কিছুদিন আগে ব্লগার লেখক পারভেজ আলমের নেয়া সাক্ষাৎকারটি পড়লাম। শুরুতে যতটা আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম ততোটাই হতাশায় ভরে গিয়েছিল মন। প্রথমত, পারভেজ আলমের বাঙলা বলার ধরণ অর্থাৎ উচ্চারণ সব সময়ই আমার কাছে আপত্তিকর মনে হয়েছে। শব্দ দূষণ যাকে বলে সেটা পারভেজ আলমের উচ্চারণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সাক্ষাৎকারটির প্রথম খণ্ড পড়ে নতুনত্ব খুঁজে পায় নি তবে কিছু আপত্তিকর বাক্য পেয়েছি। সাক্ষাৎকারটি নিয়ে মুক্তমনাদের সাথে বামঘরোনার মানুষদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা লক্ষ্য করলাম। উত্তেজিত হওয়া যে অস্বাভাবিক ছিল তাও নয়। তবে গুটিকয়েক মুক্তমনা মাত্রাতিরিক্ত করেছে এটাও স্বীকার করছি।
সাক্ষাৎকারটিতে আপনি বলেছেন, আর যখন ভিন্ন কিছু চিন্তা হয়, তখন হয়ে যাচ্ছে নাস্তিকের আস্ফালন। হুমায়ুন আজাদ যেমন নাস্তিকের আস্ফালন করেছেন। আমি তো মনে করি না যে এইটা রাইট পথ। এইটা রাইট পথ নয়। রাইট পথ হইল আমাকে ধর্মগ্রন্থগুলি পড়তে হবে ঠিক যেভাবে আমি অন্য বইগুলি পড়ি”।
প্রিয় যতীন সরকার,
হুমায়ুন আজাদ সম্বন্ধে আপনি যে মন্তব্যটি করলেন সেটা কতটা যৌক্তিক ছিল? হুমায়ুন আজাদ দীর্ঘ ৩৬ বছর শিক্ষকতা করেছিলেন। বাঙলা ভাষার সমৃদ্ধির জন্য তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন। আপনি কী “বাঙলা ভাষা”(১ম ও ২য় খণ্ড) পড়েছেন? কিংবা আপনি কী “বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র” পড়েছেন? আপনি নিজেও শিক্ষকতা করতেন। আমাদের দেশে কেনো একজন শিক্ষক আরেকজন শিক্ষককে সম্মান প্রদর্শন করে না সেটা আজও আমার জানা নেই। আপনি কী হুমায়ুন আজাদের “ভাষা আন্দোলনঃ সাহিত্যিক পটভূমি” পড়েছেন? কিংবা “শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ”? কিংবা “সীমাবদ্ধতার সূত্র” কিংবা “প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে”? কিংবা “রবীন্দ্র প্রবন্ধঃ রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তা” পড়েছেন? ছোটদের নিয়ে লেখা “আব্বুকে মনে পড়ে” কিংবা “ ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না” পড়েছেন? কিংবা “জলপাই রঙের অন্ধরকার”? “পার্বত্য চট্রগ্রাম সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা” পড়েছেন? আপনি কী তার কবিতাগ্রন্থে চোখ বুলিয়েছেন? আপনি কী তার উপন্যাস পড়েন নি? আপনার কাছে কেনো নাস্তিকের আস্ফালন মনে হল?
“আমার অবিশ্বাস” ও “ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য” এই দুটো গ্রন্থই কী আপনার কাছে বেশি মুখ্য হল? আপনি নিজেও একজন নাস্তিক! তাহলে এভাবে বলার কারণটা কি প্রিয় যতীন সরকার? আপনি বলেছেন, “আমি তো মনে করি না যে এইটা রাইট পথ। এইটা রাইট পথ নয়। রাইট পাথ হইল আমাকে ধর্মগ্রন্থগুলি পড়তে হবে ঠিক যেভাবে আমি অন্য বইগুলি পড়ি”। আপনার কী মনে হয় না হুমায়ুন আজাদ ধর্মগ্রন্থগুলি পড়েছিলেন? নাকি আপনি বলতে চেয়েছেন, আপনি নিজে যে পন্থা অনুসরণ করছেন সেটাই রাইট পথ। এমনটাই কিন্তু মনে হচ্ছে প্রিয় যতীন সরকার!
চঞ্চল আশরাফের একটি লেখার কয়েকটি লাইন মনে পড়ছে। তিনি লিখেছেন, “প্রায় সব লেখকের বড় হয়ে ওঠার পেছনে কোনো না কোনোভাবে থাকে তার লেখকবন্ধুর অবদান; তারা তা স্বীকার করেন; ক’রে মানুষ হিসেবে বড় হয়ে ওঠেন। যেমন টিএস এলিয়ট, যিনি এজরা পাউন্ডের অবদানের কথা স্বীকার করেছেন; যেমন উইলিয়াম ফকনার; যিনি তার লেখকবন্ধু শেরউড অ্যান্ডারসনের অবদানের কথা জানাতে ভোলেননি। আমাদের দেশে এই সংস্কৃতি নেই”।
প্রিয় যতীন সরকার আপনাকে বলছি-
আপনি যা বলেছেন তাতে কারা লাভবান হল- একটু ভেবে দেখবেন কিন্তু। আমরা নিজেরা অহমিকা দেখানোর জন্য নিজেদের গোত্রে অবদান রাখা মানুষদেরই অস্বীকার করি! অসাম্প্রদায়িক বাঙলা বিনির্মাণের ক্ষেত্রে যাদের অবদান আছে, শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে যাদের গুরুত্ব আছে, নতুনকে জানার সম্ভাবনা যারা তৈরি করে গেছে- তাদেরকে ছোট করে কাদের হাতে অস্র তুলে দিলেন স্যার? ভেবে দেখবেন।
বামপন্থীরা আজ এই দেশে কোন গতি করতে না পেরে কৌশলী হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তারা কৌশলী হতে গিয়ে মৌলবাদীদের সমর্থনে বক্তব্য দিচ্ছে। তাদের কর্মকাণ্ড জামাতী ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের সুযোগ করে দিচ্ছে মুক্তমনা মুক্তচিন্তক স্বাধীনতাকামী মানুষদের বিপক্ষে লড়তে। দুঃখজনক।
স্যার লক্ষ্য করবেন,
বেগম রোকেয়া যখন নারীমুক্তির আন্দোলন শুরু করেছিলেন তখন এই পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম সমাজ রোকেয়াকে থামানোর জন্য নানা ধরণের কৌশল অবলম্বন করেছিল। রোকেয়াকে সহ্য করতে হয়েছিল ইসলামিক মৌলবাদীদের দ্বারা অসহ্য যন্ত্রণা।
কাজী নজরুল ইসলামকে এখন বাঙলাদেশের জাতীয় কবি বলে খুব গর্ব করে মুসলমান বাঙালিরা অথচ এক সময় এই কবির গলায় ছুরি চালানোর জন্য ইসলামিক মৌলবাদীরা হিংস্র থেকে হিংস্রতর হতে উঠেছিল।
যে মুনীর চৌধুরীকে একাত্তরে হত্যা করা হয়েছিল- যার নামের পূর্বে ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী’ শব্দদ্বয় জুড়ে দিয়ে মায়াকান্নায় ভাসিয়ে দেই- সেই মুনীর চৌধুরীকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছিল ইসলামিক মৌলবাদীরা।
সামান্য একটি কবিতা লেখার কারণে মুক্তিযুদ্ধের পর দাউদ হায়দারকে পাসপোর্ট ছাড়াই প্লেনে তুলে ভিন্নদেশে পাঠিয়ে দেয় শাসকগোষ্ঠী। ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠী এই কবির উপর চড়াও হয় এবং দেশ ত্যাগে বাধ্য করে।
তসলিমা নাসরিন যখন পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম সমাজের হিংস্রতা পাষণ্ডতা বর্বরতা বিধিবিধান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে একের পর এক সত্য প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন তখন এই পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম সমাজ তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে কোটি কোটি মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠী আজও রক্তাত্ত তসলিমাকে দেখার স্বপ্নে বিভোর।
যার কবিতা পড়ে কোটি কোটি বাচ্চা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সাথে পরিচিত হয়েছিল সেই শামসুর রাহমানের উপর ইসলামিক মৌলবাদীগোষ্ঠী হত্যা করার উদ্দেশ্যে বাসায় আক্রমণ চালিয়েছিল।
বাঙলার ইতিহাসে শিক্ষিত মানুষের তালিকা করলে যার নাম উপরের সারিতে থাকবে, যার লেখনী বাঙলা সাহিত্যে অনন্য ভূমিকা রেখেছে, যার নাম উচ্চারণের সাথে সাথে আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের শিক্ষকেরা নতজানু হয়ে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে, যার যুক্তি খণ্ডন করার মত আজও কোন বাঙালি মুসলমানের জন্ম হয় নি সেই মানুষটি আহমদ শরীফ। ইসলামিক মৌলবাদী তাঁর গর্দান কাঁটার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল।
আরজ আলী মাতব্বরকে লেখনীর কারণে অসংখ্যবার ইসলামিক মৌলবাদী দ্বারা হুমকি ও হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়।
হুমায়ুন আজাদ একাত্তুরের রাজাকারদের, ধর্ম ব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচন করার কারণে ইসলামিক মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হন ও পরবর্তীতে জার্মানিতে হত্যা করা হয়।
লেখক অভিজিৎ রায় বিজ্ঞান মনস্ক একটি তরুণ সমাজ গঠন করার লক্ষ্যে কুসংস্কারের বিপক্ষে অগ্রসর হওয়ার কারণে ইসলামিক মৌলবাদীদের দ্বারা হুমকির সম্মুখিন এবং হত্যার শিকার হন।
বাঙলার ইতিহাস বড্ড বিচিত্র। জীবনদ্দশায় যাদের পথচলা ছিল কঠিন-কষ্টকর-দুর্বোধ্য, তাদেরকেই মৃত্যুর পর মহামানব রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। যারা এখনও জীবিত আছেন, তাদের মৃত্যুর ৫০ বছর পর নামের পূর্বে সাহসী শব্দটি জুড়ে দেবে বাঙলার নষ্ট ইতিহাস। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও বেগম রোকেয়া জলজ্যান্ত উদাহরণ। কখনও শাসকের মধ্যে মৌলবাদী ছিল, কখনও মৌলবাদীদের ভেতরে শাসক লুকিয়ে ছিল।
যতীন স্যার, স্বাধীনতার পরবর্তীতে কমিউনিস্টদের কীভাবে একঘরা করে দিয়েছিল তা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে। সেই থেকে বামপন্থিরা আজো মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে নি। এখনও বামপন্থিদের মেরুদণ্ড ভাঙা। বামদের নীতি আদর্শ এখন নষ্ট ভ্রষ্ট। আপনার সাক্ষাৎকার যিনি নিয়েছেন তিনি বেনসন সিগারেট টানতে টানতে কট্টর বামপন্থি সেজে মৌলবাদীদের পক্ষে একাধিক লেখা প্রসব করে যাচ্ছেন।অদ্ভুত! নাস্তিকদের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার! যেমনটা আপনিও নাস্তিকের আস্ফালন বলেছেন। যোগ্য উত্তরসূরি আপনার!
আপনি একাধিকবার ব্লগারদের দায়ী করলেন। যা খুবই দুঃখজনক। আজ যদি বাঙলার সকল নাস্তিক একযোগে ঘোষণাও দেয় কেউ আর ধর্মগ্রন্থ নিয়ে অকথ্য ভাষায় মন্তব্য করবে না তাহলে কি হত্যা বন্ধ হয়ে যাবে? মৌলবাদীরা কি আক্রমণ চালাবে না? আর কোন ব্লগার লেখক হত্যাকাণ্ডের শিকার হবে না? আপনি তো রীতিমত ব্লগারদের হত্যাকাণ্ড বৈধ করে দিলেন! এই ধরণের মন্তব্য মৌলবাদীরা করে থাকে। কিন্তু আপনিও একই কথা বললেন? এটাই কি বামপন্থিদের সামনে এগুনোর নতুন কৌশল? সাধারণ মানুষের চোখে বামপন্থি মানে নাস্তিক এই ট্যাগ থেকে রেহাই পাওয়ার নতুন পদক্ষেপ? প্রমাণ করতে চাচ্ছেন বামপন্থিরা নাস্তিক না, কিংবা এখন বামপন্থিরা মৌলবাদীদের চেয়ে নাস্তিকদেরই অথবা নাস্তিক্যবাদকেই তাদের প্রধান শত্রু ভাবছে? খুবই দুঃখজনক। এটা কি পলিটিকাল স্টাটেজি?
প্রিয় যতীন স্যার, আপনি হুমায়ুন আজাদ সম্বন্ধে যা বলেছেন তা অবশ্যই আপত্তিজনক। এই সমাজে আপনার অবদান আছে। আপনাকে অস্বীকার করার সাধ্য নেই। আপনি অনেক বছর ধরেই লড়াই করছেন। আপনার সাহস ও উদ্যোগকে সম্মান জানাই। আজ যদি আমিও নির্বোধ বাম ঘরোনার মানুষের মত আপনার বিপক্ষে কণ্ঠসর জোরদার করি তবে আপনি শুধু হেরে যাবেন না; হেরে যাবে মুক্তচিন্তা, মুক্তবুদ্ধি, স্বাধীনতা, মুক্তিকামী মানুষ, কুসংস্কারের বিপক্ষে লড়াই করা প্রতিটি মানুষ। এবং নির্বোধের মত মৌলবাদীদের হাতে হাতিয়ার তুলে দেওয়া হবে। যা আমি কখনোই করবো না।
ছোট মুখে বড় কথা বলেই ফেলি, আপনাদের চিন্তাভাবনা ও স্টাটেজিতে মারাত্মক ভুল আছে। মুক্তমনা নাস্তিকেরা আপনাদের শত্রু নয়। আজ যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য নাস্তিকদের দোষারোপ করছেন, একদিন তারাই মৌলবাদীদের দ্বারা সাম্প্রদায়িকতার শিকার হবেন না এমনও কোন নিশ্চয়তা নেই। মৌলবাদীদের খুশি করে আপনারা বেশি দূর যেতে পারবেন না। আজকে নিজেদের পথ তৈরি করার জন্য আপনারা মুক্তমনা নাস্তিকদের ছুঁড়ে ফেলতে চাচ্ছেন! অথচ আপনারা নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও ছদ্মবেশী সুশীল হওয়ার প্রচেষ্টায় আছেন। লজ্জাজনক। একদিন এই মৌলবাদীরা বাম নাস্তিক আখ্যা দিয়ে আপনাদের গর্দান কাটতে পিছুপা হবে না। ভেবে দেখবেন যতীন স্যার।