আজ জাতীয় কবি নজরুলের ১১৬তম জন্মজয়ন্তী
“মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য” অথবা “আমি যুগে যুগে আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু, এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু” এ ঘোষণা আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের।
আজ সাম্যের কবি, বিদ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, বেদনার কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৬তম জন্মজয়ন্তী।
তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। যার সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি করেছিল নবজাগরণ। শোষণ-বঞ্চনা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান নবজাগরণের সৃষ্টি করেছিল।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য গগনে দুর্বার বেগে আবির্ভূত নজরুলকে অভিষিক্ত করে লিখেছিলেন—
“আয় চলে আয়রে ধূমকেতু ,
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু ;
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে,
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন;
অলক্ষণে তিলকরেখা,
রাতের ভালে হোক না লেখা;
জাগিয়ে দেবে চমক মেরে,
আছে যারা অর্ধচেতন।”
“সৃষ্টি সুখের উল্লাসে' এ অমর কবির ভাব ও আদর্শ নতুন প্রজন্মকে নতুন উদ্দীপনায় এগিয়ে নিয়ে যাবে এটাই আমার প্রত্যাশা।
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৪ মে ১৮৯৯) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম ছিল 'দুখু মিয়া'। নজরুলের পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ। মাতা জাহেদা খাতুন। গ্রামের মক্তব থেকে বাল্যশিক্ষা শেষে নজরুল বর্ধমানের নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউটে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। প্রধান শিক্ষক তাকে লেটোর দলে ভর্তি করিয়ে দেন। এ সময় তিনি কবিতা, গান, পাঁচালী ও প্রহসন লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু তীব্র অর্থ সংকটের কারণে এসময় তার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। তিনি আসানসোলের এক বেকারিতে কাজ শুরু করেন। লেখাপড়ার প্রতি নজরুলের আগ্রহ দেখে ও তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে দারোগা রফিকউল্লাহ নজরুলকে সাথে নিয়ে ময়মনসিংহে আসেন এবং দরিরামপুর হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দেন। এখানে প্রায় এক বছর লেখাপড়া করার পর নজরুল সিয়ারসোল হাই স্কুলে গিয়ে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এখানে তিনি দশম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে নজরুল ১৯১৭ সালে পল্টন রেজিমেন্টে যোগদান করেন। সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম গল্প 'বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী' (১৯১৯) প্রকাশিত হয়। একই বছর বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতা 'মুক্তি'। ১৯২০ সালে তিনি সেনাবাহিনী ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। এসময় নজরুলের শুরু হয় সাংবাদিকতা ও সাহিত্য জীবন। তিনি 'নবযুগের' যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯২২ সালে তার ঐতিহাসিক 'বিদ্রোহী' কবিতা প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্য জগতে বিপুল সাড়া পড়ে যায়। কাজী নজরুল ইসলামের কবিখ্যাতি দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। নজরুল হয়ে ওঠেন স্বাধীনতা ও বিদ্রোহের প্রতীক। কিন্তু লেখনীর কারণে কবিকে বারবার ব্রিটিশ শাসকের কোপানলে পড়তে হয়। এসময় একাধিকবার ব্রিটিশ সরকার কবিকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। বাজেয়াপ্ত করে তার অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা 'ধূমকেতু' ও প্রবন্ধ গ্রন্থ 'যুগবাণী'। ১৯২৩ সালে তিনি কারামুক্ত হন। ১৯২৪ সালে কবির নতুন কাব্যগ্রন্থ 'বিষের বাঁশি' ও 'ভাঙ্গার গান' প্রকাশের পরপরই ব্রিটিশ সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে। ১৯২৬ সাল থেকে তিনি গজল রচনা শুরু করেন। ১৯৪২ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ক্রমশ বাকরুদ্ধ হন। ১৯৪৫ সালে কবিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'জগত্তারিণী স্বর্ণপদক' প্রদান করা হয়। ১৯৫৩ সালে তাকে চিকিৎসার জন্য ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়, কবি আর সুস্থ হয়ে ওঠেননি। ১৯৬৯ সালে কবিকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক 'ডি-লিট' ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৬০ সালে কবিকে ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব 'পদ্মভূষণ' প্রদান করা হয়। ১৯৭২ সালের ২৪ মে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে সপরিবারে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক 'ডি-লিট' ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৭৬ সালে সরকার কবিকে 'একুশে পদক' প্রদান করেন।