somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক মহামানবের নীরব বিদায়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি : মরহুম অধ্যাপক মনছুর খলিল স্যার স্মারক সংকলন

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

image

অধ্যাপক মনছুর খলিল স্যার।

গত ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ রোজ বৃহষ্পতিবার বিকেল ৩টায় আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

বাংলাদেশ তার বিদায়ে কি হারিয়েছে সেটা আমি বলতে পারব না, শুধু বলব, বাংলাদেশ যা হারিয়েছে, সহস্র বছর অপেক্ষা করতে হবে এরকম একজন মানুষের পুনর্জন্মের জন্যে।

স্যারকে নিয়ে খুব বেশী কিছু বলার যোগ্যতা আমার নেই। এমন একজন বড় মাপের মানুষের ছাত্র হিসেবে কিছুদিন তার সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, এটাই আমার জন্য অনেক বড় ভাগ্য; হয়ত জীবনে কোন পূন্যের প্রতিদান দিয়েছেন আমায় সৃষ্টিকর্তা।

আমার এই লেখাটায় স্যারকে নিয়ে স্যারের সান্নিধ্যে আসা কিছু মানুষ, যারা স্যারের স্পর্শে এসে নিজেদের ধন্য মনে করেছেন, তাদের কিছু টুকরো স্মৃতি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

এখানে লেখকদের নামের আগে 'ডা' বা শিক্ষার্থী কিছুই ব্যবহার করিনি আমি। আমার মনে হয়, স্যারের কাছে আমাদের সবারই একটাই পরিচয় ছিল, "বাপু" আর "বাচ্চারা"। তাই আজীবন এই পরিচয়টাই আমাদের থাকুক। আমরা আজীবন স্যারের ডাকা "বাপু" আর "বাচ্চা" নামেই পরিচিত হব।

লেখাগুলো পড়েছি আর কেঁদেছি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি। স্যারকে এতটা ভালবাসতাম, আমি নিজেও কখনো বুঝতে পারিনি আসলে। স্যারের প্রতিটি কথা যেন কানে বাজছিল বার বার।

অনেকের লেখাই হয়ত এই সংকলনে আসেনি, আমি যোগাড় করতে পারি নি বলেই আসেনি। তাই সম্ভব হলে কমেন্ট হিসেবে আপনাদের লেখাটা দিয়ে দেবেন।
ধন্যবাদ।

১.

অধ্যাপক মনছুর খলিল স্যার।

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অ্যানাটমিস্টদের মধ্যে একজন।
কিন্তু অসাধারন শিক্ষক হিসেবে আমার চোখে ইউনিক একজন মানুষ।

সত্যি কথা বলতে, আমি স্যারকে খানিকটা ভয় পেতাম। অ্যানাটমি বরাবরই আমার জন্য একটু ভীতিকর বিষয় ছিল। আমার দুর্ভাগ্য, আমি স্যারের কাছ থেকে স্যার যেভাবে চেষ্টা করেছেন, সেরকম অ্যানাটমি শিখতে পারিনি।
কিন্তু একজন সত্যিকারের শিক্ষক কেমন হতে পারেন, সেটা জেনেছি।

অসংখ্যবার বুকে জড়িয়ে ধরেছেন তার অসংখ্য ছাত্রকে। বারবার একটা কথাই মুখে থাকত তার, "আমার বাচ্চারা পারবে"!
এই একটা কথাই যেন বুকে এক বিশাল শক্তি এনে দিত।

কখনো তিনি তার শিক্ষার্থীর উপর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস হারাতেন না।

প্রফে ডিসেকশন টেবিলে একটা মাসলের নাম ভুল বলেছিলাম। উনি একটুও রাগ না হয়ে পর পর তিন বার জিজ্ঞেস করলেন। আমি ঐ একই কথা বললাম।
এরপর বললেন, "বাপু, আমি জানি এর নামটা তুমি জান, ঠিক করে বল।"
আমার তখন শরীর ঘামছে দর দর করে। আমি চুপ করে রইলাম।
তারপর বললেন, "নিশ্চই এটার নাম তোমাকে কেউ ভুল শিখিয়েছে!" এরপর তিনি নিজে আমাকে সব মাসলের নাম আবার বলে দিলেন।

অসাধারণ এই মানুষটি আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

যদিও আমি বিশ্বাস করি, তিনি পৃথিবীতে আমাদের কাছে এসেছিলেন ক্ষণিকের জন্য আলো হাতে একজন দেবদূতরূপে। যাদেরকেই তিনি ছুঁয়েছেন, তাদের মধ্যে আলোর ছিটে ফোটা হলেও জ্বালিয়ে দিয়েছেন। কাজ শেষে আবার স্বর্গে ফিরে গেছেন।

অনেক অনেক দূর থেকে পৃথিবীর দিকে তাকালে তিনি নিশ্চই সেই বিন্দু বিন্দু আলোগুলো জ্বলতে দেখতে পাবেন। অনেক আলো আমরা জ্বালিয়ে রাখতে পারিনি, অনেকগুলোই আজ নিভু নিভু।

আসুন, স্যারের পূন্য স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই আলো অন্তরে ধরে, নিজে আলোকিত হই; স্যারের মত করে পারব না জানি, তবু সেই আলো অন্ততপক্ষে একজনের হৃদয়ে হলেও জ্বেলে দিয়ে যাই।

বাংলাদেশ আলোকিত হোক।
অমর হোক স্যারের শিক্ষা।

লিখেছেন - মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ

২.

পিতা মনছুর খলিল স্যার।
বাবা কখনো তাঁর ছবি উঠাতে দিতেন না আমাদের। বকা দিয়ে সরিয়ে দিতেন। অন্যদের ছবি উঠাতে বলতেন। তাহলে তারা খুশি হবে। অনেক হাত জোর করে এই ছবিটা তুলেছিলাম আমি সেদিন।
বাবার বহু ছবি আর স্মৃতি আমার কাছে আছে কিন্তু বাবা আর নেই আমাদের মাঝে।
আমরা শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল পরিবার পুরোপুরি এতিম হয়ে গেলাম।
এভাবে হারাতে চাইনি তোমাকে বাবা।
এভাবে হারাবো কখনো ভাবিনি।
ক্ষমা করে দিও আমাদের।
আমার বাবা, আমাদের বাবার জন্য সবাই দোয়া কইরেন।
আল্লাহ বাবাকে বেহেস্ত নাসিব করুন।
আমিন।

লিখেছেন - মীর শওকত নেওয়াজ নীরব

৩.

নানা ইস্যুতে টালমাটাল আমাদের এই সময়ে একজন প্রফেসর মনসুর খলিল স্যারের অকাল মৃত্যুতে যে দেশের বিশেষ করে মেডিকেল সাইন্সের যে কত বড় ক্ষতি হয়ে গেলো তা কয়জন জানে? আজকের পত্রিকাতে স্যারের মৃত্যুসংবাদটাও খুজে পাইনি। কিন্তু গতকাল থেকে হাজার হাজার মেডিকেল স্টুডেন্ট এর পোস্ট পড়েই টের পাচ্ছিলাম কতটা জনপ্রিয় ছিলেন দুই ভাইয়ের এই অনুজ; কত ছাত্র-ছাত্রীর মনে আজীবনের জন্য দাগ কেটে গেছেন। আমার দুর্ভাগ্য স্যারের সরাসরি ক্লাস পাই নাই; কিন্তু ফার্স্ট প্রফ দিয়েছিলাম স্যারের কাছে। অল্প সময়ের সংসম্পর্শ-ই স্যারকে আজীবন মনে রাখার জন্য যথেষ্ট। মেডিকেল সাইন্সের সাবজেক্টের মধ্যে বেসিক সাবজেক্টগুলার এমনিতেই গ্লামার কম; বিভিন্ন গ্লামারাস ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টের জন্য যারা স্টুডেন্টদের বেসিক তৈরি করে দেন; বৈতরনী পার হবার কয়জনই তাদের মনে রাখে। কিন্তু বেসিক সাবজেক্টের মধ্যে থেকেও মনসুর স্যার এবং মহসিন স্যার ছিলেন বিশাল গ্লামারাস ক্যারেক্টার। আজীবন অকৃতদার এই দুইজনই তাদের সম্পূর্ণ জীবন পার করেছেন ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য; ছাত্র-ছাত্রী পড়ানো তাদের নেশা। দুর্বল ছাত্রদের জন্য তারা একই সাথে আতংক; একই সাথে তাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। তাই যে যত বড় সাবজেক্টেই পড়ুক না কেন; যত বড় পোস্টেই থাকুক না কেন- মহসীন স্যার এবং মনসুর স্যারের কথা শুনলে শ্রদ্ধায় মাথা নামিয়ে রাখতে বাধ্য এবং যে ছাত্র জীবনে একবার মহসীন স্যার অথবা মনসুর স্যারের সান্নিধ্যে এসেছে স্যার-কে আজীবন মনে রাখতে বাধ্য। এই যুগে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এত ডেডিকেটেড শিক্ষক আসবে কিনা জানি না। কিন্তু দেশ একজন সত্যিকারের ডেডিকেটেড শিক্ষক, একজন ডাক্তারকে হারালো। এই ক্ষতি অপূরনীয়। অসাধারণ মেধাবী এই মনসুর স্যার তার শিক্ষা জীবনে সাতটি সাবজেক্টে অনার্স মার্কস পেয়েছিলেন; করেছেন এনাটমি এবং ভেটেরিনারী এই দুই সাবজেক্টে পিএইচডি। যোগ্য লোককে আমরা সম্মান দেই না; এইটা আমাদের জাতিগত সমস্যা। কিন্তু মনসুর স্যার তার ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোবাসায় বেচে থাকবেন আজীবন। স্যারের শ্রদ্ধার প্রতি সম্মান জানিয়ে স্যারের প্রতি ভালবাসাকে আরেকটু স্থায়ীরুপ দিতে আমি নিচে কয়েকটা প্রস্তাবনা দিচ্ছি-
১। প্রতি বছর ঢাকা ভার্সিটির আন্ডারে ১ম প্রফেশনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া ছাত্র/ছাত্রীকে প্রসেসর মনসুর খলিল স্কলার পুরস্কার চালু করা।

২। স্যারের প্রতি সম্মান জানিয়ে উনার বন্ধু-বান্ধব, সিনিয়র এবং জুনিয়র যারা উনার সংস্পর্শে এসেছেন এবং তার অগণিত ছাত্র-ছাত্রীর কাছ থেকে স্যারের সমন্ধে লেখা সংগ্রহ করে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ।

৩। ময়মনসিংহ মেডিকেলের কোন একটা চত্ত্বর/লাইব্রেরী/ হল স্যারের নামে নামকরণ।

৪। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে স্যারের নামে একটা মনসুর স্মৃতি পদক চালু করা। প্রতিবছর ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকে ফার্স্ট প্রফে যে প্রথম হবে তাকে স্যারের নামাংকিত একটা পদক এবং এককালীন কিছু টাকা পুরস্কার হিসেবে দেয়া হবে।

কাজগুলো অনেক কঠিন। কিন্তু সবাই মিলে চেষ্টা করলে অবশ্যই সম্ভব। সবার সক্রিয় অংশগ্রহন; সিনিয়রদের সুপরামর্শ আশা করছি। লাইক দিয়ে দায়িত্ব শেষ করলে হবে না। কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সেই ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা চাচ্ছি।

লিখেছেন - মোস্তাফিজুর রহমান তপু

৪.

'মনসুর খলিল' স্যার এর কিছু Unknown Facts:

* ময়মনসিংহ মেডিকেলের ম-১৬ ব্যাচের আইকন স্টুডেন্ট হিসেবে স্যারকে চিনত সবাই । বাংলাদেশের ৭০ এর দশকে সেরা মেডিকেল স্টুডেন্ট ছিলেন

* তার সময়ে স্যার শুধু “কমুনিটি মেডিসিন” বাদে বাকি সব প্রফের সব সাবজেক্টে অনার্স মার্ক পেয়েছিলেন যা সে আমলে সেরা ।

* একই সাথে হিউম্যান ও ভেটেরেনারি এনাটমিতে পিএইচডি করেছিলেন যা বিরল ।

* আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত উচ্চ বেতনে শিক্ষকতার সুযোগ পেয়েও দেশে ছাত্র-শিক্ষকতার মায়া ত্যাগ করে যেতে ারেন নি ।

* নিজের লক্ষ টাকার সব বই দান করে গেছেন সিওমেক লাইব্রেরীর রেফারে ন্স সেকশনে ।

* নিজের বেতনের অর্ধেকটা দান করে দিতেন এতিম খানায় । বাকিটা মাকে পাঠাতেন কিছু নিজের জননে রেখে ।

* স্যার এর হাতের ঘড়িটা তার প্রিয় শিক্ষকের দেয়া (আশির দশকে) যা তি নি মেরামত করে পরতেন ।

Source: Dr.Osul Ahmed Chy (Ex Principal: SOMCH)
(collected)
লিখেছেন - ডা. তানভির আহমেদ

৫.

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে সিনিয়র ভাইয়াদের মুখে প্রফেসর ডা. মনসুর খলিল স্যারের নাম অনেক শুনেছি। উনাদের সময়কার অনেক স্যার - ম্যাডামকেই তো আমরা পাই নাই। তাদের নামও জানি না। জানার কথাও না। কিন্তু মনসুর খলিল স্যারের নাম জানে না। স্যারের গল্প শোনেনি এমন কেউ নেই।
স্যারের ইন্তেকালের খবর পাওয়ার পর সবাই স্যারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করছেন। দোয়া করছেন। এখন মনে হচ্ছে বাংলাদেশের সব ডাক্তার সব মেডিকেল স্টুডেন্ট স্যারের সম্পর্কে জেনে ফেলেছেন।

আচ্ছা এত বড় মাপের একজন শিক্ষাবিদ, ছাত্র ছাত্রীদের কাছে এত প্রিয় একজন শিক্ষককে কেন জাতীয় অধ্যাপক বানানো হলো না?
প্রতিবছর কত তেলবাজ মানুষকে জাতীয় সম্মাননা দেয়া হয়। তার মতো ভালো মানুষকে কেন দেয়া হলো না? নিদেনপক্ষে কোন পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল তো একটা নিউজ করতে পারতো। তাও তো চোখে পড়লো না।
যদি ডাক্তার নামের কোন দলবাজ ক্ষমতালিপ্সু অমানুষ মারা যেত, যদি শিক্ষক নামের কোন তেলবাজ অর্থলিপ্সু অমানুষ মারা যেত তাহলে ঠিকই আমরা কালো ব্যাজ ধারণ করতাম। টিভি চ্যানেলে স্মৃতিচারণ হতো। পত্রিকায় ক্রোড়পত্র বের হতো। সবাই চিনতো। সবাই জানতো। জাতীয় কোন সম্মাননা পাওয়া না থাকলে মরণোত্তর সম্মাননা দেয়া হতো।

আমাদেরই বা কী দোষ। আমরা ছোটবেলায় গরু রচনা শিখেছি তাই ঐসব গরুদের চিনি। গরুদের স্তুতি গাই। মানুষ রচনা শিখলে মনসুর খলিল স্যারের মতো মানুষদের চিনতাম। সম্মান দিতাম। তাদের মতো হওয়ার চেষ্টা করতাম।

আল্লাহ্ তাআলা যেন স্যারের কবরকে বেহেশতের বাগান বানিয়ে দেন। আমীন।
স্যারের মতো আরো ভালো মানুষদের যেন আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়ে দেন। আমীন। আমীন।।

লিখেছেন - নাজিরুম মুবিন

৬.

কিংবদন্তীর মেডিক্যাল টিচার মনসুর খলিল আর নেই [ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন]

এদেশে অনেক বড় বড় ডাক্তার আছেন, আছেন ডিগ্রীধারী বড় বড় চিকিৎসক। সার্জনও আছেন হাত যশকরা। এক টানে পেট কাটার মতো ডাক্তার আছেন অনেক। দ্রুত সেলাই করেন অনেকে। রোগী দেখে অসুখের হাল বলে দিতে পারেন অনেকে। মনসুর খলিল তাঁদের দলে নেই। তিনি মেডিক্যাল শিক্ষক ছিলেন। এই উপমহাদেশের সবচে জনপ্রিয় শিক্ষকদের অন্যতম।

তিনি এনাটোমির নাড়ী-নক্ষত্র জানতেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অধিকাংশ গ্রন্থ ছিলো তাঁর নখদর্পণে। তিনি ঢাকার বাইরে মফস্বলের মেডিক্যাল কলেজে পড়াতে ভালোবাসতেন। সর্বশেষ কিশোরগঞ্জে প্রিন্সিপাল ছিলেন। মারা গেলেন ময়মনসিংহ হাসপাতালে। এয়ার এম্বুল্যান্সে ঢাকায় আনার প্রয়োজন বোধ করেননি কেউ।

মনসুর খলিল এদেশের মেডিক্যাল শিক্ষার ইতিহাসে টিকে যাবেন। তাঁর কথা যুগে যুগে উচ্চারিত হবে। কোন ছাত্র খারাপ রেজাল্ট করলে যখন কোন শিক্ষক গোপনে তাকে রুমে গিয়ে পড়াবেন তখন আমরা বলবো, 'এই লোক একেবারেই মনসুর খলিলের মতো।' কোন ছাত্র পিস্তল নিয়ে শিক্ষকের মাথায় তাক করলে যদি সেই শিক্ষক উত্তর দেন, 'তুই যদি গুলিস্তানের কামান নিয়াও আমারে মারতে আসস তবু আমি তরে পাশ করামু না। আমি তরে নিজে পড়ামু। এর পরের বার পরীক্ষা দিবি।' তখন আমরা এই শিক্ষককে মনসুর খলিলের সাথে তুলনা দেব।

আরেকটা কারণে মনসুর খলিল হয়তো বিশ্বে অদ্বিতীয়। তিনি সমগ্র জীবন নিজের মায়ের হাতের সেলাই করা জামা-কাপড় পরেছেন।

তাঁর মৃত্যু সংবাদ শোনার পর একটা উর্দু শের মাথায় মৃদু আঘাত দিয়ে গেলঃ ইজ্জতে শহরাতে উলফাতে চাহাতে / সভ কুচ ইস্‌ দুনিয়া ম্যায় রেহতে নেহুঁ / আজ ম্যায়ঁ হুঁ জাহা কাল কোই ইর থা / ইয়ে ভি এক দৌড় হ্যায় ভো ভি এক দৌড় থা।'

আমার সালাম, হে মহাপুরুষ।

লিখেছেন - হাজী রফিক

৭.

একজন মনসুর খলিল স্যার গতকাল প্রয়াত হয়েছেন।আজ তন্ন তন্ন করে কোন পত্রিকায় খুঁজে পেলাম না সে সংবাদ টা।মনসুর খলিল স্যারের মতো শিক্ষাবিদের মৃত্যু সংবাদ পত্রিকায় আসবে না,মিডিয়ায় প্রচারিত হবে
না। অথচ পত্রিকার সে কলামটি,মিডিয়ার সে শ্লটটি নেতার জন্য আছে,অভিনেতার জন্য আছে, কবির জন্য আছে,সাহিত্যিকের জন্য
আছে,গায়কের জন্য আছে শুধু মাত্র মনসুর
খলিল স্যারের জন্য নেই।এই অকৃ্তদার শিক্ষক তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে হাজার হাজার ডাক্তার গড়েছেন যে হাজার হাজার ডাক্তার লক্ষ লক্ষ রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন।যে রোগীদের সাথে চিকিৎসকদের সম্পর্ক শুধুই
টাকার। এক গাদা টাকা নিয়ে একজন চিকিৎসক বাড়ি ফিরছেন এতেই তিনি খুশী। সমাজে তাঁর অংশীদারিত্ব নেই,নেই কোন অংশগ্রহন। তাই মরলেও সমাজের আর কোন অংশের রাঁ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা শিক্ষক
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আর আপনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের যৎপরোনাস্তি জনপ্রিয় ও সফল শিক্ষক হয়েও শিক্ষাবিদের ব্যাজ পরতে পারেন নি। আমাদের সমাজটা এত প্যারাডক্সিক্যা
ল কেন? মনসুর খলিল স্যারের সাথে আমার সে ধরনের স্মৃতিময় ইতিহাস নেই। তবে একটা স্মৃতি শেয়ার করতে চাই। বছর কয় আগের ঘটনা। আমার ওয়াইফের পোস্টিং কিশোরগঞ্জ। সদ্য চালু হওয়া শহীদ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজের এনাটমির লেকচারার। যে বিভাগের প্রধান মনসুর খলিল স্যার।
প্রায়ই আমাকে স্যারের কথা বলে। স্যার খুবই শিক্ষানুরাগী,ছাত্রদের ব্যাপারে খুবই কেয়ারিং। আমার একমাত্র মেয়ে নৈমিষা নামিরার
মাত্র কয়েক মাস। স্যার নিজ থেকে আমার ওয়াইফকে বলেছিলেন তুমি মাঝখানে বাসায় গিয়ে তোমার মেয়েকে দেখে আসবে।আমার পোস্টিং তখন ঢাকায়। সপ্তাহান্তে আমি
কিশোরগঞ্জ যাই। শুক্রবার বিকেলটা আমাদের খুবই ভালো কাটতো। হাসপাতাল কম্পাউন্ডে প্রতি শুক্রবার বিকেলে বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের একটা গাড়ী আসতো। আমরা মেম্বার ছিলাম। আমাদের বারান্দা থেকে বই সমেত গাড়ীটা দেখা যেতো। একদিন সময় দেখে বারান্দায় আসলাম। দেখলাম কে যেন গাড়ী রাখার রাস্তাটায় পায়চারী করছে! আমার স্ত্রী বললো,
মনসুর খলিল স্যার।
বলতে না বলতেই গাড়ী এসে থামলো।
আমি বললাম, ‘চলো যাই’।
দুজনেই গাড়ীর দিকে হাঁটছি। আশে পাশের কোয়ার্টার থেকে বাচ্চারা দৌড়ে আসছে।বই জমা দিয়ে বই নিবে।
কিন্তু সবার আগে মনসুর খলিল স্যার।
এই বইপড়ুয়া শিক্ষাবিদকে ভুলি ক্যামনে?

লিখেছেন - সেলিম শাহেদ

৮.

বিদায় মনসুর খলিল স্যার!বিদায়!............................... তুখোড় ছাত্র ছিলেন,আসাধারণ শিক্ষক ছিলেন,তারচেয়েও বেশি ছিলেন এক অসামান্য মানুষ। আপনি বলতেন,নিজের জন্যে যে ভালোটা চাইবে, অন্যের জন্যেও সবসময় সেটা করার চেষ্টা করবে।এটাই ভাল মানুষ হওয়ার মূলমন্ত্র।আপনার মত মানুষ
হয়ত আমরা হতে পারবনা কোনদিন কিন্তু আপনার কথা আমাদের সবার মনে থাকবে স্যার।ভাল থাকবেন।.....

লিখেছেন - ফুয়াদ শহীদ

৯.

অধ্যাপক মনসুর খলিল

১৯৯৩ সাল। এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হলাম বগুড়া মেডিক্যাল কলেজে। সম্ভবত আগস্ট মাসে ক্লাস শুরু হয়েছিল। প্রথম দিন অরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানের পর এনাটমি ক্লাস দিয়েই শুরু হয়েছিল মেডিক্যাল জীবন। কদম ছাঁটের মোটাসোটা একজন স্যার ক্লাস নিতে আসলেন। তিনি ডাঃ মনসুর খলিল স্যার। ১৯৯২ সালে বিএসএমএমইউ (তৎকালীন পিজি) এনাটমিতে এমফিল করে মাত্রই সহকারী অধ্যাপক হিসেবে বগুড়া মেডিক্যাল কলেজে যোগদান করেছেন। প্রথম দিনের ক্লাসেই টের পেলাম উনার মেধা আর জ্ঞ্যানের গভীরতা। দেখলাম অনেকের নাম উনি জানেন। তারমানে আগেই উনি সবার ফাইল ঘেঁটেছেন। আমি নিজে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। প্রথম দিনেই উনি আমার প্রিয় শিক্ষক হয়ে গেলেন। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। কুনো প্রশ্ন করে উত্তর পাইনি তা কখনো হয়নি। সব কিছু উনি ব্যাখ্যা করতেন। মাঝে মাঝে রাতে ক্লাস নিতেন। আইটেম নিতেন। পারলে আইটেমে ১০ এর মাঝে ৯ বা ৯.৫ দিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে লাইব্রেরিতে পাঠাতেন। ৩য় /৪থ/৫ম বর্ষের বই আমাদের দিয়ে ঘাটাতেন। উনার পড়ানোর কৌশল আমার খুব ভালো লাগত। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতাম। মন ভালো না লাগ্লে উনার রুমে চলে যেতাম। এমনকি রাত ১১টা, ১২টায়ও। অনেক গল্প করতাম। উনার সাথে কথা কথা বলতে খুব ভালো লাগত। কথা বললেই মন ভালো হয়ে যেতো। কি যেন একটা ম্যাজিক ছিল উনার মাঝে।

২য় বর্ষে ওঠার পর উনি চলে গেলেন জাপান, পিএইচডি করতে। জাপান গিয়েও আমাদের খোঁজ রাখতেন। পুরো ব্যাচ এর প্রত্যেককে শুভেচ্ছা জানিয়ে আলাদা আলাদা কার্ড পাঠাতেন। তারপর অনেকদিন আর যোগাযোগ ছিল না। ২০০৬ সালে নিজেই এনাটমিতে এমফিল এ চান্স পেয়ে গেলাম। উনি তখন সিলেট মেডিক্যালে আছেন। ক্লাস শুরুর আগে দেখা করলাম। খুব খুশি হলেন। আমাকে বললেন সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের হুমায়রা ম্যাডামকে আমি যেন উনার নাম বলি। হুমায়রা ম্যাডামকে উনার কথা বললাম। বললাম আমি উনার ছাত্র ছিলাম। এটা শুনে ম্যাডাম বললেন তুমি মনসুর ভাইয়ের সাগরেদ!!! হুমায়রা ম্যাডামের সাথে একবার নাকি স্যারের দেখা হয়েছিল। ম্যাডাম বললেন আপনার ছাত্র আমার কলেজে এমফিল করছে। উনি বললেন ও আমার ছাত্র না, আমার ছেলে। আমার এম্ব্রিওলজি পরীক্ষা নিতে আসলেন শামিম আরা ম্যাডাম। উনিও জানলেন যে আমি মনসুর স্যারের ছাত্র। উনি পরীক্ষা নিয়ে বললেন যে উনার মনে হচ্ছে উনার সামনে মনসুর বসে আছে। কি যে আনন্দ লেগেছিল শুনে বলে বুঝানো যাবেনা। মনসুর স্যার ছিলেন আমার আদর্শ। আমি উনার মত হতে চেয়েছি। আমি উনার কথা বলার ধরন অনুকরন করেছি। উনার মত কপট ভাবে রাগ করার ভান করেছি। উনার মত রাতে ক্লাস নিয়েছি কক্সবাজার মেডিক্যালে, রাতে পরীক্ষা নিয়েছি।

পরে আর একবার নার্ভাস সিস্টেমের কিছু ঝামেলার জিনিস নিয়ে মহাখালীর ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে উনার সাথে কথা বলেছি। এমফিল পাস করার পর আমি এসএসএমসিতে লেকচারার ছিলাম অনেকদিন। উনি তখন চিটাগাং মেডিক্যাল কলেজে। অনেক চেস্টা করেছেন আমাকে সিএমসি তে নিতে। পারেন নাই। আমার বদলি হল কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজে। সেখান থেকে একবার আমি উনার সাথে পরীক্ষা নিয়েছি সিএমসিতে। উনার বাসায় ছিলাম। কিভাবে ছাত্রছাত্রিদের পরীক্ষা নিতে হয়, কি করতে হয় তা নিয়ে অনেক পরামর্শ দিয়েছেন আমাকে। উনি মাঝেমাঝেই ডিম সিদ্ধ করে আমার প্লেটে দিতেন। খাবনা বল্লেও শুনতেন না। তারপর আমি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিলাম। উনি খুব রাগ করলেন। উনি চেয়েছিলেন আমি যেন এম মেড আর পিএইচডি করে তারপর ছাড়ি।

বাজিতপুর মেডিক্যালে আসলাম। উনিও আসলেন কিশোরগঞ্জ সরকারি মেডিক্যালে প্রিঞ্চিপাল হয়ে। একবার উনি বাজিতপুর আসতে চেয়েছিলেন দেখা করতে। আমি তখন ক্যাম্পাসে ছিলাম না, তাই দেখা হয়নি। উনিও আসেননি। সবসময় উনি খোঁজ নিতেন আমার। কিছুদিন আগে খুলনা মেডিক্যাল কলেজে পরীক্ষা নিয়েছি। আমার সাথে যিনি ছিলেন এক্সামিনার তিনি মনসুর স্যারের সাথে চাকরি করেছেন। উনি বললেন যে মাঝে মাঝে নাকি উনার কনফিউসন হচ্ছে অবচেতন ভাবে। উনার নাকি মনে হচ্ছে মনসুর স্যার উনার পাশে বসে পরীক্ষা নিচ্ছেন। খুব আনন্দ লেগেছিল শুনে। কথাগুলু আমি ফোন করে স্যারকে বলেছিলাম। আমি বললাম অনেকে উনার নামের পাশে আমার নাম লাগায়। আমার খুব ভালো লাগে শুনে। উনি শুনে খুব খুশি হলেন। আমি উনাকে যশোর আদ-দিন মেডিক্যালে পরীক্ষা নিতে আসতে বলেছিলাম। উনি বললেন যে এটা রাজশাহীর লোকজন মানবে না। আমি যে মেডিক্যালেই চাকরি করেছি সেখানকার সবাই উনাকে খুব ভালভাবে চিনত। আমি বারবার উনার কথা বলেছি ক্লাসে। সেই হিসেবে আমার ছাত্রছাত্রিরা উনাকে তাদের স্যার মনে করত। পরোক্ষভাবে।

আমি যখনই এনাটমি নিয়ে কুনো ঝামেলায় পড়েছি, উনাকে ফোন দিয়েছি। উনি প্রতিবারই উত্তর দিয়েছেন। ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কখনো বলেন নাই যে উনি জানেন না। অনেক বিষয় আমি উনার সাথে শেয়ার করেছি। আমার ব্যাখ্যা শুনিয়েছি। উনি ঠিক করে দিয়েছেন। অনেক এনাটমিস্টকেই প্রশ্ন করি আমি। আরও অনেকের সাহায্য চেয়েছি। বেশিরভাগ এনাটমিস্ট জিনিসগুলু প্রথম শুনেন আমার কাছে। নাহয় বলেন এগুলু লাগবে না। কিন্তু মনসুর স্যার ছিলেন ব্যতিক্রম। সব উত্তর উনার জানা ছিল। আমি একটা বই লিখার কাজ করছিলাম শুনে আমাকে বলেছিলেন উনাকে কপি দিতে। উনি দেখে দিবেন।

আজ বিকেল ৫টায় হুমায়রা ম্যাডাম ফোন দিয়ে খবরটা জানালেন। আমি হতবাক। এত তাড়াতাড়ি উনার চলে যাওয়ার কথা ছিল না। আর অনেক কিছু দেয়ার ছিল উনার। এটা অন্যায় স্যার। এখন সমস্যায় পরলে আমি কাকে ফোন দিবো আপনি বলে দিন স্যার। প্লিজ স্যার, আপনি বলেন, চুপ থাকবেন না। আপনি জানেন না আপনি আমার কাছে কি ছিলেন। আপনাকে অনেক কথা বলা হয়নি আমার। আর কখনো বলা হবে না। আপনি না শুনে চলে গেলেন স্যার।

আমি লিখছি আর আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এটাই আপনার অর্জন। আজ আপনার অনেক ছাত্র-ছাত্রি চোখের পানি ফেলছে। এই পানি আপনার অর্জন। স্যার, আপনার আত্মা শান্তিতে থাকুক, এটাই আমার দোয়া। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন। অনেক অনেক দোয়া করবেন। যাকে একদিন আপনি আপনার ছেলে বলেছিলেন।

লিখেছেন - অধ্যাপক আশফাকুর রহমান

১০.

এনাটমী'র লিজেন্ড শ্রদ্ধেয় "প্রফেসর ডাঃ মনসুর খলিল" স্যার আর এ জগতে নাই...:-(.

শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ,কিশোরগঞ্জ-এর সম্মানিত প্রিন্সিপাল ও এনাটমীর বিভাগীয় প্রধান,সকল স্টুডেন্টদের গার্ডিয়ান শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ডাঃ মনসুর খলিল স্যার ইন্তেকাল করেছেন।
"ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন"।

SSNIMC-এর স্টুডেন্টরা শুধু একজন প্রিন্সিপাল স্যারকেই হারালো না,সাথে সাথে হারালো তাদের অন্যতম গার্ডিয়ান,অন্যতম সাহায্যকারীকে। তাঁর কারনেই নতুন মেডিকেল হওয়া স্বত্তেও SSNIMC আজ ভিন্ন এক মাত্রা পেয়েছে।

স্যারের ভাই শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ডাঃ মহসিন খলিল স্যার ( বিভাগীয় প্রধান,এনাটমী;মমেক) এখন একা হয়ে গেলেন। মা ছিলেন তাঁদের কাছে সবকিছু,কারন দুই ভাইয়ের কেউ বিয়ে করেননি আর মাকে খুব ভালোবাসতেন। মাকে হারানোর পর দুই ভাই জীবিত ছিলেন। আর বিয়ে না করায় স্টুডেন্টরাই তাঁদের কাছে ছিলো সন্তানতুল্য।

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা,তিনি যেনো প্রফেসর ডাঃ মনসুর খলিল স্যারকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন করেন এবং প্রফেসর ডাঃ মহসিন খলিল স্যারকে ধৈর্য্য ধরার তাওফিক দান করেন। আমিন!!!

লিখেছেন - নীল-আকাশ

১১.

দুপুর দুটোয় রুমে এনাটমি ডিপার্টমেন্ট এর মামা হাজির। রীতিমত চিৎকার করে ঘুম ভাঙিয়ে আমার হাতে ছোট একটা চিঠি ধরিয়ে দিলেন।

চিঠিতে লেখা,
মানিক,
বিকেল তিনটার মধ্যে আমার সাথে অফিসে দেখা করবে।
মনসুর খলিল।

চিঠিতে বিস্তারিত কিছু লেখা নেই। শুধু দেখা করলেই হবে। ঘুম থেকে উঠে গায়ে কোনরকমে শার্ট প্যান্ট চড়িয়ে দৌড়। আক্ষরিক না, দৌড় দিয়েছিলো রিকশাওয়ালা। স্যারের রুমে ঢোকার আগে এপ্রন ঠিক করে নিতে হলো। রুমে ঢোকার পর দেখি শ্রদ্ধেয় মহসিন স্যার এবং আরেকজন বসা।
মনসুর স্যার বললেন, ম্যাডাম এই হচ্ছে মানিক। একটাই আছে ক্যাম্পাসে।
ম্যাডাম বললেন, আচ্ছা।
মহসিন স্যার এবং মনসুর স্যার হচ্ছেন এমন দুজন মানুষ যাঁদের কথায় আচ্ছা বলাটাই সব দিক থেকে নিরাপদ।
এরপর স্যার পরিচয় করিয়ে দিলেন।
ম্যাডাম,আমাদের ক্যাম্পাসে এই একটাই মানিক, কারন এ হচ্ছে আমার দেখা একমাত্র হিন্দু বাটপার। (!!) সেদিন এরপর যা হয়েছে তার বর্ননায় যাচ্ছিনা। এনাটমি প্রফের ভাইবায় হার্ড পার্টে এক্সটার্নাল খুব কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন করছিলেন,যেগুলো পারা আমার কম্মো না। মনসুর স্যার খুব ক্যাজুয়ালি এসে এক্সটার্নালকে বললেন, এই ছেলে সবই পারে।
এক্সটার্নাল খুব হতাশ হয়ে বললেন, কই, কোন লক্ষন তো দেখিনা।
কি যে বলেন। দাঁড়ান দেখাচ্ছি। মানিক, বাবু তুমি বেইজ অফ দ্য স্কালটা নাও।
আমি তখন জাস্ট নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি। আবারও মমে হলো মেডিকেল আমার জন্যে না। আর স্যার যা ধরতে বলছেন, সেই হাড্ডি সামলানো ঘাগু ছাত্রদের কাজ। আমার না। আমি হাড্ডি হাতে নেয়া মাত্র স্যারের কর্মকান্ড শুরু। স্যার হাতের স্টিক দিয়ে একটা করে ছিদ্র দেখাচ্ছেন আর সেই ছিদ্র দিয়ে কি লি যায় তা বলে যাচ্ছেন এবং বলা শেষে বলছেন, তাইনা বাবু?? আমি হ্যা সূচক মাথা ঝাঁকাচ্ছি। সব শেষে স্যার বললেন দেখলেন ছেলেটা একদম বারুদ।
এক্সটার্নাল তখন খুব মন দিয়ে সমুচার শিল্পগুন নিয়ে ব্যস্ত।স্যার আমাকে বিদায় করে দিলেন। আর সফট পার্টে স্যার হঠাত করে উড়ে আসলেন। আমি তখন হার্টের কাল্পনিক ডেভেলপমেন্ট বলে যাচ্ছি। স্যার বললেন, মানিক কি বলছো?
হার্টের ডেভেলপমেন্ট স্যার।
ম্যাডাম এগুলো কোন প্রশ্ন? আপনি বলেন প্লিজ। মানুষের হার্ট না, মাছের হার্ট।
ম্যাডাম এবার আমার মতো খাবি খাওয়া শুরু করলেন। এরপর স্যার একেবারে ছবি টবি দিয়ে সবটা বুঝিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এখানে কি করছো? যাও।
আরো কত ঘটনা এই স্যার দুজনকে নিয়ে ক্যাম্পাস জীবনে আছে,তা বলে শেষ করা যাবেনা। স্যারের সাথে শেষ বার দেখা হয়েছে স্যারের বাসায়, ঈদে। সালামী চাইতেই পকেটে হাত দিয়ে দুই টাকার চকচকে একটা নোট যাদুকরের মতো বের করে নিয়ে এলেন।
স্যার মাত্র দুই টাকা!
সালামী সালামীই, কত সেটা বড় কথা না।
এই উত্তরের পর আসলে কিছু বলার থাকেনা।
পাশ করার আগে অতি ভয়ংকর মানুষগুলো হয়ে গেলেন একেবারে বন্ধুর মতো। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা থেকে শুরু করে কি লিখছি বা কি করছি ইদানিং অথবা সাহিত্যে নতুন কি হচ্ছে এইসব উড়াধূরা জিনিষ ছিলো আড্ডার বিষয়। আমার মতো অর্বাচীন এর সাথে এই মাত্রার উঁচু মানুষের আড্ডা দেয়ার কোন কারন নেই, পরবর্তীতে সবসময় খোজ নেবারও কোন কারন দেখিনা। কিন্তু স্যার করেছেন।
মহসীন এবং মনসুর স্যার, আমার দেখা সেরা দুজন শিক্ষক এবং মানুষ।
মনসুর স্যার চলে গেলেন। ভালো মানুষ গুলো কেন যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে যায়।
স্যার শান্তিতে থাকুন। আশা করছি, আপনার মায়ের সাথে খুব ভালো আছেন।

লিখেছেন - মানিক চন্দ্র দাস

১২.

এই দেশের মানুষ জাফর ইকবাল স্যারদের কে চিনে, পত্রিকায় বড় করে লেখা কলাম পড়ে।। কিন্তু মহসিন খলিল স্যার, মনসুর খলিল স্যারদের কথা কয়জনই বা জানবে।।।। তাদের ছাত্ররা তো কেউ বড় বড় পত্রিকার সাংবাদিক না।। সরকারের কাছে বরাবরই অবহেলিত মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থায় আলোর দিশারী একজন পথপ্রদর্শক আজ চলে গেলেন।। আপনার স্মৃতি সংরক্ষণ করার জন্য যা করা দরকার আপনার সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা করবে স্যার।।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ আপনার স্মৃতি সংরক্ষণ করবেই।। জীবনের শেষ মুহুর্তেও আপনি মমেক এর চিকিৎসার উপর আস্থা রেখেছিলেন।। ভালো থাকবেন স্যার।। মহান আল্লাহর দরবারে আপনার জন্য অজস্র সন্তানতুল্য ছেলে-মেয়েদের প্রার্থনা প্রতিনিয়ত পৌঁছাবে।।

লিখেছেন - ডা. ইমতিয়াজ সিয়াম

১৩.

প্রফের আগে আমার আইটেম কার্ড হারিয়ে গিয়েছিল...
স্যারের কাছে গেছি...
সোহান তুমি কি রাজনীতি করো...???
- না স্যার
তোমার কি প্রেমিকা আছে...??
- না স্যার
তাহলে তোমার কার্ড এখনো ইনকমপ্লিট কেনো..??
আমার সাথে বাটপারি করবে না..
সব বলার পর স্যার গালে একটা চুমু দিয়ে বলে যাও বাবা পড়াশুনা করো ভালো করো...
প্রফেসর মনসুর খলিল স্যার...
নামটা মনে হলেই মন থেকে শ্রদ্ধা আসে।
কি এক অদ্ভুত মানুষ...!!
এতোগুলো ডিগ্রি, আত্মঅহংকার নেই বিন্দুমাত্র।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের মতো জাঁদরেল মেডিকেলে স্যারের মতো অমায়িক প্রফেসর পেয়ে আমরা যে কি খুশি হয়েছিলাম...
একটি মানুষ যার চিন্তা- ভাবনায় শুধুই স্টুডেন্টদের কল্যাণ.. ক্লাস না করলে সেন্টআপ নাই, পড়া না পারলে গালি, পরীক্ষায় এমন কঠিন প্রশ্ন যার উত্তর জানা নেই এসবের কোনো বালাই ছিলো না স্যারের এনাটমি ডিপার্টমেন্টে...
স্যারের ভাষ্যমতে- "গঁৎ বাধা সব প্রশ্ন আর সহজ করে উত্তর.. ব্যাস খেলাটা শেষ"
আর এজন্যেই স্টুডেন্টরা সবচেয়ে বেশি নিয়মিত ছিল এনাটমিতে যেখানে পরীক্ষায় ফেল করার ভয় নাই। মেডিকেলের স্টুডেন্টদের পরীক্ষাভীতি দূর করতে স্যারের এক ক্লাসই যথেষ্ট...
স্যার মারা গেছেন খবরটা শুনে কেমন লাগছে বোঝানো মুশকিল। শুধু এটুকু জানি যে স্যারের জন্যে মন কাঁদবেনা এমন স্টুডেন্ট আছে বলে আমি বিশ্বাস করিনা...
আজও মনে আছে সেই কথাগুলোঃ
- বাচ্চারা তোমরা প্রেম করবে কিন্তু দেখা করবেনা, এতে পড়াশোনার ক্ষতি হয়...!!!
- বাচ্চারা, ষাঁড়ের সামনে লাফালাফি করলে সে চিৎকার করে কেনো??? কারণ সে মনে করে তুমি তার প্রেমিকাকে নিয়ে যাচ্ছো...
- বাচ্চারা তোমারা প্রক্সি দিতে পারো, তবে এমনভাবে দিবে যেন আমি বুঝতে না পারি..
- বাচ্চারা তোমরা যেখানটায় বুঝবে না আমার কাছে চলে আসবে, আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই..
-রেদওয়ান, আমি চলে গেলে এই বাচ্চাগুলোর কি হবে...??
চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকেও হঠাৎ করে চলে গিয়েছিলেন,
আজ দুনিয়া থেকেও...
আল্লাহ আপনাকে জান্নাতবাসী করুন স্যার...
খুব ইচ্ছে ছিলো আরেকটাবার দেখা করার।
হলো না... আপনি নেই তবে আপনার আদর্শ বেঁচে থাকবে আপনার সেই অগণিত বাচ্চাদের মাঝে.. কথা দিচ্ছি যদি কোনদিন শিক্ষকতা করার সুযোগ আসে আমরা আপনার মতাদর্শের অনুসারী হবো স্যার...
প্রমিজ....

লিখেছেন - সোহান চৌধুরী

১৪.

বাংলাদেশের এনাটমির লিজেন্ড প্রফেসর মনসুর খলিল স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন । আল্লাহ স্যারকে ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতবাসী করুন ।

আমার এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে , আরো খারাপ লাগছে মহসিন স্যারের জন্য[মনসুর স্যারের ভাই] , পৃথিবীতে উনি একবারেই একা হয়ে গেলেন।

ফার্স্ট ইয়ারে স্যারের ক্লাস পেয়েছি , আমাদের সম্বোধন করতেন "শোন বাচ্চারা " বলে। এমফিল এর ফার্স্ট পার্ট এর ভাইবা উনার কাছেই দিয়েছি ।

এইত কয়দিন আগেও আমাদের নাদিয়া আপুর থিসিস ডিফেন্ড ভাইবা নিতে এসেছিলেন , দেখা হয়েছে তখনও ।

আমাদের সবাইকে একে একে আবার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন মহসিন স্যার , আর আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলছিলেন - “এই ছেলেটা ইমিউনো কম্প্রোমাইজড , সারাবছর ঠান্ডা বাধায়ে বসে থাকে ।” :-)

ভাবতেই পারছি না , স্যারকে শেষবারের মত দেখতে পাব না। এনাটমিক্যাল সোসাইটির কনফারেন্সের জন্য ঢাকায় এসেছিলাম, ইচ্ছা ছিল শনিবার দেখা করব স্যারের সাথে।
খুব ইচ্ছা ছিল আমার থিসিস ডিফেন্ড স্যারের কাছে দেব ।

আল্লাহ তুমি উনাকে মাফ করে দিও , জান্নাতি হিসেবে কবুল কোরো ।

নাদিয়া আপুর থিসিস ডিফেন্ডের সময় স্যার বলছিলেন - “এমএমসি তোমার মা , এখান থেকে এমফিল ডিগ্রী নিয়ে যাচ্ছ , নিজের মা কে কখনও ভুলে যেও না ।”
[ স্যারের জন্য সবাই খুব দোয়া করবেন প্লিজ]

লিখেছেন - যুবায়ের আহমেদ

১৫.

প্রফেসর মনসুর খলিল স্যার এর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা :
যখন একটি ছাত্র তার তুখোড় মেধা নিয়ে খুব ভাল রেজাল্ট করে আনন্দ নিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হয়, তার আনন্দ হতাশায় পরিণত হয় মেডিকেলে র প্রথম সাবজেক্ট এনাটমিতে এসে। মেডিকেলের ভাষা আলাদা। এই টার্মিনোলজি আয়ত্বে এনে তারপর এনাটমির ২০৬ টি বোনস, জয়েন্টস, মাসল এটাসমেন্ট পড়তে গিয়ে স্টুডেন্ট দের নিজেদের হাড় মাংস এক হয়ে যাবার উপক্রম।টিচারদের কাছে আইটেম, কার্ড আর প্রফের সময় মনে হয় অপদার্থ আর বেকুব
এই হতাশা জনক দিন গুলোতে বাবার মত স্নেহ দিয়ে যিনি আগলে রেখেছেন ছাত্র দের তিনি ই বিখ্যাত এনাটমির প্রফেসর, মনসুর খলিল স্যার। তিনি ছাত্রদের "বাচ্চারা " বলে সম্ভোধন করতেন। তার জ্ঞানের ভান্ডার ছিল বিশাল। মানুষের এনাটমি, বিড়ালের এনাটমি, ইদুরের এনাটমি কম্পারেটিভ এনাটমিতে দক্ষ। প্রতিটি ছাত্রর প্রতি আলাদা ভাবে নজর দারী ছিল। ক্লাসে না এলে ফোন করে বা ম্যাসেজ দিয়ে না আসার কারণ জানাতে হত। স্যার মেসেজের উত্তর ও দিতেন। এনাটমি তিনি ইজি করেছেন, ভাইভা বোর্ডে তিনি ছাত্রের কাছ থেকে কিভাবে উত্তর বের করে আনতে হয়, তাও জানতেন। আর পাশ করানোর জন্যই বসে থাকতেন।" ছাত্র ফেল করবে না জানলে এটা ঠিক ই আছে, কিন্তু টিচারের ও দায় আছে কেন ছাত্র এটা পারলোনা " আমার মনে হয় আজকের শিক্ষক আর ভবিষ্যৎ এর সকল শিক্ষকের কাছে প্রফেসর মনসুর খলিল স্যার আদর্শ।
ব্যক্তি জীবনে স্যার ছিলেন খুব ই সাদাসিধা। সবসময় সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরতেন। বেতনের টাকার বেশির ভাগ অংশই দান করে দিতেন। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের তুখোড় ছাত্র ছিলেন। ছাত্র জীবনে কমিউনিটি মেডিসিন ছাড়া সব সাবজেক্টে অনার্স মার্কস পেয়েছিলেন। বিদেশে অনেক ভাল অফার রেখে দেশের টানে তিনি দেশেই থেকে গেছেন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, সিলেট এম,এ,জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ দীর্ঘদিন এনাটমি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। সবশেষে অধ্যাপক এনাটমি, আর অধ্যক্ষ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ কিশোরগঞ্জ, তাঁকে পেয়ে ধন্য হয়েছে। বুকে ব্যাথা নিয়ে হঠাত অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি হন। পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে কেবিনে যান। এর পর বাসায় যান। ২৪ ডিসেম্বর বিকেল তিনটায়, নিজ বাসায় তিনি এত গুলো সন্তান সম ছাত্রদের ফেলে না ফেরার দেশে চলে যান। ইন্নালিল্লাহি ওয়া....রাজিউন। ব্যক্তিজীবন এ অবিবাহিত স্যারের সকল মায়া আর সকল শাসন ছাত্ররা পেয়ে ধন্য হয়েছে। স্যার আপনার ছাত্রদের দোয়া সবসময় আপনার জন্য থাকবে।

লিখেছেন - স্যারের একজন গুনগ্রাহী শিক্ষার্থী

১৬.

মেডিকেলে ঢোকার পর আমার অবস্থা হয়েছিল, গরীবের হাতি কেনার মত। কোন রকমে চান্স ত পেয়েছিলাম, কিন্তু পড়াশোনার বহর দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলাম।
পড়াশোনার পার্ফরমেন্স দেখে বাকি শিক্ষকেরা এমন ভাবে তাকাতেন, যেন আকাট গো মুখ্যু এখানে এল কি করে? সব মিলিয়ে ফিলিংস হত, হোস্টেলের তিন তলা থেকে লাফ দিই, ঝামেলা চুকে যাক।

সেই ভয়ংকর দিনে শুধু একজন স্যার ছিলেন, যিনি বিগিনারস দের প্রব্লেম বুঝতেন। চেষ্টা করতেন, সব কিছু সহজ করে তোলার। বারবার বলতেন, একে অপরকে সাহায্য কর ( ভাল স্টুডেন্ট দের চিরকালীন সমস্যা, লেখা পড়া কে ব্যক্তিগত করে রাখা) স্যার বলতেন, লেখাপড়া যত শেয়ার করবে তত বাড়বে। প্রমাণ স্বরুপ দেখেছিলাম, পড়ে একজন আরেকজন কে বল্লে, বুঝালে, ডিস্কাসন করলে নিজের কাছেই বিষয় টা পরিষ্কার হয়ে যায়। স্যারের কারনেই হয়ত, আমাদের ব্যাচটায় হিংসা কম ছিল। ফার্স্ট গার্ল ও অবলীলায় তার নোট শেয়ার করত।

সাত বিষয়ে অনার্স পাওয়া এই মানুষ পরীক্ষক হিসেবে পাস করাতেন গণ হারে, ভাল পারলে অনার্স ও দিতেন। এই চিন্তা করতেন না, যে আমি ত অত সহজে অনার্স পাইনি, তোদের কেন দেব?
আক্ষরিক অর্থেই সাধু- সন্ত টাইপ মানুষ ছিলেন। দু চারটে জামাকাপড় আর ঘরভর্তি বই সহ একটা রুমে মনে হয় জীবন কাটিয়ে দিলেন। অসম্ভব মেধাবী ছিলেন, চাইলেই দু হাতে টাকা কামানো ড হতে পারতেন, তা না হয়ে এনাটমির প্রফেসর হয়ে আমার মত খাদে পরা নিউকামার দের টেনে তুলতে লাগলেন।

চিরকুমার ছিলেন, হার্ট এটাকের পর কে যে হাস্পাতালে নিল, মৃত্যু শয্যায় কে পাশে ছিল, খুব জানতে ইচ্ছে করে ( সন্দেহ নেই, উনার গাদাখানেক ছাত্রছাত্রী ছিল) সবাই বলে শিক্ষকেরা বাবার মত। কিন্তু বাবা হয়ে উঠতে পারতেন একজন ঈ, তিনি এই বাপু স্যার ( স্টুডেন্ট দের কাছে, স্যারের নিক নেম, কি শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের সাথেই না আমরা উনাকে এ নামে ডাকতাম)

স্যার, আল্লাহ আপনাকে সুখে রাখুক, অনেক অনেক। স্যার মনে হয় জীবিতকালেও খুব সুখেই ছিলেন, শুধু পড়াশোনা করে আর স্টুডেন্ট পড়িয়ে তার মত খুশি কেউ হতে পেরেছিল? মনে হয় না।
স্যারের জন্য আমার মত অধমের কিছু করার নেই। যদি কোন দিন টিচিং প্রফেশনে যাই, আপ্নার মত হবার চেষ্টা করব। নিতান্ত গবেট, স্টুপিড দেখলেও বিরক্ত হব না। আর আপ্নার গল্প শুনিয়ে যাব। এক দেশে ছিলেন, এক মনসুর খলিল স্যার।

লিখেছেন - আমেনা বেগম ছোটন

১৭.

গত মে'২০১৫ তে প্রথম বৃত্তিমূলক এমবিবিএস পরীক্ষায় আমার কলেজে এনাটমিতে ১০০% পাস করেছিল, দুইজন অনার্স মার্ক পেয়েছিল। এটা নিয়ে অনেকে সমালোচনা করেছিলেন, প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে-কিভাবে এনাটমির মত জটিল বিষয়ে ১০০% পাস করে!!! এনাটমিকে জটিল যে কেন ভাবেন তা উনারাই জানেন। এত সহজ একটা বিষয়, হাতে কলমে পড়ার, যেখানে সবকিছু ব্যাখ্যা করা যায়, সবকিছু বুঝে পড়া যায়। আমি সেভাবেই পড়াই আমার ছাত্রছাত্রিদের। তবে এই সমালোচনা মনসুর খলিল স্যারকেও শুনতে হয়েছে। কেন তিনি এত নম্বর দেন, কেন তিনি এত বেশি/সবাইকে পাস করান, কেন তিনি এত বেশি অনার্স মার্ক দেন। আমি সব কিছুতে উনাকে অনুসরন করার চেস্টা করেছি। উনি আমাকে পাশে বসিয়ে শিখিয়েছেন কিভাবে পরীক্ষার সময় কথা আদায় করতে হয়। ছাত্রছাত্রিদের প্রতি এক্সাম এর সময় কি Attitude দেখাতে হয়। কক্সবাজার মেডিক্যালে থাকার সময় একবার লিখিত পরীক্ষায় একজনকে ৩৫ এর মাঝে ৩৪ দিয়েছিলাম। আমার বন্ধু কবির, যে এক্সটারনাল ছিল, সে শুনে বলল তোমার এক্সামিনারশিপ বাতিল হবে। আমি ভয় পেয়ে নম্বর কমানোর চেষ্টা করলাম। অনেক কষ্টে ১ নম্বর কেটে ৩৩ করলাম। মনসুর স্যার পরে শুনে বললেন কেন আমি কমালাম। আসলে হাত খুলে নাম্বার দিতে বড় মন লাগে, সবাই পারে না। উনি আমাকেও অনেক নম্বর দিতেন। আমিও আমার ছাত্রছাত্রিদের তা দেই। উনি উনার ছাত্রছাত্রিদের পাস করানোর জন্য যে যে পাগলামি করতেন, তা কিভাবে যেন আমার মাঝেও চলে এসেছে। তাই এইসব সমালোচনা আমিও উনার মত গায়ে মাখিনা। আমার কাছে প্রধান হল আমার ছাত্র-ছাত্রি। বাকিসব পরে। এই সব Attitude এর পিছনে আমার স্যার এর অবদান ভুলবো না। আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব উনার কাছে।

লিখেছেন - অধ্যাপক আশফাকুর রহমান

১৮.

মনসুর খলিল স্যার,the legendary professor of anatomy dept...শুধু এটুকু বললে হয়ত অনেক বেশি কম বলা হয়ে যাবে।স্যারের সরাসরি স্টুডেন্ট না হওয়ায় খুব বেশি স্যারকে দেখা হয়নি,তবে যতটুকু দেখেছি,as a teacher,as a guide,as a human being আমার দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষদের মাঝে স্যারের নাম উপরেইথাকবে সবসময়।জীবনের প্রথম প্রফ,কোনোরকম ইন্টারনাল ছাড়া বাইরে থেকে সিএমসিতে ভাইভা দিতে যাওয়া স্টুডেন্টগুলোকে স্যার যেভাবে পথ দেখিয়েছিলেন,আমি আমার পুরো মেডিকেল লাইফে এমন শিক্ষক খুব কমই দেখেছি।স্যারের নেওয়া ক্লাসগুলোতে দেখেছি each nd every stdnt এর প্রতি স্যারের ছিলো equal attention.পরীক্ষার আগে আমরা যখন সবাই যখন দিশেহারা,সিএমসিতে ভাইভার জন্য কিভাবে পড়বো,কি কি স্লাইড আছে কিছুই যখনজানিনা,স্যার প্রতিটা স্লাইড আমাদেরকে নিজে দেখিয়ে দিয়েছিলেন,ভাইভার পড়াটা যেনো হঠাতই মনে হচ্ছিলো অনেক সহজ।কারো ভেতর জানার আগ্রহ দেখলে অনেক খুশি হতেন।আমার জীবনে একমাত্র দেওয়া ভাইভা যেটাতে আমি নার্ভাস হওয়ার সুযোগ পাইনি।কখনোই মনে হয়নি আমরা বাইরের মেডিকেল থেকে আসা স্টুডেন্ট,কোনো ভেদাভেদ ছিলোনা স্যারের মাঝে,যা একমাত্র খুব বড় মনের মানুষ না হলে সম্ভব না।এমন একজন মানুষ এখন অনেক দুর্লভ।
স্যার আপনি যেখানেই থাকেন,ভালো থাকেন।আল্লাহ আপনাকে বেহেশত নসিব করুন এ দোয়াই করি।

লিখেছেন - নাজিফা হৃদি

১৯.

২৪শে ডিসেম্বর, ২০১৫।
আজ আমরা হারালাম একজন অতুলনীয় ডাক্তার এবং জনপ্রিয় শিক্ষককে।

যার মুখের কথার মাধ্যমে, এনাটমির মতো কঠিন রসকষহীন সাবজেক্টও আকর্ষনীয় হয়ে উঠতো, আমাদের সেই স্যার শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ডা. মনসুর খলিল স্যার [MBBS, DFM, MCPS, MS, MPhil, PhD, MMEd] যাকে অভিহিত করা হয় “এনাটমির কিংবদন্তী প্রফেসর” নামে ( কিশোরগঞ্জের শহীদ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ও এনাটমির ডিপার্টমেন্টাল হেড এবং আরেকজন সুবিদিত প্রফেসর ডা. মোহসীন খলিল স্যারের ভাই) আজ বিকেল ৩ঃ২০মিনিটে ইন্তেকাল করেছেন!

ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন।

মূলত, বেশ কিছুদিন আগে হঠাৎ respiratory distress, chest tightness এর কারনে স্যার হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তার Pulmonary Hypertension ডায়াগনসিস হয়।

স্যার ২১তারিখ সোমবার হতে, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের CCU তে এডমিট ছিলেন। শারিরীক অবস্থার উন্নতির কারনে তাকে আজ হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হয়।

বাসায় ফেরত আসার পর, বিকেলের দিকে তিনি মারা যান। :'(

স্যার ছিলেন আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।
তিনি যেখানে শিক্ষকতার জন্য গেছেন, সেখানেই ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছেন।

মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে স্যারের আত্নার মাগফেরাত কামনা করছি।

লিখেছেন - ডা. নেফারিয়ো।

২০.

বড়ভাই চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে পাশ করেছেন।তাদের সময় এনাটমি ডিপার্টমেন্টের প্রধান ছিলে প্রফেসর ডা:মনসুর খলিল স্যার।আজ ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম স্যার কেমন ছিলেন?
ভাইয়ের একটাই উত্তর যারা মনসুর স্যারকে পেয়েছেন তাদের মধ্যে মনসুর স্যারকে খারাপ বলতে পারবে এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না,স্যারের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ কেউ তুলতে পারবে না।স্যারের মত মানুষ হয় না।
স্যার আপনি ভাল থাকুন।আল্লাহ আপনাকে জান্নাতবাসী করুক।আমিন।

স্যার বলতেন, বই এর ছবিগুলো দেখবে।

সব ছাত্র-ছাত্রীকেই আপন করে নিতেন……… দরদ মিশানো আপন। একবার এক ছাত্রকে বললেন, কলা দেখেছো, কলা? এত সোজা নয়। (মানে কলা যেমন সহজে খাও্য়া যায়, সে রকম সোজা পড়াশোনা নয়)। সেই বকা দেয়ার মধ্যে এত দরদ, স্যারের মুখে নিজে না শুনলে সেটা বুঝা যাবে না।

খুব পড়া পাগল ছিলেন। সব সময় পড়াশোনা নিয়ে থাকতেন। সংসার করেননি। বলতেন, আমি তো রাত্রে Gray ( Gray's Anatomy বই) বুকে নিয়ে ঘুমাই।

সবগুলো প্রফেসনাল পরীক্ষায় ফার্ষ্ট স্ট্যান্ড করেছিলেন। যে কোন Clinical Subject এ খুব সহজেই Post Graduation করতে পারতেন, করেন নি। অর্থ টানেনি তাঁকে, Education টেনেছিল, Dedication টেনেছিল……… a true educationist.
স্যারের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে ফোনে, ২০০৮ সালের দিকে। বললেন, তোমার FETUS ( Embryology Book FETUS ) বইটা খুব ভাল হয়েছে।

একবার নীলক্ষেত গেছি, এক বই এর দোকানের মালিক বলল, কিশোরগঞ্জ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল মনসুর খলিল স্যার ( DR.MONSUR KHALIL ) উনার কলেজ লাইব্রেরীর জন্যে আপনার ৫০ কপি FETUS বই কিনে নিয়ে গেল।তখন মেডিকেল কলেজটি মাত্র নতুন হয়েছে, কলেজের মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যায় ৫০ জন। লাইব্রেরীতে সব ছাত্র-ছাত্রীর জন্যে একটা করে FETUS বই কিনে দিয়েছেন ……… এমনই পাগল টাইপ ছিলেন স্যার।

এরকম উন্নতমানের, নিবেদিত শিক্ষক বাংলাদেশ আর কবে পাবে……

আল্লাহ স্যারকে বেহেশত নসীব করুন। আমীন।

লিখেছেন - আবেদুর রহমান

২১.

ড. মনসুর খলিল স্যার...........বাচ্চাদের ফেলে এইভাবে চলে গেলেন!...মেডিকেল লাইফের প্রথম ক্লাশটি এখনো ভুলি নি স্যার...একজন গোলগাল ভালমানুষ কি অদ্ভুত রকম সহজ করে কটমটে মানবদেহ(এনাটমি) পড়াচ্ছিলেন!...
দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পরে যখন মেডিকেলে ফিরেছিলাম...১ দিনের আল্টিমেটামে হেড-নেক কার্ড দিলাম স্যারের কাছে....স্যার শুধু বলেছিলেন.."বাচ্চা তুমি শুধু তোমার খেয়াল রাখবে...বাচ্চা তুমি তো ডাক্তার হচ্ছ...এর চেয়েও বড় ব্যাপার আগে মানুষ হও..বেঁচে থাকো "...তখন বুঝেছিলাম তিনি আসলে ভুল করে পৃথিবীতে চলে এসেছিলেন!.....পৃথিবী তো খারাপ মানুষের জায়গা!....
এই ভালমানুষ এর জন্য আমার স্যালুট...
আপনি বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেলেন স্যার...#

লিখেছেন - ফাবলীনা নওশীন

২২.

বাবা 208 টা ছেলেমেয়েকে এতিম বানিয়ে চইলা গেলা.....
আমাকে না!! ক্লাস 1 ডাক্তার বানানোর কথা ছিল??
আমি কার কাছে সব কথা বলব....
আমার চারপাশে কেউ নাই....
একবার দেখে যাও এক মৃত্যুপুরী, তোমার স্বপ্নের এই মেডিকেল টাকে....
বাবা আমাকে সকালে জগিং করার কথা বলবা না....
বাবা এমনি করে আমার স্বপ্ন গুলো ভেঙ্গে ফেললা...
একবারের জন্য আসবা, বাবা বলে ডাকব...
যেখানেই থাকো, ভাল থেকো বাবা...
অধ্যাপক ডাঃ মনসুর খলিল স্যার
আমাদের প্রিন্সিপাল
আমাদের বাবা.....

লিখেছেন - আহসান রানা

২৩.

বিছানার উপর বসে বাচ্চাদের মতো কাঁদছেন পিতা। ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। খুব ইচ্ছে করছে তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেই। যেমন করে তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন।
.
মানুষটি আমার জন্মদাতা পিতা নন। আমার
প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর মহসিন খলিল।
জন্মদাতা পিতার মতো করে এই একজন মানুষকেই পিতৃতুল্য শ্রদ্ধা করি। স্যারও সেটা জানতেন।
.
মাঝে মাঝে কান্না থামিয়ে প্রলাপের মতো বলছেন,
"জিনিশ টা ঠিক হয় নাই।"
"সে এভাবে চলে গিয়ে ঠিক করে নাই!"
"আমার সাথে অন্যায় হয়েছে, অনেক বড় অন্যায়!"
বড় বড় প্রফেসর স্যাররা এসে স্যারের পিঠে হাত রেখে স্বান্তনা দিচ্ছেন।
স্যার বললেন, "আপনারা মেনে নিতে বললেও আমি মানতে পারছি না!"
.
আপনজন হারানোর বেদনা মেনে নেওয়া যায় না। তার উপরে যমজ ভাই। সারা জীবন একসূত্রে গাঁথা ছিলো দুইজনের জীবন। দুইজনের কেউই বিয়েশাদি করেন নি। সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন তাঁদের অগণিত সন্তানদের কে ডাক্তার বানানোর জন্য। তাঁদের মতো ভালো মানুষ বানানোর জন্য।
মনসুর স্যার হঠাৎ চলে যাওয়ায় মহসিন স্যার
বড্ড একা হয়ে গেলেন। মাত্র বছর দুই আগেই তাঁর হাতে মাথা রেখে মারা গেলেন তাঁর মা। আর এবার যমজ ছোট ভাই।

স্যার পাগলের মতো প্রলাপ বকতে
থাকলেন, "কাজটা ঠিক হয় নাই। আমার ভাই
মারা যাবার জন্যই আমার কাছে এসেছে।"
.
ভাইয়ের ডেড বডি কে সামনে রেখে স্যার কিছুই খাবেন না। সারা দিন না খেয়ে ছিলেন। স্যার নিজেই ডায়াবেটিস আর হার্টের রোগী। নিয়মিত ইনসুলিন লাগে। দুপুর থেকে বড় বড় প্রফেসররা এসে হাত বুলিয়ে জোর করে স্যার কে খাওয়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোন
কিছুতেই লাভ হল না। শেষ পর্যন্ত আমি আর স্যারের আরেক প্রিয় স্টুডেন্ট ছোটভাই ফখরুল মিলে রাতের বেলায় স্যার কে ভেতরের রুমে নিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিলাম। আমি স্যার কে বললাম,
"আপনি যদি সারা রাত না খেয়ে থাকেন
তবে আমরাও কিছু খাবো না!"
দুইজনের কাছে একটাই দাবি ছিলো, সন্তানের দাবি! স্যার সে দাবি কে উপেক্ষা করতে পারলেন না।
.
এতেই প্রমাণিত হয়, দুই ভাই-ই তাঁদের স্টুডেন্ট দের নিজের সন্তানের মতো কতোটা ভালবাসেন। মনসুর স্যারের মৃত্যুর খবর পেয়ে বাসের পর বাস ভর্তি স্টুডেন্ট আর ডাক্তাররা দূর দূরান্ত থেকে চলে এসেছে। কয়জন ভাগ্যবান শিক্ষক তাঁদের স্টুডেন্ট দের এমন পিতৃতুল্য শ্রদ্ধা পায়?
.
ভাই কে হারানোর কষ্ট স্যার কোনভাবেই সহ্য করতে পারছেন না। বুকে ব্যথা উঠায় স্যার রাতে ঘুমানোর আগে নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে নিলেন। স্যার ঘুমানোর পর ফিরে এলাম। আমার বুকেও এখন কেমন যেন ব্যাথা করছে- অনুশোচনার ব্যাথা! অসুস্থ জেনেও মনসুর স্যারের সাথে দেখা না করতে পারার ব্যথা! স্যারের ভাই হারানোর কষ্ট হয়তো আমরা বুঝবো না। কিন্তু একজন ভালো মানুষ, একজন স্নেহশীল পিতা হারানোর কষ্ট আমরা বুঝি!
.
প্রিয় মনসুর স্যার,
আল্লাহ যেন আপনাকে জান্নাত বাসী করেন-
মনেপ্রাণে এই প্রার্থনা-ই করি!

লিখেছেন - শাহীন সরওয়ার জয়

২৪.

আমরা ম-42 ব্যাচ পর্যন্ত মনসুর খলিল স্যারকে পেয়েছি , স্যার ক্লাস নিতেন মাইক্রোফোন ছাড়া , কিন্তু ক্লাসের শেষ বেঞ্চের স্টুডেন্টও পরিষ্কার শুনতে পেত প্রত্যেকটা ওয়ার্ড । সবাইকে কত আদর করে " শোন বাচ্চারা " বলে সম্বোধন করতেন ।

কিশোরগঞ্জ মেডিকেলের স্টুডেন্টদের সেদিনের কান্না যারা দেখেনি তারা বুঝবে না একজন টিচার স্টুডেন্টদের কত প্রাণের হতে পারে । এইরকম স্টুডেন্টপাগল একজন টিচার পৃথিবীতে বারবার আসে না ।

গতকাল খুব খারাপ লাগছিল যখন মহসিন স্যার বলছিলেন - 'আমার কি ছিল , আমার তো কিছুই ছিল না , মনসুরই তো আমাকে টেনে আজ এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে । আমি ছিলাম ব্যাচের লাস্ট স্টুডেন্ট , মনসুর ছিল "এ" ব্যাচে , শুধুমাত্র আমাকে হেল্প করার জন্য সে "এ" ব্যাচ থেকে আমার সাথে "সি" ব্যাচে চলে আসে , শুধুমাত্র আমাকে হেল্প করার জন্য ।'

স্টুডেন্টদের শুধু দিয়েই গেলেন , কিন্তু অসুস্থতার শেষ সময়ে স্টুডেন্টদের একটুখানি সহযোগীতাও নিতে চাননি , উনি বলে দিতেন "আমি লজ্জিত" ।

আচ্ছা আমরা কি একটা কাজ করতে পারি না ? আমাদের কলেজের কোন একটা স্থাপনা স্যারের স্মৃতি হিসেবে নামকরণ করতে ?

যেমন আমাদের পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েট লাইব্রেরির নাম "প্রফেসর মনসুর খলিল পোস্টগ্র‍্যাজুয়েট লাইব্রেরি" বা "প্রফেসর মনসুর খলিল এনাটমি মিউজিয়াম "।

এই নামকরণ প্রস্তাবনা নিয়ে আমরা স্টুডেন্টরা একটা এপ্লিকেশন লিখে প্রিন্সিপাল স্যার বরাবর এপ্রোচ করতে পারি ।

অন্তত মহসিন স্যারের স্নেহধন্য স্টুডেন্ট হিসেবে আমরা এতটুকু কি করতে পারি না ?

লিখেছেন - যুবায়ের আহমেদ

২৫.

মনসুর খলিল স্যার আর নেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন। স্যারের সাথে আমার প্রথম দেখা ময়মনসিংহ মেডিকেলে। আমার ভাইয়া, আপু স্যারের স্টুডেন্ট ছিল। আমার ভাগ্নে জামি কে ভর্তি করতে নিয়ে গেছিলাম। পরে কর্মক্ষেত্রে দেখা কিশোরগঞ্জে। বিসিএস এ যোগ দেওয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, এখনি ব্যাংকে গিয়ে একটা নতুন একাউন্ট খোল। ঘুষের একাউন্ট। ওষধ কোম্পানী থেকে টাকা নিয়ে সেটাতে জমাবা আর ডিজি অফিসে গিয়ে সে টাকা দিয়ে কাজ করাবা। লাস্ট দেখা মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার গার্ড দিতে গিয়ে। আমি ছাড়া কিশোরগঞ্জের আর কোন ডাক্তার আসেনি। স্যার আমাকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে মাঠের মাঝখানে গালে চুমু খেলেন। সেদিন ভীষন লজ্জা পেয়েছিলাম। ভাল থাকবেন স্যার। আবার দেখা হবে।

লিখেছেন - রেজা আহমেদ

২৬.

আমি জীবনে কোন ফেরেশতা দেখিনি,দেখার সাধও নাই,কারণ আমি মনসুর খলিল স্যারকে দেখেছি।

আপনি হয়ত নিঃসন্তান ছিলেন,কিন্তু আপনার বিদায়ে আপনার হাজারো "বাচ্চার" হৃদয়ে আজ পিতৃবিয়োগের আর্তনাদ।

জানি অনন্তের ঐ জগতে ভালই থাকবেন।ঐ জগতটা যে ভালমানুষেরই।

"বিদায়" চিকিৎসা শিল্পের হে মহান শিল্পী।

লিখেছেন - মামুনুল হক

২৭.

বাংলাদেশের পুরো ডাক্তার সমাজ নড়েচড়ে
বসেছে, শুধু একটা মানুষের মৃত্যুতে..... নড়বে
না
কেনো???? তিনি যে সাধারণ কেউ নন,,........
তিনি অধ্যাপক মনসুর খলিল স্যার।
কত নামকরা ডাক্তারের টিচার তিনি,যাদের
অধিকাংশই ১.৫
বছর শিক্ষাগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছে,
কিন্তু
আমরা????
শহীদ_সৈয়দ_নজরুল_ইসলাম
মেডিকেল
কলেজের স্টুডেন্টরা গত চার বছর ধরে তার
ছায়াতলে ছিলাম, আচ্ছা এই মেডিকেল এর
২০০ ছাত্র-ছাত্রীর কেউ কি বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে স্যার আমার নাম টা জানতেন না, কিংবা আমার পরিবার,মা-বাবা কি করে এসব সম্পর্কে স্যারের ধারণা ছিলোনা? পারবে না।

স্যার প্রতিটা স্টুডেন্ট এর নাম ধরে
ডাকতেন,একটা
মানুষ কিভাবে পারতো জানিনা, খুব বেশি
ভালোবাসা না
থাকলে হয়তো কেউ এমনটা পারেনা।

একাডেমিক কাজ থেকে শুরু করে, রান্না
ঘরের
খালা মামা,হোস্টেলের ডাইনিং, এমনকি
বাথরুমের
একটা লাইট নষ্ট হয়ে গেলেও সেটা স্যারের
নলেজে থাকতো। ।

একটা ফোন পেলেই কত সুন্দর করে এক
মুহূর্তে খেলাটা শেষ করে দিতেন, সব কিছুই
কেমন নিয়মের মধ্যে ছিলো, কিন্তু মনসুর
সাহেব, খেলাতো এখনো অনেক বাকি,
খেলার
মাঝপথে কেনো আপনি খেলাটা ছেড়ে দিয়ে
চলে গেলেন????

পরীক্ষায় যে ছেলেটা খারাপ করতো তার
প্রতি স্পেশাল নজর রাখার জন্য টিচারদের ফোন দিয়ে দিয়ে ব্যস্ত করে রাখতো,, ১০০% পাশ তো এমনি এমনি আসেনি সবই প্রিন্সিপাল স্যারের নিয়ম মত চলেছিলো, পড়াশোনা, পরীক্ষা। এই যেমন পরীক্ষার ছয় মাস আগেই সিলেবাস শেষ, তারপর প্রি_প্রফ নেওয়া,কোনো মেডিকেলে হয় কিনা আমার জানা নেই।

বলতেন, "দেখো বাচ্ছারা আগে পড়াশুনা করবে তারপর অন্য কিছু।"

আচ্ছা মনসুর সাহেব, আপনি না ২০০ স্টুডেন্ট
এর বাবা
মা কে কথা দিয়েছিলেন, পাঁচ বছরের জন্য
আমরা
আপনার সন্তান???? পাঁচ বছর পর আমাদের
তাদের
কাছে ফেরত দিবেন, আপনি কেনো এমন
করলেন??? আমরা তো এখন এতিম হয়ে গেলাম।

আমার বাবা যখন বললো,তোমার স্যার এত
আগেই তোমাদের আমাদের কাছে ফেরত দিয়ে
দিলো, আমার বাবা তো আপনার স্টুডেন্ট ও না, তার পর ও কথাটা বলার সময় তার কন্ঠ এতটা ভারী ছিলো মনে হচ্ছিলো ছোট বাচ্চাদের মত কেঁদে দিবে, আমি কিচ্ছু বলতে পারিনি শুধু নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

বাংলাদেশ একটা রত্ন হারালো, উপমহাদেশের বিখ্যাত এনাটমিস্ট কে হারালো , ডাক্তার সমাজ তাদের প্রাণের টিচারকে হারালো....... কিন্তু আমরা শহীদ_সৈয়দ_নজরুল_মেডিকেলের ২০০ স্টুডেন্ট তাদের আদরের বাবা কে হারালাম।

ছোট এই মেডিকেল টা তার কারণেই মাথা উঁচু করে বড় বড় মেডিকেলের নামের পাশে জ্বল জ্বল করছিলো , আমরা অসহায়, প্রতিটা স্টুডেন্ট এর মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে ।
.
রেখে আসলাম, একা একটা মাটির ঘরে।

বাবা তুমি ভালো থেকো।।।

লিখেছেন - শামিম আফজাল।

২৮.

২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে তোমার সাথে প্রথম দেখা হয় বাবা,অনেক বকেছিলে সেদিন পরে চুমু খেয়ে অবশ্য মন ভালো করে দিয়েছিলে।বিগত ৪ টা বছর ধরে মাথার উপর ছিলে ছায়ার মতো।তুমি তো কথা দিয়েছিলে বাবা, দায়িত্ব নিয়েছিলে ৫ বছরের, তবে কেনো তোমার সে কথাটা তুমি রাখলেনা,দায়িত্ব টা পুরোপুরি ভাবে পালন করলেনা?কেনো অামাদেরকে এতিম করে দিয়ে চলে গেলে,কেনো মাঝ সমুদ্রে অামাদের ফেলে দিয়ে ঐপারে চলে গেলে? তুমি কি জানো, প্রতিষ্ঠান টার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে অাজ,নাকি দেখতে চেয়েছিলে সন্তানদের চোখে কতো জল পিতার জন্য? তবে দেখে যাও সবাই অাজ কাঁদছে,পিতৃশোকে কাতর সবাই, কালকে থেকে কি হবে কিছুই বুঝতেছিনা,ভাবতেই পারছিনা যে এই মানুষ টাকে অার দেখতে পাবো না। কেউ যেনো অামাদের হাত পা বেধে পানিতে ফেলে দিছে,জানো বাবা আর কেউ জিগ্গেস করবে না ঠিকমতো বাসায় পৌছালাম কিনা,কোনো মেডিক্যাল এর প্রিন্সিপাল সব ছেলে মেয়ের নাম,কয় ভাই বোন, মোবাইল নাম্বার এগুলো জানেননা রাখেন ও না, কেনোই বা রাখবেন তারা তো মনসুর খলিল নন,মনসুর খলিল একজনি ছিলেন, যিনি আমাদের বাবা,তিনি আমাদের জন্ম দাতা পিতা নন,তিনি নিজ কর্মগুনে আমাদের পিতৃত্বের অধিকার আদায় করে নিয়েছেন।এই মেডিক্যাল কলেজের প্রত্যেকটি ইটের মধ্যেও তোমার নাম লিখা রয়েছে বাবা, বিগত ৪ বছরের প্রত্যেকটা দিন ঘুম থেকে উঠছি তোমায় ভেবে, ঘুমোতে গেছি তোমায় ভেবে।তোমার মতো এতোটা সৎ মানুষ কখনো দেখিনি, আর জানি তোমার মতো এতো আপন করে কেউ নিতে পারবে না,আর এই মেডিক্যাল কলেজের ভাগ্যেও এমন পিতারূপী প্রিন্সিপাল আর আসবেন না।যেখানেই থাকুন ভালো থাকবেন বাবা।মৃত্যু পরবর্তী শ্রেষ্ঠ জায়গাটাই যেন তোমার আলোয় আলোকিত হয়।
প্রফেসর ডঃ মনসুর খলিল, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ একজন এনাটমির প্রফেসর, গতকাল দুপুর ৩ টার দিকে পরলোক গমন করেন।সবাই যেন উনার আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করি।

লিখেছেন - প্লাবন রায়

২৯.

ফেইসবুকের নিউজ ফিড-এ যতবার মনসুর স্যারকে নিয়ে আবেগময় পোষ্ট দেখছি,চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে...
মনসুর স্যারকে পেয়েছি গেস্ট টিচার হিসেবে।প্রথম প্রফেশনাল পরীক্ষার আগে স্যার এসেছিলেন আমাদের হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট মহসীন খলিল স্যারের আমন্ত্রণে।কয়েকটা লেকচার,অসাধারণ লেকচার।কিন্তু স্যারকে চিনেছি তো মেডিকেলের সেই প্রথম দিন থেকেই। বড় আপুদের মুখে শোনা সেই সব গল্প,মনসুর খলিল আর মহসীন খলিল-দুই ভাইয়ের মিষ্টি কিছু দুষ্টুমির গল্প,লিজেন্ড হয়ে ওঠার গল্প....
অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট এই মানুষ দুজনের কেউই বিয়ে করেন নি,সেজন্য আমাদের আফসোসের শেষ ছিল না;এই অদ্বিতীয় জেনেটিক বৈশিষ্ট্য পরের প্রজন্ম পাবে না-এটা ভেবে।মানুষ দুজন নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেন তাঁদের স্টুডেন্টদের জন্য...
মনসুর স্যারের সাথে প্রথম এবং শেষবার মুখোমুখি দেখা করতে যাই কিশোরগঞ্জে,শহীদ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে।কোন উদ্দেশ্য ছাড়া, শুধুমাত্র একজন মহামানবের ছায়াতলে কিছুক্ষণ বসব বলে।স্যার আমাকে বলেন, 'তুমি এনাটমি তে ক্যারিয়ার করতে পার,৮টা-২টা অফিস,অল্প সময়ে প্রমোশন।সারাদিন চেম্বার করলে ছেলে-মেয়ে মানুষ করবে কে?' আমি হাসি।নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের চেয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কথা বেশি ভাবেন বলেই তো তিনি মনসুর স্যার....

কেন যেন মহসীন স্যারের জন্য বেশি কষ্ট হচ্ছে।আরো বেশি একা হয়ে গেলেন কি?

চিকিৎসাবিদ্যায় হাতেখড়ির সময়টায় অকল্পনীয় পড়াশোনার চাপ আর মেন্টাল স্ট্রেস নিতে না পেরে হারিয়ে যেতে বসা কত শত ছাত্র-ছাত্রীকে যে টেনে তুলেছেন এই মানুষ দুজন, হিসেব নেই।
আল্লাহ মনসুর স্যারকে জান্নাতবাসী করুন,আর মহসীন স্যারকে আমাদের মাঝে আগের মতোই হাসিখুশি আর সুস্থ রাখুন আরো অনেক বছর।
আমিন।

লিখেছেন - আয়েশা সিদ্দীকাদ্দীকা লাবনী

৩০.

স্মরণ # সদ্য প্র‍য়াত প্রফেসর মনসুর খলিল স্যার

স্যারের সাথে পরিচয় হবার আগেই উনার সম্বন্ধে অল্প ধারণা পেয়েছিলাম তসলিমা নাসরিনের উপন্যাস থেকে( সম্ভবত "উতল হাওয়া" উপন্যাস), স্যার যে পড়াশুনা নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকতেন সেরকম দুএক লাইন লেখা ছিল উপন্যাসে।পরে স্যারের সাথে পরিচয় ওসমানী মেডিকেলর এনাটমি বিভাগে।উনি আসার আগে আমাদের মেডিকেলে এনাটমি বিষয় নিয়ে একটা ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছিল, আর এনাটমিতে বেশি ফেলের করণে সেশনজট চলে আসছিল তা থেকে উত্তরণের জন্য হয়ত উনাকে আমাদের মেডিকেলে পদায়ন করা হয়। উনি যে কি মহৎ মানুষ ছিলেন তা বলে শেষ করতে পারবো না। আমাদের সহপাঠী গোকুল মারা যাবার পর গোকুলের লাশ নিয়ে উনি গোকুলের গ্রাম পর্যন্ত পৌছে দিয়েছিলেন, উনার সাথে যারা লাশ নিয়ে গেছে তারা পরে এসে জানালো উনি সারাদিন এম্বুলেন্সের ভিতর কিছুই মুখে দেননি।আরো কত কিছু।

আমার নিজের স্মৃতি টুকু বলি:
উনাকে আমাদের ৩৯তম ব্যাচ যখন বিদায় সম্ব্র্ধনা দেয় তখন প্রত্যেকে আমরা নিজের আবেগ দিয়ে চিঠি লিখে একটা স্বহস্তে লেখা স্মারক তৈরি করি। আর সেই স্মারকে সবার প্রথম ছিল আমার লেখা। সেই লেখা আমার এখন ১০০ ভাগ মনে নেই কিন্তু দুয়েকটা শব্দ বাদে সব হুবহু মনে রয়েছে।

আমার লেখা ছিল -----
"বসন্তের কচিপাতা কিংবা শীতের ঝরা পাতার মত পৃথিবীতে মানুষ আসে, মানুষ চলে যায়।রেখে যায় শুধু তার কর্মের ধ্বংসাবশেষ। এ পৃথিবীতে আপনি এসেছেন মানব সেবার আলোকবর্তিকা নিয়ে তাইতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে করেছেন আপনার বাসস্থান আর ছাত্রছাত্রীদেরকে করেছেন আপন ছেলেমেয়ে। এটুকু জানি আমি আপনার মত কিংবদন্তী হতে পারবো না।আশীর্বাদ করবেন আপনার পদাংক অনুস্মরণ করে আমি যেন সারাজীবন মানব সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে পারি"

স্যার আপনি বেহেস্ত বাসী হোন।

লিখেছেন - ডা. সুবল জ্যোতি চাকমা

৩১.

আমাগো ফার্স্ট প্রফের ঠিক আগে দিয়া আমাগো এনাটমি ডিপার্টমেন্টে এক নয়া স্যার আইলেন। প্রফেসর। অনেক মিথ হুনলাম হ্যারে লয়া। যেমন তিনি এই পোড়া দ্যাশের এনাটমি বিভাগের একমাত্র ফুল প্রফেসর, উনার এনাটমি জ্ঞানের ধারে কাছে দক্ষিণ এশিয়ায় কেউ নাই, ইত্যাদি। যাউকগা, এডি ব্যাপার না, কত কিছুই তো হুনা যায়, কত মাইনষের সম্বন্ধে। হুনলাম, উনি অবিবাহিত। তার একমাত্র বিনোদন/বিলাসিতা হইলো ভালমন্দ খাওয়া আর মাইনষেরে খাওয়ানো। যেখানেই যান বদলি হয়া, লগে থাকেন একজন বাবুর্চি। যাউকগা, এডিও হুনা কতা।
তো, হেই নয়া স্যারের অতি-মানবিক দক্ষতায় আমাগো ব্যাচের রেকর্ড পরিমাণ পোলাপাইন পাশ করল। উনি অমায়িক এক্সটার্নাল আনাইলেন, ইন্ডিভিজুয়ালি এবং গ্রুপওয়াইজ নিজ এবং অপর বিভাগের(ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি) শিক্ষকদিগকে মোটিভেইট কইরা ফালাইলেন পাশের হার বাড়ানোর ব্যাপারে। প্রায় অসম্ভব একটা কাম। উনি পারলেন, তার একগুঁয়েমি আর পার্সোনালিটি আর কারিশমা দিয়া।
উনি আমাদের ব্যাচের লাইগা কী করছিলেন, সেইটা অন্য এবং বিরাট ইতিহাস, অন্যরা ক’বে। আমি আমার পার্সোনাল অভিজ্ঞতা জানাই।
তো, এই পরিস্থিতিতে, আমাগো মেডিকেলের ইতিহাসে, ফার্স্ট প্রফে রেকর্ড পরিমাণ পাশের ভিত্রেও আমরা কয়েকজন অসমান্য দক্ষতার সাথে ফেল কত্তে সমর্থ হইলাম। মাত্র ২৫ জন ফেল করছিল, ১৭০ জনের ভিত্রে, কেউ এনাটমি আর বেশির ভাগই ফিজিওলজি। আমি, মিঠু আর রাশেদ ভাই উভয় বিষয়েই ফেল কল্লাম। সবাই মুগ্ধ হইল আমাগো তিনজনের অবিশ্বাস্য কৃতিত্বে।
ফেল কইরা আমরা যখন সর্বস্তরের জনগণের প্রশংসা-বাক্যে সিক্ত হচ্ছি, তখন একদিন খবর পাইলাম, এনাটমি ডিপার্টমেন্টের প্রধান, প্রফেসর মনসুর খলিল স্যার আমাগো বুলাইছেন, মানে ডাক পাঠাইছেন, দেখা করবেন। আমরা উপদেশাবলি ও তুমুল গালি খাওনের মানসিক প্রস্তুতি লয়া, আর আত্মরক্ষার্থে ‘ওঁয়া ওঁয়া’ করা মনে মনে প্রাকটিস কইরা গেলাম হ্যার সামনে, দুপুর তিনটায়, স্যার যখন যাইতে কইছেন আর কি। পুরা কলেজ ক্যাম্পাসে পিন-পতন নীরবতা। হ্যার সামনে ট্রে ভর্তি ভিসেরা – হৃদয়, মগজ, টেস্টিস, পাকস্থলি, বৃক্ক ইত্যাদি।
আমার প্রতি স্যারের প্রথম বাক্য – “মুনতাসির, তুমি সনাতন বাবুকে চেন?”
আমি আসমান থিকা পড়লাম। ঝাড়ি আশা কত্তেছিলাম, কিন্তু এইডা কী কইল? আমি তো টেনশনে, যে এই সনাতন-ব্যাডা কিডা? কুন ডিপার্টমেন্টের টিচার? কথা সইত্য, আমি অনেক স্যারেরই নাম জানিনা।
কইলাম, “(ওঁয়া) না, স্যার, চিনিনা”।
স্যার কইলেন, “তুমি আজকে যাওয়ার সময়, মেডিকেলের গেট দিয়ে বের হয়ে, বামে ঘুরবে, ঠিকাছে?”
আমি – “(ওঁয়া) জী, স্যার!”
স্যার কয়া চললেন, “বামে একটু হেঁটে হাতের বামে দেখবে একটা লেপ-বালিশের দোকান। আর তার পাশেই একটা সেলুন। বুঝেছ?”
আমি- “(ওঁয়া) জী, স্যার!”
স্যার কইলেন, “ঢুকে বলবে - ‘সনাতন বাবু কি আছেন? আমাকে মনসুর খলিল স্যার পাঠিয়েছেন, যেন আমার চুলগুলো খুব সুন্দর করে কেটে দেয়া হয়’। সনাতন বাবু চুল কাটেন। কী মুনতাসির, পারবে বলতে?”
হতভম্ব আমি খালি কইলাম, “জী, স্যার”।
স্যার যে আবার বড়-চুল বিরোধী না আর দশটা মাস্টারের লাহান, এইটাও তিনি পরের বাক্যে ক্লিয়ার করলেন, “দেখ, বাপু, বড় চুল তো রাখাই যায়, রাখতেই পার। কিন্তু চুল বড় থাকলে, কিছু যত্ন-আত্তি আছে, সেগুলো করতে হয়। কিন্তু তোমার তো মনে হয় না সেই ধৈর্য্য এবং সময় আছে। তো, যত্ন যখন নিতে পার না, ঝামেলা বরং দূরই করে ফেল।

আমরা দুই ঘণ্টা ক্লাস করলাম তার, আমরা নয়জন, যারা এনাটমিতে ডাব্বা মারছি। ভর দুপুরে একজন প্রফেসর একের পর এক ভিসেরা লয়া ধইরা, ধরায়া হাতে কলমে আমাদের শিখাইতেছেন - দৃশ্যটা রেয়ার, খুবই রেয়ার। এরপর থিকা পত্তেকদিন উনি দুপ্রে, সিয়েস্তার টাইমে কেলাস লইতেন আমাগো। দ্বিতীয় দিন, আমি চুল কাইটা গেছি, শুধু তাই না, পইড়াও গেছি খানিক। তো, কিছু পটপট কসসিলাম, স্যারের পড়া পারছিলাম। ক্লাস শেষে স্যার আমারে আলাদা কইরা জিগাইলেন, “মুনতাসির, তুমি কি মনে কর যে, পরীক্ষায় তুমি পাশ করলেই তোমার দায়িত্ব শেষ?” আমি যথারীতি তব্দা খায়া ভাবতেসি যে কী কইলে স্যার খুশি হইব, ফলে আমার মুখ দিয়া ‘ওঁয়া ওঁয়া’ ছাড়া কিছু বাইর হইল না। স্যার কইলেন, “যদি তুমি মনে কর, তুমি পাশ করলেই আমি খুশি হব, তাহলে ভুল ভাবতেছ। যদি তুমি পাশ কর, আর মাহবুব(মিঠু), রাশেদ ফেল করে – আমি কোনদিন তোমাকে ক্ষমা করব না। তুমি যখনই পড়তে বসবে, তাদের সাথে নিয়ে বসবে। তাদের পাশে না রেখে কখনই পড়বে না। আর হ্যাঁ, আমার কানে কিন্তু সব খবরই আসবে”।
দ্যাট’স দ্যা ফার্স্ট মোমেন্ট, আমি স্যারের গ্রেটনেসের একটু নমুনা দেখলাম। আমি গইলা গেছিলাম, ভক্তি-ভালবাসায়।
স্যার আমাদের নিজে পড়াইতেন, এবং বৃষ্টির বাসায় ৯ জন ছেলে-মেয়ে একত্রে পড়ার অর্ডার দিলেন। রেগুলার খোঁজ নিতেন, সবাই গেছিল কিনা, কে আসতে দেরি করছিল ইত্যাদি। আর রাইতে আমরা পুলারা পত্তে বইছি কিনা, হেইডার খবরও লইতেন।
আমি স্যারের কথা কিছুটা রাখসিলাম। রাশেদ ভাই ছিল আমাগো সিনিয়র, তার লগে খাতির ঐ টাইমেই হয়, এবং আমি সৌভাগ্য লাভ করি তার মাপের একজন ফেরেশতার লাহান মানুষের লগে পরিচিত হবার।
মনে আছে, ইভেন ভাইভার আগের রাতেও আমি মিঠুরে রুমে আইনা পত্তে বইছিলাম ফিমার, স্টার্নাম, মাথার খুলি ইত্যাদি লয়া। রাইত গভীর হয়, আর মিঠু ঘুমে ঢইলা পড়ে। আমি লাথি মাইরা উঠাই ওরে। পড়ি একলগে। মিঠু বারবার কয়, “মিশু, আমি একটু না ঘুমাইলে মারা যাব, বিলিভ মি, সিরিয়াস। জাস্ট ৫টা মিনিট ঘুমাই? আই প্রমিজ, উইঠা যামু”। আমি কই, ঘুম তর জি দিয়া ভ’রে দোবো। এক পর্যায়ে অয় কয়, “মিশু, আমি একটু হাইগা আসি, আমার খুব হাগা ধরছে”। ও গেল। আধা ঘণ্টা হয়া গেছে, হালায় আহে না। আমি তিনতলায় উইঠা অর রুমের জানলা দিয়া তাকায়া দেখি, হালায় ভিত্রে থিকা দুয়ার লাগায়া ঘুমাইতাসে নাক ডাইকা। আমি বাথরুম থিকা পানি আইনা, ফিক্কা অরে উডাইলাম। দিস মাচ, মনসুর খলিল স্যার ইন্সপায়ারড মি, উইথ জাস্ট ওয়ান লাইন।
পরীক্ষার সময়ে আরেক কাণ্ড। এনাটমি(স্যারের সাবজেক্ট) পরীক্ষা শেষ। আমরা চিন্তিত, এহন তো আর মনসুর খলিল নামের কুনু এলিয়েন নাই, আমাগো বাঁচাইব কেঠা? ফিজিওলজি ভাইভার আগের রাইতে খবর পাইলাম, স্যার ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রির সব টিচারগো নাকি বলে চাইনিজ খাওয়াইছেন। সত্য মিথ্যা জানি না আইজও। যদিও স্যার মানুষরে খাওয়াইতে ভালবাসেন, তা সবসময় হুনি। আমরা ঘটনা সইত্য বইলা ধইরা নিলাম, আর স্যার যে কেবল তার সাবজেক্ট না, ফিজিওলজিতে আমরা পাশ করি কিনা, তাও মাথাত রাখছেন – এইডা ভাইবা আমরা সাহস ফিরা পাইলাম। পরদিন ভাইবা চলতাছে, একটু পরেই দেখি, দরজায় মনসুর খলিল স্যার, উনি এমন ভাবে ঢুকলেন, যেন আমাগো কাউরে চিনেন না। তয় উনারে দেইখাই আমাগো সবডির মুখে হাসি ফিরা আইল। স্যার ভাইভার একজামিনারদের সামনে গিয়া হাসিমাখা সেলাম দিয়া কইলেন, যে তার করার মত কুনু কাম নাই, তাই ভাবছেন যে এট্টু আড্ডা দিয়া যাইবেন। উনি একপাশে বয়া থাকলেন। উনি জানতেন, আমরা সাহস পাব, আর উনার উপস্থিতিতে ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রির স্যার-মেডামরা কঠোর হইতে পারবেন না খুব একটা।
শেষ। হ, পাশ কসসিলাম।
আরেকটা কথা মনে পত্তেসে। এনাটমি ডিপার্টমেন্টেরই কোন চতুর্থশ্রেণির কর্মচারির রিটায়ার করার কথা, তো একদিন এনাটমি ডিপার্টমেন্টের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার দেখলাম, যে যিনি অবসর নিচ্ছেন তার উদ্দেশ্যে বিদায়ী সম্বর্ধনা ও খানাপিনার আয়োজন করা হয়েছে। সবাই আমন্ত্রিত। এইরকমটা আর কখনো দেখি নাই মেডিকেলে, স্যারের আমলেই দেখছিলাম। আর, মন বলতেছিল, এই আয়োজনের পিছে মনসুর খলিল স্যারই আছেন।
আমরা তখন থার্ড বা ফোর্থ ইয়ারে। একদিন ফরেনসিক মেডিসিন লেকচারে, আদিল স্যারের লেকচার। আমি লেকচার তো তেমন করি নাই, কী কারণে অইদিন উপস্থিত ছিলাম ভাগ্যগুণে, ফলে একটা অসাধারণ দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হইছিল। ক্লাস চলতাসে। এট্টু পরে দরজা খুইলা গেল। দেহি মনসুর খলিল স্যার। ঢুকার অনুমতি নিয়া আদিল স্যাররে একটা নীরব সালাম দিয়া উনি মাথা নিচু কইরা গ্যালারির একেবারে লাস্টে গিয়া বয়া পড়লেন। আমরা তো আমরা, আদিল স্যারও কয়েক সেকেন্ডের লিগা হতভম্ব হয়া গেলেন। তারপর, আদিল স্যার, ‘স্যার, স্যার, কী করেন’ বইলা দৌড় দিয়া পিছে গেলেন। কইলেন, “আপনি আমার পাশে বসেন, স্যার”। মনসুর খলিল স্যার কইলেন, “কেন, আমি তো আপনার ছাত্র, তাছাড়া আসতে দেরি হয়ে গেল, আমার পিছে বসাই উচিত”। আদিল স্যার অনেক বলার পর মনসুর খলিল স্যার সামনে গেলেন, তয় কোন ভাবেই আদিল স্যারের পাশে চেয়ারে বসলেন না। উনি ফার্স্ট রো তে বইলেন, গ্যালারিতেই। আদিল স্যার লা-জবাব হয়া ক্লাস আবার শুরু করলেন। তো, ঘটনা কী? ফরেনসিক মেডিসিনের লেকচারে এনাটমির প্রফেসর কেন? ঘটনা হইল, যদিও স্যারের এনাটমিতে পিএইচডি আছে( হুনছি, ভেটেরিনারি’র এনাটমিতেও নাকি তার উচ্চতর ডিগ্রি আছে), হেলথ এডুকেশনে মাস্টার্স আছে, তাও তার মনে হইল, ফরেনসিক মেডিসিন এনাটমির সাথে সংশ্লিষ্ট, যেহেতু অটপ্সি কত্তে হয়। তো, উনি ফরেনসিকে একটা ডিপ্লোমা কইরা ফালাইলেন।
তার আর স্মৃতি নাই। তয়, থার্ড ইয়ারে, আবু সিনার একটা কাহিনী মনে পত্তেসে। ঐ সমকা কথা, যখন আমি, মহসিন, মিজান পরাবাস্তব দুনিয়ায় আছি, দিন-রাইত কাটে সিলেটের বাউলদের গান, বই আর পাঁঠা স্টাডি কইরা(মহসিন কত্তো, আমি পাঁঠারে আদর কইরা ধইরা থাকতাম)। রাজ্যের দুনিয়ার জানলা মহসিন খুইলা দিতাসে আমার সামনে। একদিন গভীর রাইতে, আমরা তহন মেইবি রাইত তিনটায় রুমের ভিত্রে ক্রিকেট খেলতে গিয়া পাশের রুমের ঝাড়ি খায়া চুপ কইরা বয়া রইছি – মহসিন হঠাৎ কইল বই পত্তে পত্তে, যে তসলিমা’র ‘ক’-এ নাকি মনসুর খলিল স্যারের কথা আছে। ঠিক খেয়াল নাই, মহসিন পইড়া শুনাইছিল, যে মনসুর খলিল নামে এক গুডবয় ভাল ছাত্র তসলিমাদের ব্যাচমেট ছিল, যার গুল্লাগুল্লা গাল দুইটা ছিল গোলাপী, আর যে পড়া-লেখা ছাড়া কিসসু বুঝতো না। ময়মনসিংহ মেডিকেলে তসলিমা নাসরিন আর আবু হাসান শাহরিয়ারদের ব্যাচ-মেট ছিলেন সম্ভবত মনসুর খলিল স্যার।
আমার লাহান স্যারের হাজার, হাজার, হাজার স্টুডেন্টেরও নিশ্চয়ই অসংখ্য কাহিনী আছে, স্যাররে লয়া। একত্র কল্লে মহাকাব্য হবে। স্যারের দান, পরোপকার – এসবের গল্প করব না। আমি আর কী-ই বা জানি। শোনা কথা কিছু। অন্য কেউ জানাক। তার পাণ্ডিত্যর গল্পও না। আমি খালি তার ‘অহেতুক প্রেম’-এর ক্ষমতার দুই-একটা নজির দিলাম। স্যারের মারা যাবার খবরটা পাবার কিছু পর থেকেই মাথায় ঘুরতেছিল চারটা লাইন –
“সিজারকে দাও পাওনা যা তার
মাওলাকে দাও পুরো আমিত্ব
অহেতুক প্রেম ক্ষমতা তোমার
ধু ধু শূন্যতা তোমার বিত্ত”।(সৈয়দ তারিক)
হি ইজ দ্যা বেস্ট টিচার আই হ্যাভ এভার সিন, ইন দ্যা...ওয়েল..ইন দিস প্ল্যানেট। (ইউনিভার্সের বেস্ট যিনি, তিনি অন্য গ্রহের, আক্ষরিক অর্থেই এলিয়েন, তার নাম ম্যালিখ্রাউফ।)

আমি পারি নাই, কিন্তু স্যারের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী, বা তাদের কেউ-কেউ তাঁর লিগ্যাসি বহন করুক। দ্যা গ্র্যান্ডমাস্টার মনসুর খলিল স্যার বিরাজুক সকলের অন্তরে। জগতের মঙ্গল হোক..

লিখেছেন - কাজী মুনতাসীর বিল্লাহ মিশু

৩২.

# স্মৃতিচারণ
# আমি_আর_মনসুর_খলিল স্যার


সময়টা ২০১২সালের শেষের দিকে,মেডিকেলে
চান্স পেয়েছি, এমন একটা মেডিকেল যে মেডিকেলের নাম আগে কখনো শুনিনি,
ইন্টারনেট এ সার্চ দিয়েও খুব একটা ইনফরমেশান পাইনি , অনেক কষ্টে জানলাম মেডিকেল টা কিশোরগন্জে।।।।

ভর্তি হতে এসে দেখি মেডিকেলে কিছু নেই, নার্সিং ইন্সটিটউট থেকে ধার করা একটা রুমের বাইরে লেখা
অধ্যক্ষ, মনসুর খলিল, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ।

ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম, উনি কাঠের চেয়ারে
বসে আছেন, একজন প্রিন্সিপাল কেনো কাঠের চেয়ারে বসবেন??পরে শুনলাম, এত আরাম আয়েশ তার পছন্দ না।


আমার দিকে তাকিয়ে বললেন তোমার নাম কি???
আমি বললাম স্যার শামিম,
তোমার বাসা কোথায়??? স্যার লক্ষীপুর।।।।।
ঠিক আছে বাপু তুমি মাইগ্রেশান দিয়ে নোয়াখালী মেডিকেলে চলে যাবে, এটা একটা
রদ্দি মার্কা মেডিকেল এখানে কিছু নেই ( কথাটা শুধু
আমার জন্য না যতগুলো স্টুডেন্ট ভর্তি হয়েছে
সবাইকেই একবার করে বলা হয়েছে)

ইচ্ছে করেই নোয়াখালী মাইগ্রেশান দেই
নাই,হোস্টেলে উঠার আগে উনার সাথে দেখা
করতে গেলাম, শামিম, তোমার মাইগ্রেশান হয়নি??

(স্যার আমার নাম কিভাবে মুখস্ত রাখলেন আমি জানিনা, শুধু আমি না সবার নাম ই মনে থাকতো) , না স্যার আমি নোয়াখালী মাইগ্রেশান দেইনি, কিছুক্ষন রাগী চোখে তাকিয়ে ছিলেন, তারপর বললেন ঠিক
আছে, এখানে কিন্তু ক্লাস হবেনা ঠিকমত, কোন টিচার নাই তুমি কান্না কাটি করবে না, আমার সাথে কখনো বাঁদরামি করবেনা, আমার যখন ইচ্ছে হবে আমি ছুটি দিবো তার আগে বাসায় যাবেনা, ঠিক আছে????

আমি বললাম,জ্বি স্যার আমি আপনার কাছে থাকবো,,, তারপর স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু দিলেন, বড় হওয়ার পর থেকে আমার নিজের বাবা ও আমাকে চুমু দেয়নি, তাই কেমন জানি লজ্জা লাগছিলো,,,,,,,....

কলেজ থেকে ভাড়া নেওয়া হোস্টেলে উঠলাম,উঠে তো রিতিমতো অবাক!! খাট,আলনা,চেয়ার টেবিল,তোশক,পানির
জগ,গ্লাস,মশারি,ময়লা ফেলার জন্য ঝুড়ি, সবকিছুই প্রতিটা স্টুডেন্ট এর জন্য রুমে রুমে রেডি করা!!!


তারপর থেকে শুরু হলো ক্লাস, ক্লাস তো আর
শেষ হয়না, ১৫দিন না যেতেই ফার্স্ট কার্ডের ডেট দিয়ে দিলো, অন্য মেডিকেলের বন্ধুরা তখন travelling to lakhshmipur আপলোড দিচ্ছিলো। আমাকে ফোন দিয়ে যখন শুনলো কার্ড পরিক্ষা তখন ওপাশ থেকে কাশি দেওয়া শুরু করলো..........


কোন এক শুক্রবার সকাল, প্রতিটা রুমের দরজার সামনে ধাক্কানো হচ্ছে,,, এত সকাল কে
আসছে??? স্বয়ং প্রিন্সিপাল স্যার ছেলেদের
হোস্টেলে হাজির তাদের কে দেখার জন্য।।


মাত্র তিন বছরের মাথায় কি হয়নি মেডিকেলে????? প্রথম পেশাগত পরীক্ষাতেই ঢাকা ভার্সিটির আন্ডারে ১ম হয়ে সাড়া জাগিয়ে দিয়েছিলো, স্থায়ী ক্যাম্পাস পেয়ে গেছি, নিজেদের হোস্টেল, একাডেমিক
ভবন সব হয়ে গেছে, ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট হসপিটাল টার ৬ তলা পর্যন্ত উঠে কিশোরগন্জ শহরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, সবই মনসুর খলিল স্যার এর অবদান।।।।

যেখানে একজন মনসুর খলিল ছিলো সেখানে
সবকিছুই হয়েছে।

প্রথমদিন উনার পরনে যে কাপড়গুলো দেখেছিলাম, সেগুলোই সেলাই করে করে
পরতেন। কিভাবে এত সাধারণ জীবন যাপন করতেন এত বড় মাপের মানুষ হয়েও আমার জানা নেই।।
এরাই আসলে প্রকৃত মানুষ, দশ বার জন্ম নিলেও তার মতো হতে পারবো কিনা জানা নেই।
.
লিখেছেন - শামীম আফজাল
SSNIMC

৩৩.

। #একজন_বাবার_জন্য_হাহাকার

#মনসুর_খলিল স্যার মারা গেছেন চার দিন হলো, সবাই আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে!
ডাক্তারদের প্র্যাকটিস থেমে নেই, ক্লাস, পরীক্ষা সবই শুরু হয়ে গেছে। কয়েকদিন
এখানে সেখানে শোকসভা হবে, তারপর একসময় সবাই ব্যস্ততার জন্য ভুলে যাবে! কারো বা হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়বে। তারপর প্রতিবছর একবার করে স্যারের মৃত্যু বার্ষিকী পালন করা হবে গুটি কয়েক জায়গায়; একদিনের জন্য স্যার কে স্মরণ করা হবে। এটাই কেনো জানি নিয়ম, এই স্বার্থপর পৃথিবীতে আমরা সবাই স্বার্থপর কিন্তু স্যার কে
দেখেছি নিঃস্বার্থ ভাবে অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তানের মত করে যত্ন নিতে। সকালে
ক্লাসে খেয়ে গিয়েছে কিনা,সন্ধ্যার পর হোস্টেলে ফেরত আসছে কিনা, প্রতিটা পরিক্ষায় রেগুলার পাশ করতেছে কিনা, কিংবা ছুটি পাওয়ার পর ঠিকমত বাসায় পৌঁছাইছে কিনা। কই অন্য কোন টিচার কে তো দেখেনি এত খবর রাখতে??????


হোস্টেলের মামা,সজিব মিয়াকে দেখিনা সন্ধ্যার পর এসে টহল দিতে, কেনোই বা দিবে তার কাছে তো ফোন আসেনি, সজীব দেখো
হোস্টেলে সবাই আছে কিনা দেখে আমাকে
জানাও,, সজিব মিয়া ও হয়তো কোথাও মুখ লুকিয়ে সবার আড়ালে চোখের জল ফেলছে।


ছেলেরা অনেক কঠোর হয়,তাদের চোখে পানি আসেনা সহজে, আর ডাক্তার ছেলে হলে তো কথাই নেই। কিন্তু মনসুর খলিল স্যারের জন্য কাঁদে নাই তার এমন কোন স্টুডেন্ট নেই, হোক ছেলে বা মেয়ে.....


সেদিন ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের আব্দুল হাই স্যার আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে কেঁদেই দিলেন,,, আচ্ছা,প্রিন্সিপাল স্যার না থাকলে তো টিচাররা ক্লাস না নিলেও কেউ ফোন দিয়ে বলবেনা, স্যার আপনি কেন ক্লাসটা নেননি??? ছেলেমেয়েদের অনেক ক্ষতি হয়ে
গেছে....... কাদির স্যার, বাশার স্যারকে
দেখেছিলাম কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল হয়ে
গেছে...উনিই হচ্ছেন মনসুর স্যার যিনি সবার মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন ..


সারা বছরের মধ্যে মনে হয় হাফিজ স্যারের একটা ক্লাস মিস হয়েছিলো,পরের বছর ঠিকই প্রিন্সিপাল স্যার হাফিজ স্যারকে বলেছিলো গত বছর আপনার একটা ক্লাস মিস হয়েছিলো, এবার কিন্তু আমি এটা মানবো না। খুব অসুস্থতা নিয়েও হাফিজ স্যার কে দেখেছিলাম ক্লাস নিতে।।।

গাইনী ওয়ার্ডে প্লেসমেন্ট ছিলো একবার,রাতের বেলা খুব বৃষ্টি হচ্ছে,বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে,হোস্টেলের নিচে পানি আর পানি, প্রিন্সিপাল স্যার কে ফোন করা হলো ছুটি নেওয়ার জন্য,নাহ্ উনি কিছুতেই ক্লাস ফাঁকি দিতে দিবেন না,,,,,
হসপিটাল গিয়ে দেখি কারেন্ট নেই, এই ইলেকট্রিক যুগে আমিন স্যার কে দেখেছিলাম রাতের বেলা মোমবাতি জ্বালিয়ে ওয়ার্ড করাতে।।।



সবাই ভুলে যেতে পারবে,,, কিন্তু শহীদ_সৈয়দ_
নজরুল_ইসলাম মেডিকেল কলেজের ছাএ _
ছাএীরা কখনো ভুলবেনা,, মানুষ সবচেয়ে
সহজে যেটা ভুলে যায় সেটা হলো মৃত্যু শোক,
কিন্তু বাবা হারানোর শোক কেউ ভুলেনা „প্রতিদিন
মনে পড়ে হয়তো আমরা কাউকে বুঝতে না
দিয়ে এড়িয়ে যাই......

কিভাবে ভুলবো আমরা, এই মেডিকেলের প্রতিটা ইট,বালুকণার সাথে মনসুর খলিল স্যারের পরিশ্রমের ভালোবাসায় সিক্ত শরীরের ঘাম মিশে আছে।

কেউ কারো সাথে মন খুলে কথা বলছেনা, যে
যার মত পড়ে আছে সবার ভিতরেই একটা হাহাকার......
একজন বাবা হারানোর হাহাকার।।

এক সময় হয়তো আমরা ও গত হবো, এটাই
জগতের নিয়ম, কিন্তু শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ বাংলাদেশের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে ,আর সেখানে কয়েকশত বছর পরেও বেঁচে থাকবে মনসুর খলিল স্যারের নাম,ইনশাআল্লাহ সেই ব্যবস্থাই করা হবে .....

হয়তো একশত বছর পর কোনো মা তার ছেলে
কে গল্প বলে ঘুম পাড়াবে,, এক দেশে এক বাবা
ছিলো, নাম তার মনসুর খলিল...... রাত বাড়তে থাকবে,গল্প এগিয়ে যাবে,সন্তানের চোখে ঘুম আসবেনা,যত শুনবে ততই মুগ্ধ হবে আর জানার আগ্রহ বাড়বে মনসুর খলিল স্যার কে নিয়ে।

বাবা ও বাবা একবার একটু ফোন দিয়ে খোঁজ নাও না তোমার ছেলেমেয়ে গুলো কেমন আছে।।। তুমি কি আমাদের আর্তনাদ শুনতে পাওনা????? :( :(

লিখেছেন - শামীম আফজাল

৩৪.

আরেকটা কারণে মনসুর খলিল হয়তো বিশ্বে অদ্বিতীয়। তিনি সমগ্র জীবন নিজের মায়ের হাতের সেলাই করা জামা-কাপড় পরেছেন।

Dr.Monsur Khalil was the head of the department of anatomy of Chittagong Medical College. But this can't express his greatness. This great man has more than 7 degrees including MBBS DFM MCPS MS MPhil PhD MMEd. He has sacrificed his whole life for the sake of students. By means of his father like behaviour,he has established him as one of the most popular & best teacher in the country......!!!

লিখেছেন - লিলি ফারুক

৩৫.

তখন সবে সেকেন্ড সেমিস্টারে পড়ি। ক্যাম্পাসের বয়োঃবৃদ্ধ প্রফেসর কাশেম স্যারের (নানা স্যার নামে পরিচিত) এনাটমি ক্লাসের অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় দেখলাম- নানা স্যারের সাথে প্রমাণ উচ্চতার সুঠাম স্বাস্থ্যের এক ভদ্রলোকও ক্লাসে প্রবেশ করলেন। বুঝাই যাচ্ছিল- ভদ্রলোকের স্মার্টনেস তার বয়সের কাছে হার মেনেছে। উনার পরনে ছিল সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট। এবার নানা স্যার উনাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন- প্রফেসর ড, মনসুর খলিল (এনাটমি ডিপার্টমেন্ট হেড, সিএমসি)। তবে সেদিন আমরা উনাকে নানা স্যারের সরাসরি ছাত্র (মনসুর স্যার তখন কলেজে আরা নানা স্যার ভার্সিটিতে) ছাত্র জানতে পেরে বেশ অবাকও হলাম।
.
এরপর আমরা মনসুর স্যারের ক্লাস উপভোগ করতে লাগলাম। 'ইচ্ছে যেমন কবিতার খাতা' সেদিন 'ইচ্ছে যেমন এনাটমির পাতা' তে যেন নতুন এক রূপ পেল। তবে স্যারের সেই দু'ঘণ্টার ক্লাসে সিম্পেথ্যাটিক-প্যারাসিম্পেথ্যাটিক নার্ভ নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছিল।
.
স্যারের ঐদিনের ক্লাসেই জানলাম- ভেগাস (vagus) নামটি তার বিশদ প্রবাহ ব্যপ্তিতার ছুতোয় ভেগাবন্ড (vagabond) থেকে এসেছে। স্যারের এই তথ্যে ততক্ষণে ক্লাসে নীরব হাসির রোল খেলে গেল। কারণ, আমার ফেসবুক আইডি নামে ভেগাবন্ড শব্দটি জুড়ে ছিল তখন।
.
শুধু তাই নয়- ক্লাসের প্রয়োজনে ব্যাচের মুনতাহা ও রানা কে স্যার ডায়াসে নিয়ে গেলেন। সেখানে তাদের পরিচয় জানতে চাইলে- মুনতাহা'র ভয়েসে ওর অখেয়াল বশত 'আমার রানা' শব্দটি বেরিয়ে আসল। সেদিনের পর থেকে আজো 'আমার রানা' এই ডায়ালগটি ব্যাচের মধ্যে ট্রেডমার্ক স্পিচ হিসেবে বেঁচে আছে। তবে দুঃখের কথা, না মানতে পারার কথা- বেঁচে নেই আমাদের সেদিনের সেই প্রাণবন্ত মানুষ স্যারটি। আজ আর আমাদের কারোর মাঝে নেই। আমাদের মত অসংখ্য ছাত্র আর শুভাকাঙ্ক্ষী ছেড়ে, গতকাল উনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নালিল্লাহি রাজিউন...)
.
আমাদের পাঁচ বছরের ডিভিএম (Doctor of Veterinary Medicine) লাইফে পাওয়া স্যারের ঐ একটি ক্লাস ই উনাকে ভালো লাগার জন্য যথেষ্ট ছিল। মহান আল্লাহ তা'য়ালার কাছে বিনম্র চিত্তে প্রার্থনা করছি- তিনি যেন স্যারকে বেহেস্তে নসিব করেন। আমিন।

লিখেছেন - মুজিব রহমান

৩৬.

আজ তিনটি বছর মেডিকেলে কাটানোর পর প্রথম বারের মতো সুযোগ হয়েছিলো প্রিন্সিপাল স্যারের বাসায় আসার। কিন্তু উনার সাথে আর দেখা হলো কই ! উনি তো চির নিদ্রায় শায়িত।
কেনো জানি বিশ্বাস হচ্ছে না নিজের চোখকে, কোনভাবেই সায় দিচ্ছে না মন।

বারবার মনে হচ্ছে, যা দেখছি সবই ভুল। এই বুঝি স্যারের ঘুম ভাঙবে ।
হয়তো বা সম্ভব হতো যদি সৃষ্টিকর্তা চাইতো ।

এমন নাইনসাফী তো হওয়ার কথা ছিলো না ।
এই ক্ষতিপূরণ তো কোনো কিছু দিয়েই সম্ভব না।

আমরা আজকে কি হারালাম, সেটা হয়তো আমরা আন্দাজ ও করতে পারবো না। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, যে মানুষটা গত কয়েক বছর যাবৎ আমাদেরকে তার শাসন আর নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ রেখেছিলো, যার নখদর্পণে ছিলো প্রতিটা স্টুডেন্ট এর A to Z history,
যার দেখানো পথে এই মেডিকেল লাইফ শুরু হয়েছিলো, সবার সার্বক্ষণিক তত্তাবধানই যার একমাত্র চিন্তা ছিলো, এতোটা ডেডিকেশন যার মনে স্থান নিয়েছিল, সেই শ্রদ্ধেয় প্রিন্সিপাল স্যার আর আমাদের মাঝে নেই।
উনার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি ।

এখন তো আর কেউ খোঁজ নিবে না, কে সময় মতো ক্লাসে এলো, আর কে আসে নি, কার এতো ঠেকা :(

কেউ হয়তো খবর নিবে না পড়াশোনার ।

তার এই অকাল মৃত্যু কেনো জানি মনে হচ্ছে আমাদের গতিটাকে কমিয়ে দিবে, সব কিছুই কেমন জানি অনিশ্চিত মনে হচ্ছে,
ভবিষ্যৎ টা কেমন জানি ঝাপসা মনে হচ্ছে।
যাকে ভরসা করে এখানে থেকে যাওয়া, তিনিই তো আর রইলেন না ।

কোমলতা আর কঠোরতার এক সংমিশ্রণ ছিলেন তিনি ।

তার শাসনের কাছে সবাই মাথা নত করেছে ।
অনেক সময় হয়তো রাগের বশে অনেক কেই কঠিন শাস্তি দিয়েছেন, এর পিছনে কিন্তু উনার বিন্দু মাত্র স্বার্থ ও ছিলো না। যা ছিলো সেটা শুধুই আমাদেরকে নিয়মের আয়ত্তে আনার প্রয়াস।
ভুল ত্রুটি নিয়েই আমাদের জীবন, কেউই এই নিয়মের উর্ধে না।
আশা করি আমরা এমন কিছু মনে রাখবো না ।
তার নিয়ম গুলো মেনে চলার চেষ্টা করবো।

এইতো গত ১৬ ডিসেম্বরে সকাল বেলা স্যার নাম ধরে ডাকলেন।
বার বার কানে বাজছে তার কথাগুলো।

হঠাৎ এমন একটা শকড নিউজ পাবো, কেউ হয়তো আশাও করি নি।

মনে পড়ছে এইতো সেদিন তার সাথে পুরো ব্যাচের ছেলেরা একত্রে লাঞ্চ করলাম, তার ভাগের মাংস খানা আমার পাতে ঢেলে দিলেন , কতো হাসি ঠাট্টা করেছিলেন সেদিন।
স্যারের হাতের প্রথম চড় খাবার সৌভাগ্য টা এই মেডিকেলে মনে হয় আমারই ছিলো, দোষটা অবশ্য আমারই ছিলো।
এনাটমির মতো কঠিন সাবজেক্ট কে যিনি সহজ করে তুলেছেন, উনার কথা কি আর বলে শেষ করা যাবে?
আজ বার বার মনে হচ্ছে, কেমন জানি একটা অস্বস্তি !
খুব কাছের কাউকে হারিয়েছি বলে মনে হচ্ছে , কারণ এই ক্ষণিকের জীবনে
মা বাবার পরে কেউ যদি এতো টা কেয়ার নিয়ে থাকে, তবে উনি এই মনছুর খলিল স্যার, আর কেউ নন ।

তার মরদেহটা দেখে মনে হচ্ছে, যেনো এক নিষ্পাপ শিশু ঘুমিয়ে আছে মায়ের কোলে ।
এইবার মনে হয় তার মুক্তি হয়েছে, সব শৃঙ্খল ভেঙে আজ উনি চলে গেলেন।

লেখক ঠিকই বলেছেন, #মানুষ_মরে_গেলে_পচে_যায়,আর বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায় :(

আর আমরা কতোটা নিষ্ঠুর, যে মানুষ টা আমাদের জন্য এত্তো করলো, তার জীবনের শেষ সময়ে এসেও আমরা কিছুই করতে পারলাম না ।

একটা আফসোস রয়েই গেলো, স্যার কারো প্রতি সন্তুষ্ট হলে তাকে কপালে চুমু দেন। হয়তো আমি এমনটার যোগ্য ছিলাম না। তাই পেলাম না ।
আশা করি একদিন এমন কিছু করবো, যেন আপনি যেখানেই থাকেন না কেনো আমায় নিয়ে গর্ব করতে পারেন।
চোখ বন্ধ করলেই হাসি মাখা মুখটা ভেসে উঠছে । :(

দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নেই আপাতত ।
মনটা ভারাক্রান্ত , ভুল ত্রুটির জন্য অনেক গালি গালাজ শুনেছি, তবুও মনের গহীনে এক বিন্দু জমানো ভালোবাসা থেকে বলছি, আল্লাহ যেনো আপনাকে বেহেশত নসীব করেন ।
এইটুকুই কামনা রইলো স্যারের এক নগণ্য ছাত্রের পক্ষ থেকে।

লিখেছেন - শাহ মোহাম্মদ রিমন
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৮

আজ (১০ মে ২০২৪) রাত দুইটা দশ মিনিটে নিউ ইয়র্কের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হবার কথা। এর আগেও পশ্চিমের দেশ আমেরিকা ও কানাডায় গিয়েছি, কিন্তু সে দু’বারে গিয়েছিলাম যথারীতি পশ্চিমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২৪


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×