সদরঘাটের ভাসমান নৌকা হোটেল
আপেল মাহমুদ
সদরঘাটের বুড়িগঙ্গায় ভাসমান নৌকা হোটেলের ঐতিহ্য বেশ প্রাচীন। পঞ্চাশ বছর আগেও এসবের অধিকাংশই ছিল হিন্দু হোটেল। বুড়িগঙ্গার বুকে তখন ভাসত পঞ্চাশটিরও বেশি নৌকা। মূলত ঢাকার বাইরে থেকে আসা ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষই এসব হোটেলে থাকা ও খাওয়ার জন্য যেত। এখন নৌকা সংখ্যা কমে পাঁচটিতে দাঁড়িয়েছে। নৌকা হোটেলগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে শুধু থাকার জন্য।
বুড়িগঙ্গা হিন্দু হোটেল
বুড়িগঙ্গা হোটেলটি মূলত ঢাকার বাইরে থেকে আসা হিন্দু ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। সেই সময় মদনমোহন কু-ু ছিলেন এর মূল মালিক। বর্তমানে এর মালিক নয়া মিয়া। মালিক বদলালেও হোটেলের মূল কাগজপত্র ও লাইসেন্স এখনও মদনমোহন কুণ্ডুর নামেই আছে। হোটেলটির নামেও কোনও পরিবর্তন আসেনি। এ ব্যাপারে হোটেলটির ম্যানেজার আবদুল হাই বলেন, ২৫ বছর আগে এলাকার প্রভাবশালী নয়া মিয়াকে হোটেলটি দিয়ে মদনমোহন ভারতে চলে যান। তিনি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কোনও কিছুই পরিবর্তন করা হয়নি।
৫০ কেবিনের এই তিন তলা হোটেলটি এক সময় হিন্দু ব্যবসায়ীদের পদচারণায় মুখরিত ছিল। শুধু থাকা নয় অল্প খরচে খাবারেরও সুব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে খাবার বন্ধ হয়ে গেছে, সেই সঙ্গে থাকার সুব্যবস্থাটিও দুরবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে। এ ব্যাপারে ম্যানেজার বলেন, ‘নদীর পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে, তাই খাবারও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আগে বুড়িগঙ্গার পানি দিয়ে রান্নাবান্না করা হতো, কিন্তু এখন পানি কিনে আনতে হয়। এতে ঝামেলা এবং খরচ বাড়ে। তাছাড়া নদীর দুর্গন্ধে থাকাই কঠিন, খাবারের ব্যবস্থা করব কিভাবে। বুড়িগঙ্গা হিন্দু হোটেলে বর্তমানে ঘাটের শ্রমিক, ফল বিক্রেতা ও হকারদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। দৈনিক ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকায় নিরাপদে থাকার জন্য এটি ব্যবহার করছে তারা।
শরীয়তপুর হোটেল
শুরুতে হোটেলটির নাম ছিল পুষ্পিতা আবাসিক হোটেল এবং এর মালিক ছিলেন গান্ধী বাবু। সেই সময় এটি হিন্দু হোটেল নামেই পরিচিত ছিল। বাবরি মসজিদ নিয়ে ভারতে যখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয় তখন সেই দাঙ্গার আঁচ লাগে গান্ধী বাবুর হোটেলে। স্থানীয় মুসলমানরা হোটেলটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। গান্ধী বাবু এ দেশ ছেড়ে চলে গেলে আবদুস সাত্তার নামে স্থানীয় ব্যবসায়ী নৌকা হোটেলটির সংস্কার করেন। কাঠের বদলে স্টিলের বডি দিয়ে হোটেলটি দুই তলা করেন। শুরুতে এখানে থাকা এবং খাওয়া দুটোর ব্যবস্থাই ছিল। বর্তমানে এটিতে যারা থাকে তাদের বাইরের হোটেলে খাবার সারতে হয়।
শরীয়তপুর হোটেলটির ম্যানেজার বলেন, খাবারের আয়োজন করা খুবই ঝামেলার কাজ। তাই খাবার বন্ধ করে দিয়েছি। বর্তমানে শুধু থাকার ব্যবস্থা আছে, ফলে যে কেউ খুবই অল্প খরচে এখানে থাকতে পারে।
উজালা হিন্দু হোটেল
উজালা হিন্দু হোটেলটির বর্তমান মালিক চুনকুটিয়ার ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম। বর্তমানে তার বাবা নয়া মিয়া হোটেলটি দেখাশোনা করেন। ৩৩ কেবিনের ৩ তলা নৌকা হোটেলটি এক সময় হিন্দু মালিকানাধীন ছিল। আজ থেকে ১০ বছর আগে নয়া মিয়া হোটেলটি কিনে নেন। বর্তমানে হোটেলটিতে যারা থাকেন তাদের অধিকাংশ ঘাটের সরদার, শ্রমিক ও হকার। এই হোটেলে অনেকে আবার স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছেন। এ রকম একজন ঘাটের সরদার জাহাঙ্গীর বলেন, প্রায় ৭ বছর ধরে এখানে রয়েছি। বাইরে বাড়িভাড়া কিংবা হোটেলে থাকতে গেলে অনেক খরচ হয়। তার চেয়ে ত্রিশ বা চল্লিশ টাকায় এখানে থাকা অনেক ভালো। তবে এখানকার পরিবেশ খুব একটা ভালো না। একহাত জায়গার মধ্যে গুটিসুটি হয়ে থাকতে হয়। তাছাড়া ছারপোকা ও মশার অত্যাচার রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আগে বুড়িগঙ্গার পানি দিয়ে গোসল করতাম। এখন টয়লেট ছাড়া আর কোনও কাজে বুড়িগঙ্গার পানি ব্যবহার করা যায় না। আগে হোটেল থেকে খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ফরিদপুর মুসলিম আবাসিক
৩৫ কেবিনের ৩ তলা হোটেলটির বর্তমান মালিক আবদুল ফজল মিয়া। আজ থেকে ১৫ বছর আগে তিনি আবদুস সাত্তারের কাছ থেকে হোটেলটি কিনে নেন। কেবিন ছাড়াও এই হোটেলে পাটাতনে থাকার ব্যবস্থা আছে। কেবিনে থাকতে হলে ৫০ থেকে ৬০ টাকা লাগলেও পাটাতনে খরচ লাগে মাত্র ১০ টাকা। তবে এখানে কাঁথা-বালিশের কোনও ব্যবস্থা থাকে না। নিজে কাঁথা বালিশ এনে ঘুমাতে হয়। বোর্ডারদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে এখানে বাস করছেন। তাদেরই একজন বরিশালের মুহাম্মদ এরশাদ বলেন, প্রায় ত্রিশ বছর হলো এখানে থাকি। শুরুতে এক পয়সা দুই পয়সা দিয়ে আবার কখনও ফ্রি থাকতাম। বর্তমানে প্রতিদিন ১০ টাকা দিয়ে থাকতে হয়। বাড়ি থেকে কাঁথা বালিশ নিয়ে এসেছি, তাই পাটাতনেই ভালোভাবে থাকতে পারি। এখানে তেমন কোনও সমস্যা হয় না। বর্তমানে এটাকেই নিজের বাড়ি বলে মনে হয়।
থাকার পাশাপাশি এখানে খাবারেরও ব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে হোটেলটির ম্যানেজার বলেন, এক বছর হলো খাবার বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ এখন খাবারের আয়োজন করতে খরচ বেশি পড়ে। মূল্যও বেশি রাখতে হয়। খদ্দেররা স্বল্প আয়ের মানুষ হওয়ায় তারা এই বাড়তি মূল্যে খেতে চায় না।
নাজমা নৌকা বোর্ডিং
নৌকাটি এক সময় পানসি নৌকা নামে পরিচিত ছিল। বিয়ে অনুষ্ঠানে এই নৌকা ব্যবহার করা হতো। পানসি নৌকার ব্যবহার বন্ধ হওয়ায় বর্তমানে এটি বোর্ডিং হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। নাজমা ভাসমান নৌকা বোডিংটি শুরুতে কাঠের থাকলেও পরে স্টিল লাগিয়ে দুই তলা করা হয়েছে। তবে এখানে যে কয়টি ভাসমান নৌকা হোটেল আছে তার মধ্যে এটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ নৌকার বেশ কয়েক জায়গায় বড় আকারের ফাটল ধরেছে। যে কোনও মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই ভয়ে কেউ এখানে থাকতে চায় না, তাই বেশির ভাগ সময় এটি ফাঁকা পড়ে থাকে। বর্তমানে হোটেলটির মালিকানায় আছেন নয়া মিয়া।
সদরঘাটের লঞ্চঘাটের পাশাপাশি রাজার ঘাট ও পান ঘাটে ছিল আরও বেশ কয়েকটি ভাসমান নৌকা হোটেল। এখন আর একটিও অবশিষ্ট নেই। রাজার ঘাটের স্থানীয় অধিবাসী কেরামত আলী বলেন, এখানে ৫টা হোটেল ছিল যার মধ্যে ১টা ছিল হিন্দু হোটেল। সেগুলোতে থাকা ও খাওয়া দুটোর ব্যবস্থাই ছিল। বিভিন্ন জেলা থেকে হিন্দু-মুসলমান ব্যবসায়ী এসে এসব হোটেলে থাকত।
লেখাটি সাপ্তাহিক ২০০০ এ প্রকাশিত

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


