রিফাত আনমনা হয়ে পড়ন্ত বিকেলের ক্লান্ত সূর্যটাকে শেষ বিদায় জানান দিচ্ছে।পার্কের এই দিকটাতে মানুষজন তেমন একটা আসে না।রিফাতের জায়গাটা খুব প্রিয়।রিফাতের জায়গাটা প্রিয় রাত্রির প্রিয় বলেই।মেয়েটা যে কি কারণে জায়গাটাকে এতো পছন্দ করে আজো বলে নি।রিফাতও তেমন জোর করেনি জানার জন্য।হয়তোবা রাত্রিকে অনেক ভালোবাসে বলেই জানার চেষ্টা করে নি।আজ প্রায় মাস দুয়েক পরে আবার এসেছে সে এ জায়গাটাতে।নদীর ধারের এই গাছটাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নদীর মায়ায় নিজেকে হারাতে তার অনেক ভালো লাগে।আজো সে দাঁড়িয়ে আছে।হাতে তার প্রিয় ব্রেন্ডের পরিচিত সিগারেট জ্বলছে।
-এই রিফাত তুমি কি বসবা? আমি কখন থেকে বলছি।শুন না! এই রিফাত কি হলো!এইবার না শুনলে আমি কিন্তু চলে যাবো।
রাত্রি উঠতে যাবে এমন সময় রিফাত যেন সম্বিত ফিরে পায়।মেয়েটা এবার কেঁদে ই ফেলবে বোঝা যাচ্ছে।রিফাত অর্ধেক হয়ে যাওয়া সিগারেটটাকে নির্দ্বিধায় ফেলে দেয়।রাত্রি মেয়েটা ভীষণ জেদী।এই জেদটাই যেন মেয়েটার সব বৈশিষ্ট্য ঘিরে রাখে।প্রকাশিত হতে দেয় না।শেষবার রাগ ভাঙ্গাতে গিয়ে তো জ্বরই উঠে গিয়েছিল রিফাতের।সে কি জ্বর।প্রায় ১৪ দিন বিছানার বাইরের জগত দেখা হয় নি।সে এক মজার কাহিনী।মাঝে মাঝে বিছানার ডেস্কের উপরের ভাঙ্গা ফুলদানীটার দিকে তাকালেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফোটে উঠে।
রাত্রি উঠতে যাবে এমন সময় রিফাত তার সামনে এসে দাঁড়ায়।রাত্রি আর উঠে না আগের যায়গাতেই বসে থাকে।তবে এবার চুপচাপ।কিছু বলে না।অনেক্ষণ কেটে যায়।দুজনার মাঝে কোনো কথা হয় না।রাত্রি এই নিরবতাকে বেশিক্ষণ স্থায়ী না করে দিয়ে বলে উঠলো, "চলো আজ তোমাকে নিয়ে বাসায় যাবো।আম্মুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো।"
রিফাত কিছুই বলে না।থমকে থাকতে চেষ্টা করে এই গোধূলীর সাথে নিজেকে একাকার করতে।গোধূলী রিফাতের খুব প্রিয়।
-আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।ছেলে বাইরে থাকে।বড় দুলাভাই এর অফিসের এম.ডি.র ছেলে।গতবার যখন আপু-দুলাভাইয়ের ম্যারেজ ডে তে তাদের ওখানে গিয়েছিলাম তখনই নাকি আমাকে পছন্দ করেছে।আজ কথা পাকাপাকি করতে আসবে ওরা।বলেছে দু-মাস পর তনিম দেশে আসলেই বিয়ের পিড়িতে বসতে হবে।
রাত্রি একটানেই কথাগুলো বললো অন্যদিকে ফিরে।
চোখের জল লুকানোর এর চেয়ে সহজ উপায় যে আর জানা নেই ওর।
-রিফাত কিছুই বলল না।প্রকৃতির অপরূপ এই চিরন্তর সত্য কথা যেন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।কিই বা বলবে! ওর মতো চালচুলহীন ছেলের হাতে তো কোন বাবাই আর তার মেয়েকে তুলে দিতে চাইবে না।একটা চাকরী পাবার আশায় কত কিছুই না করেছে সে।কিন্তু বিধি বাম,চাকুরী জুটে নি।রাত্রির বাবার সামনে যাওয়ার সাহসও তাই হয়ে উঠে নি।
মামা ফুল নিবাইন! আফা কই? আইতাছে? আরে এই ফুলডা নেইন।আফা পছন্দ করবো।এতোক্ষণ স্মৃতির ক্যানভাসে উল্টে পাল্টে ছবি দেখার বিভোরে থাকা রিফাত ফুল বিক্রি করা মেয়েটার কথা শুনে বাস্তবে ফিরে আসলো।
-মেয়েটাকে খুশী করতে নিজের দু:খ কে ভুলতে ব্যার্থ চেষ্টা করে বললো হ্যা নেবো।কোনটা দিবে বলো?
-এই লালডা নেন।
-লালটা।উমম।দাও।তোমার নাম কি?
-আমার নাম মিনতি।তয় শুধু বাপেই ডাহে।বেবাক মাইনসেই মরজিনা ডাহে।
-তোমার মিনতি নামটাই তো সুন্দর।ওটাই ডাকবো।এই নাও তোমার ফুলের টাকা।
এই বলে রিফাত একশো টাকার একটা নোট দিয়ে দিল ছোট মেয়েটার হাতে।মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা এমনি একটা ফুলের জন্য একশতো টাকা গরীবকে দিতে কখনও দ্বিধা করে না।বিধাতা এই গুণটি দিয়েছেন বলেই হয়তো মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলেদের ভালোবাসার গাঢ়তা কবি-সাহিত্যিকদের লেখনিতে ফোটে উঠে।নিশ্চই রিফাত একশো টাকা এক ঘন্টা ব্যায় করেও অর্জন করে নি।কিন্তু তা শিশুটির এই ক্ষণিক খুশির কাছে অর্থহীন।
-আজ রাত্রির বিয়ে।মনটা বেশি ভালো নেই।তবুও আজ এই জায়গাটাতে এসেছে একবার রাত্রির সাথে শেষ দেখা হবে এই আশায়।বিয়ে হয়ে গেলে তো আর দেখা করা যাবে না।রাত্রি এখনো আসে নি, আসবে কিনা জানে না।লাল গোলাপটি পাশে রেখে আবারো সে আনমনা হয়ে যায়।
-হ্যা রাত্রি আসবে না।কারণ ও তো আর আমাকে অপেক্ষা করতে বলে নি।আসবেই বা কেনো! আনমনে আমি শুধুই প্রলাপ বকছি আর কিছুই নয়।
সিগারেটের ধোয়ায় চোখের কোনে জল এসে গেছে।বাধ্য হয়েও যেন আজ আর সিগারেট ফেলতে মন চাচ্ছে না।শুধুই চোখের জল ঝরাতে ইচ্ছে হচ্ছে।
অনেক্ষণ কেটে গেছে রাত্রি এখনো আসে নি।সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এলো বলে।আর আসবেও না মনে হয়।থাক আমি বরং ক্লান্ত পথিক হয়েই নীড়ে ফিরে যাই।আমার জন্য ভালোবাসা না।ভালোবাসা আমার পাওয়ার অধিকার নেই।
এই ভাবতে ভাবতে রিফাত যখন উঠতে যাচ্ছে এমন সময় ঠিক পিছনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার মতো শব্দ শুনতে পেলো। কান্নাটা একটা মেয়ের হবে বোধহয়।থাক আজ আর কারো কান্না দেখতে মন চাইছে না।সেদিকে তাই না তাকিয়েই চলে যেতে উদ্যত হলো রিফাত।কিন্তু কি মনে করে যেন পিছনে তাকালো।ও ফুলটাই যে নেয়া হলো না।ফুলটা নেওয়ার জন্য নিচে তাকাতেই রিফাত যা দেখলো তাতে নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।ও স্বপ্ন দেখছে না তো।তাহলে কি মেয়েটা অনেক্ষণ যাবত এভাবেই বসে ছিল ওর পাশে! কখন বসলো আমার পাশে?
এ কি রাত্রি!