অনেকক্ষন ধরে ঘরবার করছি বাবার জন্য। সবকিছু গোছানো হয়ে গেছে। আমাদের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে। এখন শুধু বাবার অপেক্ষা। বাবা এসে খেয়ে নিলেই রান্নাঘর গুছিয়ে বেরিয়ে পরা যায়। কেন যে এত দেরী করছে? আজকে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরার কথা। গাবতলী থেকে রাতের কোচ ধরতে হবে।
আগের রাতে মা ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে। সারা সন্ধ্যা সে যখন ঘরের কাজ করছিলো, আমরা দুই ভাই বোন তার পিছে পিছে ঘুরেছি। কখন কাজ শেষ হবে, কখন ব্যাগ গোছাবো, কি কি নেব, এসব প্রশ্ন করে ব্যতিব্যাস্ত করেছি। মায়ের কাজের কি অন্ত আছে? তারপরে সে যখন মাদুর বিছিয়ে ব্যাগ নিয়ে বসলো, আমরা দুজন সেখানে যেয়ে বিড়ালের মত থাবা মেরে বসেছি। দেখছি কি কি নেওয়া হয়। আমাদের পুজোর জামা, আরেকটা ভালো জামা, ঘরে পরার দুইটি জামা নেওয়া হলো। বাবার জামাকাপড় কি নেওয়া হবে তার হিসাব হলো। মায়ের হয়তো এবার পুজায় নতুন কিছু কেনা হয়নি। পুরানো শাড়ি থেকেই দুটো ভালো শাড়ি, দুটা আটপৌড়ে শাড়ি উঠলো। খাবারের ব্যাগ সহ সব ব্যাগ গুনে ভাগ করে দেওয়া হলো রাস্তায় কার দ্বায়িত্বে কোন ব্যাগ থাকবে।
তারও তিনমাস আগে থেকে ক্যালেন্ডারে দিনগুলো দাগিয়ে চলেছি। এখন সেই দিন গোনা এসে ঠেকেছে ঘন্টা-মিনিট গোনায়। আর বাবা এত দেরী করছে? শেষে বাবা এলো, তাড়াতাড়ি না, অনেক দেরী করেই। আমরা সবাই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পরলাম।
গাবতলীর বাস কাউন্টারে যখন পৌঁছালাম, তখন বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। বুকের মধ্যে ধুকপুক করছে, যদি বাস মিস করি। এ মা, বাসেরই দেখি কোনো খবর নেই! নির্দিষ্ট সময়ের বেশ অনেক পরেই বাস এলো। তারপরে ঢুকুর ঢুকুর করে রওনা হলো আরিচার উদ্দেশ্যে। গাবতলী না ছাড়ানো পর্যন্ত্য জ্যাম ছিলো। তারপরে বাস ভালো গতিতেই চলতে লাগলো। সাভার কি এসে গেলো? জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করি জাতীয় স্মৃতিসৌধ। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায়না। বাইরের অন্ধকার দেখতে দেখতে আরিচা ঘাটে পৌঁছাই। সেখানে অন্ত্হীন অপেক্ষা। বসে বসে ঝালমুড়ি, ডিমসিদ্ধ, আর ডাবওয়ালাদের ডাকাডাকি শুনতে থাকি। ডাব কিনে খেয়ে ডাবওয়ালাকে বলি ডাবটা দুইভাগ করে দিতে, ভিতরের শাস খাব। এর মধ্যেই ফেরী এসে যায়, বাসসুদ্ধ আমরা ফেরীতে উঠি।
ওপারে নগরবাড়ি ঘাটে যেতে লাগে তিন ঘন্টা। অথচ ফেরার সময় নগরবাড়ি থেকে আরিচা ঘাট দেড়ঘন্টা। বাবা সুন্দর করে নদীর স্রোত, ফেরীর গতি, আর তার সাথে সময়ের হেরফেরের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে। হুম, যখন গন্তব্যে পৌঁছুতে মন ছটফট করছে, তখনই কিনা স্রোতের উল্টোদিকে যেতে হয়। কি বিচ্ছিরী ব্যাপার। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে অন্ধকার নদীর শোভা দেখি। ফেরীতেই পেটচুক্তিতে রাতের খাওয়া সারা হয়।
নগরবাড়ি ঘাটে নেমে বাস চলতে শুরু করে। এর মাঝেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙ্গে যখন বাস এসে থামে উত্তরবঙ্গের কোনো এক জেলা শহরে। তখন প্রায় ভোর। সেখান থেকে মুড়ির টিন বাসে উপজেলা সদর, তারপরে রিক্সা । সামনেই বাজার, সিনেমা হল, তার একটু পরে আমার প্রিয় মিষ্টির দোকান, সোনালী ব্যাংক, আমাদের বাড়ি। সেখানে আমার ঠাকুরমা থাকে বড়জেঠুর সাথে। অন্য কাকা জ্যাঠারাও পুজোয় বাড়ি আসেই আসে।
ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে রিক্সা দুটো থামে বাড়ির সামনে। থামতে না থামতেই ভিতর থেকে হই হই করে ছুটে আসে হালিপোল্লির দল। সেজমা-সেজকারা এসে গেছে----। আমরা রিক্সা থেকে নামার আগেই ব্যাগগুলো হাতে হাতে চলে যায় বাড়ির মধ্যে। ভিতর থেকে উকি দেয় বড়দের দল। পাশের বাড়ির আপা চলে আসে আমাদের দেখতে।
একটু পরে আমিও মিশে যাই হালিপোল্লির দলে। হই চই করে খেলতে থাকি সবার সাথে। এর মধ্যেই শুনতে পাই বাড়ির সামনে রিক্সা থামার আওয়াজ। খেলা থামিয়ে ছুটে যাই দেখতে আর কে এলো।
আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।
সবাইকে জানাই শারদীয় দূর্গাপুজার শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৯ রাত ৮:৩৩