সহকর্মী ও ছাত্রীদের সাথে অনৈতিক আচরণের অভিযোগে রাঙ্গুনিয়া কলেজের অধ্যাপক এন. কে. এম. শাহরিয়ারকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ক্লাস চলাকালে মদ্যপান করে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে মাতলামি করাসহ সহকর্মীদের উত্যক্ত করার অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত অধ্যাপক শাহরিয়ার রাঙ্গুনিয়া কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
তাঁর অসদাচরণ ও সহকর্মী নারী শিক্ষকদের উত্যক্ত করার ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় কলেজ পরিচালনা কমিটির সভায় তাঁকে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এমন ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের ঘটনায় শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থীসহ এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এদিকে এ-ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর ওই অধ্যাপকের নানান অপকর্মের আরো কাহিনী বেরিয়ে আসছে, যা এতোদিন মান-সম্মানের ভয়ে ছাত্রী ও সহকর্মীরা চেপে রেখেছিলেন। ফলে রাঙ্গুনিয়ায় আরেকজন দুশ্চরিত্র পরিমলের আবির্ভাব হয়েছে বলে মন্তব্য স্থানীয়দের। সংশ্লিষ্টরা জানান, রাঙ্গুনিয়া কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এন. কে. এম. শাহরিয়ার গত ১১ জুলাই চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁওয়ে একটি কমিউনিটি সেন্টারে একই কলেজের লাইব্রেরিয়ান অপরাজিতা বড়ুয়ার বিয়ের অনুষ্ঠানে তারই সহকর্মী উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপিকার সাথে কুরুচিপূর্ণ আচরণ করেন। মদ্যপ অবস্থায় তিনি ওই অধ্যাপিকাকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করার এক পর্ যায়ে গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা চালান। এ-ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে অধ্যাপিকা ও তাঁর স্বামী উপস্থিত কলেজ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেন। গত ২৩ জুলাই চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত কলেজ পরিচালনা কমিটির সভায় অভিযোগটি উপস্থাপন করা হলে, অভিযুক্ত অধ্যাপককে কারণ দর্শানোর নোটিস প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ-সভায় পরিচালনা কমিটির সভাপতি, রাঙ্গুনিয়ার সাংসদ, বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ সভাপতিত্ব করেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কলেজ কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত অধ্যাপককে তাঁর অপকর্মের জবাব চেয়ে পরপর তিনটি নোটিস দেয়। এসব নোটিসের জবাব সন্তোষজনক না-হওয়ায় পরিচালনা কমিটি গত ২০ আগস্ট এ-অধ্যাপককে সাময়িক বরখাস্ত করে। এদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে যে, সাময়িক বরখাস্ত করার পরও এ-অধ্যাপক অদৃশ্য ক্ষমতাবলে দোর্দণ্ড প্রতাপে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কোনোকিছুরই তোয়াক্কা করছেন না। প্রায় প্রতিদিনই মদ্যপ অবস্থায় কলেজে আসছেন এবং ক্লাস করছেন। তাঁকে নিষেধ করেও কোনো ফল হচ্ছে না। এ-ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ ঈদের ছুটির পর চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে বলে জানা গেছে। এদিকে কলেজ অধ্যাপকের এ-কীর্তি প্রকাশ পাওয়ার পর বেরিয়ে আসছে আরো নানান কাহিনী। নাম প্রকাশ না-করার শর্তে একজন ছাত্রী বলেন, এ-অধ্যাপক দাম্পত্য-অসুখী একজন অসুস্থ মানুষ। প্রায়সময় মদ পান করে বুঁদ হয়ে থাকেন তিনি। ক্লাস করেন মদ্যপ অবস্থায়। সুযোগ পেলেই দাম্পত্য অপূর্ণতা ঘোচাতে ছাত্রীদের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি সর্বশেষ প্রকাশিত কলেজ ম্যাগাজিন সরণীতে 'প্রেম' শিরোণামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন, যেটা তিনি ক্লাসে নির্দিষ্ট পাঠের বদলে পড়ে শোনাতেন। বলতেন, এমন লেখা অতীতে কেউ লিখতে পারে নি। ছাত্রীরা এ-প্রবন্ধের কোনো অংশ না-বুঝলে তাঁর কাছ থেকে জেনে নিতে বলতেন। তিনি ক্লাসের ভেতরে এ-প্রবন্ধ পড়ে ছাত্রীদের কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত ও আচরণ করে বিব্রত করতেন। অনেক ছাত্রীই তাঁর যৌন হয়রানির শিকার হয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এ-ছাত্রী জানান, তিনি পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ছাত্রীদের ডরমেটরিতে গিয়ে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করতেন। এ ছাড়াও নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার কথা বলে এবং নিজের স্ত্রীর নামে অপপ্রচার করে ছাত্রীদের সহানুভূতি আদায় করে তাদেরকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে কলেজ ডরমেটরিতে নিয়ে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে ফেলতেন। মান-সম্মানের ভয়ে কেউ এ-ব্যাপারে মুখ খুলতেন না। ঈদের ছুটিশেষে অভিযুক্ত শিক্ষকের অপসারণের দাবিতে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি গ্রহণ করবেন বলে জানান কলেজের শিক্ষার্থীরা। কলেজের এক অধ্যাপক জানান, গত বছর কলেজ থেকে শুভলং পিকনিকে গেলে সেখানে অধ্যাপক শাহরিয়ার মদ্যপ অবস্থায় কলেজের শিক্ষিকা ও ছাত্রীদের সাথে অশালীন আচরণ করলে বাধ্য হয়ে তাঁদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে নিতে হয়েছে। কলেজের অধ্যক্ষ তরুণ কান্তি বড়ুয়া ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, অভিযোগ পেয়ে পরিচালনা কমিটি তাঁর বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে মদ্যপ অবস্থায় ক্লাস করার অভিযোগেও কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয়েছে। কলেজ পরিচালনা কমিটির সদস্য গিয়াস উদ্দিন খান স্বপন জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে মানুষ গড়ার কারখানা। আর মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরাই যদি চরিত্রহীন হন, তাহলে সে-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধ্বংস অনিবার্য। অধ্যাপক শাহরিয়ার দীর্ঘদিন ধরে মাতাল অবস্থায় ক্লাস নেয়াসহ কলেজে নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার সত্যতা পাওয়া গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। অভিযুক্ত অধ্যাপক শাহরিয়ারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি অশ্লীল গালি দিয়ে বলেন, "প্রেম সবার মধ্যে থাকে না, এটি মানবীয় বিষয়। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে কলেজে আছি, ছাত্রী কিংবা অন্যকারো সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়।" শুভলং পিকনিকে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির বিষয়টিকে তিনি স্রেফ পিকনিকের আনন্দ বলে উড়িয়ে দেন। সহকর্মীর সাথে অসদাচরণের ব্যাপারে বলেন, "যাঁর সাথে করেছি, তাঁকেই জিজ্ঞেস করুন তাঁর সাথে কী করেছি। পত্রিকায় ভালো করে লিখুন, আমার কিছুই ছিঁড়তে পারবেন না।" এসব পরিচালনা কমিটি ও শিক্ষকদের একাংশের ষড়যন্ত্র বলে তিনি দাবি করেন।