তাই স্বপ্ন দেখব বলে আমি দু চোখ পেতেছি!
মৌসুমি ভৌমিক এর সেই গান এর শেষ লাইন।
লোডশেডিং দেখে মেঘ বুঝতে পারলো, এখন গরমকাল পরেছে। ঘরে ফ্যান থাকলে অবশ্য আগে থেকেই বুঝতে পারত! এখানে ফ্যান নাই। মাঝেমাঝে গা ঘেমে যায়। তবে সেটার দিকে তেমন একটা মনোযোগ দেওয়া হয়না বলে গরম এর ব্যাপারটা পাত্তা পায়না। আর শহরে গরমকালে যথেষ্ট লোডশেডিং হলেও শীতকালে একটুও হয়না!
বিদ্যুৎ কখন আসবে, মেঘ জানে না! কয়েকমাস পর আজকেই বিদ্যুৎ গেল। আগেও গেছে। তবে তখন বিদ্যুৎ এর অভাব টা অনুভব করার প্রয়োজন পরেনি। তাই বুঝতেও পারেনি।
আজকেও অনুভব করত না! তবে গানটা এখন বন্ধ হয়ে গেল। তাই অনুভব করতে পারছে। শেষ লাইন বলার আগেই কারেন্ট চলে গেল। শেষ লাইনটা তখন মেঘ নিজের মনেই বেসুরো গলায় গাইল। এখন বেসুরো গলায় দু এক লাইন গাইলে তেমন একটা প্রবলেম নাই। কারন, ঘরে সে এখন একা। সবাই বাহিরে। বারোটার আগে কেউ ঘরে ফেরে না। মেঘ আটটার পর থেকে একা একা গান শোনে।
আর ভাবে।
ভাবনা গুলো ওকে সুখ এনে দেয়।
কখনও বা বুকের বাঁ পাশে হালকা মতন ব্যাথা! চোখের কোনে দু এক ফোটা জল জমতে জমতে জমে না!
সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল। লেখাপড়া, প্রেম, আড্ডা... সবকিছু। কিন্তু সব কিছু ভেঙ্গে গেল একটা ঝড়ে। এখনও ওর স্পষ্ট মনে পরে।
অনুর সাথে অনেকক্ষণ রিক্সায় ঘুরলো। ফার্মগেট থেকে রিক্সা নিয়ে লালবাগ কেল্লা। সেখানে নেমেই আবার অন্য একটা রিক্সা নিয়ে হাতির ঝিল। সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার ফার্মগেট।
মাঝের সময়টা ছিল ওদের। ওদের দুজনের। হাতে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে প্রেমের ভাষায় কথা বলা! ঘারে মাথা রেখে এক হাত দিয়ে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে আর অন্য হাত দিয়ে হাত ধরে রেখে পরম নিশ্চয়তায় চোখ বুঝে অনু সেদিন মেঘকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ওকে ছাড়া অনু এক মুহুর্তও কাটাতে পারবে না।
মেঘ সেদিন নিশ্চিত হয়েছিল, অনুকে কখনও হারাতে হবে না! হারাতে হয়নি হয়ত! অনু মেঘকে হারিয়েছে।
সেদিন বাসায় ফিরে ফোন অন করল। চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল লালবাগ গিয়ে।
একসাথে অনেক মেসেজ আসলো। অনু ছাড়া অন্য কারুর তো মেসেজ দেওয়ার কথা না। মেঘ ফিরেছে কিনা, সেটা জানার জন্য দু একটা মেসেজ দিতে পারে। তাই বলে এতগুলো!
সব মেসেজ বাসা থেকে। ভাইয়া চারটা। মামা দুইটা। কাকা দুইটা। গ্রামের একটা ফ্রেন্ড তিনটা।
মেঘ এর বাবা আজ আসর এর নামাজ এর পর মারা গেছে।
মেসেজগুলো দেখে ওর কান দুটো দিয়ে যেন বাষ্প বের হচ্ছিল। মাথা ঝিম ধরে আছে। চোখ ধীরে ধীরে ঝাপসা হচ্ছে, বুঝতে পারছে। ও এখন কি করবে? কাঁদবে? কিভাবে কাঁদবে? হাউমাউ করে? তা না হলে তো মনের উপর থেকে মেঘ সরে যাবে না। খুব চিৎকার করে কাঁদা উচিত। কিন্তু কিভাবে কাঁদবে? এত বড় একটা ধামরা ছেলে। হাউমাউ করে কাঁদা মানায় না।
দু বছর হয়ে গেছে। তবুও ওর এখনও মনে পরে, কিছুক্ষণ এর জন্য ওর মাথা শুন্য হয়ে ছিল। কেমন একটা অনুভূতি! মাথায় কিচ্ছু নাই। আর মাথায় কিচ্ছু নাই মানে, কোন আনন্দ নাই, শোক নাই, বেদনা নাই, কষ্ট নাই, কিচ্ছু নাই! শুধু শুন্যতা! তখন হয়ত মস্তিষ্ক অতিরিক্ত শোক সহ্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল!
এ সময় ওর শক্ত কোন সাপোর্ট দরকার ছিল। ওর বাবা! ওর বাবা ছাড়া আর কে ওকে সাপোর্ট দিতে পারে? কোন বন্ধু? সে তো মরীচিকা। অনুর কথা মনে পরেছিল তখন। তবে ফোন করেনি। বেচারা মেঘকে অনেক ভালোবাসে। আর মেঘও। মেঘ কেন অযথা ওকে বারতি কষ্ট দিবে? এটা কি মেঘ পারে? ওকে ভালোবাসে তো।
একা একাই বাসায় ফিরেছিল। ও বড় হয়েছে। এখন অন্য কারুর সাহায্য নিয়ে যাওয়াটা অপমান জনক। আর কোন বন্ধুকে বললে মনে হয়না, ওর সাথে যাবে! কারুর সাথে সম্পর্ক ভালো না! কেন, তা মেঘ জানে না। এখনও কারনটা খুজে পায়নি! ওর কোন বান্ধুর নাম্বার বাসায় জানে না বলেই সরাসরি ওকে জানিয়েছে। অথবা, ভেবেছে, ও হয়ত অনেক বড় হয়েছে। জানালে কি আর হবে?
আসলেই তো তাই! একা একা গেল। চার ঘণ্টার রাস্তা। কিন্তু শেষ হতেই চায়না! মনে হচ্ছিল, অনন্ত কাল ধরে বাসে বসে আছে।
শেষ পরযন্ত যখন বাসায় পৌছালো, রাত দুইটা তখন। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। বাস থেকে নেমে মিনিট দশেক হাঁটতে হয়। ফোন করলে মামাতো ভাই এসে নিয়ে যাবে। কিন্তু একা একা যেতে ইচ্ছা করছে। অনেক সময় পরে এখন একটু একা হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এটা হারানো ঠিক হবে না।
গঞ্জ থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামলো। দূরে কথাও খেঁকশিয়াল ডেকে উঠল। নিঝুম রাত বলে হয়ত খুব কাছে কথাও থকে শব্দ আসলো বলে মনে হল।
রাতের এই নিরবতা ভেদ করে একটা গুনগুন শব্দ কানে এসে বাজছে বারবার। যত এগুচ্ছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে শব্দটা!
বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। এটা ওর মা’র কণ্ঠ। সদা হাস্যজ্জল মহিলা। সবাইকে খুশী রাখে। নিজেও খুশী থাকে। সেই মানুষ এখন কাঁদছে। ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন হাহাকার করে উঠল। আর কতখন মেঘ ওর চোখের পানি আটকে রাখবে? শেষ পর্যন্ত পারবে তো?
পাশে একটা ছোট সাঁকো। বসে পরল। ছোট বেলায় যখন খুব গরম পরত, তখন ওর বাবার সাথে এখানে এসে বসে থাকতো। বাবা চাচা রা গল্প করত। বেচে থাকার গল্প।
এখন এই জায়গাটাও যেন কিছুক্ষণ পর পর ফুঁফিয়ে উঠছে। সাথে সাথে মেঘ এর বুকটা।
বাবা সবসময় লুঙ্গি জড়িয়ে হাটুর উপরে তুলে সাঁকোর কোনাটায় বসতো। রাতের বেলা। কোন সমস্যা নাই। আর এই জায়গাটা বাবার জন্য সবাই ফাঁকা রাখত। অন্য কেউ বসত না। বাবা সবার সাথে গল্প করত। অনেক রাত পর্যন্ত। আর মেঘ কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে যেত। পরে ঘুম থেকে উঠে দেখত, ওদের বাসায় ওর বাবার পাশে ঘুমিয়ে আছে।
যে জায়গাটায় বাবা বসত, সেই জায়গাটা জড়িয়ে ধরে কাঁদলে অনেক ভালো লাগতো।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে আসলো। তবে এখনও বুকের বাঁ পাশটাতে হালকা মত ব্যাথা করছে। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে লাইট বন্ধ করে বসে পরল।
সিগারেট জ্বালানোর আগে সিগারেট টানতে ইচ্ছা করলেও এখন আর টানতে ইচ্ছা করছে না। আবার ফেলেও দিতে ইচ্ছা করছে না। থাক। ওটা হাতেই থাক।
সাঁকো থেকে আর পাঁচ মিনিটের রাস্তা। তাহলেই ওদের বাসা। ভেতরে আলো জ্বলছে। গ্রামের দিকে সাতটায় গভীর রাত। এখন দুটা বাজে। গ্রামের সবাই ঘুমাচ্ছে।
দরজা খোলা ছিল। বাড়িতে পা দিতেই ভেতরটা আরেকবার মোচড় দিয়ে উঠল।
কেউ খেয়াল করল না, ও এসেছে। আঙিনায় একটা চেয়ারে বড় কাকা চুপচাপ বসে আছে। কোন দিকে খেয়াল নেই। মামাতো ভাই একটা টুলে বসে হাটুতে হাত আর হাতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। বারান্দায় মা শুয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে হয়ত ফিট হয়ে গেছে। মা’র মাথা কোলে রেখে বড় কাকী দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। উনিও কাদছিল। মহিলারা অন্যের কান্না দেখে কান্না আটকাতে পারে না।
মেঘ এর বড় বোন দেওয়ালে হেলান দিয়ে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আশেপাশে কোন খেয়াল নেই। উনার পাশে উনার পিচ্চি মেয়েটা বসে চোখ ঘষছে। হয়ত এখনই ঘুম থেকে উঠল। মেঘ এর দিকে তাকিয়ে থাকল এক মুহুর্ত। তারপর নিচের ঠোঁটটা উল্টিয়ে দৌড়ে আসলো মেঘ এর দিকে। মেঘ ওকে কোলে নিল। তারপর মেয়েটা কাঁদতে শুরু করল। সবাই কাঁদছে। ওর দিকে কারুর খেয়াল নেই। এই কারনে হয়ত।
ওর বোন এবার মেঘ এর দিকে তাকাল। তাকিয়েই চিৎকার দিয়ে উঠল!
“ভাই রে! আব্বা কই গেল?”
মেঘ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। ও অনেক ক্লান্ত। এখন একটু নিজেকে ছেড়ে দেওয়া উচিত। করুক, মন যা চায়!
গিয়ে বসলো বোনের পাশে। মা কিছুক্ষণের জন্য চোখ খুলে মেঘ কে দেখল।
“ও মেঘ! তোর বাবা কই!” বলেই আবার ফিট হয়ে গেল। মেঘ ওর মা’র মাথাটা জড়িয়ে ধরল বুকে। বুক ফেটে যেন এবার হুহু করে কান্না বের হয়ে এল। মেঘকে তো বৃষ্টি হয়েই ঝরে পরতে হবে।
মেঘ হাতের সিগারেট এ একটা টান দিয়ে বুঝল, এটা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। চোখের জল মুছে ফেলল। এখন আর ওসব ভাববে না। ওসব ভাবলে কষ্ট ছাড়া আর কি হয়?
কিছু কথা, কিছু অতীত ভাবলে মানুষ শুধু কষ্টই পায়। চোখ ভরে যায় জলে। তবুও মানুষ বেছে বেছে ওই অতীত গুলোই ভাবে। তারপর চোখের জল মোছে। প্রকৃতি এই মানুষগুলোকে অনেক কষ্ট বিলাস করে পাঠিয়েছে।