বসের ঝারিটা এখনো কানে বাজছে। -- ‘একটা চিঠি টাইপ করতে দশটা ভুল। যান ঠিক করে নিয়ে আসেন’। দুইটা বানান ভুল হলেই যদি বলে দশটা ভুল তাহলে কাজ করা কঠিন। চাকরিটা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু এখনই ছাড়া যাবে না। সুমনকে বলছিলাম তার অফিসে ম্যানেজারের পোস্ট খালি হলে আমাকে নিতে। দুইদিন যাবৎ ফোন দেই শালা আর ফোন ধরে না। আরে বেটা ফোন ধরে কিছু একটা বলতে তো পারিস। স্কুল লাইফের বন্ধুর জন্য এইটুকুন করতে পারবি না। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। অফিস থেকে বের হতেই মনে হল গায়ে কেউ গরম পানির ভাপ ঢেলে দিছে। ৫টা বিশ বাজে কিন্তু রোদের কোন কমতি নাই। বাসায় ১টা রুমে এসি লাগাতে হবে। ১টন এসির দাম কত কে জানে? ১২ বছর চাকরি করেও মনে হয় মাসের শেষে সংসার চলে না। এখন পর্যন্ত একটা ফ্ল্যাট কিনতে পারলাম না অথচ বন্ধুদের অনেকেই বাড়ি গাড়ি করে ফেলেছে। কেন যে রতন মামারে কইছিলাম এই চাকরি খুঁইজা দিতে।
শাপলা চত্তরের সামনে দাঁড়িয়ে শফিক একটা বাসের জন্য ওয়েট করে। ২ বছর বেকার থাকার পর রতন মামা শফিককে তাঁর বন্ধুর প্রাইভেট অফিসে চাকরি দেয়।
কিছুক্ষণ পর মোহাম্মদপুরের একটা বাস আসলে অনেকের সাথে শফিক হুরমুর করে উঠে পরে। মাঝামাঝি একটা সিটে জানালার পাশে বসে সে ঝিমাতে থাকে। মেয়ের দুইটা টিউশন আর ইন্টারনেটের বিল এখনো দেয়া হয়নি। প্রতি মাসে একটা না একটা বেশতি খরচ লাইগাই আছে। বস যে কিপ্টা এ বছর ইনক্রিমেন্টটা মনে হয় মাইর দিবে। প্রেসক্লাব পার হতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। জ্যাম। আজকে যে বাসায় যেতে কয়টা বাজে। মৎস ভবনের সামনে থেকে মাঝ বয়সী রোদে পোড়া চেহারার এক লোক বাসে উঠে। হাতে একটা ব্যাগ। পরনে পুরোনো স্যান্ডেল। চোখে তিক্ষ্ণ দৃষ্টি। -- ‘অনুমতি দিলে একটা সুন্দর গান গাইতে পারি’। অত্যন্ত ভরাট কণ্ঠে লোকটা বলল। শফিক জানে এইটা ভিক্ষার নতুন কৌশল। সে শুনার কোন আগ্রহ দেখালো না। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্ঠা করছে। তাছাড়া সুন্দর গান গাইব বলে যে শুরু করে সে গান শেষ পর্যন্ত কানের জন্য সুখকর হয় না। যাই হোক আগন্তুক লোকটি শেষ পর্যন্ত কারো অনুমতি না †পলেও গাওয়া শুরু করল। -- ‘একদিন মাটির ভিতর হবে ঘর, মন আমার কেন বান্ধ দালান ঘর’। গানে টান †দয়ার সাথে সাথে বাসে পিনপতন নিরবতা। গানের গলা অত্যন্ত ভালো বলতেই হবে। সবচেয়ে বড় কথা বাসের শেষ সিট পর্যন্ত গানের গলা শোনা যাচ্ছে। জ্যামে বাস এখনো নড়ছে না। মজার ব্যাপার হল পাশের বাস থেকে কয়েকজন গান শোনার চেষ্টা করছে। শফিক এবার লোকটাকে দেখার চেষ্টা করল। একি! কামালের মত লাগছে। কামাল নাকি! কিন্তু কামাল ভিক্ষা করবে কেন? শফিক এখনো নিশ্চিত না। সে এবার অপলক তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। গানগাইতে গাইতে লোকটা এবার শফিককে পাস করে বাসের শেষ প্রান্তে। গানের কণ্ঠ শুনে এবার শফিক মোটামোটি নিশ্চিত লোকটা কামাল তবে আরেকটু শিউর হতে হবে। শফিক বুঝতে পারছেনা তার কোন ভুল হচ্ছে কিনা। কামাল বুয়েটের ছাত্র ছিল। শফিক কামালের চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু চোখে চোখ পড়ছে না। অবশেষে গান থামল। শফিক কিছু বলতে যাবে এমন সময় কামাল তার ব্যাগ থেকে কিছু পন্য বের করে। একটা চার্জ লাইট আর একটা চার্জ লাইটসহ ফ্যান। তারপর হকারদের ভংগিমায় বিভিন্ন কথা বলে এগুলো বিক্রির চেষ্টা করতে থাকে। শফিকের কামালকে থামাতে ইচ্ছা হলো না। তবে তাদের চোখে চোখে কথা হল। শফিকের মনে হল কামাল তাকে চিনতে পারছে। কামাল যাত্রীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগল। কেউ জিজ্ঞাস করে কতদিন টিকবে? চার্জ দিব কিভাবে? কয় ঘণ্টা জ্বলবে? ইত্যাদি। চার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সে কয়েকটা চার্জ লাইট বেচঁতে সক্ষম হল। কামাল বাস থেকে নামতে যাবে এমন সময় শফিক সিট ছেড়ে এগিয়ে গেল।
উচ্ছাসের সঙ্গে বলল কামাল তুই!
কামাল বলল হ্যা দোস্ত আমি। তোর এ অবস্থা কেন?
কামালের উত্তর -- সে অনেক কথা।
-- আমার সাথে বাসায় চল।
-- আজ সময় নাই আরেক দিন।
-- তার মোবাইল নাম্বার দে।
বাসের সব যাত্রী নিঃশব্দে দুই বন্ধুর কথোপকথন শুনছিল।
-- আমার মোবাইল হারিয়ে গেছে। এখনো †কনা হয়নি। তুই আমার বাসায় আস একদিন। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পিছনে। যেকোন দিন সন্ধার পর আসিস।
-- ঠিক আছে আমার কার্ড রাখ। শফিক তার কার্ড বের করে দেয়।
বাস চলতে শুরু করে। কামাল দ্রুত বাস থেকে নেমে যায়।
কামাল আর শফিকের বন্ধুত্ব ইন্টারমিডিয়েট থেকে। কামাল অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র, শফিক মোটামোটি। কামাল ঢাকায় পড়ার চান্স পেলেও টাকার অভাবে সাহস করেনি। শফিকের বাবা কামালকে জেলা শহরে দুইটা টিউশনি পাইয়ে দেয় আর সেখানে শফিকের সাথে ভর্তি করে দেয়। শফিকও ছাত্র খারাপ না। তবে আড্ডা, গান এসব করে পড়াশোনার বেশী সময় পেতোনা। কামাল কোন ক্লাস ফাঁকি দিতোনা আর শফিক তার নোট পড়ত পরিক্ষার আগে। শেষে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে দুজনই ভালোভাবেই। কামাল বুয়েটে চান্স পেলো। শফিকের ঢাবির ক ইউনিটে চান্স পেলো না। কামাল পেলো। শফিক বুঝতে পারলো সরকারি ভার্সিটিতে পড়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। শেষ চেষ্টা হিসেবে সে কামালকে সাথে নিয়ে ঘ ইউনিটে পরিক্ষা দিল। দুজনেই টিকে গেল। শফিক সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একটা সাবজেক্টে ভর্তি হয়ে †গল। কামাল পড়ছে বুয়েটের আর্কিটেকচার। প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে দুএকবার দেখা হত অবশ্যই। সময়ের সাথে দেখা হওয়ার পরিমাণ কমে যায়। দুজনই নতুন বন্ধত্বের জালে জড়িয়ে পড়ে। শফিক ছাত্র রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়। বন্ধু, আড্ডা আর মিটিংয়ের ফাঁকে কামালের খবর নেয়ার খুব একটা সময় হয় না। কামালের দিনকালও ভাল যাচ্ছিল না। তার বাবা প্রায়ই অসুস্থ থাকে। বাড়ি থেকে ঘুরে আসলে ক্লাস মিস হয়ে যায়। একবার ক্লাস মিস করলে পরের ক্লাসে কিছু বোঝা যায় না। ঘন ঘন বাড়ি যেতে যেতে কামাল পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ে। ফার্স্ট ইয়ারের পরে শফিকের সাথে কামালের আর কোন যোগাযোগ নাই। সম্ভবত কামাল বুয়েট থেকে ড্রপআউট করে।
শফিকের বাসায় পৌঁছাতে আটটা বেজে যায়। দরজা খুলে শফিকের ছেলে শুভ। তার চোখ বাবার হাতের দিকে। শফিকের ডান হাতে খাবারের বাটি ছাড়া আর কিছু নাই। শুভর মনটা খারাপ হয়ে গেল।
-- আব্বু আমার বেনটেনের ঘড়ি?
-- ভুলে গেছি বাবা। কাল অবশ্যই নিয়ে আসব।
-- বাবা তুমি কি জান, আজকাল তুমি প্রায়ই মিথ্যা কথা বল। তুমি গত কালও বললে আজ নিয়ে আসবে।
নীপা এদের কথা শুনে পাশে এসে দাঁড়ায়। তের বছর হ’ল শফিক আর নীপার ছোট সংসার। শফিক ছেলের মাথায় হাত বুলাবে বলে এগিয়ে যায়। শুভ রাগে তার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। শফিক বুঝতে পারে শুভ আজ আর দরজা খুলবে না। শফিক মনে মনে ভাবে ছেলের পড়াশুনার জন্য আলাদা রুম দিলাম আর সে এখন কথায় কথায় দরজা লাগিয়ে দেয়। আমাদের সময়তো আলাদা রুম ছিলনা আমরা কি পড়াশোনা করিনি? ক্লাস সেভেনের ছাত্রের আলাদা রুমের দরকার নাই এই কথাটাই সে নীপাকে বোঝাতে ব্যর্থ। যাই হোক কালকে অবশ্যই বেনটেনের ঘড়ি আনতে হবে। কোথায় পাওয়া যায়? নিউমার্কেটে পাওয়া গেলে দামটা একটু কম পড়ত।
(২)
পনের-বিশ দিন পর কোন এক দিন। শফিকের মনটা বেশ ভালো। বৃহস্পতিবার। আজ সে বেতন পেয়েছে। কদিন ধরেই সে কামালের বাসায় যাবে ভাবছে। আজ যাওয়া যায়। কিন্তু কামালকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তবে বাসাটা চিনে আসলে ভাল হয়। যে বন্ধু তার এত উপকার করল তাকে খুঁজতে একটু কষ্ট হলে হোক। তবে একটা অসুবিধা আছে। কামাল এখন হকার। সে যদি টাকা ধার চায় তাহলে সমস্যায় পড়তে হবে। পকেটে দুতিন হাজার টাকার বেশী রাখা যাবে না। অফিস শেষে শফিক কামালের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। শফিকের মনে বেশ কৌতুহল ও খানিকটা অবিশ্বাস। সে তার মনকে বিশ্বাস করাতে পারছে না কামালের এ হাল হতে পারে। তার ধারণা ছিল কামাল এর মাঝে তাকে ফোন করবে। এ কদিন সে শাহবাগ দিয়ে যতবার গিয়েছে কামালকে মনে মনে খুঁজেছে। কামালের বাসায় সে কোন কিছু নিয়ে যাচ্ছে না। কামাল বাসায় থাকে নাকি মেসে? সম্ভবত ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পিছন দিকটা বস্তির মত। কামাল কি সন্ত্রাসী কোন কিছুর সাথে জড়িয়ে পড়েছে? ঢাকা শহরের অনেক হকারই রাতে মাদকের ব্যবসা করে। কামাল কি এরকম কিছু করছে? এসব ভাবতে ভাবতে শফিকের রিক্সা গিয়ে থামল ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সামনে। রিক্সা ভাড়াটা চুকিয়ে সে মন্দিরের পাশের গলি দিয়ে হেঁটে এগুতে থাকে। সামনে তিনটা অল্পবয়সী মেয়ে খেলছে। সে তাদের জিজ্ঞাস করবে কিনা বুঝতে পারছে না। আর একটু সামনে এগুলে কারেন্টের পিলারের কাছে দুটো চিপাগলি। এবার কাউকে জিজ্ঞাস করা যায়। মোড়ে কাছেই একটা চা’র দোকান।
-- চাচা মিয়া কামালের বাসা কোনটা?
-- কোন কামাল?
-- বাসে বাসে চার্জ লাইট বিক্রি করে।
-- পরের গলির শেষ মাথা।
দোকানদার চাচা হাতে ইশারা করে দেখিয়ে দেয়। পুরনো ধাচের দু’তলা বাড়ি। শফিক বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বাড়ির সামনে ছোট কয়েকটা আম ও পেয়ারা গাছ। দশ-বার বছরের একটা মেয়ে গাছে পানি দিচ্ছে।
-- এইটা কি কামালের বাসা?
-- হ্যা। আপনি একটু দাঁড়ান আমি আব্বুকে ডেকে দিচ্ছি।
প্রায় সাথে সাথেই কামাল তার মেয়ের হাত ধরে বাড়িয়ে আসে। দুই বন্ধুর কোলাকোলি। তারপর অনেক উচ্ছাসমাখা কথাবার্তা। কামালের বাসায় দুইটা রুম। বাইরে একটা বারান্দার মত। বারান্দায় তিনটা লম্বা স্কুল বেঞ্চ পাতা। শফিককে সেখানে বসতে দেয়া হ’ল। একটা বেঞ্চে দুইটা ছেলে বসে চার্জ লাইট এসেম্বলিং করতেছিল। তারা কিছুক্ষণ পর একটা টালী খাতায় কামালকে হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল। কামাল শফিকের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিল। একসময় কামালের বউ এসে তাদের হোম মেড কিছু নাস্তা দিয়ে গেল। শফিক কথায় কথায় জানতে পারল কামাল সকালে ১০টা ছাত্র পড়ায়। আরো গর্বের বিষয় হচ্ছে কামালের মেয়েটা ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছে। ও এখন নাইনে পড়ে। শফিক জেনে অবাক হল শাহবাগ ও আশপাশের এলাকায় হকারের মাধ্যমে যত চার্জ লাইট বিক্রি হয় তার সবগুলোই কামালের বাসায় তৈরী। কামালের ভবিষ্যত পরিকল্পনা তার মেয়েকে ঘিরে। মেয়েকে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবে। তারা তিনজন প্রতি শুক্রবার বিকালে ঢাবি ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ায়। অবশেষে এল কামালের বুয়েট ড্রপআউটের কাহিনী।
কামালের বাবা অসুস্থ থাকত প্রায়ই। প্রায় ছয়মাস জেলা শহরে চিকিৎসার পর জানা যায় উনার ক্যান্সার। ততদিনে জমানো সব টাকা শেষ। কিছু ধারদেনা করে ঢাকায় আবার দেখানো হল। প্রচুর পরীক্ষা নীরিক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া গেল ক্যান্সারের ব্যাপারে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়া হল ইন্ডিয়ায় যাওয়ার। কিন্তু টাকা কোথায়? এদিকে আবার ধারের টাকার জন্য পাওনাদারদের চাপ। অল্প জমি আর বসতবাড়ি বিক্রি করে যা পাওয়া গেল তাতে চিকিৎসার খরচ মেটার কথা। প্রথমে নেয়া হল চেন্নাই। সেখান থেকে দুই মাস পর আবার ভেলর। ইন্ডিয়ানেবার তিনমাস নয়দিন পর তার বাবা মারা গেল। দেশে ফিরে দেখে থাকা-খাওয়ার জায়গা নাই। সব টাকা পয়সা শেষ। মানসিকভাবেও কামাল অনেক বিপর্যস্ত। সংসার চালাতে সে শহরে একটা জুতার দোকানে চাকরি নিল। চাকরিটা বেশী দিন টিকল না। চার মাস পর এক কর্মচারীর ষড়যন্ত্রে অনেকটা †চার সাব্যস্ত হয়ে চাকরিটা ছাড়তে হল। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। ছোট বোনের পড়ার খরচ চালানোটাই কঠিন হয়ে দাঁড়াল। কামালের হাতের লেখা ছিল অসাধারণ। সে শহরে একটা সাইনবোর্ড আর্টের দোকান দিবে বলে চিন্তা করল। কিন্তু টাকা কোথায় পাবে? শেষ পর্যন্ত তার ? ঠাঁই হল ঢাকার এক প্রান্তে। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়র বাসায় অনেকটা আশ্রিত হয়ে। বুয়েটে ততদিনে দুই সেমিস্টার গ্যাপ পড়ে গেছে। একমাস চেষ্টার পর দুইটা টিউশনি পেল। টিউশনিতে নতুন অবস্থায় টাকা বেশী পাওয়া যায় না। কামাল যা পাচ্ছে তাতে নিজেরই কোনরকম চলে। বাড়িতে টাকা পাঠাতে তার তিনমাস লাগল। টিউশনির সংখ্যা বাড়তে লাগল। তবে সকাল বিকাল তার সময় কমে গেল। কয়েক বছর পর এক ছাত্রের বাবার পরামর্শে টুকটাক ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি তৈরী করে বিক্রি শুরু করে।
(৩)
চার বছর পর কোন এক সন্ধ্যা বেলা। শফিক অফিসে তার বসের সামনে বসে আছে। শফিকের বস জামান সাহেবের মনটা খুব উৎফুল্ল। তিনি গত মাসে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। ব্যবসাটা খুব ভালো চলছে। সামনের মাসে সম্ভবত চীন যাবেন। শফিকের প্রমোশন হয়েছে। সে এখন সিনিয়র ম্যানেজার। বেতনও বেড়েছে অনেক। আগের বাসাটা ছেড়ে বাস স্ট্যান্ডের কাছে একটা বাসায় উঠেছে। পুরোনো সেই সোফাগুলো বেঁচে দিয়ে নতুন সোফা কিনেছে। গাড়ি কেনার টাকা আছে। চাইলেই কেনা যায় কিন্তু একটু সময় নিয়ে কিনবে। এলিফ্যান্ট রোডে একটা ফ্ল্যাটের বুকিং দিয়েছে গত বছর। ছেলে এ+ পেয়ে ভালো একটা কলেজে ভর্তি হয়েছে। জামান সাহেব তার পিএ-কে ডেকে দু’টা কফি দিতে বললেন। শফিক বোঝতে পারল বস ভালো কোন সংবাদ দিবে। নারায়ণগঞ্জের অর্ডারটা কি কনফার্ম হল নাকি?
-- এটা †দখেন। জামান সাহেব একটা দাওয়াত কার্ড এগিয়ে দিলেন। সরকারি খাম। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আসছে।
-- স্যার এটাতো খুবই খুশির খবর।
-- আমি সাগরের সাথে কথা বলেছি। আপনাকেও নিয়ে যাব।
-- থ্যাংক ইউ স্যার। শফিক খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল।
সাগর প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-৩। সে জামান সাহেবের আত্মীয়। আগামীকাল রাতে প্রধানমন্ত্রীর সাথে গণভবনে ডিনারের দাওয়াত। শফিক অনেক বড় বড় প্রোগ্রামে গেছে তবে গণভবনে কখনো যায়নি। খবরটা সবাইকে জানানো দরকার। নীপাকে ফোন করে বসুন্ধরা সিটির সামনে থাকতে। নীপার চয়েজ খুব ভালো। একটা শার্ট আর একটা টাই কিনতে হবে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে কেমন হয়? না, এখনই স্ট্যাটাস দেয়া ঠিক হবে না। অনুষ্ঠানের একটা ছবি তোলে কাল স্ট্যাটাস দিতে হবে। গণভবনের ভিতরে ছবি তুলতে দেয় কিনা কে জানে?
জামান সাহেবের গাড়িতে শফিক আর জামান সাহেব বসে আছে। এত জ্যাম। ঢাকা শহরে মানুষ থাকে কিভাবে! দেরী হলে গেইট দিয়ে ঢুকতে না দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। গণভবনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাদের রাত ৮টা পার হয়ে গেল। ভিতরে সুন্দর ফুলের বাগান। মন ভাল করা বাতাস বইছে। একজন সিকিউরিটি তাদের রাস্তা দেখিয়ে দিল ‘স্যার এদিকে’। এখানে সবাই প্রায় নিঃশব্দে কথা বলে। তাদেরকে বসতে দেয়া হল একটা সেমিনার রুমে। স্টেজে বসে আছেন প্রধানমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রীসহ অন্যরা। হঠাৎ শফিকের চোখ আটকে গেল তাদের সারির অপর প্রান্তে। কামাল বসে আছে ওখানে! সে দাওয়াত পেল কিভাবে? এখন উঠে গিয়ে কামালের সাথে কথা বলার পরিবেশ নাই। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হল। আচমকা স্টেজে কামালের ডাক পড়ল। এবছরের সেরা তরুণ উদ্যোক্তা কামাল আহমেদ। কামালের দিকে তাকিয়ে শফিক একটা শুকনো হাসি দিল। কামাল প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছে। কামালের চার্জ লাইট প্রকল্পে ১৫০ জন ছেলের কর্ম সংস্থান হয়েছে। তার ছোট খাট ফ্যাক্টরীতে এখন চার্জ লাইট ছাড়াও সৌর বিদ্যুতের সেল তৈরী হচ্ছে। সেখানে উৎপাদিত পণ্য দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। এসব পণ্য উৎপাদনের ফলে আমদানী উপর নির্ভরশীলতা কমছে। শফিক উঠে দাড়িয়ে মোবাইলে একটা ছবি তোলে নিল। তারপর তার বসকে কামাল সম্পর্কে জানাল। ডিনার শেষে কামালের সাথে কিছুক্ষণ কথা হল। কামালের মেয়ে এবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হয়েছে।
ফেরার পথে শফিক ফেসবুকে কামালের ছবিটা আপলোড দিল। ক্যাপশন “ জীবনের গল্প এতো ছোট নয় একদিনেই তা ফুরিয়ে যাবে ”।
* একটি পুণর্মিলণী স্মরণিকায় প্রকাশিত