নষ্ট ইঞ্জিন ঠিক করে পাঁচ ঘণ্টা পর মধুমতী এক্সপ্রেস ছুটে চলছে। জায়গাটা পাবনার পাকশি পেপার মিলের কাছাকাছি। রেললাইনের অনেক নিচে ঘরবাড়ি, গাছপালা। মনে হচ্ছে পাহাড়ি জনপদ! পাবনাতে পাহাড়ি জনপদ কথাটি শুনলে হাস্যকর লাগে। তবে গল্পকার সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, 'সমতল ভূমির মানুষদের মন একটু উঁচু স্থান দেখলেই উতলা হয়ে পরে'!
আমি জানালায় দুই হাত পেতে তার উপর থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছি। সামনে রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিশাল বিশাল সব ক্রেন আর কন্সট্রাকশন সাইট। দেখলেই মনে শিহরণ জাগে। অবশ্য জাগাটা স্বাভাবিক বটে, নিজের বিষয় বলে কথা!
হার্ডিঞ্জ ব্রিজে এসে গতি কিছুটা কমলো। সামনে ধু ধু জলরাশি, আর লালন শাহ্ সেতু। আর নদীর পার পর্যন্ত রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মযোগ। মনে ভবনা ধরেছে, রুপপুর যদি চেরনোবিল হয়ে যায় কি হবে তখন? এই নদীর পানি কি ওই বিপর্যয় মোকাবেলা করতে পারবে? মনে তো হয়না। খারাপ কিছু না হোক এটাই চাই।
আমার সামনে একজন পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে, চোখে চশমা, গায়ে নীল পাঞ্জাবী, আর কেমন যেন দাড়ি। দেখার মত বিষয়টা হল, তার বুকে একটি ব্যাচ ঝোলানো তাতে লিখা আছে, 'বীর মুক্তিযোদ্ধা'! কিন্তু তার চাহনি, মুখভঙ্গি বরং শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের মত লাগে, সেলিনা হোসেনের কাকতাড়ুয়া উপন্যাসের চেয়ারম্যান! কেউ মুক্তিযোদ্ধা হলে তার বুকে ট্যাগ ঝুলিয়ে মানুষকে দেখানোর প্রয়োজন হয়, আমি মুক্তিযোদ্ধা? হতে পারে আমি জানিনা। যাহোক কথা এটা নয়, ট্যাগ ঝোলানো মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে আমার মনে পরে গেছে আরেকজনের কথা।
এইতো কদিন আগে এই মধুমতী এক্সপ্রেসেই যাচ্ছিলাম। পাশে এসে এক ভদ্রলোক বসলেন। হাফহাতা শার্ট, হাতে ব্যাগ, বয়স ষাটের বেশি। আমি আরেকজনের সাথে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে কথা বলছিলাম, আমার কথায় লাহোর চুক্তি নিয়ে কিছু ভুল চলে আসে। তখন ক্ষিপ্র হস্তে ওই ভদ্রলোকটি আমার ভুল ধরিয়ে দিলেন। তারপর শুরু হল তার সাথে গল্প। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন! হার্ডিঞ্জ ব্রিজে উপর নাকি যুদ্ধের সময় বিমান থেকে বোমা ছোড়া হয়েছিল। তিনি যোদ্ধা ছিলেন, পাক-মিলিটারিদের হাতে ধরাও পরেছিলেন। আমি তখন নির্বাক শ্রোতা হয়ে তার গল্প শুনছিলাম। দাদার কাছে শোনা মুক্তিযুদ্ধ-ধরনের অনুভূতি!
তিনি বলছেন, মুঘল থেকে ব্রিটিশ, বঙ্গ-ভঙ্গ, দ্বি-জাতিতত্ব, ৬৫'র পাক ভারত যুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ, সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান অবস্থান-পরিস্থিতি থেকে শেষ হল রহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে। তিনি বলে চলছেন, মাঝে মাঝে পাকিস্তান পিরিয়ডের কোন সংলাপ বলতে গেলে উর্দুতেও বলে যাচ্ছেন। আমি শুধু একটা ঘটনার সাথে আরেকটি যোগসাধন করে দিচ্ছি আর সে অবলীলায় বলে যাচ্ছেন! যোগসাধন বলতে গেলে, কেউ কি মুঘলদের সাথে রহিঙ্গা ইস্যুর কোন সম্পর্ক আছে? কিন্তু কথার কি স্রোত, যে স্রোত আমাদের গল্প মুঘল আমল থেকে শুরু করে রহিঙ্গাদের পর্যন্ত নিয়ে গেছে!
তিনি একজন লোক যাকে দেখলে শ্রদ্ধায় চোখে জল এসে যায়। তিনিও মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু তার বুকে কোন মুক্তিযোদ্ধার ট্যাগ নেই, কিন্তু তার কথায়, তার আচরণে তিনি মুক্তিযোদ্ধা তা ফুটে উঠেছে। আমি এই মুক্তিযোদ্ধাদের ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। কথায় আছে বৃক্ষ তোমার নাম কি, ফলে পরিচয়!
ট্রেন পাকশি স্টেশনে এসে থামল, আবার কোলাহল শুরু হল, আমার ভাবনায় কিছুক্ষণ ভাটা পড়ল। বাস্তবে ফিরে এলাম, স্টেশনে কত হট্টগোলের ভিড়ে চোখ পড়ল এক বাদাম বিক্রেতার দিকে। তার বাদামের খাড়ি পরে আছে মাটিতে পড়ে, এদিক ওদিক বাদাম ছড়িয়ে আছে। আর বাদাম-ওয়ালা অভিমানী চোখে গলায় গামছা ঘষতে ঘষতে একদিকে দ্রুত হেটে যাচ্ছে আর অন্যপাশে স্টেশনের কোন এক কর্মকর্তা অগ্নিদৃষ্টিতে তার হেটে যাওয়া দেখছে। এই অগ্নিদৃষ্টির কাছে বাদাম-ওয়ালার অভিমান কোন পাত্তাই পাবে না।
ট্রেন আবার ক্যু ঝিক ঝিক করে চলতে শুরু করেছে। শুনতে পেলাম পাশে বসে থাকা মহিলাটির মানিব্যাগ চুরি গেছে, ভাগ্যিস মাত্র সাড়ে তিনশত টাকা মানি ব্যাগে ছিল। তাই তার চেহারায় খুব একটা বিস্ময় নেই। এ যেন ট্রেনে স্বাভাবিক ঘটনা। এর মধ্যে ট্রেনে কত ভিক্ষুক এলো-গেল, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন চাঁদা তুলে গেল। চাঁদা দিতে না চাইলে স্পর্শকাতর জায়গায় তারা হাত দেয়! কি একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড।
একটা বোবা লোক এলো, তার পায়েও সমস্যা হাঁটতে পারেনা ঠিক মত। তার হাতে একটি লোকাল পত্রিকা। দু-পাতার লোকাল পত্রিকা কিন্তু দাম পাঁচ-টাকা! লোকটার শারীরিক সমস্যা কিন্তু তাও সে ভিক্ষা না করে পত্রিকা বিক্রি করে খেটে-খাচ্ছে দেখে আমি একটা পত্রিকা কিনলাম। জানি এটা অখাদ্য হবে তাও কিনলাম। যথারীতি এই লোকাল পত্রিকা তার থেকে কেউ কিনছে না।
না, একজন ব্যতিক্রম দেখতে পেলাম। সচরাচর কেন এমন ঘটনা বিরল বলা চলে অবলীলায়। এক লোক পাশের সিটে ই বসেছিল। রুক্ষ চুল, মোটা ফ্রেমের চশমা। পরনে সাদা লুঙ্গি সাথে সাদা পাঞ্জাবী। লুঙ্গি-পাঞ্জাবী পরেছে তবুও তাকে স্যুট-প্যান্ট পরা জেন্টলম্যানের থেকেও বেশি জেন্টলম্যান মনে হয়। কিন্তু মুখটা গম্ভীর। সে বোবা লোকটার একটা পত্রিকা হাতে নিলো, কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখল তারপর হকার প্রতিবন্ধী লোকটিকে পাশে বসিয়ে একরকম হুমকি দিল পরবর্তী স্টেশন আসা পর্যন্ত বসে থাকবার জন্যে। আমি মনে মনে চটে গেলাম, ব্যাটা তুমি পত্রিকা কিনলে কিন, নাহলে যেতে দাও, হুমকি-ধমকি দিয়ে বসিয়ে রাখার কি আছে? কিন্তু কিছু না বলেই চুপ করে রইলাম।
পোড়াদহ জংশনে এসে ওই লোকটা পত্রিকাওয়ালার হাত ধরে নেমে গেল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। লোকটা চলে গেল বড় পত্রিকা দোকানে। সেখান থেকে ত্রিশ কিংবা চল্লিশের মত জাতীয় দৈনিক কিনে বোবা লোকটির হাতে ধরিয়ে দিল। তারপর ধমকের সাথে বলে, হারামজাদা ডালভাত বিক্রি করে খাস এখন থেকে পোলাও মাংস বিক্রি করবি। বোবা লোকটির চোখে বিস্ময়!
এ জগতে কত ধরনের মানুষ! ভাল মানুষ, খারাপ মানুষ, আবার কেউ কেউ ভালো-খারাপের মাঝামাঝি। আমি আবার একটু জানালায় গা এলিয়ে দিলাম। গোয়ালন্দ ঘাটে পৌছাতে আরও তিন ঘণ্টার মত লাগবে। এদিকে সন্ধ্যে সাতটা হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা বাতাস, সাথে কত বড় চাঁদ, জ্যোৎস্নার আলো! এরপর কয়েকটা জংশন গেল আমি জানালা থেকে নড়লাম না। কত মানুষের ব্যস্ততা, হাকারের হাকাহাকি, কুলিদের ছুটে চলা। কেউবা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, এই ক্লান্তি দূর করতে গামছাটাই সম্বল।
রাত দশটা। ট্রেন থেকে নামলাম। এই রাতেও ট্রেনের মানুষের হুরোহুরি। আমি প্লাটফর্ম দিয়ে না গিয়ে রাস্তায় নেমে পরলাম। স্লিপারের উপর দিয়ে হাটার চেষ্টা করছি। কিছুদূর যেতেই মানুষের কোলাহল থেকে মুক্তি পেলাম।
এদিকে মানুষ জন নেই, চাঁদের আলো ছাড়া অন্য আলোও নেই। সামনে স্লিপারের উপর একটি মেয়ে বসে আছে। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক, হাতে কাচের চুড়ি। আমাকে দেখে উঠে এসে বলে, কাম করবেন? দুইশ দিলেই চলব। আমি তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। শ্যামলা মুখটায় কত গল্প লেখা আছে!
পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একশ টাকার দুটি নোট বের করলাম। তার হাতে নোট দুটো দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছি, পিছনে ফিরে তাকাইনি।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১:৪৯