somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশ ব্যাংক কেলেঙ্কারি ও বিদেশি নির্ভরতা

১৫ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ৯:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং ইতিহাসের সেরা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব গণমাধ্যমের আলোচনায়। জনগণের টাকা চুরির এই ঘটনায় প্রতিদিন নতুন নতুন প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। প্রশ্নের উত্তর যাদের থেকে পাওয়ার কথা, উত্তর যাদের দেওয়ার কথা, তারা ‘চুপ’ করে আছেন। এক অর্থে নির্বিকারও।

বিদেশি গণমাধ্যমের সূত্রে দেশের গণমাধ্যম কিছু সংবাদ প্রকাশ করছে। যার থেকে মানুষ পরিষ্কার ধারণা পাচ্ছেন না। বিক্ষুব্ধ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। স্বাভাবিকভাবে তাতে তথ্যের চেয়ে আবেগ বেশি কাজ করছে। এতে আবার ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরা। তাদের দাবি, কেউ কিছু না জেনে লিখছেন, না জেনে বলছেন। নিজেরা কিছু জানাচ্ছেন না, বলছেন না! ধরে নিলাম আপনি বা আপনারাই সঠিক, আমি বা আমরা কিছু জানি না। তো আপনারা জানাচ্ছেন না কেন? আমরা তো জানতে চাইছি! না জানিয়ে ক্ষিপ্ত হচ্ছেন কেন? সামগ্রিক এই অর্থ চুরির প্রসঙ্গ ও বিদেশি নির্ভরতা নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছু কথা।

০১. ঘটনাটি ঘটেছে গত জানুয়ারি মাসের শেষ দিক থেকে। এখন পর্যন্ত জানা তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জেনেছে ৫ ফেব্রুয়ারি। এ দিন ‘ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক’ (ফেড) বাংলাদেশ ব্যাংককে জানায়। যদিও আরও আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের তা জানার কথা। অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কখন কোন অ্যাকাউন্টে যাচ্ছে, তা সঙ্গে সঙ্গে জানবে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তারপরও ধরে নিলাম বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম জেনেছে যে, তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চলে গেছে। ২৯ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের ‘ইনকোয়ারার’ পত্রিকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারির সংবাদ প্রকাশ করে। এই সংবাদের সূত্র ধরে দেশের গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। দেশের মানুষ জানতে পারে। ঘটনা জানার ১ মাস ২ দিন পরে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে টাকা চুরির বিষয়টি স্বীকার করে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলে ‘ফেড’র অ্যাকাউন্ট ‘হ্যাকড’ করে বাংলাদেশের অর্থ চুরি হয়েছে। চুরি হওয়া এই অর্থ ফিলিপাইন এবং শ্রীলঙ্কায় গেছে। শ্রীলঙ্কায় যাওয়া অর্থ ইতোমধ্যে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

০২. এই স্বীকারোক্তির পর প্রশ্ন তৈরি হলো- ক. বাংলাদেশ ব্যাংক কেন ১ মাস ২ দিন দেশের মানুষকে কোনো তথ্য না জানিয়ে পুরো বিষয়টি গোপন রাখল? খ. বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ‘হ্যাকড’ হয়েছে ‘ফেড’ থেকে বাংলাদেশের অ্যাকাউন্ট। ‘ফেড’ সুনির্দিষ্ট করে বলল, তাদের প্রান্ত থেকে ‘হ্যাকড’ হয়নি। এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতেও তেমনই ধারণা হচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক ১ মাস ২ দিন সময় নিয়ে কেন অসত্য তথ্য দিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করল? গ. অর্থমন্ত্রী প্রথম দিন বললেন তিনি কিছু জানেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে কিছু জানায়নি। শুধু জনগণকে নয়, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থমন্ত্রীকেও কেন জানাল না? যদিও অর্থমন্ত্রী আবার পরের দিনই বাংলাদেশ ব্যাংকে দায়মুক্তি দিয়েছেন! আজ ১৩ মার্চ আবার বলেছেন, আমাকে না জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অর্থমন্ত্রী ফেড 'র বিরুদ্ধেও ব্যবস্থার হুমকি দিয়েছিলেন। এতে নাকি চটে যায় ফেড। এই হুমকির পরের দিনই বাংলাদেশ ব্যাংক ফেডকে ইমেল করে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যকে 'দেশীয় রাজনৈতিক বক্তব্য ' হিসেবে উল্লেখ করে ফেড'র সহায়তা চায়। তারপর ফেড নমনীয় হয়। ঘ. মার্চের ৭ তারিখে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, শ্রীলঙ্কা থেকে তারা কিছু টাকা উদ্ধার করেছে। যদিও পরিমাণ বলেনি, কেন বলেনি সেটাও একটা রহস্য। রহস্যের এখানেই শেষ নয়। ১১ মার্চ শ্রীলঙ্কার ‘লংকা বিজনেস অনলাইন’সহ অন্যান্য গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করল, এই টাকা শ্রীলঙ্কায় যায়নি (The money has not actually reached Sri Lanka, so we are trying to trace what happened to it)। ঙ. শ্রীলঙ্কার একটি অনিবন্ধিত এনজিও’র নামে ২ কোটি ডলার যাওয়ার ‘অ্যাডভাইস’ দেওয়া হয়েছিল ভুল বানানে। জার্মানির ডয়েচ ব্যাংকের মাধ্যমে এ অর্থ পাঠানোর সময় ভুল বানানের বিষয়টি ধরা পড়ে এবং জার্মানি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। ফলে ২ কোটি ডলার শ্রীলঙ্কায় যাওয়ার আগেই আটকানো সম্ভব হয়। টাকা তো আটকালো জার্মান ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক কী করে শ্রীলঙ্কা থেকে এই টাকা উদ্ধার করল? ‘টাকা শ্রীলঙ্কায় যায়নি’-শ্রীলঙ্কান গণমাধ্যমে এই সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো বক্তব্য দেয়নি।

০৩. বাংলাদেশ ব্যাংক ঘটনার দায় ‘ফেড’র ওপর চাপাতে চেয়েছে। যা ইতোমধ্যে অসত্য হিসেবে প্রায় প্রমাণ হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কায় টাকা যায়ইনি, অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করছে তারা শ্রীলঙ্কা থেকে টাকা উদ্ধার করেছে। ১ মাস ২ দিন পরে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন ‘অসত্য’ ‘বিভ্রান্তিকর’ ‘রহস্যজনক’ তথ্য দিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করল? ১ মাস ২ দিন সময় তারা কেন নিলেন তদন্তের জন্যে? কী তদন্ত করলেন যে, অসত্য তথ্য দিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিতে হলো?

০৪. যিনি যে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করবেন, ব্যাংকের দুর্বলতা, ভুল বা অসততার কারণে যদি অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরি হয় বা খোয়া যায়, দায়-দায়িত্ব নিতে হবে ব্যাংককে। সারা পৃথিবীজুড়ে এমনই নিয়ম। বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি অনুযায়ী, ‘হ্যাকড’ হয়ে টাকা চুরি হয়েছে ‘ফেড’র বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংক যাবে ‘ফেড’র কাছে, দাবি করবে চুরি হয়ে যাওয়া অর্থ। ‘ফেড’ টাকা উদ্ধারের জন্যে দৌড়াবে চোরের পেছনে। এক্ষেত্রে ঘটেছে সম্পূর্ণ উল্টো ঘটনা। বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ফেড’র কাছে নয়, দৌড়াচ্ছে চোরের পেছনে। তারা গেছে ফিলিপাইনে টাকা ফিরিয়ে আনতে। এর কারণ কী? কারণ এই যে, বাংলাদেশ ব্যাংক শুরু থেকেই নিশ্চিত ছিল ‘ফেড’ থেকে তাদের অ্যাকাউন্ট ‘হ্যাকড’ হয়নি। যা কিছু হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতর থেকে হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিলিপাইনে ছোটাছুটিতেই তা প্রমাণ হয়েছে।

০৫. বাংলাদেশ ব্যাংকের যে কম্পিউটার থেকে ‘সুইফট কোড’ ব্যবহার করে ‘ফেড’-এ সবসময় ‘অ্যাডভাইস’ পাঠানো হয়, সেই কম্পিউটার থেকেই অ্যাডভাইস পাঠানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো যার পাঠানোর কথা তিনি পাঠিয়েছেন, না অন্য কেউ পাঠিয়েছেন? এখানেই ‘হ্যাকড’র প্রশ্ন আসছে। ‘হ্যাকড’ হয়ে টাকা চুরি হয়েছে, যত সরলভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আসলে কী বিষয়টি তেমন? মোটেই তেমন নয়। ধরে নিলাম যে, ‘অ্যাডভাইস’ পাঠানো কম্পিউটার ‘হ্যাকড’ হয়েছিল। হ্যাকাররা অ্যাডভাইস পাঠিয়েছে ফেডে। বিষয়টি এমন নয় যে, অ্যাডভাইস পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে তা ফেডে চলে যাবে এবং টাকা ছাড় করে দেবে। অ্যাডভাইস পাঠানোর পর আরও দুটি সুনির্দিষ্ট কম্পিউটার থেকে তা অনুমোদন করতে হবে। অর্থাৎ অ্যাডভাইস যিনি পাঠানোর জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত, তিনি তার কাজ করার পর আরও দুই ধাপে তা ‘চেক’ হয়। এবং এই দুজন ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন কম্পিউটার। এখন বলা হতে পারে, পুরো ‘সিস্টেমই’ হ্যাকড হয়েছিল! ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্যে এসব কম্পিউটার উন্মুক্ত ছিল (যা থাকার কথা নয়)।

০৬. বাংলাদেশ ব্যাংক পরিষ্কার করে কিছু বলছে না। যদিও নানা সূত্রে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। ফিলিপাইনের গণমাধ্যম, আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সসহ সবাই সংবাদ প্রকাশ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র অনুযায়ী জানা যাচ্ছে, যে অর্থ ছাড় হয়েছে, টাকা ছাড়ের আগে ফেড বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ই-মেইল করে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। উত্তর না পেয়ে একটি নির্দিষ্ট সময় পর ফেড টাকা ছাড় করে দিয়েছে। তথ্যটি যদি সঠিক হয় এক্ষেত্রে প্রশ্ন দু’টি- ক. নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেডের ই-মেইলের উত্তর না দেওয়ার কারণ কী? কেন বাংলাদেশ ব্যাংক উত্তর দিল না? খ. সন্দেহ হওয়ার কারণেই ফেড বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জানতে চেয়েছিল। উত্তর না পাওয়ার পরও কেন ফেড অর্থ ছাড় করে দিল?

০৭. এখানেই বাংলাদেশ, আমেরিকা, ফিলিপাইনে ছুটির প্রসঙ্গ আসছে। হয়ত বলা হবে, ছুটির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেডের ই-মেইলের উত্তর দিতে পারেনি। ডিজিটাল আর্থিক দুনিয়ায় ‘ছুটি’ বলে কোনো শব্দ নেই। ‘২৪ ঘণ্টা কার্যক্রম’ বলে শব্দ আছে এবং তার প্রয়োগ হয় দুনিয়াজুড়ে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব বিভাগেও ২৪ ঘণ্টা লোক থাকে। যখন ফেড থেকে ই-মেইল এসেছে, তখনই বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তা দেখার কথা। তিনি বা তারা কেন দেখলেন না? বলা হতে পারে, ছুটির দিনে লোক থাকে না। এটা কোনোভাবেই হতে পারে না। আর যদি হয়েই থাকে, তবে কতটা অরক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংক!

০৮. উত্তর না পেয়েও ফেড কেন টাকা ছাড় করে দিল? এমন কী নিয়ম আছে যে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উত্তর না দিলে ফেড টাকা ছাড় করে দিতে পারে? যদি নিয়ম থেকে থাকে, তবে তো কিছু করার নেই। নিয়ম না থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। আসলে কী বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু করছে?

০৯. এবার আসি তদন্ত প্রসঙ্গে। ১ মাস ২ দিন পর ভুল তথ্যের বিজ্ঞপ্তি বড় রকমের প্রশ্ন তৈরি করছে তদন্ত বিষয়ে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার প্রায় দুই মাস হতে চলল। এখন বলা হচ্ছে ‘৩টি আইডি’ শনাক্ত করা হয়েছে। ৩টি আইডি শনাক্ত করতে দুই মাস সময় লাগল? কোন ৩টি আইডি থেকে অ্যাডভাইস পাঠানো হয়েছে, এটা তো প্রথম দিনই জানার কথা। কে পাঠিয়েছে সেটা জানতে হয়ত সময় লাগতে পারে। ‘৩টি আইডি’ শনাক্ত হয়েছে- এর মধ্য দিয়ে প্রশ্ন আসে, আদৌ কি কোনো তদন্ত হচ্ছে?

১০. র‌্যাবের গোয়েন্দা ও সাইবার অপরাধ বিষয়ক দল ও তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সাইবার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তারা সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ করে দেখছেন। এই দলের সদস্য তানভীর হাসান একাত্তর টেলিভিশনকে বলেছেন, ‘মূল সমস্যাটা বাংলাদেশ ব্যাংকের লোকাল সার্ভার থেকে হয়েছে। অ্যাডভাইসগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার থেকেই পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারের নিয়ন্ত্রণ কীভাবে হ্যাকাররা নিল, সেটা আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।’ এই তদন্ত দলের অনুসন্ধানে জানা গেছে, জানুয়ারির ২৪ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার হ্যাকারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক তা জানতে পারে দু’সপ্তাহ পরে, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। বিস্ময়করের চেয়েও বেশি কিছু এই যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিভাগের দুই সপ্তাহ সময় লাগল এটা বুঝতে যে, তাদের সার্ভার হ্যাকড হয়েছে! এ বিষয়ে তানভীর হাসান বলেন, ‘ফেডারেল ব্যাংক বারবার বলেছে, অ্যাডভাইস বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো উত্তর আসেনি। তাহলে এই সুইফট কোড বা অ্যাডভাইসের যে বিষয়টি তা কীভাবে সংগঠিত হলো, এই বিষয়টি খুবই সন্দেহজনক, আমাদের মনে এখানে অনেক প্রশ্ন জাগ্রত হয়েছে। এই সার্ভারের যিনি ডাটাবেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর তিনি কখনোই এই জাতীয় হ্যাকিং, এই জাতীয় অর্থ কেলেঙ্কারির দায় এড়াতে পারেন না। এটা উনার ব্যর্থতা, উনার সার্ভার কীভাবে লোকাল হোস্ট কন্ট্রোল করে ফেলল, কীভাবে আইডি হ্যাক হলো, উনাদের মনিটরিংটা তাহলে কী ছিল? আন্তর্জাতিক গেটওয়ের ভেতরে, এতগুলো অর্থ লেনদেন হচ্ছে, আমাদের বাংলাদেশে, আমাদের রিজার্ভ ব্যাংকের বিষয়, এ বিষয়ে অবশ্যই নিরাপত্তা উদাসীনতা আমাদের কাছে স্পষ্টত দৃশ্যমান হয়েছে।’ নিরাপত্তা বিষয়ে তানভীর হাসান বলেন, ‘এখানে কোনো ‘ফায়ার ওয়াল’ বা ইউটিএফ কোনো কিছু ইনস্টল করা ছিল না। এটা খুবই বিস্ময়কর! বর্তমানে একটা প্রাইভেট ব্যাংকের ডাটা সেন্টারগুলোতেও যে স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে তাও করা হয়নি। কেন ফায়ার ওয়াল বা ইউটিএফ ইনস্টল করা হয়নি?’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার স্থাপনে ফিলিপাইনের বেশ কয়েকজন কাজ করেছিল। চুরি হওয়া অর্থেরও প্রায় পুরোটা গেছে ফিলিপাইনে। তদন্ত দলের কাছে এটাও একটা বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে।

১১. স্থানীয় এই তদন্ত দলের বাইরে পুরো তথ্য-প্রযুক্তির বিষয়টি তদন্তের জন্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়োগ দিয়েছে বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ভারতীয়-আমেরিকান রাকেশ আস্তানার প্রতিষ্ঠানকে। তার মৌখিক পরামর্শে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সফটওয়্যার পরিবর্তন করা হয়েছে। পুরনো সফটওয়্যারের তথ্য এসব কম্পিউটারে থাকবে না বা নেই। তদন্তের জন্যে ‘ব্যাকআপ’ রাখার কথা। রাখা হয়েছে কিনা নিশ্চিত করে জানা যায়নি। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ফিলিপাইনের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে কেন সার্ভার স্থাপন করতে হলো? রাকেশ আস্তানার মতো একজন বিদেশিকে কেন রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হলো? প্রশ্ন করেছিলাম তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপনকে, রাকেশ আস্তানা মানের বা তার চেয়ে ভালো মানের বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ কী নেই? আমরা যে গল্প শুনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রযুক্তিবিদরা কাজ করেন? তাহলে কী এগুলো গল্প, সত্যি নয়? সত্যি হলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখার দায়িত্বে বিদেশি কেন? ‘রাকেশ আস্তানা মানের বা তার চেয়ে ভালো বাংলাদেশি প্রযুক্তিবিদ অনেক আছেন। খোঁজ করলে দেখা যাবে ফেডারেল ব্যাংকেও হয়ত বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন। সিলিকন ভ্যালিতে তো আছেনই। আমাদের অনেক ভালো মানের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আছেন। এগুলো গল্প নয়, বাস্তব সত্য। সাধারণত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজের দেশের বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগানো হয়। রাকেশ আস্তানাকে কেন, কোন শর্তের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তা জানি না। এখানে বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো সংস্থার অর্থে কাজ হচ্ছে কিনা, তাদের অর্থ অনুযায়ী বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কিনা জানি না।’

১২. রাকেশ আস্তানার প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাকেশ আস্তানা নিয়োগ করেছে ‘ফায়ার আই’কে। তার মানে কী রাকেশ আস্তানা বা তার প্রতিষ্ঠান এই ঘটনা তদন্তে সক্ষম নয়? তাই তারা তৃতীয় আর একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছে? কোন শর্তে, কোন যোগ্যতায় রাকেশ আস্তানার প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করা হয়েছে? প্রয়োজন অনুযায়ী ‘ফায়ার আই’ বা পৃথিবীর অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়োগ করছে না কেন? কেন ভায়া রাকেশ আস্তানার প্রতিষ্ঠান? ১

১৩. গত কয়েক দিনে সিলিকন ভ্যালিতে কর্মরত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কয়েক দফা আলাপ হলো। অফিসিয়াল অনুমতি ছাড়া তারা স্বনামে কথা বলতে পারেন না। তারা যা বললেন তার সংক্ষিপ্ত রূপ এমন-

ক. রাকেশ আস্তানাকে নিয়োগ দেওয়াটা রহস্যজনক।
খ. এ ধরনের বড় অর্থ চুরির আগে হ্যাকাররা ছোট ছোট কিছু চুরি করে থাকে। একবারে বড় চুরি করেছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ছোট চুরি আগে করেছে, তা বিশ্বাসযোগ্য। আর এটা প্রচলিত ‘হ্যাকড’ না। এটা স্রেফ চুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক সার্ভারের দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সিসি ক্যামেরা অকেজো থাকা, লগ ইন তথ্য না থাকা... চুরির প্রমাণ বহন করছে, হ্যাকিংয়ের নয়।
গ. ১ মাস ২ দিন গোপন রাখার মানে হচ্ছে পুরো বিষয়টি চাপা দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল। সেভাবেই সবকিছু আগাচ্ছিল। ছোট ছোট চুরির বিষয় হয়ত চাপা দিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছেও। এর আগেও যে এমন আরও চুরি হয়নি, তাও বলা যাচ্ছে না। এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সব পরিকল্পনায় বাধা তৈরি করেছে মূলত ফিলিপাইনের ‘ইনকোয়ারার’ পত্রিকা। তা না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক পুরো বিষয়টি চাপা দিয়ে দিতে পারত। এ বিষয়ে ফেড কোনো প্রশ্ন তুলত না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যাওয়া অ্যাডভাইসের মাধ্যমে যেহেতু ফেড টাকা ছাড় করেছে, ফলে এখানে তাদের কোনো দায় নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশ্ন না তুললে, পরে কোনো দিন হয়ত এটা প্রকাশ হতো অথবা হতো না।
ঘ. আমাদের দেশের সব কিছুর মধ্যে রাজনীতি খোঁজা হয়। এক্ষেত্রেও হচ্ছে। প্রচারণা চলছে, বাংলাদেশের সুইফট কোড ভারত থেকে পরিচালনা করা হয়। আসলে বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। এশিয়ায় সুইফটের একটি অফিস আছে দুবাইতে, আরেকটি আছে মুম্বাইতে। সম্ভবত সুইফটের মুম্বাই অফিসের সঙ্গে বাংলাদেশ কাজ করে। অফিস মুম্বাই হলেও, এর সঙ্গে ভারতের কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সবকিছু পরিষ্কার করে না বললে, আরও রহস্য এবং গুজব তৈরি হবে।
ঙ. রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দায়িত্ব, আর্থিক খাতের নিরাপত্তার দায়িত্ব পৃথিবীর কোনো দেশ কোনো বিদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেয় না। বাংলাদেশের আইটি বিশেষজ্ঞ কেন বিদেশ থেকে আনতে হচ্ছে, আনা হয়েছে- এটা সত্যি আমাদের কাছে বিস্ময়কর প্রশ্ন! আমরা, আমাদের বিশেষজ্ঞরা পৃথিবীর সর্বত্র কাজ করছে, যোগ্যতা-দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। অথচ নিজের দেশের কাছে তারা উপেক্ষিত থাকছে।

১৪. বাংলাদেশের মানুষের ভেতরে এক ধরনের অদ্ভুত রকমের নির্লিপ্ততা লক্ষণীয়। আমাদের দেশপ্রেম এখন সম্পূর্ণরূপে ক্রিকেটনির্ভর হয়ে পড়েছে। আপনি ফেসবুকের প্রোফাইল ক্রিকেটময় করলেন না, সুতরাং আপনি দেশপ্রেমিক নন। যারা দেশপ্রেমের এসব সার্টিফিকেট বিতরণ করছেন, তারা কিছু বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। কেউ কেউ আবার কিছু প্রশ্নও তুলছেন।

ক. বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ৮০৮ কোটি টাকা চুরি নিয়ে তাদের কোনো উদ্বেগ নেই। আগে ‘তদন্ত’ হোক, তদন্তের প্রতি তাদের গভীর আস্থা!
খ. কমপক্ষে ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচারও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এ বিষয়ে কথা না বললেও তাদের দেশপ্রেমে ঘাটতি হয় না। দেশপ্রেমের সকল সম্পর্ক শুধু ক্রিকেটের সঙ্গে।
গ. কেউ কেউ আবার বলছেন, অর্থনীতির অবস্থা যেহেতু ভালো, সুতরাং এমন কিছু ঘটনা ঘটতেই পারে। বেশ ভালো যুক্তি! হাততালি দিয়ে স্বাগত জানানো যেতেই পারে। ঘ. সুন্দরবন ধ্বংসের প্রতিবাদ করলে দেশপ্রেম প্রশ্নের মুখে পড়ে। নির্লিপ্ত থাকলেই আপনি দেশপ্রেমিক।

১৫. যারা অন্যায় করছেন, যারা চুরি করছেন, যারা চুরির সহায়তা করছেন, চুরির ঘটনা চাপা দিতে চাইছেন, কোনো সন্দেহ নেই তারা অপরাধী। যারা সচেতন মানুষ, শিক্ষিত মানুষ বলে নিজেদের দাবি করেন, সমাজের সুযোগ-সুবিধা ভোগকারী এই শ্রেণিটি নীরবতা পালন করে সবচেয়ে বড় অপরাধ করছেন।

গোলাম মোর্তোজা:সাংবাদিক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ৯:৩৭
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×