কিশোরীবেলায় মায়ের বইের সংগ্রহ থেকে একটি বই খুঁজে পেয়েছিলাম। বইটির মলাট তো মলাট, সামনে পিছে কিছু পাতা বেমালুম গায়েব। সামনের পাতা নেই, তাতে খুব একটা অসুবিধা নেই, পড়তে আরম্ভ করে দিলাম। বেশ পড়ছিলাম। আদিম মানুষ জংলা হয়ে বন-জঙ্গল-পাহাড়-পর্বত ঘুরছিলাম। গোল বাঁধল শেষে, তখন আমি, মানে জংলা, যুদ্ধবন্দী দাস হয়ে পাথর টানছি। এ আমারই পাপের শাস্তি। আমি নিনানির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি শিলাঙ্গীকে পাওয়ার জন্য, আবার শিলাঙ্গীর বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখিনি, আরো কত পাপ করেছি নিজের লালসা পুরনের জন্য। পাথর টানার কঠোর কাজে যদি এর প্রায়শ্চিত্ত হয়, হোক। ....বিজয়ী রাজ্যের রাজা এসেছে কাজ দেখতে, তার বাহুলগ্না হয়ে রাজার প্রিয়তমা রানী। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা, রানী আর কেউ নয়, আমারই প্রেমাস্পদা, রহস্যময়ী নিনানি। নিনানি আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমি আর সহ্য করতে পারছিনা, ঈশ্বর...............
এরপর আর নেই। পরের পাতাগুলো ছেড়া। আমার ছোটবেলার কীর্তি। সেই হামাগুড়ি কি হাটি-হাটি-পা-পা বয়সে যা পেতাম তাই ছিড়তাম। ইচ্ছা হলো টাইম মেশিনে চেপে অতীতে ফিরে যাই, খুন করে আসি ঐ হামাগুড়ি দেওয়া পাজী মেয়েটাকে। নেহাৎ টাইম প্যারাডক্সের সৃষ্টি হবে বলে করলামনা।
বইটির নাম স্থাবর। বনফুলের বিখ্যাত উপন্যাস দ্বয়ী 'স্থাবর ও জঙ্গম' এর একটি। বছর আটেক আগে অনেক হাঙ্গামা করে বই দুটো যোগার করেছিলাম। হাতে পাওয়ামাত্র স্থাবরের শেষের পাতা পড়ে নিলাম। তারপরে শুরু করলাম প্রথম থেকে। ভয় ছিল বনফুলের 'পাঠকের মৃত্যু' গল্পের মত আমার ভিতরের পাঠিকাও মারা গেছে কিনা। না, পাঠিকা বহাল তবিয়তেই বেঁচে আছে। মুূুহূর্তের মধ্যে ডুবে গেলাম এক প্রাগৈতেহাসিক কালে, সময় যেখানে স্থাবর।
বই: স্থাবর
লেখক: বনফুল
প্রথম সংকরণ: এপ্রিল ১৯৫১
মানব সভ্যতার ইতিহাসের অতি অল্প অংশই আমরা জানি। সেই প্রস্থর যুগে যখন মানুষ যূথবদ্ধভাবে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত খাদ্যের সন্ধানে, যখন বালক বয়োপ্রাপ্তির লক্ষন দেখালেই নিহত হত অথবা বিতারিত হত দল থেকে, সেই সময় আমরা শুধু অনুমানই করতে পারি। সেই সুদুর অতীতের কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। হয়তো কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় পাথরের অস্ত্র, গুহার ভিতর আঁকা প্রাগৈতেহাসিক ছবি, কিংবা ফসিল হয়ে যাওয়া প্রাণীদেহ। বেশীভাগই থাকে আড়ালে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা সেই সামান্য পাওয়া থেকেই অজানার অবগুন্ঠন সরানোর চেষ্টা করে যান, বুঝতে চেষ্টা করেন কেমন ছিল প্রাগৈতেহাসিক মানুষের জীবনযাত্রা। লেখক প্রত্নতত্ত্ববিদদের পাওয়া তত্ত্ব থেকে কচকচানিটুকু বাদ দিয়ে, বস্তু টুকু নিয়ে, উপভোগ্য ভাবে নির্মান করেছেন মানুষের উত্তরনের গল্প। চিত্তাকর্ষক ভাবে উপস্থাপন করেছেন এক একটি গোষ্ঠির উৎপত্তি কাহিনী, কিভাবে গড়ে উঠে সেই গোষ্ঠির বিশ্বাস, একেঁছেন অন্য গোষ্ঠির বিশ্বাসের সাথে বিরোধের ছবি। তিনি বলেছেন এমন এক সময়ের কথা যা আমাদের অজানা। যে সময় ফসিল হয়ে আছে অজানা ইতিহাস বুকে নিয়ে।
সময়ের স্থির জলে ভেসে উঠে এক একটি পর্ব। সেখানে পাঠক মিশে যায় এক আদিম মানুষের সাথে যে বন্য পশুর সাথে লড়াই করে খাদ্যের সংস্থান করছে। সঙ্গিনী সংগ্রহ করে গড়ে তুলছে একটি দল। এভাবে কেটে যায় শত শত বছর, স্থির জল কেঁপে উঠে, ভেসে উঠে আরেকটি চিত্র। কখনও সে সামনে পরে একদল শিকারীর, যারা ছুটছে বিশালাকার ম্যামথের পিছনে। আবার উঠে বুদবুদ, নতুন ছায়ায় দেখা যায় সে গুহার পাথরে ছবি আঁকছে বলগা হরিনের, পাশে প্রদীপ হাতে সর্দারকন্যা জোলমা । ছবি যত নিঁখুত হবে, ততই হরিনের দল ছুটে আসবে নিকটবর্তি জঙ্গলে। জোলমার প্রেমার্থী সেই আদিম মানব, কিন্তু জোলমাকে চিরকুমারী থাকতে হবে দলের কল্যাণে। কখনো অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে শষ্যবীজ হতে তৃন উদ্গমনের প্রক্রিয়া। কখনো সে পশুতাড়নকারী দলের সদস্য, তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় বন্য গরুর দলকে। শিখে নেয় পশুদুগ্ধ পান করা। দৃশ্য আসে, দৃশ্য যায়, আদিম মানুষটি এগুতে থাকে সভ্যতার পথে........
এভাবে চলতে চলতে পাঠক নিজেকে আবিস্কার করে এক চাষভিত্তিক সমাজে। সর্দারের কনিষ্ঠ পত্নী লাস্যময়ী নিনানির কৃপাদৃষ্টিধন্য সেই মানব। দুর পাহাড়ের গোদুগ্ধপায়ী গোষ্ঠির কন্যা শিলাঙ্গী প্রার্থনা করে তার বন্ধুত্ব। নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে তাদের মিলন হয়, ক্ষনিকের জন্য। আক্রমন করে উলম্ভনের দল। তারপরেই সেই পাথর টানা দৃশ্য, .......উলম্ভনের সস্ত্রীক পরিদর্শন, ......নিনানির উপেক্ষা, ....... ' হে দেবতা, আমি আর সহ্য করিতে পারিতেছিনা, মৃত্যুদন্ড দিয়া আমার পাপের চরম শাস্তি দাও এবার। আমি পাপী, ক্ষমা প্রার্থনা করিবার অধিকারও আমার নাই, আমাকে............ '
যাহ্, এর পরের পাতাগুলি ছেড়া। ঠিক যেমন হারিয়ে গেছে ইতিহাসের কোনো কোনো অধ্যায়। কোথাও পাঠককে আকন্ঠ কৌতুহলে ডুবিয়ে কাহিনী এগিয়ে যায় পরের ধাপে। আমরা জানতে পারিনা কি হয়েছিলো মাঝখানে।
শুধু জানি, মানুষের যাত্রা থেমে নেই। সেই অজানা অতীতে শুরু হয়েছিল যে যাত্রা, তা আজও চলছে, চলবে।
পাদটীকা: বইটি বনফুল রচনাসমগ্রের ষষ্ঠ খন্ডে আছে। এখন অনলাইনে পাওয়া যায়।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৯ রাত ১১:৪৯