অপলক দৃষ্টতে তাকিয়ে আছে রুদ্র। তাকিয়ে আছে দূরে। বহুদুরে। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। বুকটাও টিপটিপ করেছে। বাঁ পাশে। রাস্তাটা বৃষ্টিতে ডুবে গেছে। হাঁটু পানি হবে হয়ত। মাতাল করা শব্দ হচ্ছে, যখন এখানে টিপটিপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পরছে। আকাশে সাদা মেঘ। কালো মেঘ হলে ঝরঝর করে বৃষ্টি হত।
দূরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কুয়শার মতো আবছা। ওদিকে হয়ত মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। যাকে cats and dogs বলে ইংরেজিতে। কুত্তা বিলাই বৃষ্টি। ওই বৃষ্টিতে ভিজতে মজা। এখানে যেহেতু ইলশেগুঁড়ি হচ্ছে, ভেজা যাচ্ছে না।
নিজের জীবনের কোথাও হয়ত এই বৃষ্টির সাথে কিছু একটা মিল আছে।
“আশা আশা চার পাশে কুয়াশা”
ছিল। এখনও আছে। বাড়ছে। আবার কখন কমছে।
গানটার মতোই হাটি হাটি পা পা শুরু হয়েছিল।
টিপটিপ বৃষ্টিতে বসে ছিল রুদ্র ধানমন্ডি লেকের ব্রিজটায়। উপরে ছাদ। লেকে পানি পরছে টিপটিপ করে। টিপটিপ বৃষ্টি শহরে ব্যাস্ত মানুষগুলোকে আটকাতে পারে না। এদের আটকানোর জন্য কুকুর বিড়াল বৃষ্টির দরকার হয়। সবাই সবার মতো ব্যাস্ত।
সেখানে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল একটা মেয়ে। ব্রিজটার রেলিং এ। দুঃখী দুঃখী চেহারা। আর চোখ ভর্তি স্বপ্ন। আর বিস্ময়! সবাই ওর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক বার করে দেখে যাচ্ছে। রুদ্রও বসে বসে দেখছে। রেলিং এর উপরেই বসে ছিল। ওর দিকে তাকিয়ে।
বৃষ্টি হয়েই চলেছে। থামার কোন নাম নেই।
রুদ্র প্রতিদিন এখানে এসে বসে থাকে। মানুষ দেখে। দেখে তাদের পড়তে চেষ্টা করে।
কয়েকটা পিচ্চি অন্য পাশের ব্রিজটা থেকে লেকে লাফালাফি করছে। এরা কতো সুখী মানুষের মতো অভিনয় করছে!
প্রত্যেকেই কোন না কোন ভাবে অভিনয় করে। কেউ দুঃখে থেকে দুঃখের অভিনয় করে, আর কেউ দুঃখে থেকে সুখের অভিনয় করে। বাস্তবে সুখের কোন এক্সিস্ট্যান্স নাই। পুরোটায় অভিনয়। রুদ্র এটা জানে। কারন, সে নিজেও প্রচণ্ড সুখের অভিনয় করে।
সুখ, দুঃখ মানুষকে দেখানোর কিছু না। যখন কোন কিছু দেখানোর জন্য করা হয়, সেটা অভিনয় ছাড়া আর কি?
ওই পিচ্চিরা যখন টাকা চাইবে যুবক যুবতীদের কাছে, তখন তারা দুঃখী মানুষের অভিনয় করবে। এত অল্প বয়সেই ওরা বুঝে গেছে, অভিনয় ছাড়া জীবন চলবে না। কোন কোন যুবতি হয়ত ওদের দুঃখের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে তার পাশের যুবককে অনুরধ করবে ওই পিচ্চিটাকে টাকা দিতে। যুবকটা বাধ্য হয়ে মনে মনে বিরক্ত হয়ে দানবীর এর অভিনয় শিল্পী হয়ে দু চার টাকা ওকে দিয়ে দিবে। যুবতিটি তখন প্রেমিকার অভিনয় করে হয়ত বলবে, আমার লক্ষ্মীটি! তুমি এত ভালো কেন?
-কি ব্যাপার? আপনি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
চমকে উঠে রুদ্র পাশে মেয়েটার দিকে তাকায়। ওখানে যে বসে ছিল, সে এসেছে। ওর চেহারা সুন্দর বলে ভেবেছিল, কণ্ঠ হয়ত ভালো হবে না। তবে তার ধারনা খুব ভুল ছিল। মেয়েটা ক্ষুদে গানরাজে গেলে ভালো কিছু করতে পারে। অবশ্য ক্ষুদে গান রাজ নাও হতে পারে। মেয়েদের চেহারা দেখে বয়স ভেবে নেওয়া বোকামি ছাড়া কিছু না।
এতখন মেয়েটার দিকে তাকিয়েই রুদ্র ভাবছিল। হঠাৎ কখন উঠে এসেছে, বুঝতেই পারেনি।
-কি হল, কথা কানে যাচ্ছে না?
কি যেন বলছিলেন?
-বলছি। আমার দিকে এভাবে অপলক তাকিয়ে আছেন কেন?
কই নাতো!
-কি ভেবেছেন? কিছু বুঝি না?
আপনি কোথায় বসে ছিলেন যেন?
-কেন? এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন, আর এখন বলছেন, আপনি জানেন না, কোথায় বসে ছিলাম?
বুঝতে পেরেছি। আমি আসলে আপনার পেছনের দিকে ওই ব্রিজটায় তাকিয়ে ছিলাম। দেখেন পিচ্চিরা লাফালাফি করছে। কতো সুন্দর সুখী মানুষের মতো অভিনয়!
কথাটা শুনেই মেয়েটার চেহারায় রাগী ভাব থেকে কেমন একটা নরম ভাব চলে আসলো। ওদিকে তাকিয়েই জিজ্ঞাস করল,
-আপনার নাম কি?
আপনার নাম কি?
আমার দিকে তাকাল। আবার রাগী রাগী ভাব টা আনল মুখে। এবার ইচ্ছাকৃত ছিল।
-আমি আগে জিজ্ঞাস করেছি না?
এভাবে কৃত্রিম রাগী রাগী চেহারায় প্রেমিকারা তাদের প্রেমিক এর সাথে কথা বলে। এই মেয়ে হয়ত প্রেম করেনি কখনও। তাই আমার সাথে এভাবে কথা বলছে। মেয়েরা তাদের প্রেমিক এর সাথে যেভাবে কথা বলে, অন্য কারুর সাথে ওভাবে কথা বলে না।
আমি রুদ্র। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। এবার তো আপনার নাম বলুন!
-বলব না। আপনি মিথ্যা বলেছেন।
কিভাবে বুঝলেন?
-আমি জানি।
আচ্ছা ঠিক আছে। আমার নাম রুদ্র কায়সার।
-এটাও মিথ্যা। যান। আপনাকে নাম বলতে হবে না।
মেয়েটা চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হল।
এই দাঁড়ান দাঁড়ান। আমার নাম রুদ্র হাসান।
-সত্যি তো?
আপনি তো সত্য মিথ্যা বুঝতে পারেন। আপনিই বলুন, সত্য না মিথ্যা?
-এটা সত্য মনে হচ্ছে।
এবার আপনার নাম বলুন।
-মিথ্যা বলব নাকি সত্য?
আপনার ইচ্ছা!
-উম... আমার নাম ...... রূম্পা তানিশা।
এত ভেবে বললেন যে?
-মিথ্যা বললাম। তাই।
ও আচ্ছা। এখানে অনেকক্ষণ ধরে দেখছি বসে আছেন। কেন, জানতে পারি?
-আপনি তো বললেন, আমার দিকে তাকিয়ে নেই। তাহলে কেমনে বুঝতে পারলেন আমি অনেক্ষন বসে আছি?
আপনার পাশ দিয়েই তো তাকিয়ে ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম, ওখানে আপনি বসে আছেন।
-ও আচ্ছা। আপনি কি করছেন?
আপনি বললেন না। থাক বলতে হবে না। আমি এখন সরোবরে যাব।
-আমিও যাব।
চলুন, এক সাথে যাই।
-আচ্ছা।
এভাবে শুরু হয়েছিল।
তারপর লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প......
ভাবছি, উড়ে বেড়াব কাল সারারাত।
-আমাকে সাথে নেবে?
যাবে? সত্যি?
-হুম।
আচ্ছা।
আবার কোন দিন হয়ত ফোন করে রুদ্র বলল,
জানো? আজ আমি বৃষ্টিতে ভিজলাম।
-ইশ!
কি হল? পিঁপড়া কামড়েছে?
-হুম।
আমি পাঠিয়েছি।
-এখন আমার কিছু হলে তোমার দোষ।
আমি তো দাঁত ভেঙ্গে পাঠালাম। যাতে শুধু ঠোঁট দিয়ে আদর করে দিতে পারে।
-আমিও পাঠাব।
অপেক্ষায় থাকলাম।
একটু লুকোচুরি।
তারপর হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকা। আবার কাছে যেতে একটা ভয়।
“হয় হয় শুধু হয় ভয় ভয়”
পুড়োটা গানের সাথে মিলে যাচ্ছে। গানটা যেন রুদ্রকে উদ্দেশ্য করেই লেখা!
রুদ্রের জন্মদিনে মেয়েটা ফোন করল সবার আগে। রূম্পা বা তানিশা বা কিছু একটা হবে হয়ত নাম।
খুব খুশি হয়েছিল রুদ্র।
আজ আমি সব চেয়ে খুশি। তুমি কি চাও, বল। আচ্ছা, তোমাকে তিনটা বর দিলাম। যা চাইবে, দিব।
-আমি তিনটা নিব না। দুইটা নিব।
কেন?
-আমার দুই সংখ্যা ভালো লাগে।
হাহা!
-তবে তিনটা বর দেওয়ার জন্য আমিও খুশি হয়েছি। তোমাকে তিনটা বর দেওয়া হল। বল, কি কি চাও?
পরে কোন এক সময় চেয়ে নিব। এখন তোমারটা বল।
-উহুম। আমি পরে বলব। তোমার বলা শেষ হলে।
আপাতত একটা বলি। আমাকে গান শুনাও।
তারপর গান।
“একটুকু ছোঁয়া লাগে একটুকু কথা শুনি
তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাগুনী
কিছু পলাশের নেশা কিছু বাচা পায় দিশা
তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি
রচি মম ফাল্গুনী
যেটুকু কাছেতে আসে খনিকের ফাকে ফাকে
চোখই তো মনের কোনে স্বপনের ছবি আঁকে
যেটুকু যায় রে দূরে ভাবনা কাপায় সুরে
তাই নিয়ে যায় বেলা নুপুরের তালগুনি
রচি মম ফাল্গুনী”
রুদ্রের কখনও মনে হয়, এটা বুঝি ওকে উদ্দেশ্য করে গাইছে। আবার কখনও মনে হয়, নাহ! তা হবে কেন? হয়ত মেয়েটাও এরকমই কিছু একটা ভাবে। হয়ত ভাবে না। এমনি মজা করে! হয়ত এভাবেই ও কথা বলে!
লুকোচুরি খেলা! হাহাহা...! কেউ জানে না, এ খেলার শেষ কোথায়!
রুদ্রর বাকি দুইটা বর এখনও জমা আছে। পরে কোন একদিন চেয়ে নিবে যদি সময় আসে। সব কাজ সময়েই করতে হয়। আগেও না, পরেও না। সময় যদি না আসে, তাহলে আর বর চাইবে না। যদি অন্যভাবে আসে, অন্যভাবেই চাইবে।
রুদ্রর চাওয়া শেষ হলে রুম্পার চাওয়ার পালা। রুদ্র জানে না, কি চাইবে।
বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে। দূরের কুয়াশ প্রায় পরিষ্কার হয়ে এসেছে। ওদিকে বৃষ্টিও বন্ধ হয়েছে নিশ্চয়।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল।
-রুদ্র?
হ্যাঁ। বল।
-আজ পূর্ণিমা।
হ্যাঁ। জানি।
-আলোতে সাঁতার কাটবে?
তুমি রবীন্দ্রনাথ হলে নাকি?
-আজব! এখানে রবীন্দ্রনাথ হওয়ার কি হল?
না কিছু না। এমনি বললাম। চলো। সাঁতার কাটি।
-আজকে আমি আমার দুইটা বর চেয়ে নিব।
তুমি না বলেছিলে, আমার চাওয়া শেষ হলে তুমি চাইবে?
-আমি জানি, তুমি চাইতে পারবে না এখন। তাই আমিই আগে চেয়ে নিব। তোমারটা পরে চেয়ে নিও। আর আমি জানি, তুমি তখন কি চাইবে!
আচ্ছা। একটু হিন্টস দেওয়া যায়?
-না।
আচ্ছা।
আকাশ আবার মেঘ করে আসছে। এবার কালো মেঘ ছুটাছুটি করছে আর ধীরে ধীরে গাড় হয়ে যাচ্ছে। এবার কুকুর বিড়াল বৃষ্টি হবে। সেই সাথে রুদ্রর মনেও ঝড় বয়ে যাওয়া শুরু করল। এ ঝড় যেন ভেঙ্গে চুড়ে নিয়ে যাচ্ছে মনের পুরনো কুরেঘর। এরপর এখানে হয়ত আবার নতুন করে সুন্দর একটা ঘর তুলে ফেলবে। ঝড়টা শেষ হয়ে গেলেই। আর নয়ত আর কোনোদিনই ঘর তুলবে না। ওদিকটায় থাকবে ধু ধু প্রান্তর।
সেদিন রাতে হয়ত তাদের পৃথিবী আলোময় করে দিয়েছিল পূর্ণিমা বাকিটা জীবনের জন্য। নয়তবা কুয়াশা গাড় হয়ে অমাবস্যার রূপ ধারন করেছিল! চাঁদ আর আসেনি কখনও তাদের জীবনে।