বাকের ভাই; হুমায়ুন আহমেদ স্যারের সৃষ্টি করা বিখ্যাত চরিত্র। কোথাও কেউ নেই নাটক হয়ত অনেকেই দেখেছে, কেঁদেছে। আজ বইয়ের পাতা থেকে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে।
কিছু কিছু মানুষের জন্মই হয় হয়ত কষ্ট পাবার জন্য। মুনা যখন অনেক ছোট, খেলাধুলা, এদিক-ওদিক করে সন্ধ্যেবেলা মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শোনার কথা। তখনই সে বাবা-মাকে হারিয়েছে। এদিক-ওদিক করে শেষে মামার কোলে আশ্রয় হয় মুনার। তের বছর বয়সে পৃথিবীর খারাপ রুপটা সে দেখেছে। মামার অনুপস্থিতিতে কেউ একজন তাকে জড়িয়ে ধরে, তারপর... মুনা কাউকে কিছু বলেনি আড়াল করে গেছে।
মামা বিয়ে করে। সাধারণত দেখা যায় মামার বাড়ি থেকে মামীর সাথে বনিবনা হয় না। কিন্তু এখানে মামীর সাথে মুনার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। মুনা বড় হয়, চাকরি করে মামার টানাটানির সংসারে একটু হলেও হাত লাগায়।
মামার একটি মেয়ে বকুল দশম শ্রেণীতে পড়ে আর ছেলে বাবু সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। মামা শওকত সাহেব কেরানির চাকরি করেন, উপর মহলের কারো চাপে টাকা হাতিয়ে নেয়ার মামলায় ফেঁসে যান। জেল-টেল হয়ে যেত যদিনা মুনার দায়িত্বশীলতা আর বাকের ভাই দৌড়াদৌড়ি না করত।
বাকেরকে এলাকা দায়িত্বশীল যুবক রুপে দেখা যায় কিন্তু এলাকার সবার দৃষ্টিতে সে একজন ছোটখাটো গুন্ডা! কিন্তু এলাকার কারো কোন সমস্যা হলে বাকেরকেই আগে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। বাকের মুনাকে পছন্দ করে আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকে কখন মুনাকে একটু সাহায্য করা যায়। কিন্তু বাকের মুনার সামনে গেলেই মন খারাপ হয়ে যায় আর মনে উদাস ভাব লক্ষ্য করা যায়।
মুনা শক্ত ধরণের মেয়ে। মুনা আর মামুনের সম্পর্ক তিন বছরের। মামুন কলেজের লেকচারার। তাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। মামুন কল্যাণপুরে একটি বাসা ভাড়া নিয়েছে, কিছুদিন পরে তারা বিয়ে করে সেখানে থাকবে।
হঠাৎ মামুন কেমন বদলে যায়। মাঝে মাঝে কাউকে কিছু না বলে গ্রামের বাড়ি চলে যায়, কয়েক মাসে কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। তার ভিতর মুনা স্বার্থপরতা আর অনিহা লক্ষ্য করে।
মামি মারা যায়। মুনার মন খুব খারাপ থাকে। এরইমধ্যে সে মামুনের সাথে কল্যাণপুরের বাসা দেখতে যায়। মামুনের এমন উদাসীনতা লক্ষ্য করে মুনা দ্বিতীয়বার ভাবতে শুরু করে সে মামুনকে বিয়ে করবে কিনা। একথা মামুনকে বলতেই সে ঘরের দরজা লাগিয়ে দেয়, মুনাকে জোর করে জড়িয়ে ধরে, তারপর... মুনা দ্বিতীয়বার পৃথিবীর খারাপ রুপটা দেখে।
মুনা মামুনের সাথে বিয়ে প্রত্যাখ্যান করে যদিও মামুন তার কাজের জন্য মুনার কাছে ক্ষমা চায়। মামুন তিন বছর আগে মুনার সাথে ঠিক যেভাবে সম্পর্ক করেছিল ঠিক সেভাবে জাহানারা নামের এক মেয়ের সাথে সম্পর্ক করে তারপর বিয়ে করে। কিন্তু বিয়ের পরও তার মুনার কথা মনে পরে!
ডাক্তার জহিরের সাথে বকুলের বিয়ে হয়। বকুল তার শশুর বাড়ি নেত্রকোনায় চলে যায়। কিছুদিন পর বকুল তার ভাই বাবুকেও তার শশুর বাড়ি নিয়ে যায় আর সেখানকার স্কুলে ভর্তি করে দেয়।
মামা আর মুনা শুধু বাড়িতে থাকে। কিছুদিন পর মামা মারা যায়। মুনা সম্পূর্ণ একা হয়ে যায়। বকুলের ছেলে হয়।
ভদ্রলোকের পাড়ায় পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে কথা বলা এবং সিদ্দিক সাহেবের ভাড়টিয়া উচ্ছেদে বাধা দেবার জন্য বাকের রাজনৈতিক নেতা সিদ্দিক সাহেবের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। মিথ্যা অস্ত্র মামলায় চার মাস জেল খাটে। জেলে থাকবার সময় বাকেরের প্রতি মুনার দুর্বলতা লক্ষ্যনীয়। প্রতিদিন সে বাকেরে জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে যায়। মুনা নিজেই উকিল ঠিক করে বাকেরের মামলা লড়ে।
পুরো উপন্যাস জুড়েই মুনার পরিবারের প্রতি বাকেরের ভালবাস এবং টান লক্ষ্য করা যায়। নষ্ট ফ্যান ঠিক করে দেয়া, কাজের লোক রেখে দেয়া থেকে শুরু করে সে নেত্রকোনা গিয়ে বকুলের সাথে দেখা করে আসে। অসুস্থ বকুলকে দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসে, ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করে। ঘন্টায় ঘন্টায় মুনা আর বকুলের খোঁজ নিতে দেখা যায়। শুধু মুনার পরিবার নয়, পাড়ার যেকারো বিপদে আপদে সে যেন ছোটাছুটিতে রেডি।
বকুল চলে যাবার পর মুনা পুরোপুরোপুরি একা হয়ে যায়। প্রতিটা দিন তার একাকিত্বে কাটে। একা বাসায় মুনার জ্বর হয়। বাকের দেখতে যায়। মুনা বাকের হাত ধরে বলে, "বাকের ভাই আপনি কি আমাকে পছন্দ করেন? " বাকের কিছু বলে না। মুনা বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকে, বলুন বাকের ভাই আপনি আমাকে পছন্দ করেন কিনা। একসময় বাকের বলে, হ্যাঁ করি। মুনা অন্য ভঙ্গিতে বলে, আমি আপনাকে একদমই পছন্দ করি না। কিন্তু মুনা হয়ত মনে মনে বলছিল, বাকের ভাই আমি আপনাকে ভালবাসি, আপনি কেন বুঝেন না?
মুনা বাকের হাত ধরে বলে, বাকের ভাই আপনি সব গুন্ডামি, মাস্তানি ছেড়ে ভাল হতে পারবেন না? আমি একটা বাসা ভাড়া নেব, সেখানে শুধু আমি আর আপনি থাকব, সব ছেড়ে দেবেন আপনি।
বাকেরের চোখে পানি এসে যায়, দুফোটা পানি গড়িয়ে পরে। বাকের হয়ত মনে মনে বলে আমি সব ছেড়ে দেব মুনা, সব ছেড়ে দেব। তোমার জন্য কিনা করতে পারি আমি মুনা বল।
বাকের আমার দৃষ্টিতে প্রকৃতই ভাল মানুষ। এত দুঃখ, কষ্ট, একাকিত্ব ভুলে, মুনা হতয় বাকেরকে আকঁড়ে বাচতে চেয়েছিল। কিন্তু ওইযে মুনার জন্মই হয়েছে কষ্ট পাবার জন্য।
এগারো নাম্বার বাড়ির (যে বাড়িতে তিনজন পতিতা থাকে) কেয়ারটেকার জোবেদ আলিকে খুন করে সিদ্দিক সাহেব। কিন্তু বলির পাঠা হয় বাকের। বাকেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
বাকেরের লাশ নিতে এসেছিল মুনা। বাকের কি হয় আপনার? জেলর মুনাকে জিজ্ঞেস করাতে মুনা বলে, কেউনা, আমি ওর কেউ না।
পরিশিষ্ট: হুমায়ুন আহমেদ আমাকে কাঁদিয়েছে, ২৫২ পৃষ্ঠার কোথাও কেউ নেই দিয়ে আমায় কাঁদিয়েছে...
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৯ রাত ৯:২১