্ব কালাম চৌধুরী সেবার সেই সুযোগটাই নিয়ে নিয়েছে।
বিপুল পরিমান টাকা দিয়ে সরকারী দলের মনোনয়ন কিনে সেবার বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় এমপি নির্বাচিত হয়ে গেলো। সেই থেকে টাকা দশ বছর সংসদ সদস্য হয়ে কাটিয়ে দিয়েছে নির্বিঘ্নে। কালাম চৌধুরী এখন একাধারে এমপি, শিল্পপতি, ব্যাংকের পরিচালক, বাস মালিক সমিতির সভাপতি, মসজিদ কমিটির সভাপতি আর ঐ এলাকার স্কুল কলেজগুলোর সভাপতি তো অটোমেটিক হয়ে গেছে।
এখন স্কুল কলেজের নিয়োগে, ঠিকাদারী কাজে তার ভাগ অবধারিত। আর ব্যাংকের পরিচালক হবার সুবাধে নামে বেনামে প্রতিষ্ঠান খুলে তার ঋন নেয়া, আবাসন প্রকল্পের নামে সরকারি খাসের জমি দখল করে প্লট বেচা, হাট বাজারের ইজারা সহ বানের জলের মতো চতুর্দিক থেকে পয়শা আসছে কালামের হাতে। সেই কাড়ি কাড়ি টাকা পাচার করে দুবাইতে হোটেল করেছে। কানাডায় বাড়ি কিনেছে। স্ত্রী ছেলে মেয়েরা এখন সব বিদেশে থাকে। বিভিন্ন দেশে টুর দিয়ে বেড়ায়।
(৪)
এতো দিন নিশ্চয়ই গ্রামে তার গরু চুরির ঘটনা কারো মনে থাকার কথা না। তবুও কালামের মনে অজানা সংশয় সব সময় কাজ করে। নিজ গ্রামে গিয়ে যদি শোনে সে একদিন গরু চুরি করে গ্রাম ছাড়া হয়ে ছিলো তখন তার এই নাম যশ, খ্যাতি সব শেষ হয়ে যাবে। অবশ্য সেই সময়ের অনেকেই হয়তো আর বেচে নেই। তাছাড়া গ্রামে গেলে তার সাথে প্রটোকল হিসাবে পুলিশ থাকবে, নিজস্ব গানম্যান থাকবে। আর গ্রামের লোক ওসব মনে করার সাহস পাবেনা ।
কালামের শুধু মনে হচ্ছিলো, সুশান্ত বাবুকে একবার ধন্যবাদ দিয়ে আসি। যদি সেদিন তার গরু চুরি করে গ্রাম ছাড়া না হতাম তাহলে আজকের এই সব কিছুই হতো না হয়তো। কিন্তু সুশান্ত বাবুও করোনায় মরে গেছে সে খবরও পেয়েছে।
প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর এযাবৎ চৌধুরী সাহেব (!) আরো তিনটা বিয়ে করেছিলো। দু’টো বউ এখনো আছে। দ্বিতীয় বউটা পরকীয়া করে এক ড্রাইভারের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলো। এখন তিন সংসারে পাঁচটা ছেলে আর তিনটা মেয়ে। প্রত্যেকের নামে আলাদা আলাদা বাড়ি লিখে দিয়েছে কালাম।
কিন্তু কালাম এবার তার সর্বশেষ নির্বাচনে দলীয় নমিনেশন পায়নি। গোয়েন্দা রিপোর্টে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম আর দুর্নীতির সন্ধান পেয়েছে। তবুও কালাম বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে এবার নির্বাচনে জিতে এসেছে। প্রচুর টাকা ব্যয় করেছে। তার প্রতি-মন্ত্রী হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি। লাইন ঘাট ভালো হলে ফুল মন্ত্রিও হয়ে যেতে পারে।
আলহাজ্ব আবুল কালাম চৌধুরীর জন্য এখন প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর মসজিদে তার জন্য বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত হয়ে । মহল্লার জ্ঞানী-গুনিজন সেই মোনাজাতে আমিন আমিন বলে মজলিস ভারি করে।
ঢাকা,
২৭ পৌষ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ।
ছবিঃ অন্তর্জাল।
বিঃদ্রঃ (পোষ্টের সকল চরিত্র স্থান কাল পাত্র সম্পুর্ন কাল্পনিক। কারো সাথে হুবহু বা আংশিক মিলে গেলে তা অনভিপ্রেত কাকতাল মাত্র)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১১:০২