মৎস ভবন থেকে শহবাগের দিকে হাটছে রিশাক। ডানপাশের ফুটপাথ দিয়ে। মাথার উপরে সূর্য! এতো গরমেও রিশাক ঘামছে না। খুব ঠান্ডা মাথায় হাটছে। বাঁ হাতে একটা ব্রেসলেট। মাস্তান টাইপ ছেলে এই ধরণের ব্রেসলেট পরে। রিশাক ভদ্র ছেলে। তবুও পরেছে। আজকাল মাস্তান হতে ইচ্ছ করে। হাঁটতে হাঁটতে কারুর সাথে মাস্তানি করা যায় কিনা, খুঁজতে থাকে ও।
ডানপাশে রমনার দরজা। ভেতরে ঢুকে গেল রিশাক। বেশ কয়েকটা বেঞ্চে ছেলে-মেয়েরা বসে আছে। মানে, জোড়ায় জোড়ায় আর কি।
একটা সময় ছিল, ছেলে-মেয়েদের এভাবে দেখলে রিশাক এর মাথা শ্রদ্ধায় নত হতো। ভালোবাসা ব্যাপারটাকে অনেক সম্মান করত। কিন্তু এখন আর সম্মান আসে না। মনে হয় ভালোবাসা একটা ফালতু অনুভতি ছাড়া কিছুই না। রিশাক এখন ভালোবাসায় শুধুই যৌনতা ছাড়া কিছুই খুঁজে পায় না।
একটা ছেলে একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। রিশাক ওদের থেকে সামান্য দূরে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ছেলেটা মেয়েকে ছেরে দিয়ে তাকিয় থাকলো। রিশাক ওর দিকে তাকিয়েই প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো। হতের ইশারায় ছেলেটাকে কাছে ডাকল।
জি ভাইয়া
কি করতাছস এহানে?
সরি?! তুই বলছেন কেন?
মাদার***, তোরে কি বাপ ডাকুম হে? এহানে বইয়া কি করতাছস?
না মানে ভাইয়া, আমার গার্লফ্রেন্ড এর সাথে...
গার্লফ্রেন্ড এর সাথে আসছস, বুঝছি তো। বইয়া থাকবি, এইডাও বুঝছি, ঘারে হাত দিছস, এইডাও সমস্যা না। সমস্যা হইল, হাত ঘারের নিচে নামে ক্যান হে?
বলে একটা থাপ্পড় দিল ছেলেটার গালে। রিশাক নিজে নিজেই অবাক হল। কিন্তু বুঝতে দিল না। জীবনের প্রথম কাউকে থাপ্পড় দিয়েছে। ছেলেটা গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশের কয়েকজন তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। কেউ কিছু বলছে না।
কি হল? দাঁড়ায়ে আছস ক্যা? আরও থাপ্পড় খাবি? ভাগ এহান থেইক্যা! সোজা বের হইয়া যাবি।
ছেলেটা অই মেয়েকে নিয়ে চলে গেল। রিশাকের দিকে আশেপাশের অনেকেই তাকিয়ে আছে। রিশাক কিছুই কেয়ার করে না, এমন ভাব নিয়ে বেঞ্চে গিয়ে বসলো উদাস ভাবে। মনে মনে ভাবছে, চেহারায় মাস্তান ভাবটা আনা উচিত। নইলে কেউ ওকে ভয় পাবে না। আবার খুব মজাও লাগছে!
সিগারেট শেষ করে এখান থেকে উঠতে হবে। মাস্তানরা এক জায়গায় বেশিখন থাকে না। আর তারা একাও থাকে না। সাথে সাঙ্গপাঙ্গ রাখতে হবে। রিশাক এর কোন বন্ধু নাই। নতুন বন্ধু তৈরী করতে হবে। ঠিক বন্ধু না। ছোটভাই।
অই, এদিকে শোন।
একটা ছোট বাচ্চাকে ডাকলো। হেটে বেড়াচ্ছিল। আশেপাশেই কোন ফুটপাথে থাকে হয়ত।
কই থাকিস?
অই পাশের ওভারব্রিজে।
অ! সিগারেট খাস?
না ভাই। একটা কথা কই?
ক।
কাজটা ভালো করছেন ভাই। আমি বড় হইলে দুইডা থাপ্পড় দিতাম।
হুম। শোন। এরপর যদি কাউরে এরকম দেখিস, ওরে আমার কথা বলবি। রাশু ভাই। প্রয়োজনে তোর বন্ধুদের নিয়া পিটাবি। কেউ কিছু কইলে আমি আছি। পরিবাগের অইপাশে চা দোকানগুলায় খোঁজ করলেই পাবি আমারে।
যাক! কিছু সাঙ্গপাঙ্গ পাওয়া গেল। এদের এখন রিশান যা বলবে, তাই শুনবে। রাশু নামটা পছন্দ হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করে বলে ফেলছে। তবে রিশান নামটা ভদ্র ভদ্র। একটা মাস্তান টাইপ নাম না হলে কেউ ভয় পাবে না।
অনিমার কথা মনে পরে গেল। আগে এক সঙ্গে কত হাটত! পারলে সারাদিন হাঁটে! রিশাক মানা করত। অনিমা শুনত না। ও নাকি রিশাক এর সাথে সারাজীবন এভাবে হাঁটতে চায়।
একদিন ধানমন্ডি লেকে বসে আছে দুজনে। হঠাৎ দেখে, অনিমা কাঁদছে।
কাঁদছ কেন? কি হয়েছে?
কিছু না।
ওকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত নেড়ে দিতে দিতে বলল,
বল না, কি হয়েছে? কাঁদছ কেন? আমি আছি না?
যদি আমাকে ছেরে চলে যাও?
ধুর পাগলি! এই জন্য কাঁদছ? তোমাকে ছেরে চলে যাওয়ার আগে আমাকে মরে যেতে হবে। কখনও তোমাকে ছেরে যাব না!
যদি আমি তোমাকে ছেরে যাই?
তোমাকে যেতে দিলে তো? তোমাকে কোথাও যেতে দিব না। সারাজীবন আমরা একসাথে হাঁটবো।
এরপর অনিমা রিশাককে জড়িয়ে ধরল। হাত দিয়ে রিশাক ওর চোখের পানি মুছে দিল।
রিশাক ওকে ছেরে যায়নি। অনিমা ছেরে গেছে। রিশাক ধরে রাখতে পারেনি। রিশাকের ভুল কি ছিল, সেটা বলতেও অনিমা নাকি বাধ্য না!
আসলে পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নাই। সব শারীরিক চাহিদা বিনা পয়সায় মেটানোর ধান্দা। এই ধান্দাকে মহৎ প্রমান করতে একদল মানুষ ব্যাস্ত হয়ে থাকে সবসময়। ধান্দাটাকে প্রেম-ভালোবাসা নাম দিয়ে।
হাঁটতে হাঁটতে এসব ভাবে রিশাক।
পরিবাগে একটা চা দোকানে বসলো ও। এখানে আগে প্রতিদিন অনিমাকে নিয়ে আসতো ও।
মামা, আজ ভাবী আইলো না?
আমি মামা হইলে আমার প্রেমিকা আপনার ভাবী কেমনে?
হেহেহ! অই হইল! আজ আইলো না ক্যান?
জানিনা। বলেনি। আর কখনও আসবে না।
অ আচ্ছা! মামা, চিন্তা কইরেন না। একটা মাইয়া যাইব, হাজারটা আসার রাস্তা খুইল্যা যাইব। কড়া লিকারে একটা চা দেই?
দাও।
আর একটা সিগারেট জ্বালালো।
হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। অই রিক্সা অই অই! থামা। অই, কি হল, কানে কথা যায় না? রিক্সা থামা।
একটা রিক্সাওয়ালা বাঁয়ে তাকিয়ে বলল, মামা, আমি?
তুই না তো কি তোর বাপ?
রিক্সা থামালো।
হুড নামা।
ভেতরে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে।
অই, তোরা কি করতেছিলি ভেতরে?
ইতিমধ্যে আশেপাশের সবাই এগিয়ে এসেছে। চা দোকানীও আসলো। হাতে কাপ। রিশাকের হাতে দিয়ে বলল, মামা, দিমু নাকি একটা?
কি হল? চুপ কইরা আছস ক্যা? রাস্তাঘাটে টিপাটিপি করার জন্য বাইর হইছস হে? থাবড়ায়ে সব কয়টা দাঁত ফেলায়ে দিমু!
সরি ভাইয়া!
কিসের সরি? অই, কিসের সরি? রিক্সা থেইক্যা নাম! নাম কইলাম!
ছেলেটা রিক্সা থেকে নামলো। মেয়েটা কাচুমাচু করে তাকালো। অই, তোর বাপের ফোন নাম্বার দে।
মেয়েটাকে থাপ্পড় দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলা ঠিক না।
অনিমাকে থাপ্পড় দিত। কিন্তু মেয়ে বলে কিছু করেনি। পাশে দেওয়াল ছিল। অনেক জোরে একটা ঘুষি দিয়েছে। হাতের হাড়ে এখনও ব্যাথা করছে। কয়েকদিনেও ঠিক হয়নি।
কি হল? ফোন নাম্বার দে!
রিশাক ফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে।
চা দোকানী একটা ঝারী দিয়ে বলল, মামা কি কয়, কানে যায় না আপনের? আপনের বাপের ফোন নাম্বার দেন।
সরি ভাইয়া। আর এরকম হবে না।
খবরদার সরি কইবি না! থাবড়ায়ে বাপের নাম ভুলায়ে দিমু।
ছেলেকে বলল, অই, তোর বাপের নাম্বার দে।
সরি ভাই।
অই, এখনই কইলাম, সরি কইবি না!
বলেই জোরে একটা থাপ্পড় দিল ওর গালে। ছেলেটা পরতে পরতে কোন মতো সামলে নিল। মেয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে।
অই, কান্দছ ক্যা? কে মরছে? কান্দস ক্যা? অই মামা, এরা নাম্বার দেয় না ক্যান?
থাক মামা, মাফ কইরা দেন।
অই রিক্সা, এই মেয়েরে নিয়া এর বাসায় রাইখ্যা আয়। আর অই, তুই এদিকে আয়।
রিক্সা পাঠিয়ে দিয়ে রিশাক ছেলেটাকে নিয়ে এসে দোকানে বসলো।
মামা, এরেও একটা চা দেও।
কতদিন এর প্রেম?
চার মাস।
আমি চার বছর প্রেম করছি। রুম ডেট করছি। তুই রুম ডেট করছস?
না ভাই।
শুন। কিছু মনে করিস না। মেয়েদের দেখলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। এরা তোরে শরীর এর সব কিছু দিয়ে দিবে। কয়েকদিন পর বলবে, আমাকে ভুলে যাও। সিগারেট খাস?
জ্বী ভাইয়া।
মামা, দেখ, কি সিগারেট চায়, এরে একটা দাও। কিছু মনে করিসনা। ঠিক আছে? থাকিস কই?
ফার্মগেট।
তাইলে এদিকে কেন?
ওকে নিয়ে আসছিলাম ভাইয়া।
অ আচ্ছা। ওকে। যা তাইলে। আর শোন। প্রেম কখনও একটা করবি না। কয়েকটা করবি।
ও চলে গেল। রিশাককে দিয়ে আসলে মাস্তানি হবে না। মাস্তানরা যাকে মারে, তাকে সরি বলে না। রিশাক বলে।
অনিমাকে এতো করে সরি বলল, অনিমা শুনলই না!
-প্লীজ অনিমা, আমি নিজের অজান্তেও যদি কোন ভুল করি, প্লীজ মাফ করে দাও!
-আশ্চর্য! তোমাকে আমার সহ্য হচ্ছে না। কেন বুঝো না?
সেদিন যে নাইম বলেছিল, অনিমা একটা নতুন ছেলের সাথে লাইন মারার চেষ্টা করতেছে, সেটাই হয়ত সত্য। হয়ত, অই ছেলের সাথে আর হাঁটতে হবে না। গাড়িতে করে ঘুরতে পারবে।
এরকমই হয়ে থাকে। একটা সুন্দরী মেয়ে পেলে ছেলেরা অতীত ভুলে যায়। আর ধনী বাবার ছেলে পেলে মেয়েরা অতীত ভুলে যায়। যে তোমাকে কেঁদে কেঁদে বলবে, কখনও আমাকে ছেরে যেও না, সেই তোমাকে কেঁদে কেঁদে বলবে, কেন আমাকে ছাড়ো না? কি দোষ করেছি?
রিশাকেরও এরকম হওয়া উচিত ছিল। গতবছর নিশু রিশাককে প্রপোজ করেছিল। রিশাক বলল, ও অন্য কাউকে ভালোবাসে। নিশু অনিমার থেকেও সুন্দরী ছিল। আর ও প্রতিদিন নিজে গাড়ি চালিয়ে ভার্সিটি আসত। তবুও না করেছিল। অনিমাকে ভালোবাসে বলে। কিন্তু অনিমা বিপরীত কাজটা করলো। যদি এটা ও জানতো!
উপরে তাকালো রিশাক। একটা কাঠবাদাম এর গাছ। কয়েকদিন আগে সব পাতা ঝরে পরেছে। শীতকাল ছিল। এখন নতুন পাতা গজাচ্ছে। কচি। সবুজ।
পৃথিবী পরিবর্তনশীল। সবকিছু পরিবর্তিত হয়। কিছু স্মৃতি পুরাতন হয়ে যাবে। শুকনো পাতার মতো ঝরে পরবে। আবার নতুন উদ্যমে নতুন কুড়ি জন্মাবে। যারা শুকনো মরা পাতা নিয়ে বসে থাকতে চায়, তারা আসলে বোকা। শুকনো ঝরা পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে কিছুখনের জন্য শীত নিবারন করা যায়। অগুলা নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায় না।
কাঠবাদাম এর গাছে একটা কাক বাসা করেছিল। কা কা করত। আজ এদের দেখা যাচ্ছে না। এখানে কিছু কোকিল ডাকছে।
বসন্ত এসে গেছে। কোকিল কুহু কুহু করছে।