একটু আগে কিশনক ফোন করেছিল। কাল দেখা করতে বলল। কাল ১৪ ফেব্রুয়ারী।
আমার তেমন সাজতে ভালো লাগে না। আজ সাজব। অনেক সাজব। ঘুমাব না। সেজে বসে থাকব ছাদে। সারারাত বসে থাকব।
একদিন কিশনক কে বলেছিলাম, বিয়ের পর আমরা সারারাত চাঁদ দেখব বসে বসে। ও বলল, কাকে বিয়ে করবি?
কেন? তোকে।
তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
আসলেই আমার মাথা খারাপ ছিল। ওর সাথে বন্ধুত্বের কয়েক মাস পর থেকে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কেমন জানি মনে হত, ওকে ছাড়া বাঁচবো না। এখন আর তা মনে হয় না। এখন মনে হয়, এক মুহূর্তের জন্য হলেও ওর ভালোবাসা আমার লাগবেই।
ওকে আমি আমার ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলাম গত বছর জানুয়ারিতে। তেইশ তারিখ। আমার জন্মদিন ছিল। আমাদের বাসায় আসলো। বাবা-মা সবাই জানে, কিশনক আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। অনেক ভালো ছেলে। সেদিনের অনুষ্ঠান শেষ যখন ওকে বাহিরে রেখে আসার জন্য নিচে নামছিলাম, সিঁড়িতে হঠাৎ দাঁড়ায়ে গেলাম। আমাকে দেখে কিশনকও দাঁড়িয়ে পড়লো।
কি হলো রে?
তুই আমাকে ভালবাসবি?
মানে?
আমি তোকে ভালোবাসি।
তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বাসায় গিয়ে ঘুমা। যা!
আমি সিরিয়াস।
ধুর! যা তো! পরে এ ব্যাপারে কথা বলা যাবে। এখন ঘুমা।
আমার কথা ও সেদিন বিশ্বাস করেনি। কিন্তু একটু কেমন জানি হয়ে গিয়েছিল। আমি বন্ধুত্ব নষ্টের ভয়ে পরেরদিন বললাম, মজা করেছি।
কিন্তু আমার ভেতরে জ্বলে যাচ্ছিল। যার ধোঁয়া ভালোবাসা হয়ে বের হয়। আটকিয়ে রাখা যায় না। ও বুঝতে পেরেছিল সবকিছু। কিন্তু না বুঝার ভান করত। আমি জানি, ও আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চাইত না।
এর মাঝে অনেক বার ওকে বলেছি, ভালোবাসি। ও প্রত্যকেবার এড়িয়ে গেছে। এজন্য ওর জন্মদিনে ওকে উইশও করিনি। পরে অবশ্য সরি বলেছিলাম।
ছাদে আয়না নাই। আয়না থাকলে ভালো হতো। লাল রঙের শাড়ি পরেছি। মা’র আলমারি থেকে বের করে নিয়ে। বাবা ঘুমাচ্ছে। মা মরে যাওয়ার পর আমি মাঝে মাঝেই উনার শাড়ি পরে বসে থাকি।
এবারের জন্মদিনেও একটা লাল শাড়ি পরেছিলাম। কিশনক এসেছিল। অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম। ওকে বললাম, বিয়ে করবি?
হুম।
আমাকে কিন্তু।
না!
কেন? আমাদের ভার্সিটিতে আমার থেকে সুন্দরী কোন মেয়ে আছে?
নাই। তবুও...
খুব রাগ হচ্ছিল তখন। প্রতিদিন একটা না একটা ছেলে আমাকে প্রেম প্রস্তাব দেয়! আর আমি কিনা পরে আছি কিশনক এর পেছনে! যে আমাকে পাত্তাই দেয় না! তখন শাড়ীটা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছিল রাগে! তবে সেদিন থেকে আমি কিশনক এর সাথে কথা বলতাম না। এড়িয়ে চলতাম।
যেদিন মা মরে যায়, সেদিন বাসায় বাবা ছিল না। মা খুব অসুস্থ। বাবা অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে। দুই রুমের বাসায় আমি আর আমার মা। রাতে খুব ঝড়! আমি মা’র পাশে বসে আছি। আমার হাত উনার বুকে। উনি জড়িয়ে ধরে আছেন। হঠাৎ আমাকে বলল, যা তো মা, আমার বিয়ের লাল শাড়ীটা পরে আয়। আমি লাল শাড়ি পরতে গেলাম। সুন্দর করে সেজেগুজে আসলাম মা’র সামনে। কিন্তু মা আর বেঁচে নেই।
আমার কান্না পায়নি সেদিন। মায়ের পাশে অই লাল শাড়ীটা পরেই বসে ছিলাম। যেটা আজ পরে আছি। বিয়ের পিঁড়িতে মেয়েরা যেভাবে বসে থাকে, আমিও সে ভাবেই বসে আছি। সেদিনও এভাবেই বসে ছিলাম। তবে মাথায় বিয়ের কনেদের মতো ঘোমটা নেই।
এই বছরের তেইশ জানুয়ারির পর থেকে আমি কিশনক এর ফোন রিসিভ করি না। আজ কি মনে করে করলাম!
হ্যালো!
অই! থাপ্পড় খাবি একটা। আমার সাথে এরকম করিস কেন?
সরি।
কিসের সরি? কাল দেখা করবি।
কেন?
তুই আমাকে ভালবাসতি?
হুম।
এখন বাসিস?
হুম।
গুড গার্ল। কাল দেখা করবি।
কোথায়?
সেটাও বলতে হবে?
না। দেখা করে কি হবে?
তোকে আমার ভালোবাসার সাথে পরিচয় করাব।
অ আচ্ছা!
সেই মেয়ে কে, জানতে চাস না?
না।
আরে, মেয়েটা তোর বেশী দূরে নাই। আয়নার সামনে গেলেই দেখতে পারবি।
এরপর আমি আর কথা বলতে পারিনি। কান্না করছিলাম। আনন্দে।
আমাদের দুই জনের অনেক প্রিয় একটা জায়গা আছে। আমরা প্রায় সবসময় ওখানে বসে থাকতাম। আমাদের ভার্সিটির পেছনের দিকের বাগানের এক পাশে। সামনে ছোট পুকুর। কাল ওখানেই দেখা করতে হবে।
এখনও আমি কিশনক এর ভালোবাসার দিকে তাকিয়ে আছি। আমি কতদিন ধরে ওকে ভালোবাসি। এতদিন পরে ও আমাকে ভালোবাসে। কেমন অভিমানও লাগছে। ইচ্ছা করছে, এতদিন আমি যত কষ্ট পেয়েছি, সেটা শোধ দিতে।
বাবার রাতে ঘুম হয় না। উনার ড্রয়ারে সব সময় কিছু ঘুমের ওষুধ থাকে।
ছাদে আজ অনেক সুন্দর বাতাস। বসন্ত বসন্ত লাগছে। আজ বসন্তের প্রথম দিন ছিল। আজকাল বসন্তের সময় শহরে বসন্তের আমেজ পাওয়া যায় না। কিন্তু এখন পাওয়া যাচ্ছে। দক্ষিণ দিক থেকেই বাতাস আসছে। মনটাকে কত সুন্দর হালকা করে দেয় এই বাতাস।
আচ্ছা, কাল যখন কিশনক আমার জন্য অপেক্ষা করে আমাকে পাবে না, তখন ও খুব কষ্ট পাবে? কি করব তখন ও? খুব জানতে ইচ্ছা করছে।
অনেক ঘুম পাচ্ছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু এখন ঘুমানো ঠিক হবে না। এতো সুন্দর রাত আর কোনোদিন দেখতে পারব না। শেষবারের মতো দেখে নেওয়া উচিত। আকাশে চাঁদ থাকলে আরও ভালো হতো। শেষবারের মতো মন ভরে চাঁদ দেখে নেওয়া যেত।