::::পাঠ প্রতিক্রিয়া:::::
বইঃ একাত্তরের কানাগলি
লেখকঃ আসিফ সিদ্দীকী দীপ্র
প্রকাশনীঃ রোদেলা
#মূলকাহিনীঃ
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের কোভার্ট এ্যাকশন ডিভিশনে একটি ইন্টারোগেশন হয়, যার সাথে আপাতদৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের কোনো সম্পর্কই ছিল না; তার সূত্র ধরে হয় একটি ছোট্ট অপারেশন, এবং এরপর থেকেই বিভিন্ন প্রশ্ন জাগতে শুরু করে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মনে। যার উত্তর উদ্ধার করতে গিয়ে বের হয়ে পড়ে পর্দার অন্তরালে চলতে থাকা একটি অত্যন্ত গোপন এবং উন্মত্ত অপারেশনের।
এমন কিছু সেই অপারেশনে ছিল যা বাস্তবায়িত হলে কেবল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেই নয় ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়ে যাবে সমগ্র্র বিশ্বজুড়েই।
মাত্র গুটি কয়েক লোকের কাছে ফাঁস হয়ে যাওয়া সেই প্ল্যান বানচাল করতে, বাংলাদেশকে, এবং সারা বিশ্বকে একটি সাম্ভাব্য ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচানোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য কিন্তু একই লক্ষ্য নিয়ে একদল বেপরোয়া লোক নেমে পড়ে একটি অত্যন্ত গোপন মিশনে।
মুক্তিযুদ্ধের সাথে সমান্তরালভাবে চলতে থাকা সেই মিশনের ফলাফলের উপর নির্ভর করছে মুক্তিযুদ্ধের ভাগ্য, বাংলাদেশের ভাগ্য এবং সমগ্র বিশ্বের ভাগ্য।
সাথে রয়েছে কিছু রহস্যময় চরিত্র, যাদের আনাগোনা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে পুরো মিশনটাকে এবং নিজেরাও প্রভাবিত হয়েছে মিশনটির কারণে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ, আমেরিকা থেকে চীন এবং করাচীর গলি থেকে শুরু করে ধাণমন্ডির রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা একটি সম্পুর্ণ ভিন্নধর্মী স্পাই থৃলার 'একাত্তরের কানাগলি'র গল্প।
এবার আমার পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ
উপরের মূলকাহিনী পড়ে আসলে কাহিনীর ব্যপ্তি আর ঘভীরতার সিকিভাগও বোঝা যাবে না, যে কি চীজ ধরে আছেন দুই হাতের ফাঁকে।
যাক, শুরু করলাম লেখকের ডিসক্লেইমার দিয়ে। ড্যান ব্রাউন আর রোলিন্সের বইতে দেখেছি আগে। এখন দেখছি আমার বাংগালি এক ভাইয়ের বইয়ে। প্রত্যাশার পারদ একটুখানি চড়ল। এরপর মুখবন্ধে পেলাম বাস্তব জগতের পরিচিত এক ঘৃন্য চরিত্রকে।
এরপর লেখক আমাকে পিংপং বল বানিয়ে ফেলল। It's a রোলার কোস্টার রাইড। কাহিনী এত দ্রুত আর আর এত জায়গাতে ঘটছিল যে নিজেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একই সাথে বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধরত ফিল্ড মার্শালের মত মনে হচ্ছিল। একবার কাহিনী করাচিতে তো পরে ইউকে তে, তারপর যুক্তরাষ্ট্রে, পোল্যান্ডে, নিউইয়র্কে, আবার করাচিতে, আবার বাংলাদেশে; কখনো চরিত্র হয়ে আসছে সোহরাওয়ার্দী আর শেখ মুজিবুর রহমান, কখনো ইয়াহিয়া খান আর জুলফিকার আলী ভুট্টো, আবার কখনো রিচার্ড নিক্সন আর হেনরী কিসিঞ্জার। তাদের কথোপকথন গুলো এত হৃদয়গ্রাহী আর বাস্তবঘেষা যে, মনে হচ্ছিল লেখক নিজে টাইমট্রাভেল করে দেখে আসেননি তো!!
আমি স্পাই জগতের ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহী পাঠক। আর এখানে আমার আগ্রহ পূরনের উপাদান পেয়েছি একেবারে মনমতো। কেননা দৃশ্যপটে আছে ত্যাদড় ত্যাদড় কয়েকটা সংস্থা। CIA, ISI, MOSSAD, RAW, FBI, KGB একেবারে বিগ সাইজ কম্বো। লেখক স্পাইগেমটা পুরো প্রফেশনাল খেলেছেন। ইন্টেলিজেন্স, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স, ডাবল কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স, স্পাইদের বিশ্বাসঘাতকতা, হঠকারীতা সব উঠে এসেছে সাবলীল বর্ননায়।
জায়গায় জায়গায় আর্মড আর আন আর্মড হ্যান্ড-টু-হ্যান্ড কমব্যাট বর্ণনাভঙ্গি তে হয়ে উঠেছে জীবন্ত। সাথে আছে বইয়ের জমজমাট ফুল প্যাকড কাহিনী। কয়েকজন শক্তিশালী চরিত্র সৃষ্টি করেছেন লেখক।
যেহেতু কাহিনীটা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক, তাই বিভিন্ন চরিত্রের ভিতর দিয়ে উঠে এসেছে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা, সুগভীর দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ। পড়ে শিহরিত হিয়েছি যে, কিভাবে একজন লোক তার last full measure of devotion দিয়ে দেশপ্রেম এ অটুট থেকে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে।
লেখক চরিত্রসৃষ্টিতে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। যেহেতু অনেক চরিত্রের বাস্তব অস্তিত্ব ছিল তাই তাদের সবার individual personality এর প্রতি লেখকের সজাগ দৃষ্টি ছিল, সেটা তাদের কার্যকলাপ আর ডায়লগের ভিতর দিয়ে খুব ভালভাবে ফুটে উঠেছে। বাস্তবের সাথে সহজেই মিলানো গেছে। এটা কাহিনীকার এর সবচেয়ে বড় সফলতার একটা বলে মনে করি।
কাহিনীর প্রথমার্ধের আপাত অসামঞ্জস্যতা পরের অর্ধেকে এসে এত সুন্দরভাবে মিলে গেছে যে খুব উপভোগ্য হয়ে উঠেছে উপন্যাসটা।
সমালোচনা বলতে বলব; কয়েকটা জায়গায় 'টাকা' এর বদলে 'অর্থ' শব্দটা ব্যবহার করলে ভাল হত, কারণ টাকা বলতে স্পেসিফিক বাংলাদেশের মুদ্রাকেই বোঝানো হয়। বোম শব্দটার বদলে 'বোমা' বা 'বম্ব' ব্যবহার করলে ভাল হত বলে অভিমত প্রদান করলাম। গর্দভ শব্দটা কিছু জায়গায় গর্ভব হয়ে গেছে। ব্যাস!!
লেখক বইয়ের ফ্ল্যাপে বলেছেন, বিদেশী লেখকদের থৃলার দেখলে তিনি ঈর্ষার সুক্ষ্ম খোঁচা অনুভব করতেন। ওকে, আর করার দরকার নেই। আপনি নিজে দারুন একটা থ্রিলার লিখে ফেলেছেন।
পাঠ্যান্তে দাবিঃ লেখককে অচিরেই গত এন এস আই এর AD পদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও পদটির জন্য সুপারিশ করে সরকারী গেজেট প্রকাশিত হোক
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:৩১