পত্রিকার হেডলাইনে চোখ আটকে গেল জুয়েলের।
“পর পর তিন মাসে তিন জন তরুণীর রহস্যজনক মৃত্যু”।
সকালে উঠে সিগারেট আর পত্রিকা ছাড়া জুয়েলের দিন শুরু হয়না। চা পরে খেলেও চলে। কিন্তু চোখ মেলেই সিগারেট লাগবে। হেডলাইন দেখেও আজকাল জুয়েলের বিরক্ত লাগে। সহজ কোন ব্যাপারকে সাজিয়ে গুছিয়ে পেঁচিয়ে হয়ত রহস্যময় বানিয়ে ফেলেছে। তবুও পুরো খবর পড়লো। যা বুঝল, তা হল, তিন জনই আত্মহত্যা করেছে। তবে তিনজনই তাদের জন্মদিনে আত্মহত্যা করেছে। এটাই ওদের দোষ। একারনেই মৃত্যুটাকে রহস্যজনক বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে একটা রহস্যজনক ব্যাপার আছে। গলায় ফাঁসি দিলে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট যেমন আসার কথা, তেমন আসেনি। প্রত্যেকেরই হার্ট অ্যাটাক এর কারনে মৃত্যু হয়ছে। এর থেকেও রহস্যজনক ব্যাপার হল, ওদের পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, কারুরই হার্ট এর কোন সমস্যা ছিল না।
ব্যাপারটা সত্যিই রহস্যজনক মনে হচ্ছে। জুয়েলের ফোন বেজে উঠলো। রিপার ফোন।
হ্যালো
হ্যাঁ জুয়েল, খবরের কাগজ দেখেছ?
হ্যাঁ। কেন?
আরে, গত মাসে রিনি মারা গেল না? আমার কাজিন, ওর মতো একই ভাবে গতকাল আরেকজন মরে গেছে।
অ আচ্ছা
অ আচ্ছা না। একইভাবে আগের মাসে আরও একজন মরে গেছে।
তাই?
হ্যাঁ। চিন্তা করো, কি ভয়ানক ব্যাপার?
ভয়ানক এর কি আছে? আত্মহত্যা করতে গিয়ে ভয়ে হার্ট অ্যাটাক করতে পারে না?
তা পারে। কিন্তু তিন জনই তাদের জন্মদিনে কেন মরবে, বল?
হুম। এটা চিন্তার বিষয়।
এটা তো লীপ ইয়ার। তোমার সাথে আমার তিন বছরের রিলেশনে প্রথমবার আমার জন্মদিন পালন করা হবে। কিন্তু এখন দেখ, কেমন ভয় ভয় লাগছে!
ধুর! ভয় এর কি আছে? তুমি তো আর আত্মহত্যা করবে না। কোন কারনও নাই!
তা নাই। তবে, এটা যদি খুন হয়?
চিন্তা করো না বাবু। আমি আছি তো। আমি থাকতে তোমার কিচ্ছু হতে দিব না।
লাভ ইউ সোনা।
লাভ ইউ ঠু। ফ্রেশ হয়ে আসি।
ফোন রেখে ব্রাশ হাতে নিল। বিরক্ত বিরক্ত লাগছে। কথা বলার কোন প্রসঙ্গ না থাকলে কথা বলার কি দরকার? সকাল সকাল কি সব খুন টুন এর গল্প শুরু করলো। আজও দিনটা ভালো যাবে না মনে হচ্ছে।
বাসা থেকে বের হয়ে কোন রিক্সা পাচ্ছে না। মতিঝিল একটা ফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করে ওকে নিয়ে বিকালে বই মেলায় যেতে হবে। আজ দুপুরে ওদের বাসায় খাওয়ার কথা। ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন তারাতারি পৌঁছানো দরকার। রিক্সা পাওয়া না গেলে সিএনজি লাগবে।
এই সিএনজি, যাবা?
কই মামা?
মতিঝিল?
শাপলা চত্বর?
হুম।
ওঠেন।
ভারা কত?
মিটারে যাবে।
আজকাল অধিকাংশ সিএনজি মিটারে যায়। ব্যাপারটায় এখনও জুয়েল অভ্যস্ত হতে পারেনি। তাই ভারা জিজ্ঞাস করে ফেলে।
আবার রিপার ফোন। রিসিভ করতে ইচ্ছা করছে না। থাক। বাজুক ফোন। তারচেয়ে সিএনজির লুকিং গ্লাসে নিজেকে দেখা যাচ্ছে। একটু দেখে নেওয়া যাক।
গত তিনমাস ধরে জুয়েল সবসময় কালো চশমা পরে থাকে। এমনকি অন্ধকারেও। কেউ জিজ্ঞাস করলে বলে, সবার একটা নিজস্ব স্বকীয়তা থাকা উচিত। সেটা যেমনই হোক। যেটা দেখে তাকে চিনতে পারা যাবে। তার মানসিকতা আন্দাজ করা যাবে।
আবার রিপা ফোন করেছে।
কোথায় তুমি? কতখন ধরে ফোন করছি, রিসিভ করোনা কেন?
সিএনজি খুঁজছিলাম। একটু রাকিবের বাসায় যাব
অ আচ্ছা।
রাখব?
আচ্ছা
রিপার মন খারাপ হয়ে গেল। জুয়েল কয়েক মাস ধরে কেমন জানি বদলে যাচ্ছে। আগের মতো এখন আর কথাও বলতে চায়না। শুধু মনে হয়, কিছু একটা কাজে ব্যাস্ত আছে। কিন্তু রিপাকে বলেনা। কয়েকদিন পর তো, রিপা ওর বউ হবে। এখনও কোন কথা লুকানোর কি দরকার?
রিপা বোঝে না।
একদিন চন্দ্রিমায় হাঁটছিল। প্রথম দিকে। তখন ওর জুতাটা ছিঁড়ে যায়। জুয়েল ওর জুতা হাতে নিয়ে ওকে কোলে করে বাহিরে রিক্সা পর্যন্ত নিয়ে আসে। আশেপাশের সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল। রিপার তখন কি যে ভালো লাগছিল! এখন আর একদম ওই রকম নেই। সেদিন ধানমন্ডি লেকে হাঁটছিল। রিপার জুতা ছিঁড়ে গেল। জুয়েল দেখেও না দেখার ভান করে হেটেই যাচ্ছিল। রিপা যখন ওকে ডেকে বলল, জুতা ছিঁড়ে গেল। তখন জুয়েল বলল, যাও। সেলাই করে নিয়ে এসো। অই পাশে সেলাই করার লোক আছে। বলে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বসে পরলো।
এতোটা পরিবর্তন একটা মানুষের কীভাবে হয়?
তিন বছর ধরে ওদের প্রেম। এখনও রিপার জন্মদিন পালন করা হয়নি। ২৯ ফেব্রুয়ারি হলে তো প্রতিবছর আর পালন করা যায় না। আর কয়েকদিন পর ২৯ ফেব্রুয়ারি। সেটা নিয়ে জুয়েলের কোন মাথা ব্যাথা নাই। থাক। জুয়েলকে কিছু বলবে না আর। ও যা করে করুক।
তবে মনে মনে রিপা জুয়েলের থেকে বড় ধরণের সারপ্রাইজ আশা করে। হয়ত একটু বদলে গেছে। কিন্তু প্রথমবার জন্মদিন। একটু আশা করতে দোষ কোথায়?
২৯ তারিখ সারারাত রিপা জেগে ছিল জুয়েলের ফোনের অপেক্ষায়। কিন্তু ফোন করলো তো না ই! না পেরে যখন রিপাই জুয়েলকে ফোন করলো, তখন দেখে, ওর ফোন অফ। সুইচ স্টপ করে সুন্দর ঘুমাচ্ছে। এতোটা কেয়ারলেস কীভাবে হয় একটা মানুষ। ওদের প্রেম এর পর প্রথমবারের জন্মদিন। একটা বার উইশ করেলই তো হয়। কী এমন ঘুম নষ্ট হয়ে যেত?
রাগ করে ঘুমিয়ে পরলো ফজর এর আজানের পর।
ফোনের শব্দে ঘুম ভাংল ঠিক বেলা বারোটায়। একটা অচেনা নাম্বার।
ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলল, হ্যালো
রিপা, তারাতারি আমার বাসায় এসো।
এটা কার ফোন নাম্বার? তোমার নাম্বার অফ কেন?
পরে বলব। তুমি আমার বাসায় এসো।
রিপা অনেক খুশি হলো মনে মনে। নিশ্চয় বড় ধরণের কোন সারপ্রাইজ পেতে যাচ্ছে।
অপেক্ষা করছে জুয়েল। এতো দেরি করলে কীভাবে হবে? জুয়েলের হাতে সময় অনেক কম। যা করার এর মধ্যেই করতে হবে।
পকেটে হাত দিয় দেখল, জিনিসটা আছে কিনা। না থাকার কোন কারন নাই যদিও।
ব্যালকুনিতে বসে সিগারেট জ্বালালো জুয়েল। চোখে চশমা নেই। বাঁ চোখের কোনে সামান্য কয়েক বিন্দু পানি। ছোট বেলার কথা মনে পরলো। ওর একটা সুন্দর মাটির পুতুল ছিল। ওর মা মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে বানিয়ে দিয়েছিল। তখনও জানত না, ওর মা মারা যাবে। মারা যাওয়ার পর জুয়েল সারাদিন অই পুতুল নিয়ে খেলত। পুতুল নিয়েই ঘুমাতো। পুতুলকে সাথে নিয়ে স্কুলে যেত। পুতুল পাশে না থাকলে ও কিছুই খেত না।
একদিন হঠাৎ করে দেখে পুতুল নাই। কোথাও নাই। অনেক খুজেও পাওয়া যায়না।
কয়েক বছর পরে পাওয়া যায়। ওর বন্ধু রাকিবের বাসায়। তবে একটা না। ভেঙ্গে কয়েক টুকরা হয়ে পরে আছে।
এরপর ওর বাবা ওকে একটা বিড়াল কিনে দেয় ওর জন্মদিনে। অনেক ভালোবাসতো এটাকেও। অনেক। একদিন ওর বন্ধু সেলিম ওকে বলে, বিড়ালটা অনেক কিউট। আমার কোলে একটু দিবি?
জুয়েল দেয়নি। সেদিন রাতে বিড়ালটাকে ছাদ থেকে ছুরে ফেলে দেয়। মরে যায়।
কলিং বেল বেজে উঠল। এর আগেও অনেবার রিপা এসেছে এখানে। কাজের বুয়া না আসলে রিপা এসে রান্না করে দিয়ে যায়। ঘর গুছিয়ে রেখে দেয়। ময়লা কাপড় ধুয়ে দেয়। বিয়ের পর তো এসব রিপাকেই করতে হবে।
দরজা খুলে জুয়েল অবাক! রিপাকে এতো সুন্দর আগে কখনও লাগেনি! এতো সুন্দর একটা মানুষ কীভাবে হয়? পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যের কেন্দ্র বিন্দু যেন রিপা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।
রিপা কেমন জানি লজ্জা পাচ্ছে। প্রথমবার যখন দেখা হয়েছিল, তখন জুয়েল ওর দিকে এভাবে তাকিয়ে ছিল। চোখের পলক ফেলছিল না। আজও ঐভাবেই তাকিয়ে আছে। রিপা জুয়েলকে সরিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পরলো।
দরজায় দাঁড়িয়ে রেখেই আমাকে দেখবা? আগে বসতে দাও।
দাঁড়াও।
কেন?
উত্তর না দিয়েই একটা সাদা কাপড় ওর চোখে বেধে দিল।
চোখ একদম খুলবে না। ঠিক আছে?
আচ্ছা বাবু। আই লাভ ইউ!
আই লাভিউ ঠু সোনা...
রিপা জানেনা, ও কি পরিমাণ সারপ্রাইজড হবে! যে সারপ্রাইজে আগেও তিনজন হার্ট অ্যাটাক করেছে!
পকেট থেকে ইনজেকশন বের করলো। সিরিঞ্জ লাগিয়ে পটাশিয়াম ক্লোরাইড এর দ্রবণ দিয়ে সম্পূর্ণ ইনজেকশন ভর্তি করলো।
হাতটা এগিয়ে নিল। রিপাও হাত বারিয়ে দিল।
রিপা বাবু...
হ্যাঁ সোনা, বলো।
আই আভ ইউ সো মাচ! তুমি শুধু আমার। শুধুই আমার। তুমি কারুর হতে পার না। তোমাকে কারুর হতে দিব না বাবু।
বলতে বলতে হাতে সম্পূর্ণ পটাশিয়াম ক্লোরাইড পুশ করে দিল হাতের ধমনীতে। রক্তের সাথে মিশে যাবে। হৃৎপিণ্ড বন্ধ হতে বেশী সময় লাগবে না আর। মেয়েটা খুব ঘামছে।
জুয়েল ওর ভালোবাসার কোন কিছুই কারুর হতে দেয়না। কখনও হতে দিবে না। প্রয়োজনে সব শেষ করে দিবে।