বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মাঝেও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বেশ সন্তোষজনক। কৃষিতে পরপর তিনবার বাম্পার ফলন হয়েছে, যা জিডিপিতে বড় অবদান রাখছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা বিরাজ করছে তাও অতি দ্রুত কেটে যাবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা। সার্বিক বিবেচনায় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন বেশ ভাল বলা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর বলেছেন, বিদু্যত ও জ্বালানি ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো হবে। যদি সত্যি বিদু্যত ও জ্বালানি খাতে আশানুরূপ বিনিয়োগ করা যায়, তবে মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। যাতে দেশের অর্থনীতির গতি আরও তরান্বিত ও স্বনির্ভর হবে। ব্যাংকিং সেক্টরের উদ্বৃত্ত তারল্য, রিজার্ভ, রাজস্ব প্রবৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, মুদ্রানীতিসহ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় ভাল থাকার দরুন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর সঙ্গে নতুন করে কোন ঋণ চুক্তিতে আবদ্ধ হতে চাচ্ছে না। এটি নি:সন্দেহে পজেটিভ অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বহির্প্রকাশ
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক টানাপোড়েনের কারণে স্বাধীনতার প্রায় চার দশকের কাছাকাছি সময় পার হলেও বাংলাদেশ এখনও পুরোপুরি স্বনির্ভর দেশের কাতারে উঠতে পারেনি। একটা সময় ছিল যখন বাজেট ঘাটতি পূরণ বা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দাতাদের সহায়তা ছাড়া কোন বিকল্প ছিল না। আর দুর্বল সেই অর্থনৈতিক কাঠামোর সুযোগে দাতারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছে। অনেক দেরিতে হলেও দেশ এখন এমন এক পর্যায়ে এসে পেঁৗছেছে যখন আর দাতাদের সব শর্ত মেনে নেয়ার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। যা দেশ ও জনগণের মঙ্গলে আসবে শুধু তাই গ্রহণ করা হবে। একটা সময় দাতাদের ওপর নির্ভরতা ছিল মূল বিষয়। ধীরে ধীরে এখন তা ঐচ্ছিক বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য শুভ ইঙ্গিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর শনিবার তারই ইঙ্গিত দিলেন। তিনি বললেন, দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে কাঁচুমাচু করে কথা বলার দিন শেষ।
অর্থনৈতিক ভীত দুর্বল থাকার কারণে অতীতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকসহ অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর যে কোন শর্ত অবলীলায় মেনে নিয়ে ঋণ, সহায়তা বা অনুদান গ্রহণ করতে হতো। সরকার আস্তে আস্তে পুরনো সেই ধাঁচ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে, যা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। নিজেদের উন্নয়ন নিজেদেরই ভাবতে হবে। যার যার প্রয়োজনীয়তা তার চেয়ে অন্য কেউ ভাল বলতে পারে না। অতীতে দেখা গেছে, ঋণ বা অনুদান পাওয়ার জন্য অনেক সময় দাতাগোষ্ঠীর অনেক অন্যায্য দাবি বা শর্ত মেনে নিতে হয়েছে, যা দীর্ঘ মেয়াদী দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
আমাদের উন্নয়ন বাজেট এখনও বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর_ এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে ক্রমান্বয়ে নির্ভরতা কমিয়ে আনার যে চেষ্টা চলছে তা সফল হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্প আয়ের দেশে উন্নীত হবে। এক দশক আগেও যেখানে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে বৈদেশিক সাহায্যের অবদান ছিল ৭ থেকে ৮ ভাগ, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশের কম। বিগত কয়েক বছরের আর্থিক চিত্র পযর্ালোচনা করলে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দাতারা তাদের প্রতিশ্রুতি রাখতে পারছে না।
দাতারা দু'ভাবে সহায়তা দিয়ে থাকে। একটি হচ্ছে ঋণ, অপরটি অনুদান। অনুদানের অর্থ ফেরত দিতে হয় না, তবে ঋণের জন্য সুদ পরিশোধ করতে হয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে তার বিপরীতে সরকারকে প্রতিবছর গড়ে ৬০ থেকে ৭০ কোটি ডলার সুদ গুনতে হচ্ছে। দীর্ঘমেযাদী প্রভাব বিবেচনা না করে অতীতে নানা ধরনের শর্তযুক্ত ঋণ নেয়ার কারণে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা ছিল। ছোট ছোট পদক্ষেপে হলেও দেশ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আর্থিক সক্ষমতা ও স্বনির্ভর হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং আত্মবিশ্বাস আমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের স্বার্থে দাতাদের কাছ থেকে ঋণ নেয়া যেতে পারে, তবে তা কঠিন শর্তে নয়।