আপেল মাহমুদ
জলদস্যু আতঙ্কে অতিষ্ট নোয়াখালী ও ভোলা জেলার জেলেরা। প্রতিদিন হামলা চালিয়ে জেলেদের জালসহ ট্রলার ছিনতাই করে দস্যুরা আস্তানায় নিয়ে যাচ্ছে। পরে তাদের মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয় বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। জলদস্যুদের দল সংখ্যা একাধিক হওয়ায় জেলেদের অসংখ্য বাহিনীকে চাঁদা দিতে হয়।
জেলা দুটির চারপাশের নদী ও বঙ্গোপসাগর এলাকায় মুন্সিয়া বাহিনী, নাসির বাহিনী ও জাহাঙ্গীর বাহিনী সক্রিয় । এছাড়া আরো অনেক জলদস্যু বাহিনী আছে, যাদের পরিচয় জেলেরা বলতে পারেন না। নদী ও সাগরের জেলেরা শত শত মাছ ধরার ট্রলার নিয়ে এক সময় দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে (বঙ্গোপসাগরে) মাছ ধরতে যেতেন। কিন্তু এখন খুব কম সংখ্যক ট্রলার বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে দেখা যায়। জেলেরা এখন নিজ নিজ ঘাটের আশপাশের এলাকার নদীতে মাছ ধরেন। কিন্তু তারপরও জলদস্যুদের কবল থেকে তাদের রেহাই নেই।
মুন্সিয়া বাহিনী
বর্তমানে ভোলা ও নোয়াখালি জেলায় নেটওয়াক বিস্তার করে আছে মুন্সিয়া বাহিনী। আগে বাশার বাহিনী এই স্থান দখল করলেও এখন তাদের আনাগোনা নেই বললেই চলে। হাতিয়ার উত্তরে নাসির বাহিনীর সাথে গত ঈদের সময় সংঘর্ষ হলে শুরুতে মুন্সিয়া বাহিনী পিছু হটলেও পরে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয়। নোয়াখালিতে মুন্সিয়া বাহিনীর পাশাপাশি অন্যান্য বাহিনী থাকলেও ভোলাতে একছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে। এই এলাকায় বর্তমানে কার্ডের মাধ্যমে জলদস্যু চালাচ্ছে। এক একটি কার্ডের মেয়াদ তিন মাস এবং এর জন্য নৌকা প্রতি দিতে হচ্ছে বড় নৌকার জন্য ৫০ হাজার , মাঝারি নৌকার জন্য ৩০ হাজার এবং ছোট নৌকার জন্য ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। মনপুরার এক জেলে জানান, এই কার্ডের ওপর লেখা আছে আল্লাহর দান মৎসভান্ডার, টাইগার গ্রুপ। যাদের কাছে এই কার্ড নেই তাদের নৌকা ও জাল ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাই জেলেদের মধ্যে কার্ড করার ধূম পরে গেছে। তিনি আরো জানান, এক একটি কার্ড করতে আমাদের হাতিয়া যেতে হচ্ছে। আর এর জন্য ২ থেকে ৩ দিন সময় লাগচ্ছে। মাছ ব্যবসায়ি জামাল উদ্দিন জানান, কিছুদিন আগে মুন্সিয়া বাহিনী আমার জেলেদের ওপর হামলা করে একজরে দুটি আঙ্গুলে আঘাত করে নষ্ট করে দিয়েছে। আর অন্য জনের পিঠে এমন ভাবে চাকু দিয়ে আঘাত করেছে যে অল্পের জন্য তার ভুড়ি বের হয়নি।
মুন্সিয়া বাহিনী হাতিয়ায় ঈদুল ফিতরের দিন রাতে চরচেংগা ঘাট এলাকার মেঘনায় মাছ ধরতে গেলে ৮টি ট্রলার ছিনতাই করে নিয়ে যায়। ২৪ রমজান রামগতির গিয়াসউদ্দিন বাহিনী হাতিয়ার পূর্ব উপকূলের সুর্যমূখী ঘাট এলাকার মেঘনায় মাছ ধরা অবস্থায় দুজন জেলে ও প্রায় ৫০ হাজার টাকার ইলিশ মাছসহ দুটি ট্রলার ছিনতাই করে নিয়ে যায়। পরে বিভিন্নভাবে ওই বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে মোটা চাঁদা দিয়ে ট্রলার দুটির মালিক তমরদ্দি বাজারের চা দোকানদার খোকন দুজন জেলেসহ ট্রলার দুটি উদ্ধার করেন। ঈদুল ফিতরের দুদিন আগে রাতে হাতিয়া উপকূলের মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরে ১৯টি মাছ ধরার ট্রলার ডাকাতির খবর পাওয়া গেছে। এ ধরনের মাছ ধরার ট্রলার ডাকাতির তালিকা করলে সেটা হবে অনেক দীর্ঘ। কিন্তু জেলেরা মাছ ধরার ট্রলার ডাকাতি হলেও জলদস্যুদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে চান না। কারণ তাদের পেশা যখন মাছ ধরা, আবারও তাদের নদী ও সাগরে মাছ ধরতে যেতেই হবে। জলদস্যুদের নাম বললে তারা পুনরায় হামলার শিকার হতে পারেন।
২০০৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মুন্সিয়া বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিঝুমদ্বীপের পূর্বপাশে দমার চরে সন্দীপের ইব্রাহিমসহ ইব্রাহিম বাহিনীর ৪০ জন ও মাসুদ বাহিনীর মাসুদ নিহত হয়। অবশ্য ১৭ সেপ্টেম্বর কালাম চরে মুন্সিয়া বাহিনীর আস্তানায় ইব্রাহিম বাহিনীর আচমকা গুলিবর্ষণে মুন্সিয়া বাহিনীরও ১০ জন মারা যায়। তখন থেকে মুন্সিয়া বাহিনীর সাহস বেড়ে যায় এবং চারপাশে আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছে।
হাতিয়া বন বিভাগের সাগরিয়া রেঞ্জের চর কালাম বিটের কালাম চরে মুন্সিয়া বাহিনীর আস্তানা। বন বিভাগের বনাঞ্চলে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বিরাট একটা ঘর আছে। এ ঘরটিই মূলত বাহিনী অস্ত্র রাখা ও নিজেদের আরামের স্থান হিসাবে ব্যবহার করে, ৫০ থেকে ৬০ জন জলদস্যু থাকতে পারে ঘরটিতে। মূলত এই ঘর থেকেই সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাহিনীর লোকদের খাদ্যও এখানে রাখা হয়। বর্তমানে এদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১শ। মনপুরাগামী যেসব ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে, তার প্রতিটিতে এই বাহিনী হামলা করেছে বলে জানা যায়।
নাসির বাহিনী
বর্তমানে ভোলা ও নোয়াখালী জেলায় নাসির বাহিনীর আধিপত্য অনেকটা কমে এসেছে। বাশার মাঝির মৃত্যুর পর নেতৃত্ব দিচ্ছে নাসির কেরানি। গত রমজান মাসে ইব্রাহীম বাহিনীর সাথে কয়েকবার সংঘর্ষ হলে এখন অনেকটা আড়ালে থেকে জলদ্যুতা চালিয়ে যাচ্ছে। নোয়াখালীর কয়েকজন মাছ ব্যবসায়ি জানান, মুন্সিয়া বাহিনীর সাথে সংঘর্ষের পর এখন আর তেমন সুবিধা করতে পাচ্ছেনা। এই দলের অনেকে এখন সন্দীপে গিয়ে আস্তানা গেড়েছে এবং এখান থেকে অভিযান চালাচ্ছে।
৭ জুন দলের নীতিনির্ধারকরা নাসির কেরানির ওপর দায়িত্ব অর্পণ করে। দীর্ঘদিন ধরে বাশার মাঝির দলে জলদস্যুতায় সাহসিকতার পরিচয় দেওয়ায় মূলত তাকে প্রধান করা হয়। এ দিন তিনি ৩১ সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে শপথ গ্রহণ করেন, যাদের প্রত্যেকে দলের মূল দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োজিত। দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড এখনো সিলেক্ট করা হয়নি। কাজের যোগ্যতার ভিত্তিতে ও সাহসিকতার মাধ্যমে করা হবে বলে একটি সূত্র জানায়। বর্তমানে এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১শ।
হাতিয়ার কাজির বাজারের মাছ ব্যবসায়ী মমিনুল ইসলাম বলেন, বাশার মাঝিই ভালো ছিল। তার সময় আমরা ব্যবসা করে খেতে পেরেছি। কিন্তু বর্তমানের নাসিরের জলদস্যুতা ও অপকর্ম এত বেশি বেড়ে গেছে যে, আমরা ব্যবসা করতে পারছি না। হাতিয়ার সাবেক উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাকির হোসেনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হাতিয়ার পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম উপকূলের মেঘনায় এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরে এমন জেলের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। এসব জেলে এক বাহিনীকে চাঁদা দিলেও অন্য বাহিনী এসে তাদের ওপর হামলা চালায়। চাঁদা দিয়েও তারা নিরাপদে মাছ ধরতে যেতে ভয় করেন। জাল ও নৌকাসহ সর্বস্ব হারিয়ে অনেক জেলে পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।
জাহাঙ্গীর বাহিনী
জাহাঙ্গীর বাহিনী বাশার বাহিনীর বিপক্ষে কাজ করলেও রাজনৈতিক নেতা, কোস্টগার্ড ও প্রশাসনের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কারণে এখনো টিকে আছে। এদের অনেকে আবার বাশার মাঝির সঙ্গে মিলে কাজ করছে। এই বাহিনীর প্রধান টার্গেট ট্রলার। ভোল ও নোয়াখালীর মেঘনা নদী দিয়ে চট্টগ্রাম, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জগামী যত ট্রলার আসে সেগুলো জিম্মি করে কোনো দুর্গম চর বা দ্বীপে নিয়ে মাল খালাস করে ট্রলার পানিতে ডুবিয়ে দেয় অথবা মালিককে ফোন দিয়ে ২-৩ লাখ টাকার বিনিময়ে ট্রলার ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। মিয়ানমারে সার পাচারের সঙ্গেও এই বাহিনী জড়িত বলে সূত্র জানায়।
মনপুরার কালাম বাহিনীর উৎপাত বর্তমানে চোখে পড়ার মতো। গত মাসে এরা চরকুকরি-মুকরিতে ২৫টি ডাকাতির ঘটনা ঘটায়। এর মধ্যে চেয়ারম্যানের ট্রলারেও ডাকাতির ঘটনা ঘটে। চরনিজামের এক মৎস্য ব্যবসায়ী জানান, এখানে কোস্টগার্ড থাকলেও তাদের দেখা যায় না। তাদের নিজস্ব কোনো বাহন নেই। তাই আমরা টাকা তুলে ভাড়া ট্রলারের ব্যবস্থা করে কোস্টগার্ডকে দিলেও তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না।
জলদস্যুদের চাঁদা আদায়
জেলা দুটিতে প্রতিটি বাহিনী নিজস্ব এলাকার বাজার ও ঘাটগুলো চাঁদা আদায়ের প্রধান স্থান হিসাবে গ্রহণ করেছে। মুন্সিয়া বাহিনী নিঝুম দ্বীপ, বন্দরটিলা, বয়ারচর, চেয়ারম্যান ঘাট, ৪ নং ঘাট ও ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের প্রতিটি ঘাটে চাঁদাবাজি করছে। প্রতিটি ঘাটে ও বাজারে প্রতিটি বাহিনীর নিজস্ব লোক নিয়োগ করা আছে, যারা গোপন সংবাদদাতা হিসাবে দায়িত্ব পালন করে।
নাসির কেরানি তমরুদ্দি বাজার, কাজির বাজার, চরচেংরার বাজার, বাংলা বাজার, নলচিরা ঘাট, সূর্যমুখী ঘাটে চাঁদাবাজি করছে। প্রতিটি চরের পরিবারপ্রতি চাঁদা ধার্য করা আছে ২শ থেকে ৩শ টাকা। মাছ ধরার মওসুমে ট্রলারপ্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। যারা চাঁদা দেয় না তাদের ওপর হামলা করা হয়। অনেক সময় শ্রমিকসহ ট্রলার অজানা কোনো দ্বীপে নিয়ে নির্যাতন করে শ্রমিককে ট্রলারের মালিকের কাছে পাঠানো হয় টাকা নিয়ে আসার জন্য। এক্ষেত্রে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। ট্রলার মালিক এক্ষেত্রে টাকা দিয়ে ট্রলার ফিরিয়ে আনেন। অনেক সময় টাকা না পেলে ট্রলার নদীতে ডুবিয়ে অথবা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
ওসির বক্তব্য
হাতিয়া থানার ওসি জহিরুল ইসলাম জানান, নাসির কেরানির প্রভাব এখন নেই তবে মুন্সিয়া বাহিনীর প্রভাব আছে। মুন্সিয়া বাহিনীর প্রকোপ নিঝুম দ্বীপ এবং মনপুরার দিকে বেশি। তিনি আরো জানান, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের নিজস্ব কোনো নৌযান নেই। ফলে ভাড়া নৌকাতে অভিযান চালাতে হয় বলে তারা আগেই টের পেয়ে যায়। আমরা চেষ্টা করছি জলদস্যুদের ধরার। স্থানীয় জনগন সহযোগিতা কররে এই এলাকা থেকে জলদস্যুতা দূর করতে পারবো বলে আমি মনে করি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


