১.
সকাল বেলা মা'র চিৎকার শুনে ঘুম ভাঙল পাপিয়ার। ঘুম ভাঙার পর থেকেই খিধাটা বোঝা যাচ্ছে প্রকট ভাবে। পেটে মনে হচ্ছে আগুন জ্বলছে। পেট কেটে ওখানে ভাত বসায়ে দিলে খুব তারাতারিই ভাত হয়ে যাবে। কাল রাতে ভাত খাওয়া হয়নি। দুপুরে খেয়েছিল। রাতে ভাত না খাওয়ার জন্য বেশী না পড়ে তারাতারিই ঘুমিয়ে পরেছিল।
এখন ছয়টা বাজে। এত তারাতারি ডাক দেওয়ার কথা না। সকালে খাওয়া হবে কিনা, বোঝা যাচ্ছে না। হবে না হয়ত। বাসায় খুব সম্ভবত চাল নেই। চাল আছে কিনা, সেটা পাপিয়া জানে না। ওর মা যখন চালের ঘরা থেকে চাল বের করে, তখন ঘরে কাউকে থাকতে দেয় না। আর বাকি সময়টা চাবি দিয়ে রাখে ওই ঘরায়।
মুখ ধোওয়ার জন্য বের হল পাপিয়া। চুলা থেকে সামান্য পোড়া মাটি ভেঙ্গে নিয়ে বাহিরে গেল। বাহিরে ওর মা গরু বাঁধছিল। ওকে দেখে বলল, কে মা, উঠিছিন?
পাপিয়া ঘুম ঘুম গলায় বলল, হুম। আজ এত সকালে ডাক দিলেন ক্যান?
তোমার ওই বাড়ির তোজাম দাদা আছল(এসেছিল)।
কি কল(বলল)?
আজ অগেরে(ওদের) আলু তুলবে। তুমি জামিন(যাবে)?
হুম। ককন(কখন)?
আকনি(এখনই)।
আচ্চা। মুখ ধুয়ে যাচ্চি। সকালে খাবা(খাইতে) দিবে?
হ মা। দিবে। যাও। সকালে মিচ্চিয়ানা(একটু) আলু তোলার পর দশটার দিকে খাবা দিবে। আবার দুইটার দিকেও দিবে।
রাতেও দিবে নাকি মা?
না মা। রাতে দিবে না। খালি(শুধু) দুই বেলা খাওয়া আর বিশ ট্যাকা।
বিশ ট্যাকা দিবে?!
হ মা। বিশ ট্যাকা।
তিন ট্যাকা দিয়ে কলে(কিন্তু) আমি এডা(একটা) কলম লিব(নিব)। ইস্কুলে কেউ কলম দেয় না। পতিদিন সার আমাক মারে।
আচ্চা মা। তোমার ট্যাকা দিয়ে তুমি যা ইচ্চা করবিন।
চাউল কয় ট্যাকা করে?
ম্যালা ট্যাকা মা...
পোনর(পনের) ট্যাকা দিয়ে কট্টি(কতটুকু) হবে?
এক কটা(কৌটা)।
তালে(তাহলে) আব্বুক কয়া(বলে) আনবা(আনতে) কয়েন(বলেন) আচ্চা?
আচ্চা মা। কব(বলব)।
আর দুই ট্যাকা আপনিক দিব। আপনি লিবেন।
আমি কি করমো মা? তুমিই থুয়ে দিও।
আমি তো হারাবো।
আচ্চা। যাও যাও। মুখ ধুয়ে তারাতারি যাও। নাহলে সকালে আবার খাবা দিবে না।
পাপিয়া বাড়ির পেছনে কলঘরে গেল। এটাকে বাথরুম বাঁ টয়লেট বলা যায় না। দুই দিকে খোলা। শুধু ছেলেরা আর ছোটরা সহজে গোসল করতে পারে। মহিলারা দুই দিকে শাড়ি বেধে গোসল কর। পাপিয়াদের টিউবওয়েল এটা। অনেক আগে ওর নানা এটা বসিয়ে দিয়েছিল। এখন এখানে সব চেয়ে ভালো পানি ওঠে। গ্রামের অনেকেই এখানে এসে গোসল করে।
চোখ মুখ ধুয়ে পাপিয়া ওর মা কে বলে তোজাম দাদার জমিতে গেল। জমিতে মাত্র আলু তোলা শুরু হয়েছে। এখনও এক কাপ ও হয়নি। তোজাম দাদা ওকে দেখে এগিয়ে সে বলল,
কি? মহারাণী? ঘুম ভাঙল? আলু তোলা তো শ্যাষ। কেবল আলিন?
কোটে(কোথায়)? কেবল তো শুরু!
চুপ। তারাতারি শুরু কর্। না হলে এক টাকাও পাবু না। দেরি করে আসার জন্য তুই পনের পাবু।
আচ্চা দাদা।
বলেই শুরু করল পাপিয়া। আবার দাঁড়ায়ে থাকলে না জানি আবার কত টাকা কমায়! পনের টাকা পাবে এখন। কলম কেনা হল না। থাক। না হল। এক কটা চাল তো কেনা যাবে। অটা দিয়ে পাপিয়া, ওর আম্মু আর ওর আব্বু ভাত খাবে। খিধা লাগলে সহ্য হয় না। কিন্তু স্যার এর মার সহ্য করা যায়।
২.
সন্ধ্যা বেলায় নামায পড়ার পর পাপিয়ার আম্মু ওকে ডেকে কোলে নিল। পাপিয়া জানে, এখন ওর মা কোরআন শরীফ পড়বে। ওর মা কোরআন শরীফ পড়ার সময় ওকে কোলে নিয়ে থাকে। তখন পাপিয়ার দারুণ লাগে। অনেক ভালো লাগে। তারপর কোরআন শরীফ পড়া শেষ হলে গানের মতো সুরে মুনাজাত করে। সুরটা কেমন যেন চোখে পানি এনে দেয়। সুরের মধ্যে কোথায় যেন কষ্ট লুকিয়ে থাকে। মুনাজাত শেষ হলে পীরসাহেবের দেওয়া তেলপানি খাওয়ায়। চোখে মুখে তেল দিয়ে দেয়।
জায়নামাজে বসে হ্যারিকেন এর সলতে বাড়ায়ে দিয়ে কোরআন শরীফ পড়া শুরু করল ওর আম্মু। আজ পাপিয়ার ভালো লাগছে না। শুধু শুধু কান্না আসছে। কিন্তু কাঁদছে না। তাহলে ওর আম্মু ওকে জিজ্ঞাস করবে। ওর আম্মুকে তো কারন বলতে পারবে না। বলে কোন লাভ নেই। শুধু শুধু আম্মু কষ্ট পাবে। পাপিয়া ছোট মানুষ হতে পারে। তবে অনেক কিছু বোঝে। সময় ওকে বাধ্য করেছে সব কিছু বুঝতে। এমন অনেক কিছুই বোঝে, যা ওর বোঝা ঠিক না। যেমন, ওকে তোজাম দাদা মেরেছে। এটা ওর আম্মু কে বললে, ওর আম্মু কিন্তু তোজাম দাদাকে কিছু বলতে পারবেনা। একটা ছোট মেয়ে চায়, ওকে যে মেরেছে, তাকে ওর মা মারুক বা বকে দিক। কিন্তু পাপিয়া অন্যরকম। ও ওর মা কে বলবে না।
এখন মা'র কোলে না থাকলে ভালো হত। বাড়ির পেছনে গিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কাদলে একটু ভালো হবে। এক কাজে দুই কাজ। কষ্ট একটু কমবে। আর খিধার কথাও মনে থাকবে না।
চালও কেনা হবে না। তোজাম দাদা সম্ভবত টাকাটা দিবে না। বলল তো, সামনের হাটে দিবে। কিন্তু কয়েকদিন আগে খুরশিদ কাকাদের আলু তুলে দিয়েছিল। ওনার পনের টাকা দেওয়ার কথা ছিল। পাঁচ টাকা নগদ দিয়ে বলল, সামনের হাটে।
পরের হাটে ওনার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে আর পাওয়া গেল না। সারা হাট ওনার পেছনে ঘুরল পাপিয়া। বাজার করল খুরশিদ কাকা। হাতে কিন্তু টাকা আছেই। দিলেই হয়। কিন্তু দিচ্ছে না। পেছনে পেছনে ঘুরে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
পরে বাজার শেষ করে ওই ব্যাগ আর সাথে দিয়ে দুই টাকা পাপিয়ার হাতে দিয়ে বলল, যা। এটা আমাগেরে বাড়িত দেস।
পাপিয়া বলল, আর আট ট্যাকা?
পরে লেশ(নিস)। যা এখন চোখের সামনে থেকে। না হলে পাবু না।
পাপিয়া ওই ভারি ব্যাগ নিয়ে ওদের বাসায় দিয়ে আসল। তাই মনে হচ্ছে, তোজাম দাদাও টাকাটা দিবে না।
ওর মা এখন মুনাজাত করছে। আল্লাহ্ কাছে সব কিছু চাচ্ছেন। কান্নার মত সুরে চাচ্ছেন। যে সুর শুনে চোখ ফেটে কান্না আসতে চায়। পাপিয়া ভেবে পায় না, এত সুন্দর করে আল্লাহ্ কে ডাকা হচ্ছে, কিন্তু উনি শোনেন না কেন! আর নিজেকে সামলাতে পারল না পাপিয়া হঠাৎ করে ওর আম্মুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করল।
এখন আর খিধার কথা মনে পরছে না।
(মহাপুরুষরা নিজেকে আড়াল করতে পারে। আমি মহাপুরুষ না। নিজেকে আড়াল করতে পারি না। তাই আমার গল্পে আমার কিছু কিছু প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। কখনও কখনও সম্পূর্ণ ভাবেই ফুটে ওঠে। হয়ত হুবহু মিলে যায়! হুবহু!)