প্রথম লেখা
শৈশব থেকেই আমার লেখালেখির ঝোঁক ছিল তবে অভ্যাস ছিলোনা। আমি বিভিন্ন বিষয় নিয়েই ভাবতাম। চারপাশের মানুষ, প্রকৃতি, পশু-পাখি, নদী-নালা, বনবাদাড় বা ফসলের মাঠ এসবই ছিল আমার ভাবনার বিষয়। আমি একটু বেশিই চিন্তাশীল ছিলাম- যাকে বলা যায় অকালতত্ত্বজ্ঞানী। অধিকাংশ সময় অন্যমনস্ক থাকতাম। তৃতীয় শ্রেণীতে থাকতে প্রথম একটি কবিতা লিখেছিলাম কালবৈশাখীর ঝড় নিয়ে। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কবিতা, গল্প লিখেছি, তা শুধু নিজেই পড়েছি , আবার ছিড়ে ফেলেছি। কখনও পড়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে হারিয়ে গেছে।
এভাবে কেটে গেল হাইস্কুল। হাইস্কুল এ একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন বের করার প্রয়াস (কিংবা অপপ্রয়াস) চালিয়েছিলাম। পুরো ম্যাগাজিনটি লেখা হয়েছিল পনের টাকায় কেনা একটি খাতায়। সেই ম্যাগাজিন এ আমার একটি বা দুটি লেখা ছিল। এটা ছিল আমাদের ক্লাস নাইনের ঘটনা। ম্যাগাজিনে আমাদের নিতিমালা লিপিবদ্ধ ছিল। আমাদের আবার মাসিক চাঁদার হার ছিল ১০ টাকা। এই সাহিত্য পরিষদের সদস্য ছিলাম আমরা ৬ জন। ম্যাগাজিনটি বন্ধু সহিদুল্লার কাছে রেখেছিলাম। একদিন সে ম্যাগাজিনটি হারিয়ে যায় । সেই সাথে হারিয়ে যায় আমাদের উদ্যম। সাহিত্য আবার চলে যায় চিন্তার জগতে , পাঠাগারের বইতে, কিংবা চারুপাঠ, আনন্দপাঠ প্রভৃতিতে। এ সময়ের হাইস্কুলের একটি স্মৃতি মনে পড়ে। তখন বাংলা ২য় পত্র ক্লাস। আমি সামনের বেঞ্চে বসেছি। তাই স্যার যখন তাঁর টেবিলে বসে বই চাইলেন তখন আমি আমার বইটা দিলাম। স্যার বইএর পাতা উলটাতে গিয়ে হঠাৎ একটা ভাঁজ করা কাগজ বইএর মধ্যে পেলেন। এতে আমার একটি কবিতা লেখা ছিল। আমার বুক ধুরুদুরু করতে লাগলো। দেখলাম স্যার কবিতাটা পড়ছেন। কিছুক্ষণ পর স্যার মাথা উঠালেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ,’এটা কি তুই লিখেছিস?’ আমি বললাম, “হা”। স্যার দুইটা লাইন পরলেন। লাইন গুলো ছিল
বর্ষায় পল্লী সে হেঁসে উঠে ঝলমল
স্রোতস্বিনী বাধাহীন বয় সদা কলকল।
স্যার বললেন যে কবিতার এই লাইন গুলো ভালো হয়েছে, কিন্তু কবিতায় মাত্রা ছন্দের যথেষ্ট অসামঞ্জস্যতা আছে। এই বলে তিনি মাত্রা-ছন্দের উপর অনেকক্ষণ বক্তৃতা দিলেন। আমার মাথা বোঁ-বোঁ করতে লাগলো। এরপর ও হাইস্কুলে আরও দুই-এক বার সাহিত্যচর্চার অপচেষ্টা চালিয়েছিলাম যথারীতি অত্যাধিক গোপনীয়তা বজায় রেখে পাছে যদি আবার বক্তৃতা শুনতে হয়।
তারপর এল কলেজ লাইফ। হাইস্কুলে বাবামায়ের যথেষ্ট বিধিনিষেধের মধ্যে ছিলাম। আমি ছিলাম বরাবরই ভদ্র অতি শান্ত বড় স্বভাবের। আবার প্রচণ্ড ভিতু। তাই হাইস্কুল লাইফ এ অন্য ছেলেদের সাথে মারামারি তো দুরের কথা অনেক সময় খেলতে ও যেতাম না। কলেজ এ এসে পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে গেলাম। প্রথম ৬ মাস পড়াশুনায় খুব মনযোগী ছিলাম। কিন্তু এরপর থেকেই পুরপুরি আড্ডাবাজ হতে শুরু করলাম। এমনও অনেক দিন গেছে যেদিন আমি বন্ধুদের সাথে ১৮ ঘণ্টা আড্ডা দিয়েছি। আড্ডার নির্দিষ্ট কোন অনুষঙ্গ থাকত না। কখনও দেশ, কখনও রাজনীতি, কখনও বাংলাদেশ ক্রিকেট দল, কখনও আইলা-সিডর-সুনামি, কখনও পাশের বাসার ছাদ, জানালা, কখনও বন্ধুর বাইনোকুলার, কখনও তাব্লিগ-ছাত্রলিগ-মুসলিমলীগ ইত্যাদি গভীর প্রাজ্ঞতাপুর্ন, তত্ত্বজ্ঞান সমৃদ্ধ(!) আলোচনা করতাম। দেশ উদ্ধারে আমাদের এই প্রচেষ্টার ফল কীরূপ ছিল তা সহজেই অনুমেয়, কিন্তু আমার উন্নতি ছিল লক্ষণীয়। ১ম বর্ষ অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষায় ৩.০০, ১ম বর্ষ ফাইনালে ২.৯, টেস্ট পরীক্ষায় ২.৮। এই সময় সাহিত্য চর্চা হয়নি কিছুই কিন্তু বাকচর্চা হয়েছে অনেক। তবে এই সময় মাঝেমাঝে শহরের পাবলিক লাইব্রেরি ও আর একটা লাইব্রেরিতে বিকেলে পড়তে যেতাম।
কলেজে আমরা একটি ম্যাগাজিন বের করেছিলাম। এখানেও আমি এবং আর একজন বন্ধু সম্পাদক ছিলাম। তখন আমার নিজের সাহিত্য প্রতিভার উপর ততোটা আস্থা ছিলোনা বলে নিজে কোন লেখা জমা দেইনি। অবশ্য আমি আর বন্ধুটি মিলে সম্পাদকীয়টা লিখেছিলাম।
এরপর এল ভার্সিটি লাইফ। এখানে এসে প্রথম জানলাম কিছু দোকান থেকে বই ভাড়ায় এনে পড়া যায়। ফলে প্রথম বর্ষ থেকেই পাঠ্য বইএর বাইরে অন্যান্ন বই প্রচুর পড়তে শুরু করলাম। আবারো শুরু হল সাহিত্য চর্চা। আগের মতই লুকিয়ে লুকিয়ে। কিন্তু কোন লেখাই কোথাও পাঠানো হয়না, ভয় হয় যদি তারা বাদ দিয়ে দেয়। তাই কোন কিছু লেখার পর তা এমন জায়গায় রাখি তা পরে নিজেও খুজে পাইনা। এভাবেই কালে-ভদ্রে দু-একটা কিছু লিখি আবার হারিয়ে ফেলি।
এ পর্যন্ত আমি আমার কোন লেখাই কোথাও পাঠাই নি। সামুতে আই ডি খোলার পর থেকেই ভাবছি খুব ভালো একটা লেখা পাঠাবো। কিন্তু কি লিখে পাঠাবো তা অনেক চিন্তা করেও বের করতে পারিনি। তাই অবশেষে এই লেখাটাই লিখলাম। সামুতে এটা প্রকাশিত হলে এটাই হবে কোথাও প্রকাশিত আমার প্রথম লেখা।