somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বইঃ অপরাজিতা, লেখক- হোসনে আরা মণি, প্রকাশক- সময় প্রকাশন।

২২ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




পরাজিতা
হোসনে আরা মণি
প্রকাশক ঃ সময় প্রকাশন, ৩৮/২ ক বাংলা বাজার, ঢাকা
প্রকাশকাল ঃ একুশে বইমেলা’ ২০১৩
প্রচ্ছদ ঃ ধ্রব এষ
মূল্য ঃ ২২৫ টাকা ।

হোসনে আরা মণির প্রথম গল্পগ্রন্থ অপরাজিতাকে শকুনের চোখে চাক্ষুষ এবং নিষ্ঠুর পাঠক অন্তরে অনুভব করতে প্রয়াস পেয়েছি। শকুন এবং নিষ্ঠুর এই অর্থে যে ছিদ্রান্বেষনের একটা ইতিবাচক চেতনাকে টনটনা রেখে তার গ্রন্থের আদ্যপান্ত যাকে বলে গোগ্রাসে গিলেছি। নিরপেক্ষতার নামে কিছুটা বৈপাক্ষিক ব্যবধানে থেকে পড়তে বসা। কিন্ত প্রথম কয়েক পাতা ওল্টাতেই বইটি আমাকে বেদম কামড়ে ধরলো। অনাত্মীয়সুলভ ব্যবধান ঘুঁচিয়ে বইটি আমাকে নিবেশিত করে তুললো আশ্চর্য গল্পশক্তিতে। অতএব শুরুতেই হোসনে আরা মণিকে শাবাশি সাধুবাদ। বড় মাপের ছোটগল্প লেখার কব্জি তার আছে সত্য। সৃজনরাজ্যের বহুপথ তিনি অতিক্রম করবেন, সেই স্বপ্ন দেখার অধিকারকে তিনি উস্কে দিয়ে আমাকে সমুগ্ধ প্রাণিত করলেন। কথাসাহিত্যের তোরণে তাকে স্বাগত না বললে নিজের সাথে প্রতারণা করা হবে।

মোট বারোটি গল্প নিয়ে অপরাজিতা । গল্পগুলোর প্রত্যেকটি স্বকীয় পার্থক্যে সমুজ্জ্বল, বিষয় বৈশিষ্ঠ্যেও পরিপুষ্ঠ, ভিন্নতায় সাহিত্যিক সমৃদ্ধি রয়েছে তাতে। কিন্ত প্রতিটি গল্পের মূলসুরে একটি আর্থসামাজিক সাজুয্যের সমন্বয় খুবই মুন্সিয়ানাসমৃদ্ধ অবয়বে ভাস্বর। সেটা হলোঃ জেন্ডার-বৈষম্য পীড়িত সমাজে নারীর বঞ্চনা এবং চূড়ান্ত বিচারে পুরুষের পুরুষোচিত নৈষ্ঠুর্য্যরে পরাকাষ্ঠার যূপে বন্দি সমাজবাস্থবতা। এই সত্যকে তুলে আনতে কথাশিল্পের রং নির্বাচন এবং তুলির আঁচড় টানতে মণি তার কেরামতি দেখাতে যে সক্ষম হয়েছেন, তা যে কোন পাঠক অপরাজিতার মুখোমুখি হলেই বিস্ময়কর অনায়াসে উপলব্ধি করবেন। সমাজ সংসারকে দেখার, নারী-পুরুষকে আত্মীয়তার হিসাব ব্যতিরেকে নৃ-প্রাকৃতিক সত্যের চশমায় পুরুষতন্ত্র এবং সমাজ-অভ্যন্তরের বহুরৈখিক কাদর্য্যকে প্রতিফলিত করার যে কথাশক্তি দেখিয়েছেন মণি, তা খুবই সম্ভাবনাময়। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, তিনি এখনই মুন্সি কথাকার ।

সমাজের নিষ্ঠুরতাকে কিভাবে তিনি খনিখনন করেছেন, সেই নৈপুন্যের দক্ষতা দেখাতে কয়েকটা নমুনা এখানে তুলে ধরা যেতে পারে । যেমনঃ ‘------ গেল রাতে ওসমানের প্রাক্তন বৌয়ের নতুন বিয়ে হয়ে এ বাড়িতেই বাসর হয়েছে ।’ ‘----- মানুষের তৈরী আইন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি যত কম করা যায় ততই ভাল কিন্ত আল্লার আইনেতো ফাঁকি চলে না।’ ‘----- এখন প্রশ্ন হলো কে টিয়ার দ্বিতীয় ও একরাতের স্বামী হবে? দেখা গেল একাজে উমেদারের অভাব গ্রামে নেই। টিয়ার চেয়ে বয়:কনিষ্ঠ যুবক হতে শুরু করে ষাটোর্ধ্ব ও সর্বজনমান্য বৃদ্ধকেও সে তালিকায় পাওয়া গেল।’ ‘------ আর এ কথা কে না জানে যে নতুন স্বামী যদি স্বেচ্ছায় টিয়াকে তালাক না দেয় তাহলে টিয়াকে ফিরে পাওয়ার সব আশা ওসমানের দুরাশায় পরিণত হবে’ ( হিল্লা, পৃষ্ঠা ২৭)। “----- পুরুষের পাপকে খোদ খোদাতায়ালাই আড়াল করে রাখে; নারীর পাপ বড় বেশি উন্মুক্ত, বড্ড প্রকাশ্য।’ ‘----- আমি বাচ্চা-কাচ্চা নিচ্ছিনা কেন জানিস? যদি ছেলে হয় তাকে দুধ দিতে হবে। মায়ের স্তন পান করে বড় হয় সে অন্য নারীর স্তনে হামলে পড়বে। উহু আমি তো সেটি হতে দিব না’ ‘---- নিজের অপমানিত হবার পালাটা শেষ হতে না হতেই আত্মজার অপমানকে উপলব্ধি করা। আমি পারবনারে ,আমার মেয়ের জীবনে আমার বেদনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পারব না’ ( তিথির অতিথি, পৃষ্ঠা ৭৪, ৮২)। ‘------ তাছাড়া বিশ বছর ধরে উপোসী ষাট বছরের বুড়োর আর কতইবা ক্ষমতা। মজিলাকে তাই দীর্ঘক্ষণ কষ্ট পেতে হয় না’ ( কলঙ্কিত চাঁদ, পৃষ্ঠা ৮৭)। ‘------ স্ত্রীর উপর স্বামীর প্রভুত্বের অধিকার সব ধর্মই কি স্বীকার করেনি’ (অসূয়া, পৃষ্ঠা ৯৯)। ‘---- বেশির ভাগ ডাক্তারতো রোগীর কথা না শুনেই প্রেসক্রিপশন লিখতে শুরু করে’ ( শক, পৃষ্ঠা ১১৯)। ‘----- কারণ মাদ্রাসা শিক্ষার পেছনে দান খয়রাত করলে বেহেস্তে দাখিল হবার পথ সুগম হয় কিন্ত কলেজ ছাত্রের বিষয়ে কোনো কথা কেতাবে লেখা নেই’ ( শক, পৃষ্ঠা ১১৯,১২৮)। এ রকম ঢের উদ্ধৃতি দেয়া যাবে যার আগ-পাছ জানা না থাকা সত্বেও পূর্ণাঙ্গ সব সমাজ, সংসার, ধর্ম, নারীবঞ্চনা ,প্রশাসন, চিকিৎসা ও জাতিয় বিভিন্ন অন্তর্চিত্রের ঘৃণ্য ও বিস্ময়কর এমনসব সহজ বিষয় জানাবোঝা যাবে যা খুবই আটপৌরে হওয়ার সত্বেও স্বভাবতঃই আমরা দেখি না, দেখাই না । এক্ষেত্রে হোসনে আরা মণি তা-সবকে দেখাতে চোখে আঙ্গুল দেয়ার সাহসিকতা দেখিয়েছেন।

মণি নানা রঙের নানা সুতোয় একপ্রস্ত মসলিন বুনেছেন দক্ষ তাঁতীর পারঙ্গমতায়। তা দ্রষ্ঠব্যে এবং পরিধানে সমান সুন্দর। কিন্ত খুব কাছে থেকে গভীর বীক্ষণে দেখলে নয়নাভিরাম চিত্রেকেও কিছু কিছু ঝাপসা লাগে । দোষের সেই সৌন্দর্যগুনও যে তার বাক্যবয়নে রয়েছে তা অসত্য নয় । কিন্ত সেটা মূলের মূলকে বিশেষ ব্যাহত করতে পারেনি । কিছু কিছু শব্দ প্রয়োগ, সম্পাদনার অসাবধান ঔদাস্য , বহুবচয়ের দ্বিত্ব প্রয়োগ, বানান-রীতিতে বাংলা একাডেমীর প্রমিত রূপকে অগ্রাহ্যের বিষয়গুলো না ঘটলেই ভালো হতো। আমাদের লেখাচর্চায় সাধারণতঃ যেসব বানান স্খলন ঘটে, তারই মামুলি ভুলগুলো অপরাজিতায় প্রযুক্ত হতে দেখা যায়, তা বড় চোখে লাগে, মনেও। যেমন, ‘অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে’, ‘ফয়েস লেক’, ‘অগুনতি তারাদের, ‘মলচত্বর’, ‘হ্নদ্যতাপূর্ণ’, ‘যেসব স্বপ্নগুলো’। এইসব ভ্রমাত্মক কাঁটাগুলো বাছাই হয়ে যেতে পারেনি বোধহয় এজন্য যে, বইটি ছাপাযন্ত্রে ওঠার আগে পেশাদার প্রুফ রিডারের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত। আরো কিছু কষ্টবোধ আছে অপরাজিতার শরীরে। যা ঘটা কোনোক্রমেই উচিত হয়নি। যেমন ‘দূর্বল’ (পৃষ্ঠা ১৫,৩৫,৯৫,৯৭)। দুর্ঘটনার বানান ক্ষেত্রেও সর্বত্র দুর্ঘটনা ঘটেছে, হ্রস্ব উ না লিখে লেখা হয়েছে দীর্ঘ উ, তা কেন? বড় লজ্জা, যেমন: ‘দূর্ঘটনা’ ( পৃষ্ঠা ৪৮, ৫২), ‘দূর্বলতা’ (পৃষ্ঠা ৫৬), ‘দূর্দান্ত’ (পৃষ্ঠা ১৪১), ‘স্তুপ’ (পৃষ্ঠা৭৫), ‘অভূক্ত’, এগুলো খুব সাধারণ মানের ভুল যা অপরাজিতাকে কর্দমাক্ত করেছে বৈকি। আরো আছে ভুল শব্দ, যেমন সবেগে (পৃষ্ঠা ৮৪), সযত্নে (পৃষ্ঠা ১১৪)। খুব সাধারণরা যে সব ভুল করেন, তারই আঁধার এই গ্রন্থে নেমে এসেছে অজ্ঞতার সাহসে। যা পাঠককে আহত করবে, চাইকি ওমন নামী প্রকাশককে পর্যন্ত অদক্ষ ভাবাবে। কোলন এবং বিসর্গ এর প্রয়োগ একাধিক ক্ষেত্রে যথাযথ হয়নি। এরকম অনেক ক্ষেত্র রয়েছে এই বইটিতে যা অনেক বেশি সাবধানী সম্পাদনার দাবি রাখে। এখন ভরসা দ্বিতীয় সংস্করণ তাতে অপরাজিতা কে নির্বান দেওয়া জরুরী।।

সবমিলিয়ে চূড়ান্ত বিচারে হোসনে আরা মণি, প্রকাশক, প্রচ্ছদ শিল্পী ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। এই গ্রন্থের বহুল প্রচার কামনা করা যেতে পারে। কেননা কিছু কিছু অসঙ্গতি থাকা সত্বেও গল্পগুলো উর্ত্তীর্ণ হয়েছে এবং তার যে কমিউনিকেটিভ সমাজবার্তা নির্মানের মাহাত্ম্য সেটা নির্মানে মণি সফল হয়েছেন। তার শুভ হোক । ১৪/০৩/২০১৩ খ্রিঃ।

বিলু কবীর
৫/১০ হমায়ূন রোড,
মোহম্মপুর, ঢাকা ১২০৭
মোবাইল নম্বর ০১৮১৭১৬৯৩১৭

৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×