শীলার সাথে আমার পরিচয়ের গল্পটা বলি।ওর নাম মূলত শায়লা।আমি তাকে শীলা বলেই ডাকি।
আমি তখন মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার পুরানো আমলের তৈরী দুই-কামরার একটি টিনশেড বাড়িতে থাকি।একাই থাকি।
বাসায় গ্যাস আছে,রান্নাবান্না আমি নিজেই করি।
পড়াশোনা শেষ করে সবে একটা প্রাইভেট কলেজে চাকরী নিয়েছি।রাত জেগে টুকটাক কবিতা লেখারও অভ্যাস আছে।মাঝেমাঝে কিছু কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায়ও ছাপা হয়।
বাড়িতে অসুস্থ্য মা থাকে,মাকে দেখাশোনা করার জন্য একটা মেয়ে আছে,তার নাম-বিনু।বিনু আমার মায়ের দুঃসম্পর্কের এক আত্নীয়ের মেয়ে।তার বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে মা বিনুকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছেন।মায়ের দেখাশোনা করার পাশাপাশি সে পড়ালেখাও করে।গত বছরই মেট্রিক পাশ করেছে।আমি নিজে বাড়ি গিয়ে তাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি।
বিনুর জন্য আমার মায়ের মমতার কোন শেষ নেই।মা তাকে নিজের সন্তানের মতই স্নেহ-করেন।
কলেজ থেকে মাস শেষে যা মাইনে পাই তার একটা অংশ পাঠাই মায়ের জন্য,বাকীটা দিয়ে আমার দিব্যি চলে যায়।
ও আচ্ছা শীলার গল্পটা বলি-
তখন সম্ভবত শ্রাবণ মাস ছিলো।কখনো বৃষ্টি কখনো রৌদ টাইপ অবস্থা।
সেদিন আমি কলেজ থেকে বের হয়ে বাসার দিকে রওনা হলাম।
অন্যান্য দিন রিক্সা কিংবা সিএনজি চড়ে বাসায় গেলেও ঐ দিন হেঁটেই যাচ্ছিলাম।
মাঝ পথে আসতেই শুরু হলো বৃষ্টি।
আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম কোন রিক্সা যদি পাওয়া যায়-তেমন কিছুই পেলাম না।তাই আর অপেক্ষা না করে ভাবলাম বাসাইতো যাচ্ছি তাছাড়া অনেকদিন বৃষ্টিতে ভেজাও হয়না আজ বরং ভিজতে ভিজতেই যাই।
যেই কথা সেই কাজ-হাঁটা শুরু করলাম বাসার উদ্দেশ্যে।
কলেজ থেকে বাসা প্রায় ত্রিশ-মিনিটের মতো হাঁটাপথ।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা রিক্সা এসে আমার গা-ঘেষে দাঁড়ালো।
আমি পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের এক তরুণী রিক্সার সিটে বসে আছে।গায়ের রঙ তামাটে।
ঠিক এতোটা গ্লামার আজকালকার মেয়েদের চেহারায় সচরাচর দেখা যায় না বটে।
গায়ে আকাশী রঙয়ের শাড়ি।শাড়ির সাথে ম্যাচ করে টিপ দিয়েছে।
বয়স আনুমানিক বাইশ কিংবা তেইশ হবে।
বাতাসের ঝাপটায় শাড়ির কিছুকিছু অংশ বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে।
আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,এই যে আপনি ভিজছেন কেন?আসুন রিক্সায় উঠে আসুন।
একথা শুনে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।
নিতান্ত অপরিচিত একটা মেয়ে আমাকে বলছে তার সাথে রিক্সায় উঠার জন্য বিষয়টা রহস্যজনক।
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে পরক্ষণেই বললাম,ইচ্ছে করছে তাই ভিজছি।আপনার ইচ্ছে করলে আপনিও আমার সাথে ভিজতে পারেন।
সে বললো অসুখ করবেনা?
আমি উত্তর দিলাম অসুখ করলে ঔষধ খাবো-ব্যস ঝামেলা শেষ।
সে বললো এতো সোজা?
আমি বললাম,সোজা করে দেখলে সোজা,কঠিন করে দেখলে বিরাট কঠিন।
এরপর সে আবার বললো আরে আসুনতো রিক্সায় উঠে পড়ুন।
আমি আর কিছু চিন্তা না করেই ভিজা কাপড় নিয়ে সুবোধের মতো সোজা রিক্সায় উঠে বসলাম।
মনেমনে ভাবলাম রহস্যময়ীর রহস্যের একটা সমাধান করা দরকার।
ভেজা কাপড় নিয়ে রিক্সায় বসতে প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগলেও পরে সেটা কাটিয়ে উঠেছি।
আমাদের মধ্যে অনেক কথা হলো-
তার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম,পড়ালেখার পাশাপাশি সে সংগঠন করে।তাদের একটা নাট্যগোষ্ঠী আছে।
আজ তার মন তুলনামূলক খারাপ।একটা প্রোগ্রামে শিল্পকলায় গিয়েছিলো শেষ মুহূর্তে এসে প্রোগ্রামটা কেন্সেল হয়েছে বলেই মন খারাপ।
সেখান থেকেই বাসায় ফিরছিলো,বাসা-বনশ্রী।
আমাকে আমার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে বললো,আজ আসি তাহলে।
আমি বাসায় যেতে অনেক অনুরোধ করলাম।বললো,আজ না অন্য একদিন নিশ্চই যাবো।
আমি বললাম রিক্সা থেকে নামুন আমার বাসাটা অন্তত চিনে যান,না হলে পরে আসবেন কিভাবে?
রিক্সা থেকে নামার পর আমার মনে হলো শীলার সৌন্দর্য বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে।মেয়েদের এই বিষয়টা খুবই অদ্ভূত।একেক সময় তাদেরকে একেক রকম লাগে।ছেলেদের বেলায় এমনটা হয় না।
শীলা রিক্সা থেকে যখন নামলো তখনো গুটিগুটি বৃষ্টি হচ্ছিলো।
বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ার কারনে শাড়ির কিছুকিছু অংশ শরীরের সাথে একেবারে লেপ্টে গিয়েছিলো।
শাড়ির উপর দিয়ে তার আকাশী রঙয়ের ব্লাউজ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো।ব্লাউজের ভিতরের ব্রাটাও সুস্পষ্ট ছিলো।
ভাগ্যিস বেশী ভিজেনি তাহলে ব্রার ভেতরে কি ছিলো তাও দেখা যেত!
আমি হাত ইশারা করে দূর থেকে তাকে আমার বাসা দেখালাম।সে বললো
ঠিক আছে একদিন হুট করে চলে আসবো।
তার কিছুদিন পর এক শুক্রবার বিকেলে আমি বাসায় শুয়ে আছি।এমন সময় কেউ একজন দরজায় কড়া নাড়লো,আমি দরজা খুলতেই দেখি-শীলা!
আমাকে বললো,আসতে বলেছিলেন তাই চলে এলাম।
আমি জবাব দিলাম,ভালো করেছেন।
সে বললো,আমিতো ঠিক করেছি আজ সারা বিকেল আপনার সাথে ঘুরবো!
পার্কে যাবো,বাদাম খাবো মন চাইলে সিনেপ্লেক্সে একটা মুভিও দেখে নেবো।
আমি বললাম তাই?বিশাল প্ল্যান দেখছি।
এভাবেই ধীরে-ধীরে আমাদের সম্পর্কটা হয়ে গেলো।সাধারনত দেখা যায় ছেলে-মেয়েদের প্রেমের সম্পর্ক গুলো
হতে দুজনকেই ঝামেলায় পড়তে হয়।নানান জটিলতার পর একটা সময় এসে প্রেম হয় কিন্তু আমাদের বেলায় এমনটা হয়নি।
এরপর থেকে শীলা প্রায়ই আমার বাসায় আসতো।কখনো আমার কলেজে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করতো।
তার কিছুদিন পর গ্রাম থেকে সংবাদ এলো মায়ের শরীরের অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন।
আমি দেরি না করে বাড়ি গিয়ে মাকে ঢাকায় নিয়ে এলাম সাথে বিনুকেও।
মাকে নিয়ে আসার ফলে আমার কিছু সুবিধা হয়েছে।
যেমন আগে রান্নাবান্না থেকে শুরু করে কাপড়-ধোয়াসহ সমস্ত কাজ আমার নিজেকেই করতে হতো।এখন সেসব কাজ আর আমাকে করতে হয় না।এই দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই বিনুর ঘাড়ে গিয়ে পড়লো।।
কিছুদিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মা-মারা গেলেন।
আমি লক্ষ্য করলাম মায়ের মৃত্যু আমাকে যতোটা না ভাবিয়ে তুলেছে,আমাকে যতোটা আঘাত করেছে তার চাইতে অনেক বেশী ভাবিয়ে তুলেছে,অনেক বেশী আঘাত করেছে বিনুকে।আমি ছাড়া বিনুকে সাহায্য করার মতো তখন পৃথিবীতে আর কেউ নেই কিন্তু সে আমার উপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছেনা,এটা বিনুর চেহারায় স্পষ্ট ছিলো।নিজের ভবিষ্যত নিয়ে সে ভীষন শঙ্কিত হয়ে পড়ে যদিও আমি নিজেও শঙ্কিত ছিলাম!
তাছাড়া শীলাও বিনুকে নিয়ে বেশ ঝামেলা করছিলো,সে কিছুতেই চাচ্ছিলোনা বিনু আমার সাথে থাকুক।
মা বিনুকে কখনো তার মৃত্যুর পর বিনু কোথায় থাকবে কিংবা কি করবে সম্পর্কে কিছু বলে গেছে কিনা আমি জানিনা।
তাছাড়া শেষ দিকে এসে মা একেবারে কথাই বলতে পারতেন না,হাটা-চলা করতে পারতেন না শুধু প্রানটাই ছিলো।সুতরাং কিছু বলে গেছে এটা চিন্তা করা যায় না।
একবার ভেবেছি বিনুকে জিজ্ঞেস করবো।পরে মনে হলো যদি মা তাকে এ ব্যাপারে কিছু না বলে গিয়ে থাকে তাহলে সে যে আঘাতটা পাবে সেটা তার সহ্যের বাইরে চলে যাবে এবং বিষয়টা সেই মুহূর্তের জন্য অমানবিকও বটে।এতে করে বিনু আরও ভেঙ্গে পড়বে!
আমি কোনকোন দিন রাত জেগে লিখি আবার কখনো কখনো কলেজের লেকচার গুলো দেখার প্রয়োজন পড়ে। সবমিলিয়ে ঘুমাতে যেতে আমার অনেক রাত হয়ে যায়।আমি লক্ষ্য করলাম আমার সাথে সাথে বিনুও রাত জাগে।এক সময় আমার মনে হলো আমি কি করছি না-করছি সে তার রুমের দরজার আড়ালে থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখে।
মা বেঁচে থাকা অবস্থায় আমি এটা কোনদিন খেয়াল করিনি।তবে এটা দেখতাম আমার ঘরটা সে সবসময় সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতো কিংবা আমার জামা-কাপড় গুলোও সময়মত ধুয়ে রাখতো।
আমার উপর তার বাড়তি কদর কখনো কখনো চোখে পড়লেও এটাকে খুব বেশী গুরুত্ব দেইনি।
একদিন প্রায় রাত একটার দিকে সে আমার জন্য চা নিয়ে এলো।
দেখতে পেলাম বিনু যে শাড়িটা পড়ে এসেছে সেটা বেশ পুরানো কয়েকটা জায়গায় ছেড়াও।
এই দৃশ্য দেখে আমার নিজের উপর নিজেরই খুব রাগ হলো।
মেয়েটা আমার জন্য,আমার মায়ের জন্য এতো এতো করে চলেছে অথচ আমরা তার কোন খোঁজই রাখিনা!
বিষয়টা ভাবতেই কেমন ঘেন্না লাগছিলো নিজের উপর।
তখন আমি তাকে বললাম তুই এতো রাত জেগে না থেকে আমার জন্য ফ্লাস্কে চা বানিয়ে রাখলেই তো পারিস।
সে বললো আপনিতো ফ্লাস্কে চা রাখলে গন্ধ হয়ে যায় তাই খান না,সে জন্যই ফ্লাস্কে চা রাখিনা।
আপনাকে রাত জেগে চা বানিয়ে দিতে আমার কোন অসুবিধা হয় না।
আমি এই কথার কোন জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম-এটাকে সবসময় নিজের ঘর মনে করবি।কখনো কিছুর প্রয়োজন পড়লে আমাকে বলতে সঙ্কোচ করবিনা।বিনু আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে কেবল মাথা দুলালো।
বিনু এমনিতে খুব গুছানো মেয়ে ছিলো,অনেক চুপচাপ।প্রয়োজন ছাড়া একটি কথাও বলতো না।
তারপর দিন আমি নিউমার্কেট থেকে তার জন্য চার-পাঁচটা জামা নিয়ে এলাম এবং মাইনে থেকে আমাদের দুজনের ঘর খরচের মাসিক টাকাটা তার হাতে দিয়ে বললাম-নে এগুলো আমাদের মাসিক খরচের টাকা।তুই তোর মত করে চালাবি।আমাকে শুধু টাকা দিয়ে বলবি কখন কি আনতে হবে।বিনু প্রথমে টাকাটা নিতে চায়নি পরে আমি জোর করাতে টাকাটা হাতে নিলো।
আমি এই কাজটা করেছি কারন বিনু যেন বুঝতে পারে তার ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিচ্ছু নেই।
দুঃখ জনক ব্যাপার হলো বিনুর জন্য জামাগুলো বাসায় নিয়ে আসার পর
সে আমাকে বললো-
এগুলো আমার হয়নি,অনেক বড় হয়ে গেছে।
বদল করে আনতে হবে।আপনি দোকানিকে বলবেন আরো ছোট জামা দিতে।সাইজ জিজ্ঞেস করলে বলবেন-বত্রিশ।
বিনুর এই কথাটায় আমি কিছুটা বিব্রত হলাম আর বললাম
ও আচ্ছা!
একদিন শীলা এলো বাসায়।
বিনু আমাদেরকে চা-নাস্তা এনে দিলো।
শীলা আমাকে হুট করে বিনুর সামনেই বললো আচ্ছা একটা ধাঁধা উত্তর দাওতো,দেখি তোমার বুদ্ধি কেমন?
আমি জিজ্ঞেস করলাম কি ধাঁধা?
সে বললো-বলতো মেয়েদের শরীরের কোন অংশটা সবচেয়ে বেশী নরম?
শীলার একথায় আমি পুরোপুরি থ হয়ে গেলাম!
কি বলবো বুঝতে না পেরেই বললাম-এটা আবার কেমন ধাঁধা?
শীলার এই প্রশ্নটাকে আমি ধাঁধা হিশেবে নিতে পারিনি।
আমার মনে হয়েছে বিনুর সামনে সে একথা বলে একধরনের খেলা খেলার চেষ্টা করেছে।
শীলার আচার-আচরনে বিনুও বুঝতে পারতো যে শীলা চায়না বিনু আমার সাথে থাকুক এবং এটাও সে উপলব্ধি করতো বলেই আমার মনে হোত যে তাকে নিয়ে আমার আর শীলার মধ্যে প্রতিনিয়তই ঝগড়া হয়।
শীলা চলে গেলে আমি বিনুকে বলতাম-শীলার আচরনে তুই কিছু মনে করিস না।
বিনু বলতো ও কিচ্ছু না।
যত দিন যাচ্ছিলো বিনু ততবেশী নির্জীব হয়ে যেতে লাগলো।রাত জেগে জেগে,চিন্তা-দুঃচিন্তায় তার চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গিয়েছিলো।আমি কেবল নিরুপায় হয়ে দেখে যেতাম।
একদিন তাকে ডেকে বললাম-তোর কি কোন সমস্যা হচ্ছে?সমস্যা হলে আমাকে বল।
সে বললো না।
আমি বললাম-তোকে আবার কলেজে ভর্তি করিয়ে দেব।সারাদিন বাসায় একাএকা থাকার কোন মানে হয়না।কলেজে যাবি আবার পড়াশোনা করবি।
একথা শুনে বিনু খুশী হয়নি তানা কিন্তু তাকে যতটা খুশী হবে আমি ভেবেছিলাম সে ততটা খুশী হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি।
শুধু বললো-আচ্ছা।মুখে ঈষৎ হাসি ছিলো।এই প্রথম আমি তার মুখে হাসি দেখলাম।
রাত আনুমানিক দুইটা হবে।বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো।
হঠাত বিনুর রুমে শব্দ শুনে আমি আমার রুম থেকেই জিজ্ঞেস করলাম
বিনু কি হয়েছে?
তার কোন জবাব না পেয়ে আমি তার রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।দেখি পেটে হাত দিয়ে ও বিছানায় ছটফট করছে।
আমি তার কাছে এগিয়ে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে?শরীর খারাপ লাগছে?
সে মাথা ঝাকালো।
আমি ভীষন চিন্তায় পড়ে গেলাম,এতো রাতে আমি কি করবো,ডাক্তারই বা পাবো কোথায়?
বিনু বললো এতো অস্থির হবেন না,এটা আমার একটা মেয়েলি সমস্যা,একটু বাদেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আপনি শুধু আমার পাশে এসে একটু বসুন।এই তৃতীয়বার আমি তার সামনে এসে অপ্রস্তুত হলাম।
আমি একটা চেয়ার টেনে তার পাশে বসলাম।
কপালে হাত দিয়ে দেখি গায়ে প্রচুর জ্বর।একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম আমি তার কপালে হাত রাখার সাথে সাথেই সে চোখ মেলে একবার আমার দিকে তাকালো পরক্ষণেই চোখ বন্ধ করে পেললো।
তার সেই দৃষ্টিতে ঠিক কতটা অসহায়ত্ব ছিলো সেটা কেবল আমি জানি।
আমি তার মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করলাম-জলপট্টি দিলাম।
বিনু বললো আমার মতো এমন কপাল-পোড়া মেয়ের জন্য আপনি কেন এতো কষ্ট করছেন?
আপনার সক্কালে কত কাজ,আপনি যান শুয়ে পড়ুন।
আমি বিনুকে থামিয়ে দিয়ে বললাম আমার কাজের কথা নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না।
তুই মায়ের জন্য সারাটা জীবন যা করেছিস তার ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবোনা।
বিনু বললো এটা আপনার বাজে কথা।
আমিতো কোনদিন আপনার মাকে আলাদা করে দেখিনি।তিনি ছিলেন আমারও মা।
বিনু কথাটা মোটেও ভুল বলেনি,অন্তত আমি তা জানি।
বিনুকে জিজ্ঞেস করলাম রাতে ভাত খেয়েছিলি?
এখন কিছু খেতে মন চাচ্ছে,খিদে লেগেছে?
বিনু বললো খিদে লাগলেও কিছু করার নেই,বাসায় খাওয়ার কিছু নেই।
আপনিতো আজ অনেক রাত করে ফিরেছেন তাই আপনাকে বলিনি ভাবলাম সক্কালে বলবো।
আবার জিজ্ঞেস করলাম রাতে খেয়েছিস?
সে জবাব দিলো না-চালও শেষ হয়ে গেছে।
তাহলে আমি যে ভাত খেলাম।
দুপুরের কিছু ভাত ছিলো ওটাই গরম করে আপনাকে দিয়েছি।
বিনুর কথা শুনে আমি এতোটাই অবাক হয়ে গেছি যে কোনও কথাই তাকে বলতে পারিনি বরং নিজের উপরই নিজের মেজাজ খারাপ হলো।
বাসার কাছেই ইষ্টিশন তাছাড়া বৃষ্টিও কিছুটা কমেছে আমি দেরি না করে ছাতা নিয়ে ইষ্টিশন গিয়ে খাবার নিয়ে আসবো বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাম।বিনু বললো কোথায় যান?
আমি জবাব দিলাম তোর জন্য খাবার আনতে!
বিনু আমার হাত চেপে ধরে বললো দোহাই আপনার,আপনি কোত্থাও যেতে হবে না।
আপনি শুধু আমার পাশে বসে থাকুন-এতেই হবে।
আমি বিনুর পাশে বসলাম।সে বললো আচ্ছা ঐ দিন যে শীলা আপু আপনাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করেছিলো সেটার উত্তর দিতে পেরেছিলেন?
আমি না-সূচক জবাব দিলাম।
বিনু বললো-মেয়েদের শরীরের সবচেয়ে নরম অংশটি হলো তাদের মন।
বিনুর কথা শুনে আমি স্তুম্ভিত হয়ে গেলাম!কোন কথা আমার মুখ দিয়ে বের হলোনা-তাকে বলার মতো।
বিনু চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
আমি কয়েকবার তার কপালে হাত রাখতে গিয়েও রাখতে পারছিলাম না।পরে কি মনে করে যেন রাখলাম।বিনু একবার আমার দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো কিন্তু ঘুমে তার চোখের পাতা এতোটাই ভারী হয়ে গিয়েছিলো যে তাকাতে ভীষন কষ্ট হচ্ছিল।
আমি তার কপাল থেকে হাত সরিয়ে পেলতে যাবো ঠিক তখনি ঘুমন্ত বিনুর একটা হাত এসে পড়লো আমার হাতের উপর।
তার হাত আমার হাতের উপর এসে পড়ায় আমি আর উঠে যেতে পারলাম না।
আমি বসে বসে ঘুমন্ত বিনুকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম শীলার কথা।
শীলা কতো সুখি আর বিনু?
অথচ দুটোই জীবন।
দুটো জীবনেরই হাত আছে,পা আছে আরো যা যা থাকে সব।পার্থক্য শুধু এটাই একটা জীবন পরিপূর্ণ অন্যটা শূন্য। শান্তিহীন,ভালবাসাহীন,স্নেহ-মমতাহীন।
কারও জীবিনের সাথে কারও জীবনের কোনও মিল নেই।কোনও গল্পের সাথে কোনও গল্পের কোনও মিল নেই।
কি অদ্ভুত সব ধরন জীবনের।কি অদ্ভূত একেকটা জীবনের মানচিত্র!
মুহূর্তের ভিতরেই আমি নিজের মধ্যে একধরনের তীব্র ক্ষোভ অনুভব করলাম।আমার ভিতর দিয়ে কি যেন একটা বয়ে গেল সেকেন্ডে।
মুহূর্তের মধ্যেই আমার মনে হলো শীলা এমনিতেই সুখি মানুষ,মুখে সোনার চামুচ নিয়ে সে জন্মেছে।
আমাকে না-পেলে শীলা যে কষ্ট পাবে,বিনুর কষ্টের কাছে সেটা কিছুইনা।
আমার মনে হলো শীলাকে বিয়ে করার চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিনুর সমস্যার সমাধান করা।
যে মেয়ে তার নিজের কথা না-ভেবে তার ছোট্ট জীবনের সবটাই ব্যয় করছে আমাদের পেছনে।
আমার মায়ের জন্য সে যা করেছে আমার জন্য সে যা করেছে-তার মূল্য আমি এভাবে দিতে পারিনা।
বিনুকে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া,বিনুকে দু-মুঠো শান্তি দেয়া আমার দায়িত্ব এবং কর্তব্যও বটে।
আমি কাল বিলম্ব না-করে সিদ্ধান্ত নিয়ে পেললাম-বিনু সুস্থ্য হয়ে উঠলেই তাকে রেজিষ্ট্রি অফিসে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো আর যতদ্রুত সম্ভব বাসাটা বদলে পেলবো।
তার আগে শীলার কাছে ক্ষমা চেয়ে একটা চিঠি লিখে তাকে নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়ে দিতে হবে।
পরদিন সকালে আমি ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাসার জন্য প্রয়োজনীয় সব বাজার করে নিয়ে আসলাম।বিনুর ঘরে একবার উকি দিয়ে দেখলাম সে ঘুমাচ্ছে।
প্রত্যকদিন আমি কলেজে যাবার আগে বিনুই নাস্তা বানিয়ে রাখে আজ আমি নাস্তা বানিয়ে নিজে খেলাম এবং বিনুর জন্যও তার রুমে রেখে দিয়ে এলাম।কপালে হাত দিয়ে দেখলাম তার জ্বর ছেড়ে দিয়েছে।আমি তাকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা কতে নিতে বলে কলেজে চলে গেলাম।
কলেজ থেকে ফিরে এসে তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ্য দেখে আমারও বেশ ভালো লাগলো কিন্তু মনে হলো সে ভীষন চিন্তিত!
আমাদের মধ্যে বিশেষ কোন কথা হলোনা সেদিন।
আমি পরদিন যথারীতি কলেজে গেলাম-দুদিনের ছুটিও নিয়ে এলাম।মনে মনে ঠিক করে পেললাম বিয়েটা করে পেলবো।
বাসায় আসার আগে নিউমার্কেট গেলাম বিনুর জন্য বিয়ের শাড়ি পাওয়া যায় কিনা।কয়েকটা শাড়ি দেখেও এলাম।
বাসায় এলাম ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে।বিনুকে এসব ব্যাপারে আমি কিছুই বলিনি-
ভাবলাম বিয়ের আগের দিন বলবো।
তার পরদিন বাসায় আসার পর একটা ঘটনা ঘটলো।
বাসায় এসে দেখি বিনু বাসায় নেই।
আমার মাথা খারাপ হওয়ার মত অবস্থা হলো।কোথায় যেতে পারে আমি বুঝতে পারছিলাম না।
যেই মেয়ে ঘর থেকেই বের হয় না সে যাবে কোথায়?
আমি রাস্তায় বের হয়ে একটু খোজ খবর করলাম কিন্তু কোন ফল পেলাম না।
নিজেকে সান্তনা দিচ্ছিলাম এই বলে হয়তো কোন কিছুর দরকার পড়েছে তা কিনতে গিয়েছে নিশ্চই ফিরে আসবে!
এক ঘন্টা,দুই ঘন্টা,পুরোরাত গেলো বিনু এলো না।
পরদিন থেকে আমার দুদিনের ছুটি শুরু।
সকাল বেলা বের হয়ে আবার চারদিকে তার খোজ-খবর করতে লাগলাম কিন্তু কিছুতেই কিছু হলোনা।
চরম হতাশা নিয়ে বাসায় ফিরছি।আসার পথে হুট করে শীলার সাথে দেখা।তাকে বিষয়টা বললাম সে তেমন কোন গুরুত্ব দিলোনা বরং তাকে বেশ খুশীই মনে হয়েছে।
বললো তাহলেতো আমাদের সমস্যা সমাধান হয়েই গেলো।তুমি এতো টেনশন করছো কেন?
তুমিতো ওকে ঘর থেকে বের করে দাওনি বরং ও নিজের ইচ্ছায়ই চলে গেছে।
আমি শীলার কথার কোন জবাব করলাম না।
তাকে লেখা চিঠিটা আমার পকেটেই ছিলো কিন্তু তখন দিলাম না।
বিনু চলে যাবার পর আমি তার জন্য দুই বছর অপেক্ষা করেছি।ভেবেছি একদিন সে অবশ্যই ফিরে আসবে।
আমার ধারনা ভুল প্রমানিত হলো।আসলে সবকিছুই একদিন ঘরে ফেরে,নাড়ির তাড়নায় ফিরতে হয় কিন্তু নারী ফেরে না।নারীরা একবার চলে গেলে আর ফেরেনা।এটা নারীর ধরন এটা নারীর ধর্ম।
এইদিকে গত দুই বছর শীলাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে।
এর মধ্যে সে অনেকবার বিয়ের কথা বলেছে আমি প্রতিবারই সেটা এড়িয়ে গিয়েছি।
আমার মনে হচ্ছিল আর একটা দিন অপেক্ষা করি যদি বিনু চলে আসে!
বিনু আসেনি বিনুরা আসেনা।
অবশেষে শীলাকে আমি বিয়ে করলাম!
বিয়ের পর একটা ঝামেলা তৈরী হলো শীলার কথা হলো সে আমার এই টিনশেডের বাসায় কিছুতেই থাকবেনা।
আমি কিছুতেই তার এই আবদার মেনে নিতে পারলাম না।
তাকে বিভিন্ন ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
এই বাসাটার সাথে আমার অনেক কিছু জড়িয়ে আছে।আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে,আমার মা এখানে মারা গেছে তুমি একটু বুঝতে চেষ্টা কর প্লিজ।শীলা আমার কথা মেনে নিতে পারলোনা।
আমি স্মৃতির কথা বলাতে বরং সে আমার সাথে বিনুকে জড়িয়ে অন্য অর্থ দাঁড় করিয়েছে।
সে কিছুতেই এই বাসায় থাকবেনা বলে আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো।
তারপর বললো ঠিক আছে যতদিন তুমি ঐ বাসাটা ছাড়বেনা ততদিন আমি আমার বাবার বাসায় থাকবো।
আমি এতেও আপত্তি করলাম।
অনেক চিন্তা ভাবনা করে বললাম আচ্ছা ঠিক আছে তাই হোক।
শীলা কাজির অফিস থেকে তার বাসায় চলে গেলো আমিও আমার বাসায় চলে এলাম।
আমার ধারনা ছিলো যদি এই বাসাটা আমি ছেড়ে দেই তাহলে কোন একদিন বিনু এসে আমাকে না-পেয়ে ফিরে যাবে।আমি সেটা চাইনা।
তারও তিন বছর পরের ঘটনা-ততদিনে লেখালেখি করে আমি কিছুটা সাড়া পেলেছি।পত্রিকায় নিয়মিত আমার লেখা ছাপা হয়,মানুষজন আমার লেখা পড়ে।দেখা গেছে কলেজ থেকে আমি যা মাইনে পাই তার চাইতে দ্বিগুণ টাকা পাই লেখালেখি করে।বলা যায় আমি তখন মোটামুটি সেটেল্ড-লেখক!
এদিকে শীলাও নাটক-ফাটক করে ভালো সুনাম কুড়িয়েছে।
টেলিভিশনে তার নাটক প্রচার হয়।দেশের মানুষজন তাকে এক নামে চেনে।
আমি আমার ঐ টিনশেডেই থাকি।শীলা তার বাসায়।
শীলার বাবা-মা আমাদের বিয়ের কথা ততদিনে জেনে গেছে।
তারা বিষয়টা বেশ সহজ ভাবেই নিয়েছে।
এই রকম সাধারনত দেখা যায় না।বাবা মাকে না-জানিয়ে বিয়ে করলে মেয়েরা যত ভালো ছেলেকেই বিয়ে করুক না-কেন বাবা-মারা তা মেনে নিতে চায় না কিন্তু শীলার ব্যাপারটা আলাদা।
অবশ্য ও যে টাইপের মেয়ে বাবা-মাকে ম্যানেজ করা ওর জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আমি একদিন পত্রিকা অফিসে গেলাম লেখালেখি বিষয়ক কাজে।
পত্রিকা অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় যাবো বলে রিক্সায় উঠলাম।
বলদা গার্ডেনের সামনে দিয়েই যাচ্ছিলাম।কি মনে করে যেন রিক্সা চালককে থামতে বললাম।ভাবলাম যাই বলদা গার্ডেনটা একটা চক্কর দিয়ে যাই।
রিক্সা ভাড়া পরিশোধ করে পার্কের ভিতরে ডুকলাম।কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে বের হয়ে গেইটে আসলাম।
হঠাত পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর শুনে বুকের ভেতরটা কাঁটা দিয়ে উঠলো।
সেই কণ্ঠস্বরটা ভীষন পরিচিত ভীষন কাছের মনে হলো।
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখার পর আমার বিস্ময়ের সীমা ছিলোনা।
দেখলাম-একটা তরুণী মেয়ে কয়েকটা ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তর্কের মতো করে কথা বলছে।
একপর্যায়ে এসে যখন তাদের তর্ক থেমে গেল বুঝলাম তাদের মধ্যকার সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।
ছেলেগুলোর একজন মেয়েটির কাঁধে হাত রেখে তাকে নিয়ে দলবেদে পার্ক থেকে বের হয়ে গেল।মেয়েটির ঠোঁটের কড়া লিপস্টিক আর তার কড়া সাজসজ্জা দেখে যে কেউই বলে দিতে পারবে
এ এক সমাজ থেকে ছিটকে পড়া মানুষের গল্প।এ এক নিশিকন্যা!
যে আজ অনায়াসেই তনুর মতো বিখ্যাত অভিনেত্রী না-হলেও তার সহ-অবস্থানে থাকতে পারতো।
বিনু নামের এই নিশি কন্যার জন্য শুভ-কামনা রেখে আমি পার্ক থেকে বের হয়ে একটা সিগারেট টানতে টানতে বাসার দিকেরর্য হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম আজই শীলাকে একটা সু-খবর দিতে হবে।
আমার টিনশেডের বাসাটার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে!