somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্থাবর - আমার ছেড়া মলাটের বই

০১ লা আগস্ট, ২০১৯ রাত ৮:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কিশোরীবেলায় মায়ের বইের সংগ্রহ থেকে একটি বই খুঁজে পেয়েছিলাম। বইটির মলাট তো মলাট, সামনে পিছে কিছু পাতা বেমালুম গায়েব। সামনের পাতা নেই, তাতে খুব একটা অসুবিধা নেই, পড়তে আরম্ভ করে দিলাম। বেশ পড়ছিলাম। আদিম মানুষ জংলা হয়ে বন-জঙ্গল-পাহাড়-পর্বত ঘুরছিলাম। গোল বাঁধল শেষে, তখন আমি, মানে জংলা, যুদ্ধবন্দী দাস হয়ে পাথর টানছি। এ আমারই পাপের শাস্তি। আমি নিনানির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি শিলাঙ্গীকে পাওয়ার জন্য, আবার শিলাঙ্গীর বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখিনি, আরো কত পাপ করেছি নিজের লালসা পুরনের জন্য। পাথর টানার কঠোর কাজে যদি এর প্রায়শ্চিত্ত হয়, হোক। ....বিজয়ী রাজ্যের রাজা এসেছে কাজ দেখতে, তার বাহুলগ্না হয়ে রাজার প্রিয়তমা রানী। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা, রানী আর কেউ নয়, আমারই প্রেমাস্পদা, রহস্যময়ী নিনানি। নিনানি আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমি আর সহ্য করতে পারছিনা, ঈশ্বর...............

এরপর আর নেই। পরের পাতাগুলো ছেড়া। আমার ছোটবেলার কীর্তি। সেই হামাগুড়ি কি হাটি-হাটি-পা-পা বয়সে যা পেতাম তাই ছিড়তাম। ইচ্ছা হলো টাইম মেশিনে চেপে অতীতে ফিরে যাই, খুন করে আসি ঐ হামাগুড়ি দেওয়া পাজী মেয়েটাকে। নেহাৎ টাইম প্যারাডক্সের সৃষ্টি হবে বলে করলামনা।

বইটির নাম স্থাবর। বনফুলের বিখ্যাত উপন্যাস দ্বয়ী 'স্থাবর ও জঙ্গম' এর একটি। বছর আটেক আগে অনেক হাঙ্গামা করে বই দুটো যোগার করেছিলাম। হাতে পাওয়ামাত্র স্থাবরের শেষের পাতা পড়ে নিলাম। তারপরে শুরু করলাম প্রথম থেকে। ভয় ছিল বনফুলের 'পাঠকের মৃত্যু' গল্পের মত আমার ভিতরের পাঠিকাও মারা গেছে কিনা। না, পাঠিকা বহাল তবিয়তেই বেঁচে আছে। মুূুহূর্তের মধ্যে ডুবে গেলাম এক প্রাগৈতেহাসিক কালে, সময় যেখানে স্থাবর।

বই: স্থাবর
লেখক: বনফুল
প্রথম সংকরণ: এপ্রিল ১৯৫১




মানব সভ্যতার ইতিহাসের অতি অল্প অংশই আমরা জানি। সেই প্রস্থর যুগে যখন মানুষ যূথবদ্ধভাবে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত খাদ্যের সন্ধানে, যখন বালক বয়োপ্রাপ্তির লক্ষন দেখালেই নিহত হত অথবা বিতারিত হত দল থেকে, সেই সময় আমরা শুধু অনুমানই করতে পারি। সেই সুদুর অতীতের কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। হয়তো কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় পাথরের অস্ত্র, গুহার ভিতর আঁকা প্রাগৈতেহাসিক ছবি, কিংবা ফসিল হয়ে যাওয়া প্রাণীদেহ। বেশীভাগই থাকে আড়ালে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা সেই সামান্য পাওয়া থেকেই অজানার অবগুন্ঠন সরানোর চেষ্টা করে যান, বুঝতে চেষ্টা করেন কেমন ছিল প্রাগৈতেহাসিক মানুষের জীবনযাত্রা। লেখক প্রত্নতত্ত্ববিদদের পাওয়া তত্ত্ব থেকে কচকচানিটুকু বাদ দিয়ে, বস্তু টুকু নিয়ে, উপভোগ্য ভাবে নির্মান করেছেন মানুষের উত্তরনের গল্প। চিত্তাকর্ষক ভাবে উপস্থাপন করেছেন এক একটি গোষ্ঠির উৎপত্তি কাহিনী, কিভাবে গড়ে উঠে সেই গোষ্ঠির বিশ্বাস, একেঁছেন অন্য গোষ্ঠির বিশ্বাসের সাথে বিরোধের ছবি। তিনি বলেছেন এমন এক সময়ের কথা যা আমাদের অজানা। যে সময় ফসিল হয়ে আছে অজানা ইতিহাস বুকে নিয়ে।

সময়ের স্থির জলে ভেসে উঠে এক একটি পর্ব। সেখানে পাঠক মিশে যায় এক আদিম মানুষের সাথে যে বন্য পশুর সাথে লড়াই করে খাদ্যের সংস্থান করছে। সঙ্গিনী সংগ্রহ করে গড়ে তুলছে একটি দল। এভাবে কেটে যায় শত শত বছর, স্থির জল কেঁপে উঠে, ভেসে উঠে আরেকটি চিত্র। কখনও সে সামনে পরে একদল শিকারীর, যারা ছুটছে বিশালাকার ম্যামথের পিছনে। আবার উঠে বুদবুদ, নতুন ছায়ায় দেখা যায় সে গুহার পাথরে ছবি আঁকছে বলগা হরিনের, পাশে প্রদীপ হাতে সর্দারকন্যা জোলমা । ছবি যত নিঁখুত হবে, ততই হরিনের দল ছুটে আসবে নিকটবর্তি জঙ্গলে। জোলমার প্রেমার্থী সেই আদিম মানব, কিন্তু জোলমাকে চিরকুমারী থাকতে হবে দলের কল্যাণে। কখনো অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে শষ্যবীজ হতে তৃন উদ্গমনের প্রক্রিয়া। কখনো সে পশুতাড়নকারী দলের সদস্য, তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় বন্য গরুর দলকে। শিখে নেয় পশুদুগ্ধ পান করা। দৃশ্য আসে, দৃশ্য যায়, আদিম মানুষটি এগুতে থাকে সভ্যতার পথে........

এভাবে চলতে চলতে পাঠক নিজেকে আবিস্কার করে এক চাষভিত্তিক সমাজে। সর্দারের কনিষ্ঠ পত্নী লাস্যময়ী নিনানির কৃপাদৃষ্টিধন্য সেই মানব। দুর পাহাড়ের গোদুগ্ধপায়ী গোষ্ঠির কন্যা শিলাঙ্গী প্রার্থনা করে তার বন্ধুত্ব। নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে তাদের মিলন হয়, ক্ষনিকের জন্য। আক্রমন করে উলম্ভনের দল। তারপরেই সেই পাথর টানা দৃশ্য, .......উলম্ভনের সস্ত্রীক পরিদর্শন, ......নিনানির উপেক্ষা, ....... ' হে দেবতা, আমি আর সহ্য করিতে পারিতেছিনা, মৃত্যুদন্ড দিয়া আমার পাপের চরম শাস্তি দাও এবার। আমি পাপী, ক্ষমা প্রার্থনা করিবার অধিকারও আমার নাই, আমাকে............ '

যাহ্, এর পরের পাতাগুলি ছেড়া। ঠিক যেমন হারিয়ে গেছে ইতিহাসের কোনো কোনো অধ্যায়। কোথাও পাঠককে আকন্ঠ কৌতুহলে ডুবিয়ে কাহিনী এগিয়ে যায় পরের ধাপে। আমরা জানতে পারিনা কি হয়েছিলো মাঝখানে।

শুধু জানি, মানুষের যাত্রা থেমে নেই। সেই অজানা অতীতে শুরু হয়েছিল যে যাত্রা, তা আজও চলছে, চলবে।

পাদটীকা: বইটি বনফুল রচনাসমগ্রের ষষ্ঠ খন্ডে আছে। এখন অনলাইনে পাওয়া যায়।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৯ রাত ১১:৪৯
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×