চলতে চলতে খেয়াল করলাম কয়েকটা বিষয়। আগের চাইতে এখন ধানের চাষ বেশী হচ্ছে(আগে গম, ভূট্টাও চাষ হতো), সেচের জন্য প্রায় সব জায়গাতে সাব-মটার ব্যবহার করা হচ্ছে(আগে শ্যালো মেশিন/ডিজেল ইঞ্জিনে সেচ দিতো), নদী পুরোটা শুকিয়ে গেছে, চৈত্রে বাঁশের পাতা ঝরে পড়ায় চারিদিকে কেমন একটা রুক্ষ শুষ্ক ভাব।
বাসায় পৌছে টিউবয়েলে ফ্রেস হতে গিয়ে দেখি পানি ওঠে না! আবাক হলাম, ৫০-৬০ফিট নীচেও পানি নেই!(আগে ৩০-৪০ফিট নীচেই পানি পাওয়া যেত) পরে শুনলাম পাশের সাব-মটার(সেচপাম্প/বড় সাবমার্সিবল পাম্প। ওটা প্রায় ২০০ফিট দূরে অবস্থিত) যখন চলে টিউবয়েলে পানি থাকে না। ওটা বন্ধ করলে বা বিদ্যুৎ চলেগেলে টিউবয়েলে পানি ওঠে। আশ্চর্য হলাম, ডিপ টিউবয়েলের ১৫-২০ফিট দুরেই পুকুর। তারপরও পানি নেই। আগে দেখতাম নরমাল টিউবয়েলেই পানি উঠাতো। শুধু চৈত্র, বৈশাখে একটু সমস্যা হতো, তখন বড়িং(সেচ কাজে ব্যবহৃত) থেকে পানি নিয়ে আসা হতো।
বিকেলে ঘুরতে বের হলাম। পুরো মাঠ শুধু ধানের আবাদ, সবুজ আর সবুজ। হঠ্যাৎ খেয়াল করলাম মাঠের মাঝখানের উচু জমিগুলো(কয়েক একর) পড়ে আছে। পানির সংকটের ওখানে এবার ধান চাষ হয় নি। সবুজের মধ্যে জায়গাটা টাক মাথার মত বেখাপ্পা মনে হলো। আগে এখানে গম চাষ হতো, এক বছর ভূট্টার চাষ করেছিল। আমাদেরও কিছু জমি পড়ে ছিল। জ্ঞান হবার পর থেকে এবারই প্রথম দেখলাম ওখানে ইরির চাষ হয় নি।
মাঠের মাঝখানের থ্রী ফেজ ডিপ(বড় মটার) নষ্ট, ওখানে সিঙ্গের ফেজের সাব-মটার লাগিয়েছে। তাই আগের মত বেশী জামিতে পানি দিতে পারে না। আগে ৮-১০টা ডিজেল ইঞ্জিন/শ্যালো মেশিন দেখেছি, এবার একটাও চোখে পড়ে নি।[আমাদেরও একটা মেশিন ছিল, গর্ত করে(উপরের ছবির মত) মাটির নীচের পানি ওঠাতো।]
পরে বিষয়টা ক্লিয়ার হল। ডিজেলের দাম বেশী, পানির স্তরও নীচে চলে গিয়েছে। এখন গর্ত করলেও শ্যালো মেশিন দিয়ে বেশী পানি উঠানো যায় না। লাভ না হওয়ায় ওগুলো এখন বন্ধ। তার চেয়ে মটার/সাব-মটার সুবিধার। সেচ খরচ কম(সেচ পাম্পের পার ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ কম, লোডশেডিংও কম), সাব মার্সিবল পাম্পে পানিও ভালো ওঠে। ওই পানি মাটির নীচে লাইন করে এক-দেড় কিলো দুরে জমিতে দেয়া হয়। সমস্যা হল, আগের চাইতে পানি ওঠার পরিমান কমে গিয়েছে। কিন্তু এভাবে আর কত? ধান চাষ করতে প্রচুর ভূগর্ভস্ত পানি ব্যবহার করা হয়, যা পরিবেশ ও ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। এর বিকল্প ব্যবস্খা চিন্তা করা দরকার।
ধান চাষ করে খুব একটা লাভ হয় না -
ঘটনাটা গত ডিসেম্বরের। প্রায় পাঁচ বিঘা(১বিঘা= ৩৩শতাংশ) জমিতে আমন ধান(স্বর্ণা ৫) করেছিল। সব মিলিয়ে সেখানে খরচ হয়েছিল প্রায় ৬৫হাজার টাকা। মাড়াই শেষে ধান হয়েছি প্রায় ৯০মণ। ডিসেম্বরে ধানের দাম ছিল ৬৯০টাকা(মণ প্রতি), পরে দাম উঠলো ৭০০, ৭১০, ৭২০টাকা পর্যন্ত। আব্বা বললো নির্বাচনের পর দাম বাড়বে, ধান রেখে দেই। সেই শুনে লাভের আশায় আম্মা জমানো টাকা দিয়ে কিছু ধান কিনেও রাখলো। গত সপ্তাহে(এপ্রিল) শুনলাম প্রায় ৬০০টাকা দরে সব ধান বিক্রি করে দিয়েছে। লস তো লস, তার উপর লস। আশার কথা হল, টিউবয়েলের জায়গায় সাব মার্সিবল পাম্প বসিয়েছে। এবার আর পানির সমস্যা হবে না।
প্রশ্ন জাগতে পারে, ধান চাষ করে সবার কি লস হয়/লস হয়েছে। উত্তর- না। যারা নিজে থেকে শ্রম দেয় তাদের কিছুটা লাভ হয়, সেটাও নির্ভর করে ধানের বাজারের উপর। আমাদের যাবতীয় সব কাজ(জমি চাষ, আইল কাটা, ধান লাগানো, ঘাস তোলা, সার-বিষ দেয়া থেকে কাটা, বাঁধা, মাড়াই) লোক দিয়ে করাতে হয়। আমি পড়াশোনার কাজে শহরে থাকি, আব্বা একটা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকে। কাজের লোকেরা হল ফাঁকিবাজ, গেরস্থের কেউ না থাকলে ওরা কাজ করতে চায় না। তাই এই হাল।
ডিসেম্বরের প্রায় পুরোটাই গ্রামে ছিলাম। ধান মাড়াইয়ের ঐ সময়টায় দেখেছি নারী-পুরুষের অমানুষিক পরিশ্রম। সবার কাজ করা দেখে মনে খুব জোশ আসলো, সালা আমি একটু কাজ করি। ট্রাক্টর দিয়ে ধান তোলা, ধান মাড়াইয়ের মেশিন স্টার্ট দেয়া, আর মাড়াই করার দিন লোকদের সাথে টুকটাক এটা ওটা। ফলাফল: হাতের ফোস্কা, গায়ের ব্যাথা আর অলিখিত উপাধী, 'তরে দিয়া কোন কাজ হইবে না'
ঈশ্বর থাকেন শহরের ভদ্র পল্লীতে; চাষাদের মাঝে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।
ধান চাষে উৎপাদন খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। চাষের পুরো সময়টা অনিশ্চয়তা, উৎকন্ঠার মধ্যে কাটে। অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, ঝড় এসব হলে ফলন কয়েকমণ কমে যায়। অমানুষিক এত কষ্টের পর যথাযত দাম না পেয়ে কৃষকের মুখে হতাশার দেখলে খুব কষ্ট লাগে। খুব।
'বরেন্দ্র' নাকি ইন্দ্রের বর(আশির্বাদ) থেকে প্রাপ্ত ভূমি। মাঝে মাঝে ভাবি, এ কেমন বরের নমুনা!
বর্তমানে কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোটা খুব দরকার। তাদের বাঁচাতে হলে ধানের দাম যথাযত পর্যায়ে রাখতে হবে(সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হুট করে দাম কমানো/বাড়ানোটা আমার ভালো লাগে না)। আবার ধানের দাম বাড়ানো অযুহাতে চালের দাম বেশী করা যাবে না(চালকল মালিকরা/চাল ব্যবসায়ীরা যেটা করে)। ধান-চালের দামের মধ্যে একটা সমন্বয় রাখতে হবে। সরকার থেকে কম মূল্যে চাল দিতে দেখেছি, বেশী দামে ধান কিনতে দেখিনি। হয়তো কেনে, যখন হাতে ধান থাকে না তখন।
অনেকে হাইব্রীড ধানের কথা তুলতে পারে। ওই ধানের ফলন আসলেই বেশী। তবে চাল মোটা হওয়ায় দাম কম। ফলাফল লাউ আর কদু।
©অনু সাহা
(ছবিগুলো নেট থেকে সংগ্রহ করা)
// Water Resource Management/Engineering - মোস্তফা কামাল পলাশ এর ব্লগ
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১১:২৩