somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডায়রির পাতা থেকেঃ বরেন্দ্র অঞ্চলের কথা ও কিছু ভাবনা

১৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২১মার্চ ২০১৯, একটা অনুষ্ঠানে গ্রামে গিয়েছিলাম। প্রথমে বাসে তারপর অটোতে করে মোড়ে(পাশের গ্রামে) যখন নামলাম, তখন প্রায় মধ্য দুপুর। মোড়ের বেশীরভাগ দোকান বন্ধ। বছর কয়েক আগে গ্রামের স্কুল মাঠ পর্যন্ত পাকা রাস্তা করেছে, ওদিক দিয়ে বাসায় গেলে পথ দুই কিলো। একদিকে ভ্যাপসা গরম, অন্যদিকে রাস্তায় কোন ভ্যান নেই। বেশীক্ষণ বসে থাকতে ইচ্ছে করলো না, বিধায় ব্যাগ কাঁধে সর্টকার্ট রাস্তায় হাঁটা শুরু করলাম। এ পথে হাঁটতে হবে প্রায় এক কিলো। এর মধ্যে হাফ কিলো মাঠের(ধান ক্ষেত) মধ্যে দিয়ে, মাঝখানে পড়বে ছোট নদী/খাড়ি, ওটা পেরিয়ে বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে স্বল্প দূরত্বের পায়ে হাঁটা পথ(কাঁচা রাস্তা)।

চলতে চলতে খেয়াল করলাম কয়েকটা বিষয়। আগের চাইতে এখন ধানের চাষ বেশী হচ্ছে(আগে গম, ভূট্টাও চাষ হতো), সেচের জন্য প্রায় সব জায়গাতে সাব-মটার ব্যবহার করা হচ্ছে(আগে শ্যালো মেশিন/ডিজেল ইঞ্জিনে সেচ দিতো), নদী পুরোটা শুকিয়ে গেছে, চৈত্রে বাঁশের পাতা ঝরে পড়ায় চারিদিকে কেমন একটা রুক্ষ শুষ্ক ভাব।

বাসায় পৌছে টিউবয়েলে ফ্রেস হতে গিয়ে দেখি পানি ওঠে না! আবাক হলাম, ৫০-৬০ফিট নীচেও পানি নেই!(আগে ৩০-৪০ফিট নীচেই পানি পাওয়া যেত) পরে শুনলাম পাশের সাব-মটার(সেচপাম্প/বড় সাবমার্সিবল পাম্প। ওটা প্রায় ২০০ফিট দূরে অবস্থিত) যখন চলে টিউবয়েলে পানি থাকে না। ওটা বন্ধ করলে বা বিদ্যুৎ চলেগেলে টিউবয়েলে পানি ওঠে। আশ্চর্য হলাম, ডিপ টিউবয়েলের ১৫-২০ফিট দুরেই পুকুর। তারপরও পানি নেই। আগে দেখতাম নরমাল টিউবয়েলেই পানি উঠাতো। শুধু চৈত্র, বৈশাখে একটু সমস্যা হতো, তখন বড়িং(সেচ কাজে ব্যবহৃত) থেকে পানি নিয়ে আসা হতো।


বিকেলে ঘুরতে বের হলাম। পুরো মাঠ শুধু ধানের আবাদ, সবুজ আর সবুজ। হঠ্যাৎ খেয়াল করলাম মাঠের মাঝখানের উচু জমিগুলো(কয়েক একর) পড়ে আছে। পানির সংকটের ওখানে এবার ধান চাষ হয় নি। সবুজের মধ্যে জায়গাটা টাক মাথার মত বেখাপ্পা মনে হলো। আগে এখানে গম চাষ হতো, এক বছর ভূট্টার চাষ করেছিল। আমাদেরও কিছু জমি পড়ে ছিল। জ্ঞান হবার পর থেকে এবারই প্রথম দেখলাম ওখানে ইরির চাষ হয় নি।

মাঠের মাঝখানের থ্রী ফেজ ডিপ(বড় মটার) নষ্ট, ওখানে সিঙ্গের ফেজের সাব-মটার লাগিয়েছে। তাই আগের মত বেশী জামিতে পানি দিতে পারে না। আগে ৮-১০টা ডিজেল ইঞ্জিন/শ্যালো মেশিন দেখেছি, এবার একটাও চোখে পড়ে নি।[আমাদেরও একটা মেশিন ছিল, গর্ত করে(উপরের ছবির মত) মাটির নীচের পানি ওঠাতো।]

পরে বিষয়টা ক্লিয়ার হল। ডিজেলের দাম বেশী, পানির স্তরও নীচে চলে গিয়েছে। এখন গর্ত করলেও শ্যালো মেশিন দিয়ে বেশী পানি উঠানো যায় না। লাভ না হওয়ায় ওগুলো এখন বন্ধ। তার চেয়ে মটার/সাব-মটার সুবিধার। সেচ খরচ কম(সেচ পাম্পের পার ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ কম, লোডশেডিংও কম), সাব মার্সিবল পাম্পে পানিও ভালো ওঠে। ওই পানি মাটির নীচে লাইন করে এক-দেড় কিলো দুরে জমিতে দেয়া হয়। সমস্যা হল, আগের চাইতে পানি ওঠার পরিমান কমে গিয়েছে। কিন্তু এভাবে আর কত? ধান চাষ করতে প্রচুর ভূগর্ভস্ত পানি ব্যবহার করা হয়, যা পরিবেশ ও ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। এর বিকল্প ব্যবস্খা চিন্তা করা দরকার।

ধান চাষ করে খুব একটা লাভ হয় না -
ঘটনাটা গত ডিসেম্বরের। প্রায় পাঁচ বিঘা(১বিঘা= ৩৩শতাংশ) জমিতে আমন ধান(স্বর্ণা ৫) করেছিল। সব মিলিয়ে সেখানে খরচ হয়েছিল প্রায় ৬৫হাজার টাকা। মাড়াই শেষে ধান হয়েছি প্রায় ৯০মণ। ডিসেম্বরে ধানের দাম ছিল ৬৯০টাকা(মণ প্রতি), পরে দাম উঠলো ৭০০, ৭১০, ৭২০টাকা পর্যন্ত। আব্বা বললো নির্বাচনের পর দাম বাড়বে, ধান রেখে দেই। সেই শুনে লাভের আশায় আম্মা জমানো টাকা দিয়ে কিছু ধান কিনেও রাখলো। গত সপ্তাহে(এপ্রিল) শুনলাম প্রায় ৬০০টাকা দরে সব ধান বিক্রি করে দিয়েছে। লস তো লস, তার উপর লস। আশার কথা হল, টিউবয়েলের জায়গায় সাব মার্সিবল পাম্প বসিয়েছে। এবার আর পানির সমস্যা হবে না।


প্রশ্ন জাগতে পারে, ধান চাষ করে সবার কি লস হয়/লস হয়েছে। উত্তর- না। যারা নিজে থেকে শ্রম দেয় তাদের কিছুটা লাভ হয়, সেটাও নির্ভর করে ধানের বাজারের উপর। আমাদের যাবতীয় সব কাজ(জমি চাষ, আইল কাটা, ধান লাগানো, ঘাস তোলা, সার-বিষ দেয়া থেকে কাটা, বাঁধা, মাড়াই) লোক দিয়ে করাতে হয়। আমি পড়াশোনার কাজে শহরে থাকি, আব্বা একটা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকে। কাজের লোকেরা হল ফাঁকিবাজ, গেরস্থের কেউ না থাকলে ওরা কাজ করতে চায় না। তাই এই হাল।

ডিসেম্বরের প্রায় পুরোটাই গ্রামে ছিলাম। ধান মাড়াইয়ের ঐ সময়টায় দেখেছি নারী-পুরুষের অমানুষিক পরিশ্রম। সবার কাজ করা দেখে মনে খুব জোশ আসলো, সালা আমি একটু কাজ করি। ট্রাক্টর দিয়ে ধান তোলা, ধান মাড়াইয়ের মেশিন স্টার্ট দেয়া, আর মাড়াই করার দিন লোকদের সাথে টুকটাক এটা ওটা। ফলাফল: হাতের ফোস্কা, গায়ের ব্যাথা আর অলিখিত উপাধী, 'তরে দিয়া কোন কাজ হইবে না'


ঈশ্বর থাকেন শহরের ভদ্র পল্লীতে; চাষাদের মাঝে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।
ধান চাষে উৎপাদন খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। চাষের পুরো সময়টা অনিশ্চয়তা, উৎকন্ঠার মধ্যে কাটে। অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, ঝড় এসব হলে ফলন কয়েকমণ কমে যায়। অমানুষিক এত কষ্টের পর যথাযত দাম না পেয়ে কৃষকের মুখে হতাশার দেখলে খুব কষ্ট লাগে। খুব।
'বরেন্দ্র' নাকি ইন্দ্রের বর(আশির্বাদ) থেকে প্রাপ্ত ভূমি। মাঝে মাঝে ভাবি, এ কেমন বরের নমুনা!

বর্তমানে কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোটা খুব দরকার। তাদের বাঁচাতে হলে ধানের দাম যথাযত পর্যায়ে রাখতে হবে(সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হুট করে দাম কমানো/বাড়ানোটা আমার ভালো লাগে না)। আবার ধানের দাম বাড়ানো অযুহাতে চালের দাম বেশী করা যাবে না(চালকল মালিকরা/চাল ব্যবসায়ীরা যেটা করে)। ধান-চালের দামের মধ্যে একটা সমন্বয় রাখতে হবে। সরকার থেকে কম মূল্যে চাল দিতে দেখেছি, বেশী দামে ধান কিনতে দেখিনি। হয়তো কেনে, যখন হাতে ধান থাকে না তখন।

অনেকে হাইব্রীড ধানের কথা তুলতে পারে। ওই ধানের ফলন আসলেই বেশী। তবে চাল মোটা হওয়ায় দাম কম। ফলাফল লাউ আর কদু।
©অনু সাহা


(ছবিগুলো নেট থেকে সংগ্রহ করা)
// Water Resource Management/Engineering - মোস্তফা কামাল পলাশ এর ব্লগ
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১১:২৩
৯টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×