দেশের কোন সৃজনশীল মানুষের পুরস্কার পাওয়ার খবর শুনলে পুলকিত হই। কারণ এই ধরনের পুরস্কার আমার দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। এবার খবরটি পাঠ করা যাক --
লিনকিন পার্কের স্টুডিওতে বাংলাদেশি তরুণ
গানের দল লিনকিন পার্কের স্টুডিওতে যাচ্ছেন জায়েদ। রক গান দিয়ে বিশ্বের কোটি কোটি তরুণকে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন যাঁরা, তাঁদের স্টুডিওতে কী কাজ তাঁর? তিনি যাচ্ছেন এক দিনের একটি কর্মশালায়। এটা হচ্ছে ‘স্টেজলাইট মান্থলি মিউজিক কনটেস্ট’ প্রতিযোগিতায় সেরা হওয়ার পুরস্কার। যৌথভাবে প্রতিযোগিতাটির আয়োজন করেছিল লিনকিন পার্ক, গিটার সেন্টার ও ওপেন ল্যাব।
সংগীত পরিচালনায় মাস্টারিং, আরও সূক্ষ্মভাবে শব্দধারণ ও সংশ্লিষ্ট কাজগুলো তাঁকে হাতে–কলমে দেখিয়ে দেবেন লিনকিন পার্কের শব্দ প্রকৌশলী ও দলের সদস্যরা।
গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। নতুন সুর তৈরি করে সাউন্ডক্লাউডে আপলোড করেছিলেন প্রতিযোগীরা। লিনকিন পার্ক আন্ডারগ্রাউন্ড নামের একটি গ্রুপ সেগুলো থেকে বাছাই করেছে সেরা গান। এভাবে প্রতি মাসে শত শত প্রতিযোগীর মধ্য থেকে বেছে নেওয়া হয়েছিল একজন করে প্রতিযোগীকে। পুরস্কার হিসেবে সেই ১২ জনকে দেওয়া হয়েছে তিন হাজার ডলার সমমানের গানের যন্ত্রপাতি। আর ১২ মাসে বিজয়ী ১২ জনের মধ্য থেকে সেরা নির্বাচিত হয়েছেন জায়েদ। পুরস্কার হিসেবে গান কম্পোজের জন্য তিনি পাচ্ছেন একটি হাইব্রিড কম্পিউটার। আর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে প্রিয় ব্যান্ডের স্টুডিওতে গিয়ে কাজ শেখার সুযোগ। আয়োজকেরাই বহন করবেন সব খরচ।
অনেক দিন ধরে সংগীত পরিচালনা করছেন জায়েদ হাসান। তাঁর সব কাজই অবাণিজ্যিক। সেসব বিনা মূল্যে অনলাইনে শোনার জন্য করা। শব্দ প্রকৌশলী জায়েদ হাসান সংগীত পরিচালনা করেন মূলত ভিন ভাষার গায়কদের জন্য। ‘স্টেজলাইট মান্থলি মিউজিক কনটেস্ট’ প্রতিযোগিতার জন্য তাঁর সুর ও সংগীতায়োজনে ‘দ্য ওয়ে আই লাভ’ গানটি গেয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার শিল্পী হানা।
জায়েদ বলেন, ‘শ্রোতার কাছে গানটা পৌঁছালেই আমি খুশি। যাঁদের গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, তাঁদের সঙ্গে কাজ শেখার একদিনের সুযোগ পাওয়া আমার জন্য অবিশ্বাস্য ব্যাপার।’
তাঁর মতে, এটি একটি বিরল সুযোগ। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তো বটেই, ভারত-পাকিস্তান থেকেও বহু তরুণ সংগীত পরিচালক এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন।
জায়েদকে অভিনন্দন জানিয়ে লিনকিন পার্ক তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ, লিংকড ইন এবং ইনস্টাগ্রামে প্রতিযোগিতার ফল আপলোড করেছে।
শিগগিরই জার্মান রেডিও অপোতে (AUPEU) প্রচারিত হবে জায়েদের সুর ও সংগীতায়োজনে করা গানগুলো।
কেমন হওয়া উচিত জাতীয় পুরস্কার ?
উপরের খবরে আমি সবচেয়ে খুশি হয়েছি পুরস্কারের ধরন দেখে। প্রতি মাসে যারা সেরা নির্বাচিত হয়েছে তাদেরকে দেয়া হয়েছে তিন হাজার ডলার সমমানের গানের যন্ত্রপাতি। অন্য দিকে বছরের সেরা হওয়ায় জায়েদকে লিনকিন পার্ক দিচ্ছে একটি হাইব্রিড কম্পিউটার -- যা তার সঙ্গীত কম্পোজ করার জন্য খুব কাজে লাগবে। তার মানে হল, তারা পুরস্কার হিসেবে এমন একটা যন্ত্র বেছে নিয়েছে যা জায়েদের সৃজনশীল কাজকে খুব দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারা প্রকৃতপক্ষেই জায়েদকে পুরস্কৃত করছে । পুরস্কৃত করছে জায়েদের সৃজনশীলতাকে । এমন পুরস্কার দিচ্ছে যা জায়েদের সৃজনশীল কাজটাকে নতুন গতি দেবে। সৃজনশীল পুরস্কার এই রকমই হওয়া উচিত।
এবার আমাদের জাতীয় পুরস্কারের কথায় আসা যাক।
আমি চলচ্চিত্রের মানুষ। তাই চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কার নিয়ে কথা বলি। বাংলাদেশে যতগুলো জাতীয় পুরস্কার দেয়া হল তার মধ্যে সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার হল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ১৯৭৫ সাল থেকে এই পুরস্কার দেয়া হচ্ছে।
আমাদের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের অর্থমূল্য কত ?
এই প্রশ্ন শুনলে অনেকে বিরক্ত হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে জীবন কেবল পুরস্কার দিয়ে চলে না। জীবনযাপনের জন্য অর্থ দরকার হয়। ভালো সৃজনশীল কাজের জন্যও অর্থের দরকার হয়। আর চলচ্চিত্র শিল্পের মতো ব্যয়বহুল মাধ্যমে কাজ করতে হলে অর্থের দরকার আরও বেশি।
আমাদের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের অর্থ মূল্য এই রকম ---
০১) আজীবন সম্মাননা - ১ লক্ষ টাকা
০২) শ্রেষ্ঠ পরিচালক - ৫০ হাজার টাকা
০৩) অন্যান্য ক্যাটাগরি - ৩০ হাজার টাকা
গত ৩রা এপ্রিল চলচ্চিত্র দিবসে এফডিসিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর একটা দারুণ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালকের জন্য সবচেয়ে ভালো পুরস্কার হল পরবর্তী চলচ্চিত্র নির্মাণের সম্ভাব্য ব্যয়ের সমান নগদ টাকা তাকে প্রদান করা। টাকার অংকে এটা দাঁড়ায় মাত্র দেড় কোটি টাকা। এই পরিমাণ টাকা দিলে শ্রেষ্ঠ পরিচালক কোন সময় নষ্ট না করে তার পরবর্তী চলচ্চিত্রের কাজে হাত দিতে পারবে।
সংস্কৃতি মন্ত্রী অবশ্য প্রস্তাব করেন, তিন কোটি টাকা বিনিয়োগ করার । প্রথম জন পাবে দেড় কোটি এবং বাকি দুজন পাবে ৭৫ লাখ টাকা করে। পরের দু’জন হবেন তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক যার একজন পুরুষ এবং অপর জন নারী।
তিনি বলেন, আমাদের রাষ্ট্রের জন্য এই তিন কোটি টাকা কোন টাকাই না। কিন্তু মাত্র ৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে আমাদের চলচ্চিত্রের মেধাবী মানুষগুলোকে নতুন নতুন কাজ করার সুযোগ দেয়া সম্ভব। এই সুযোগের ফলে মাত্র ১০ বছরে আমাদের চলচ্চিত্রের চেহারা বদলে যাবে।
সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের প্রস্তাবটি খুবই বাস্তবসম্মত। খেয়াল করেন, আমাদের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালকরা চলচ্চিত্র বানান অনেক দিন পর পর। কারণ তাদের প্রযোজক যোগাড় করতে ঘাম ছুটে যায়। অথচ তারা পরবর্তী চলচ্চিত্র বানানোর টাকা পেলে একের পর এক চলচ্চিত্র বানিয়ে যেতে পারতেন।
এবার আমার কথা।
আমি মনে করি, একজন শিল্পীকে পদক দেয়ার পাশাপাশি কাজের জন্য যন্ত্রপাতি কিনে দেয়া বেশি কাজের। যেমন একজন ক্যামেরাম্যানকে একটা নতুন ক্যামেরা কিনে দেয়া। একজন সম্পাদককে নতুন এডিটিং প্যানেল কিনে দেয়া। একজন সঙ্গীত পরিচালককে তার প্রয়োজনীয় স্টুডিও নির্মাণে যন্ত্রপাতি কিনে দেয়া। টাকার অভাবে অনেক সৃজনশীল মানুষ তার চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যোগাড় করতে পারেন না। প্রযুক্তিভিত্তিক কাজের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি সত্য।
বেসরকারী পর্যায়ে যারা পুরস্কার দেন, তাদের বাজেট কম, তারা হয়তো কেবল একটা পদক বা সার্টিফিকেট দিতে পারেন। কিন্তু সরকারী পর্যায়ে কেবল পদক বা সার্টিফিকেট না দিয়ে সংশ্লিষ্ট শিল্পীকে কাজের জিনিস কিনে দিলে তার কাজের মান আরও ভালো হবে। কেবল তাকে উৎসাহিত করা নয়, তার কাছ থেকে ভবিষ্যতে আরও ভালো কাজ বের করে আনা যাবে।
যেমন সঙ্গীত কম্পোজ করার জন্য গানের দল লিনকিন পার্ক জায়েদকে দিচ্ছে হাইব্রিড কম্পিউটার। তার পাশাপাশি তারা জায়েদকে একটা কর্মশালা করার সুযোগ দিচ্ছেন । একজন সৃজনশীল মানুষের জন্য এর চেয়ে সেরা পুরস্কার আর কিছুই হতে পারে না।
লিনকিন পার্কের স্টুডিওতে বাংলাদেশি তরুণ
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৮