ছাতা মাথায় হাঁটু সমান পানি ভেঙ্গে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলছি। ছাতার কৃপায় মাথাটা রক্ষা পেলেও শরীরটা ভিজে ছুপছুপ করছে। গাড়ি থেকে নামার সময় প্যান্টে দুভাজ দিয়ে নেমেছিলাম। কিন্তু পানি যখন হাঁটু পর্যন্ত তখন প্যান্টে ভাজ করা আর না করার মধ্যে কোন পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। বৃষ্টির ভাবে মনে হচ্ছে পুরো আকাশটাই খোসে পরছে।
এত বৃষ্টি আর রাস্তায় পানির কারণে মানুষের মুখে বিরক্তির ছাপ। কিন্তু আমার কেন যেন বিরক্তি লাগছে না। এ বৃষ্টিতে যে ভিজতে মন চায়... এক কথায় যাকে বলে বৃষ্টি বিলাস! তারপর আবার আজ আমার সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হল।
একটু এগুতেই দেখলাম দু-তিনজন ছেলে রাস্তার পানিতে ফুটবল খেলছে। এদের একজনের গায়ে আবার মেসির জার্সি! ছোটবেলায় স্কুলের মাঠের কাঁদায় কত ফুটবল খেলেছি। সারা গায়ে কাঁদায় মাখামাখির পরে বল নিয়ে নদীতে গোসল করতে যাওয়া। বলে লাথি মেরে নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পরা। আরও কতকি!
মন কখন যে কি চায় বোঝা মুশকিল। এদের খেলা দেখে আমারও একটু ঝাপাঝাপি করতে ইচ্ছা করলেও বয়সেরও তো একটা ব্যাপার আছে। সব বয়সে সব হয় না।
কার কি মনে হচ্ছে জানি না তবে বৃষ্টির কারণে যান্ত্রিক শহরটা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। গাছের পাতায় লেগে থাকা ধুলো গুলো মুছে গেছে বৃষ্টির পানিতে। শহরটা কিছুটা হলেও সবুজ হয়ে উঠেছে।
কিছুদূর যেতেই দুপাশে কংক্রিটের অট্টালিকায় ঘেরা রাস্তা ছেড়ে লেকের পাশে চলে এসেছি। এখানে সবুজের পরিমাণ বেশি কেননা এই জায়গাটা ছোটখাটো একটা উদ্যান। এখানে রাস্তায় বেশি পানি নেই। বৃষ্টির তেজটাও অনেকটা কমে এসেছে। লক্ষ করলাম লেকের পারে একটা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে। গাড়ির সামনের দরজা ধরে ভিতরে ঝুঁকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একজন ষাটোর্ধ বয়সের বুড়ো।
বুড়ো বেশ পরিপাটি। গায়ে মার্জিত শার্ট-প্যান্ট। বুড়োকে দেখেই মনে হয় সে বড়ই রসিক মানুষ। মুখে মিটিমিটি হাসি। মাথায় ছাতা নেই, গায়ে কোন রেনকোটও নেই। সে ভিজছে! এটা শখের ভেজা। আর গাড়ির ভিতরে বসে আছে একজন মহিলা। মহিলাকে মহিলা বলার চেয়ে বরং বুড়ি বলাই শ্রেয়। কারণ মনে হচ্ছে সে ওই বুড়োটার বউ। আর বুড়োর বউতো বুড়িই হয়!
বুড়োর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। বেশ ইন্টারেস্টিং! ব্যাপারটাতো একটু দেখতেই হয়।
আমি সুড়সুড়িয়ে হেটে পাশের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম ছাতা মাথায়। এখান থেকে তাদের কথা বেশ ভালো কানে আসে। তাদের কথোপকথন শুনে বুঝতে পারলাম যে বুড়ো সদ্য চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে। বাসায় ছেলে মেয়েরা ব্যস্ততার কারণে তাদের সাথে কথা বলার সময়টুকু পায় না। এতে একঘেয়েমি আর জীবনে বিরক্তি আসাই স্বাভাবিক।
বাসায় কর্মহীন ভাবে বসে থাকতে ভালো লাগে না তাই বউয়ের সাথে লেকে বেড়াতে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টি তাদের অবকাশে পানি ঢেলে দিয়েছে। কিন্তু বুড়ো দাঁড়িয়ে ভিজছে কেন?
বুড়ির কথা শুনতে পেলাম, পুরনো চশমা পরেছও যে? বাদল এখনো তোমার চশমা পালটে দেয়নি?
-ধুর বাদ দাও তো বাদলের কথা। তার কি আর সময় আছে? শুধু ব্যবসা আর শশুর বাড়ি এই করেইতো তার জীবন চলে। আর রাত্রি তো সপ্তাহে দু-একবার ফোন কলেই দায়িত্ব শেষ। এখানে ওদের নিয়ে ভাবতে আসিনি বুঝলে নাসিমা।
বুঝতে পারলাম বুড়ো নিজে গাড়ি চালিয়ে এখানে আসেনি। এনেছে ড্রাইভার। আর বুড়ো ড্রাইভারকে গাড়ি জোরে চালানোর হুকুম করেছে। বুড়ি নাকি ভয় পেয়ে অস্থির এত জোরে গাড়ি চালানোর জন্য। ভয়তো পাবারই কথা।
বুড়োর হুকুমে ড্রাইভার স্থান ত্যাগ করেছে। ফোন পেলেই আবার আসবে।
হঠাৎ বুড়োর আহ্লাদ শুনতে পেলাম,
-এসোনা বৃষ্টিতে ভিজি।
-তুমি-তো ভিজছই
-দুজনে একসাথে ভিজবো।
বুড়োর কথা শুনছি আর মিটিমিটি হাসছি। বুড়ির আওয়াজ কিছুটা ক্ষীণ,
-বুড়ো বয়সে ভীমরতিতে ধরেছে নাকি তোমায়?
-কেন বুড়ো বয়সে কি মনে প্রেমের অনুভূতি আসতে নেই গো? ভালবাসি তোমায়!
বুড়োর কথা শুনে আমার হোহো করে উচ্চস্বরে হাসতে ইচ্ছে করছে কিন্তু তাদের আহ্লাদ নষ্ট করার ইচ্ছা নেই আমার।
বুড়ির মুখভঙ্গিতে পূর্ণ ভেজার ইচ্ছা। তবুও সে বলছে, ঠাণ্ডা লেগে আমার জ্বর এসে যাবে। আমি পারব না। তুমি একাই ভিজো।
বুড়োর মুখে হাসি, সেকি আমি একাই ভিজবো? জ্বর আসে আসুক। গাড়িতে একটা রেইন কোট আছে, তুমি ওটা পরে চলে এসো।
আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম যে বুড়ি রেনকোট পরে বাইরে চলে এলো!
বুড়ো-বুড়ির কাণ্ড দেখে আমি ফিক করে হেসে দিলাম। যদিও আমার হাসি তাদের আহ্লাদকে স্পর্শ করেনি।
বি.দ্র: এই গল্পটা আগে একবার পোস্ট করেছিলাম, তখন অনেক ভুল-ভ্রান্তি ছিল। এবার অনেকখানি পরিমার্জনা করে পোস্ট করলাম।
ছবি সূত্র: গুগোল।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ২:২২