আমাদের দেশে সিনেমা নির্মাণের জন্য দক্ষ জনবল গড়ার লক্ষ্যে গত শতাব্দীর ৬০ এর দশক থেকে চলচ্চিত্র কর্মীরা একটি সরকারী ফিল্ম ইনস্টিটিউট গড়ার দাবী জানিয়ে আসছিলেন।
২০১৩ সালের ১ নভেম্বর সেই স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। ২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের প্রথম ব্যাচের ক্লাস ও প্রতিষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে আমার সেই ঐতিহাসিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল।
আগামী ১ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে এই স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটির ৫ বছর পূর্তি হবে। এই ৫ বছরে অনেক অর্জন আছে প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, সিনেমা এখন একটি গ্লোবাল প্রোডাক্ট। সেই হিসেবে ফিল্ম ইনস্টিটিউটকেও বিশ্বমানের হতে হবে। নইলে এই প্রতিষ্ঠান থেকে যারা পড়াশোনা করে বেরুবে তারা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হবেন না। আর তারা ব্যর্থ হলে প্রকারান্তরে প্রতিষ্ঠানটিও ব্যর্থ বলে বিবেচিত হবে। তাই এখনই সময় বিসিটিআইকে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার।
বিসিটিআইকে কিভাবে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়া যায় ? আমার কিছু প্রস্তাব আছে । একদম নির্মোহ কিছু প্রস্তাব।
০১) শিক্ষার্থী সংগ্রহের পদ্ধতি বদলাতে হবে। পত্রিকায় বড় করে রঙিন গ্রাফিক ডিজাইন করে বিজ্ঞাপন দিতে হবে যাতে করে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। শুধু দেশীয় শিক্ষার্থী নয়, বিদেশী শিক্ষার্থীদেরও ভর্তি হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। প্রতিষ্ঠানটিকে গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
০২) অতি দ্রুত নিজস্ব ভবন তৈরি করে সব শিক্ষার্থীকে হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষাটা হবে ২৪ ঘণ্টার। প্রতিষ্ঠানটা হবে পুরোপুরি আবাসিক। কেবল শিক্ষার্থীদের নয়, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও আবাসিক সুবিধা দিতে হবে।
০৩) একটা উদাহরণ দিয়ে কথাটা বলি। নইলে অনেকে রাগ করবেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটে বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করার জন্য আমরা কোচ হিসেবে বিশ্বখ্যাত বিদেশী কোচদের নিয়োগ দিয়েছিলাম। তাদের পেছনে অনেক টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু ফলাফলও ভালো পাওয়া গেছে। যদি সত্যি বাস্তব কাজ জানা শিক্ষার্থী তৈরি করতে হয়, তবে বিসিটিআই প্রধান নির্বাহীসহ বিভিন্ন শিক্ষকদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আনা যেতে পারে। ওতে করে আমাদের জানাশোনার পরিধি আরও বাড়বে এবং বিসিটিআই-এর পড়াশোনার মান বিশ্বমানের হবে। আর বিশ্বমানের পড়াশোনা না হলে এটা তৈরি করার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ। সিনেমা কোন লোকাল প্রোডাক্ট না, এটা এখন গ্লোবাল প্রোডাক্ট।
০৪) প্রধান নির্বাহী পদে আমলা নয়, বরং কোন বিশ্বখ্যাত ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষককে নিয়োগ দিতে হবে। টাকা খরচ করলে বিশ্বমানের একজন মানুষকে খুঁজে বের করা খুব কঠিন কিছু নয়।
০৫) বিদেশী শিক্ষকদের পাশাপাশি যারা বাংলাদেশী শিক্ষক থাকবেন, সরকারী নিয়োগবিধি অনুসারে তাদের ফুলটাইম নিয়োগ দিতে হবে। ফুলটাইম নিয়োগ না দিলে কেউ যত্ন করে পড়াবেন না।
০৬) সিনেমা নির্মাণ করতে হলে প্রচুর কারিগরি যন্ত্রপাতি দরকার হয়। বিসিটিআই-তে প্রচুর কারিগরি যন্ত্রপাতির ঘাটতি আছে। সিনেমা নির্মাণের আধুনিক সকল প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করতে হবে। এ বিষয়ে বিসিটিআইকে পরিপূর্ণ আত্মনির্ভরশীল হবে । যন্ত্রপাতি হাতের কাছে না থাকলে কেবল বই পড়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ শেখা যায় না।
০৭) কেবল যন্ত্রপাতি কেনা নয়, সেগুলো যথার্থ পরিচালনার জন্য কারিগরি জ্ঞানসমৃদ্ধ লোকজনও নিয়োগ দিতে হবে। দরকার বোধ করলে নিয়োগ দেয়ার পর তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে।
০৮) কেবল বই পড়ে শিক্ষা গ্রহণের সনাতন পদ্ধতি বাদ দিতে হবে। বরং সিনেমা নির্মাণটাকে বেশি গুরুত্ব দিলে হাতে কলমে শিক্ষা হবে । এই হাতে কলমে শিক্ষা শিক্ষার্থীকে বিশ্বমানের একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
০৯) শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো বিসিটিআই নিজ উদ্যোগে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠাবে। এই কাজটি করার জন্য একটি আলাদা ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
১০) বিসিটিআই-এর উদ্যোগে প্রতি বছর একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করতে হবে। এই কাজটির জন্যও একটা আলাদা ডিপার্টমেন্ট থাকতে হবে।
'সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় নবতরঙ্গ' শ্লোগানকে বাস্তব করার জন্য বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান গড়ার কোন বিকল্প নাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১১:৫৮