বারঘোনা বাজারটায় যেতে হয় বারঘোনা কলোনীটাকে পাশ কাটিয়ে । অনেক ভাবে যাওয়া যায় তবে গম ভাঙ্গানোর মেশিনটা পেরিয়ে যেতে সুবিধা । গম ভাঙ্গানোর মেশিনটা পেরিয়ে যাবার সময় গরম আটার একটা তামাটে পোড়া গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায় । লোকটা তখন ছুপড়ির বাইরে এসে বসে । গরমের তেতো একটা রোদ উড়ে বেরায় । কখনো আচমকা কর্ণফুলী রেয়ন মিলের বিটকেলে গন্ধ । লুঙ্গিটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে লোকটা ফস করে বিড়ি ধরায় । প্রথম বস্তা গম উপুড় করে মেশিনের ইয়াব্বড় মুখে ছাড়া হয়েছে । পিচ্চি সহকারীটা সময় হলেই ডাক দেবে : ওস্তাদ । হাতে মেলা সময় আছে । এই সুযোগেই বিড়ি ধরানোর মওকা পাওয়া গেছে । গায়ের গেঞ্জীটা ঘামে গায়ে লেগে চিমসে রোদ্দুরে হয়ে আছে । বিড়ি দুই টান কষে টেনে দেবার পরই লোকটা ডাক দেয় কলের শব্দ ছাপিয়ে –
এরোই যা তো,একখান মুরগীর পাখনা লই আয় ।
লোকটা মুরগীর পাখা দিয়ে চোখ বুজে আরামে কান চুলকাবে । বিনা পয়সার সুখ । ১২ নম্বর লাইনের ঢোকার মুখেই অনেকগুলো বিশাল আম গাছ,একটা রেইনট্রি গাছও আছে বড় ড্রেনটার এপাশে । এতো বড় বড় গাছের কারনে রোদ এসে জমিনে পড়ে না ফলে প্রখর রোদে ও জায়গাটায় এ সময়ে ডাবের পানির মতো আরাম । লোকটার ছোট ভাই চৌদ্দগ্রামে রিক্সা চালাতো কিছুদিন আগ পর্যন্ত । আরেক রিক্সাওয়ালার বউয়ের সাথে খানিক ইচিকদানা বিচিকদানা হওয়ার সাথে সাথে ধরা,বিচার,শালিশ । ছোট ভাইটা চৌদ্দগ্রাম ছাড়া । ভাড়া রিক্সা কোনো রকম জমা দিয়ে চন্দ্রঘোনা এসে হাজির,বড় ভাইছা’র (বড় ভাই) কাছে । বড় ভাই এই গম ভাঙ্গআর মেশিনে কাজ করে । কাজ টেমপোরারী । পেপার মিলে এরকম টেমপোরারী শ্রমিক অগনিত । ইউনিয়ন নেতা কালাম গ্রুপ করে । লোকটার মাথায় এতো সব গ্রুপিং ট্রুপিং ঢোকে না । কালাম সাহেবের লাঠিয়াল পিলু ওকে এই গমের মেশিনে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে । মন্দ না । শুধু মিছিলের টাইম এলেই লোকটা ভড়কে যায় ।
তো ছোট ভাই ঘাড়ের উপর এসে পড়াতে লোকটার বউ খুব ঘ্যান ঘ্যান করলো । পারে তো নিজের ভাতার-কে ঘর ছাড়া করে । শেষে কালাম গ্রুপের কে যেন পরামর্শ দিলো বারঘোনিয়া কলোনীতে ঝাঁকা মাথায় করে ক্ষিরা বিক্রি করার জন্য । গরমে সামান্য লবন মরিচ দিয়ে কাটা ফালি ভালি ক্ষিরা খুব চলবে । অমৃত ।
ছোট ভাইটা সুরে সুরে ‘এই ঠান্ডা ক্ষীরাই’ ডেকে ডেকে ১২ লাইন ধরে ঢুকে পড়ে । কেপিএম স্কুলের সময় আসে । চারপাশ দল বেঁধে ছেলে মেয়েরা বই খাতা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে । দলে দলে । লোকটা এরকম নানা বর্ণের ছেলে মেয়ে দেখে সুর করে ডাকা ভুলে যায় ।
কনকের গীটার প্র্যাকটিস বেড়ে যায় । ৭ নম্বর লাইনের মাঝামাঝি ওদের বাসা । ওই দুপুর বেলা কনক গান শুরু করে “আবার এলো যে সন্ধ্যা ..” । লাকী আখন্দ এসে দাঁড়ায় ৭ নম্বর লাইনে । জাহাঙ্গীর রেজা গোরা সাদা জানালার পর্দা তুলে দেয় । রেডিওর ভলিউম বেড়ে যায় আচমকা । প্রজাপতির মতো বাতাসে নার্গিস পারভীনের গানের গলা ভেসে আসে
ভালোবাসা দিয়ে মোরে এত সুখ দিয়েছো,চাই না আর চাই না
মোশাররফ তখন কালুর দোকানে সিঙ্গারা খেতে খেতে লাতু’র কথা ভাবছিল । কি করে আজ চন্দ্রিমা হলে নতুন মুক্তি পাওয়া ছবি “ সবুজ সাথী” দেখা যাবে । খুব প্যাথেটিক মুভি । কাঁদতে কাঁদতে সবাই হল থেকে বের হয় । এরকম সুখ সুখ ভাবতে এক কামড়ে সিঙ্গারা সাবাড় করবে ভাবতে গিয়ে জিভে পরম ছ্যাকা এসে লাগে । উফ । কালুকে লক্ষ্য করে মোশাররফ,দেখে কালু টাইট হয়ে ক্যাশে বসে আছে । মোশাররফ মুহূর্তে বুঝে ফেলে যে আজ বিকেলে ভিউ ক্লাবে অনুষ্ঠান আছে । অনুষ্ঠান এলেই কালু’র মাঞ্জা মারা যায় । চুলের ভাজ যেন নষ্ট না হয় সেজন্য টুপি পড়ে থাকে । ফিক করে হেসে ফেলে মোশাররফ ।
দুপুরটা চিল পাখির মতো উড়ে যায় । চন্দ্রিমা সিনেমা হলের পাশে নিরীহ গোছের মশু সিগারেটের ভিতর গাঁজা নিয়ে ঘোরে । ইশারা দিলেই ভদ্র লোকের মতো আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে । না চেনার ভান করে মুখ না ঘুরিয়েই জিজ্ঞেস করবে
কয়টা লাগবো ?
আবারো দুপুর নামে চন্দ্রঘোনায় । বারঘোনা বাজারে আজ কাঁঠাল আর কলার মেলা বসেছে । পাঁকা কাঁঠালের গন্ধে মৌ মৌ পুরো বাজার । ছোট ভাইটা তখন স্কুলের পথে ক’টা মেয়ের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে,সুরের ডাক থেমে যায় । ব্রিক ফিল্ডের পাশে রেলগাড়ির মতো চাকাগুলোতে রোদের তীব্র আলো পড়ে ঝলসে যায় ।
ঘর থেকে একটা বড়সড় পোটলার মতো কি যেন নিয়ে বেরুতেই জাহাঙ্গীর রেজা গোরা’র মা জোরে ডাক দিয়ে বসে :
ও গোরা , গোরা চাল নিয়ে যাচ্ছিস কনে ?
মুহূর্তেই খান খান রোদ ভেঙ্গে চৌচির হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বারঘোনায়,চন্দ্রঘোনায় । কী যে একটা দুপুর !

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



