somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিরোনাম দেবার জন্য কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হয়!

১৮ ই আগস্ট, ২০১৩ সকাল ৮:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে আসন্নপ্রসবা মমতাজ বেগমের পেটে থাকা ৯ মাসের শিশু হয়েছে খুন। সম্ভ্রম হয়েছে লুট। আর ক্ষতবিক্ষত প্রজনন অঙ্গ ও পায়ুনালী হয়েছে চিরতরে বিকলাঙ্গ। অনাহার আর অর্ধাহারকে সঙ্গী করে পেটের মধ্যে লাগানো কৃত্রিম পায়ুনালীর অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে মমতাজ বেগম পার করেছেন ৪০টি বছর। আরও কত যে করবেন, তা তার জানা নেই!

তাই, প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসটি আসে মমতাজের জীবনের এক দুর্বিসহ স্মৃতির বোঝা নিয়ে। আজ থেকে ৪০ বছর আগে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঝড়ো হাওয়া তার জীবনটি ওলটপালট করে দিয়ে যায়। প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই ঝরে যায় তার জীবনের সব স্বপ্ন-সাধ-আহ্লাদ। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের নিরব সাক্ষী অমানুষিক নির্যাতনের শিকার ‘বীরাঙ্গনা’ মমতাজের কাহিনী জানতে হলে যেতে হবে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গোসিঙ্গার লতিফপুর তালতলা গ্রামে।

এখানে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ঘেঁষা লতিফপুর গ্রামের মেয়ে মমতাজ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মমতাজের বয়স ছিল ১৭ বছর। তখন তিনি ছিলেন ২ কন্যা সন্তানের জননী। মাত্র ১০ বছর বয়সে মমতাজের বিয়ে হয় একই গ্রামের দরিদ্র কৃষিশ্রমিক কাছম আলী মোড়লের ১১ বছরের ছেলে রমিজ উদ্দিন মোড়লের সঙ্গে। ‘ছোট বলে আড়াই বছর পর রমিজ আমাকে তার ঘরে তোলেন। রমিজ আর আমি আমাদের ২ কন্যাশিশুকে নিয়ে একরকম সুখেই ছিলাম। সংসারে অভাব ছিল। কিন্তু, নারকেল-সুপারি বাগানে ঘেরা ছোট্ট ঘরে আমাদের কোনো অশান্তি ছিল না’- বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মমতাজ।

তখন ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। আলাদা যুদ্ধ ক্ষেত্র বলতে কিছু ছিল না। সারা দেশই তখন রণাঙ্গন। শহর, গ্রামগঞ্জ, সর্বত্রই যুদ্ধ চলছে পাকিস্তানি খান সেনাদের সঙ্গে। স্বাধীনতার সৈনিক মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা হামলায় দিশেহারা পাকিস্তানি সেনা আর তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তিকমিটির সদস্যরা নির্মম আক্রোশে এ দেশের নারী-পুরুষকে শুধুমাত্র নির্বিচারে হত্যাই করেনি, জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে তারা নারীদের শ্লীলতাহানিও শুরু করে। এমনি এক নির্মম ও হৃদয়বিদারক ঘটনার শিকার হন মমতাজ।

সেই ভয়ঙ্কর দিনটির কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে মমতাজের। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৭ জুন। চাঁটাইয়ের বেড়া আর ছনের ছাউনির ঘর থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি খান সেনারা।
বন্দুকের মুখে তাকে নিয়ে যায় পাশের এক সেতুর কাছে। তখন তিনি ছিলেন ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। দল বেঁধে নরপিশাচের দল তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। শত অনুনয়, বিনয় কোনো কিছুই তাদের সহানুভূতি কাড়তে পারেনি।

পালাক্রমে ধর্ষণ করার পর তার কী হয়েছে, তা আর কিছুই মনে নেই মমতাজের। শাশুড়ির আহাজারিতে যখন জ্ঞান ফেরে, তখন তিনি নিজেকে দেখতে পান বাড়ির উঠোনে চাটাইর ওপর শুয়ে আছেন। ছোপ ছোপ রক্তাক্ত শরীরকে তিনি আর নড়াতে পারছিলেন না। অসহ্য যন্ত্রণায় বুকের নিচ থেকে শরীরটি তখন অবশ হয়ে গেছে। চোখ মেলে দেখেন তার স্বামী রমিজ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। কারো কারো চোখে পানি। আর শাশুড়ি তখন বুক চাপড়িয়ে বিলাপ করছেন, ‘হতভাগী তুই মরলি না ক্যান, অহন তোরে লইয়া আমরা কি করমু? কই যামু ক?’ আবার জ্ঞান হারান মমতাজ। পরে প্রতিবেশী কয়েকজন নারী মমতাজের গর্ভ থেকে টেনে টেনে বের করে আনেন এক মৃত পুত্র সন্তান। কিন্তু, শিশুটির দেহের একটা অংশ থেকে যায় পেটের ভেতরেই। ক্ষত-বিক্ষত পায়ুনালী আর যৌনাঙ্গ দুটি তখন একাকার হয়ে গেছে!

এই দুঃস্বপ্ন তিনি গত ৪০ বছর ধরে দেখছেন। তার মনে হয়, শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। এক মুহূর্তের জন্যও পবিত্র রাখতে পারেননি তার শরীর। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে এতগুলো বছর কেটে গেছে তার। মমতাজ জানালেন, ‘একটি রাতের জন্যও ঘুমাতে পারিনি। কানে শুনি না। ঝাঁপসা হয়ে গেছে চোখ। কোনো কাজ করতে পারি না।’ একাত্তুরের সেই দিনগুলির কথা মনে করে মমতাজ বেগম জানান, সারাদিন অন্যের বাড়িতে কৃষি কাজ করে এসে প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্বামী রমিজ উদ্দিন শীতলক্ষ্যার জলে তার রক্তাক্ত জামা কাপড় ধুয়ে দেন। ইচ্ছে করলে তিনি তখনই মমতাজকে ছেড়ে দিতে পারতেন। কিন্তু, ভালোবাসার এই মানুষটিকে বুকে আগলে রাখেন রমিজ।

কৃষিশ্রমিক রমিজ উদ্দিন গরিব হলেও স্ত্রীকে তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। আজও সেই বন্ধন রয়েছে অটুট! মহৎপ্রাণের অধিকারী রমিজ উদ্দিনের নিজস্ব জমি বলতে তেমন কিছুই নেই। যা আছে, তা বিক্রি করে এবং হাড়ভাঙা পরিশ্রমের টাকা দিয়ে গত ৪০ বছর ধরে স্ত্রীর চিকিৎসাসেবা করে চলেছেন তিনি। নির্যাতনে মমতাজের পায়ুনালী ও যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত এবং ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে স্থায়ীভাবে। তাকে ৫ বার অপারেশন করেও সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বিকল্পভাবে তলপেটে পায়ুনালী স্থাপন করে কৃত্রিম পাইপ দিয়ে মলত্যাগ করছেন ৪০ বছর।

কিন্তু, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের দলিলপত্রে মমতাজের ঠাঁই হয়নি কোথাও। কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদও ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি তাকে। কারণ, অভিশপ্ত জীবনের গ্লানি আর বোঝা বয়ে বেড়ানো নিরক্ষর মমতাজের সাধ্যে কুলায়নি কোনো তদবির করার। বিজয় দিবস আসে আর যায়! স্বাধীনতা দিবস আসে আর যায়! কিন্তু মমমতাজের খবর নেয় না কেউ! ৪০ বছরে মাত্র ২ বার উপজেলার পক্ষ থেকে বিজয় দিবসের দাওয়াত পেয়েছেন বলে জানান মমতাজ।

২০০৬ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাশিদা ফেরদৌস তাকে ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন বলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন তিনি। রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওনা বলতে এটুকুই পেয়েছেন বলে জানান। বয়েসের ভারে নুয়ে পড়া মমতাজকে এখনও প্রতিদিন প্রায় ২শ টাকার ওষুধ খেতে হয়। বৃদ্ধ স্বামীকে অতিকষ্টে জোগাড় করতে হয় এই টাকা। ওষুধের খরচ জোগাড় করতে গিয়ে প্রায়ই উপোস থাকতে হয় মমতাজ দম্পতিকে। গ্লানিকর জীবনের এই যন্ত্রণাদগ্ধ বোঝা আর সইতে পারছেন না তিনি! বেঁচে থাকার আর ইচ্ছাও তার মধ্যে কাজ করে না বলে জানান মমতাজ।
(সুত্রঃ বাংলানিউজ ২৪)
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×