আমাদের দুই পা ভেঙে বলে হাঁটো। আমাদের দুই চোখ খুচিয়ে বলে দেখো। আমাদের দুই হাত কুপিয়ে বলে লেখো। লেখো আর বগল বাজাও, চারপাশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। একটা ভুল নির্বাচন হইছে, বলা যাবেনা। একটা গুম হইছে, বলা যাবেনা। একটা খুন হইছে, বলা যাবেনা। পুলিশ ঘুষ খায়, বলা যাবেনা। সরকারি কর্মকর্তারা ঘুষ খায়, বলা যাবেনা। সাংবাদিক পার্সেন্টেজ নেয়, বলা যাবেনা। ডাক্তাররা হয়রানি করে, বলা যাবেনা। এলাকায় ডাকাতি হয়, বলা যাবেনা। লোকজন রাতে রাম দা নিয়ে পাহাড়া দেয়, বলা যাবেনা। সরকারি দলের নেতারা পাহাড়া দেওয়ার নামে ডাকাত বলে নিরীহ মানুষ পিটিয়ে মারে, বলা যাবেনা।
আচ্ছা বলা যাবে না কেন? কারণ? সেটাও বলা যাবেনা। কারণ, ক্ষমতা এক জায়গায় জমাট বেঁধেছে। কেউ তাঁর আত্মীয়, কেউ তার ঘনিষ্ঠ, কেউ তার অনুসারী। ক্ষমতার ভাই কেই আবার কেউ বেয়াই। ক্ষমতা মানে মন্ত্রী। মন্ত্রী মানে ইঞ্জিনিয়রা খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
কালের কণ্ঠের ফরিদপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক নির্মলেন্দু চক্রবর্তী শঙ্করকে গত শুক্রবার দুপুর থেকে গত শনিবার দুপুর পর্যন্ত আটকে রেখেছিল পুলিশ। আসলে পুলিশ তাকে আটকে রাখে নাই, আটকে রাখছে ক্ষমতা। ক্ষমতা মানে মন্ত্রী। গত কয়েক বছরে মালয়েশিয়া বা সৌদি আরবে সরকারিভাবে লোক নিবেন বলে যিনি মুলা ঝুলিয়েছিলেন। সেই মুলা পচে গন্ধ উঠলেও তিনি টের পাননাই। বৈধ পথে যারা লোক পাঠাত, সেই রিক্রুট এজেন্সির ব্যবসা চাঙ্গে তুলছেন। লোকজন সমুদ্র দিয়া নৌকায় যেত। গেলেই কাজ। কারণ, সরকারিভাবে গেলে মালয়েশিয়ার কম্পানিগুলো শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারবেনা। বেতন আটকে রাখতে পারবেনা। দেশে আসার সময় টাকা আটকে রাখতে পারবেনা। ইচ্ছেমতো নিয়োগ, ছাটাই করতে পারবেনা। তাই, যে পথেই আসুক দাস হলেই তাদের ভাল। তো সেই দাস হতে গিয়ে মানুষগুলো পতঙ্গের মতো ডুবে, না খেয়ে, মারপিটে মারা গেল। কেউ কবর পেল, কেউ পেল গণকবর। মন্ত্রীর তো কোনো দায় নেই। তিনি ক্ষমতার বেয়াই, তাকে ছোয় অ্যাত্তবড় সাহস কারো নাই। তিনি বহাল।
এলাকায় ডাকাতি হলে মন্ত্রীর সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। দেশের মানুষ জেনে যায়, অমুক মন্ত্রীর এলাকায় মানুষ রাতে ঘুমায় না। ডাকাতের ভয়। তাই ডাকাতি হলেও নিউজ করা যাবেনা। লোকজন রাতে না ঘুমিয়ে পাহাড়া দিলেও নিউজ করা যাবেনা।
কিন্তু আসল ঘটনা তো আরও ভয়াবহ। সেসব কথা তো একেবারেই বলা যাবেনা। নিউজ করতে এভিডেন্স লাগে, এভিডেন্স নাই। যে লোকজন রাতে পাহাড়া দেয়। তাদের হাতে টর্চ লাইট, বাঁশ, লাঠি, দা, রাম দা থাকে। এগুলো তো দেখা যায়। এ সবের ছবি তোলা যাবেনা। এ সবের ছবি ছাপা যাবেনা। কিন্তু পকেটে যা থাকে তা কি দেখা যায়? সেসব কি লেখা যাবে? ঘটনা এখানেই শেষ না। যারা পাহাড়া দেন, তাদের সন্দেহ হলেই লোকজনকে পিটিয়ে মারেন। সন্দেহ বস্তুটা কি? এটা কি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ? প্রতিপক্ষ কি কেবল অন্য দল? নিজের দলেও তো প্রতিপক্ষ থাকে? তো মানুষ পিটিয়ে মারছে এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবেনা।
প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা সভা করে বিষয়টাকে গুজব বলছে। তায়লে কি ডাকাতিটা গুজব? নাকি পাহাড়ার নামে মানুষ পিটিয়ে মারা- এটা গুজব? এসব প্রশ্নও তোলা যাবেনা।
এ সবের কিছুই তিনি করেননি। কেবল বলছেন যে, লোকজন ডাকাতের ভয়ে পাহাড়া দিচ্ছে। আর প্রশাসন বিষয়টাকে গুজব বলছে। এতেই মন্ত্রী ক্ষেপে গেলেন। কেন ক্ষেপলেন? তার সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। এসপি আছেন চার বছর ধরে। মন্ত্রীর পছন্দে আছেন। মন্ত্রীর এলাকায় ডাকাতি হয়, এসপি কিছু করেনা? এসপি করলেন, সাংবাদিককে সাইজ করার উদ্যোগ নিলেন। এর আগে তিনি প্রথম আলোর সাংবাদিক পান্না বালাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটিয়েছেন। সাইজ করতেই হয়। না করলে মন্ত্রীর সম্মান থাকে না।
ফরিদপুর প্রেসক্লাবের নির্বাচিত কমিটি ভেঙে অনুগতদের দিয়ে কমিটি করা হয়েছে। যাদের অধিকাংশ স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারি দলের অনুগত। এরা আর কি করবেন? তারা চুপচাপ থাকেন। তারা পুতুল সাংবাদিক। আর যারা সাহস দেখান, তারা হয়রানির শিকার হন।
হে মহান ক্ষমতাময়ী, আর কতটা অপমানিত হলে আমাদের অপমান শেষ হবে?
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১২:৩২