............. পর্ব-৫
গল্পে বৃহৎ প্লটের সীমাবদ্ধতা...
ব্লগার হিমালয় রচিত 'অতঃপর শূন্য দশমিক পাঁচ' গল্পটি দারুন সম্ভাবনায় বিকশিত হয়ে উঠেছে। গল্পের অনেক অনুষঙ্গ এবং প্রসঙ্গ থাকা সত্ত্বেও পাঠকের আগ্রম ক্রমাগত বাড়তে থাকে কায়সারের 'অগ্নি উপাসক' নামকরণের রহস্য উদ্ঘাটনের প্রতি। কিন্তু সেই রহস্যের জটিলতা ভেদ করার আগেই পাঠক পলাশীর মোড়ের জোক শিশুদের অসহায় জীবন বাস্তবতার ঘেরাটোপে আটকে পড়ে। অতঃপর পলাশী মোড়রের শিশুগুলোর নিত্যদিন একই আচরণের একঘেয়েমিতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও গল্পে হঠাৎ করেই কায়সারের সহপাঠী কুমুর আগমনে কিছু ঔৎসুক্য অনুভব করে। কিন্তু সেখানেও পাঠকের প্রত্যাশা নিবৃত্ত করেন নি গল্পকার। এমতাবস্থায় গল্পের বহুমুখী অনুষঙ্গ প্রকাশের সঠিক আঙ্গিক হিসেবে মনে হয় উপন্যাসের আঙ্গিকে প্রকাশ করা হলেই হয়তো এতসব অনুষঙ্গ প্রসঙ্গ জমে ওঠার সুযোগ পেত। কারণ, গল্পকার হিমালয় গল্পে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া যুবকের বেকার জীবনে টিউশনি, বিকারে আড্ডা, পথশিশুদের অসহায় জীবন বাস্তবতা কিংবা কুমুদের সম্বন্ধে যেসব ঔৎসুক্য দেখানোর পরেও প্রযুক্তিযুগের ফেইসবুকের মতো প্রসঙ্গও হাজির করেছেন। ফলে কায়সারের জীবনকে জড়িয়ে যেভাবে অনেক অনুষঙ্গের বৃহৎ প্লট সৃষ্টি করেছেন গল্পকার তা প্রকৃতপক্ষে একটি গল্পের সীমায় ধরা সম্ভব বলে মনে হয় না। বৃহৎ প্লটকে গল্পের স্বল্প পরিসরে প্রকাশ করতে গিয়ে গল্পকার কোন প্রসঙ্গ সম্বন্ধেই পাঠকের প্রত্যাশা নিবৃত্ত করতে পারেন নি। পাঠক হিসেবে আশা করি, গল্পকার হিমালয় ভবিষ্যতে এ গল্পের চমৎকার প্লটের প্রতি সুবিচার করে একটি সুপরিসর নভেল উপহার দেবেন।
নীল শার্ট পরা নীতিকথা...
রিজভান হাসান আকাশ নিজেই তার 'দ্বিতীয়বারের আশায়' গল্পের কাহিনীবৃত্তে উত্তম পুরুষের জবানীতে মাথার ওপর গোল চাঁদ আর মাথার ভেতরে টুংটাং পিয়ানোর আওয়াজ নিয়ে রাতে শহরে পরিভ্রমণ করেছেন এবং জেনেছেন-- 'কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর/ মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতে সুরাসুর।' গল্পকার রিজভান হাসান মূলত এই নীতিকথা প্রচারকে সামনে রেখেই গল্পের যে মায়াবী জাদু বিস্তার করেছিলেন তা নীল শার্ট পরা লোকটা ঝুপড়ি থেকে তৃপ্তি নিয়ে বেরেয়ে যাওয়ার পর পুনরায় যখন মেয়েটা হাসি মুখে রাস্তায় দাঁড়ায় জীবিকার তাড়নায় তখন পাঠক হোঁচট খায়। অতঃপর গল্পকার যেন সংবাদ পরিবেশনের মতো গল্পেও রিপোর্ট পেশ করেন :
আসলে যৌনতাকে না, মেয়েটার কষ্টটাকে দেখে আমার হঠাৎ লজ্জা লাগছিল। এই সমাজেরই অংশ হিসেবে আমার লজ্জিত হওয়া উচিত বোধহয়।--পৃ.৮৪
অনুপরূপ প্রতিবেদনের প্রতিভাষ্য গল্পের পরিণামে লক্ষণীয় :
মানুষকে সম্ভবত সাজা ভোগ করার জন্য এখানেই ফেলে রেখে যাওয়া হয়, যে খেলাঘরের যে কোন ধরনের অবস্থার জন্য সে নিজেই দায়ী। আজীবন ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে নিজেদের কুকর্ম আর নিজের লজ্জায় কষেট বারবার লজ্জিত হতে হবে নিজেকেই।--পৃ.৮৫
অর্থাৎ যে জাদু বিস্তারী ভাষায় গল্পের সূচনা করেছিলেন গল্পকার রিজভান তা শেষাবধি সংবাদ ভাষ্যে পরিণত হলে পাঠক হিসেবে হতাশ না হয়ে উপায় থাকে না। গল্পকার যদি নায়কের মস্তিষ্কের ঘোড় ছেড়ে ফুটপাতের জীবনে না নামতেন কিংবা বাস্তব জীবনের ঘটনাগুলোকে ঘোরের মাঝে কম্পাইল করতে পারতেন, তাহলে এ গল্পের শিল্পিত সার্থকতা সম্বন্ধে শতভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করা যেত। ভবিষ্যতে গল্প রচনার সময় এ জাতীয় বিষয় বিচ্ছিন্ন হওয়ার ব্যাপারগুলো সচেতনভাবে লক্ষ রাখবেন বলে প্রত্যাশা করি।
চিত্রকরের ইল্যুশানের জগত...
নির্ঝার নৈঃশব্দ্য একজন চিত্রীর মনোজাগতিক ইল্যুশনের বিন্যাস করেছেন 'এর ঘ্রাণ নিতে হয় চোখ বুজে' শীর্ষক চমৎকার একটি গল্পে। এক কথায় বলতে গেলে-- সরলরৈখিক বয়নে চিত্রকর এবং মডেলকে নিয়ে মানসিক বিভ্রম বিষয়ক গল্পটির জন্য গল্পকার নির্ঝার নৈঃশব্দ্যকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
চাঁদের কলঙ্কের ন্যায় গল্পটিতেও একটুখানি বিসদৃশ উপস্থাপনা লক্ষ করা যায়; যথা-- শুরুতে গল্পকার যাকে পাগল আখ্যায়িত করেছেন, পরিণামে সে চিত্রীর মডেল হওয়ার পর জানা যায়, 'সে শাদা শাড়িটা মেঝে থেকে তুলে দেহে' জড়ালে। অর্থাৎ যাকে গল্পকথক প্রথমে পাগল বলে পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, পরিণামে জানা যায় সে একজন নারী। এই অসঙ্গতিটুকু অবশ্য সকলের চোখে পড়ার মতোও নয়, তারপরও গল্পকারের ভাবা উচিত তিনি কেন গল্পের দেহে অসঙ্গতি রাখবেন! এ অসঙ্গতি ছাড়া এ গল্পের দেহ জুড়ে আছে শিল্পীমনের অবাস্তব জগত বা অতিবাস্তবতার শিল্পিত প্রতিফলন। নির্ঝার নিশ্চয় পরবর্তী সময় এই লিঙ্গ বিভ্রাটের ব্যাপারটি সতর্কতার সাথে খেয়াল করবেন।
অতঃপর জীবিকার জন্য...
আহমেদ রাকিব 'জীবিকা' শীর্ষক গল্পে পিতৃহীন দুর্বল মেরুদণ্ডের রইস মিয়াকে জীবিকার তাগাদায় শহুরে দালান-কোঠার গ্লাস-ক্লিনার হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। যে রইস ৫-৬ তলা বিল্ডিংয়ের হিসেব করতে গিয়ে প্যাঁচে পড়ত, জীবিকার প্রয়োজনে তাকেই শহরের সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিংয়ের গ্লাস ক্লিনারের কাজ নিতে হয়। কারণ, ভয়ের চেয়েও ক্ষুধা মানুষকে বেশি দুর্বল করে দেয়। এমন বাস্তবতায় আহমেদ রাকিব সরল বয়ন পদ্ধতিতে রইস মিয়ার জীবনসংগ্রামের চিত্র শিল্পিত সৌকর্যে উপস্থাপন করেছেন। গল্পটির জন্য আহমেদ রাকিবকে জানাই ধন্যবাদ।