somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পিগম্যালিয়ন এফেক্ট

০৭ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ১১:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আকাশে ভীষণ মেঘ করেছে।

ঘন কালো মেঘ ক্রমে প্রবল বাতাসে নৌকার পালের মত ফুলে ফেঁপে উঠছে। ঘরের জানালা বন্ধ। জানালার ওপাশে রাস্তার পাশে থাকা গাছের পাতা প্রচণ্ড বাতাসে ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে। দেখে মনে হচ্ছে পাতাগুলো যেন প্রচণ্ড উল্লাসে প্রাণপণে নেচে যাচ্ছে। যেন আসলেও বিশাল কোনো উৎসবের সমাবর্তন।

মুঠোফোন বের করে আরিফ একটি জিপি নাম্বার ডায়াল করলো।

-হ্যালো। আসসালামু আলাইকুম, আহসান সাহেব আছেন?
-মিটিং এ আছেন উনি। আপনার নাম?
-আরিফ। সৈয়দ আরিফুর মালিক।
-বয়স?
-৩২ বছর তিন মাস।
-মাস তো জানতে চাই নাই। এত বেশি কথা বলেন ক্যান?
-দিন, মাস, বছরের সমন্বয়েই তো মানুষের বয়স বাড়ে, সেজন্য বললাম। দিন মনে নেই, মনে থাকলে দিনও বলতাম।
-এতকিছু বলার দরকার নাই। কোথা থেকে ফোন করেছেন?
-আগারগাঁও।
-আচ্ছা এখন ফোন রাখেন, স্যার যখন আসবেন তখন আপনার কথা স্যারকে বলে দেওয়া হবে।
-জ্বী, জ্বী।

একটা নতুন চাকরী বড় প্রয়োজন। এই চাকরীতে ঠিকমত বেতন হচ্ছে না প্রায় মাস ছয়েক ধরে। এভাবে আর চলা যায় না। ম্যানেজারকে ছাপিয়ে বসের সাথে বেশ কয়েক বার কথা বলার চেষ্টা করেছে আরিফ কিন্তু কোন বারেই সফল হতে পারে নি। বসের সাথে দেখা করতে গেলে বসের পিএ প্রতিবারেই নাম আর অবস্থানের সাথে বয়স জানতে চায়। কেন জানতে চায়? একই নামের অনেক মানুষ ফোন করে নাকি উনাকে? নাকি বয়স বিচার করে উনি মানুষের সাথে দেখা করেন? বয়স বিচার করে একেক জনের সাথে একেক রকম আচরণ করেন?



আরিফ ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছুক্ষণ হাঁটল। বাইরে ঝড়ের সাথে ধুলা উড়ছে, হয়ত একটু পরেই বৃষ্টি আসবে। আরিফের বৃষ্টি খুব অপ্রিয় কিন্তু তার এখন ঘর থেকে বের হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। গন্তব্যহীনভাবে অনেক দূরে কোথাও হেঁটে চলে যাওয়া যেত যদি। হুট করে হাঁটতে চলে যাওয়ার এই অভ্যাসটা বহু পুরানো, সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে। এই অভ্যাসটা সে পেয়েছিল অতসীর কাছ থেকে।


অতসীর পুরা নাম ছিল অতসী রাণী দেবী। স্কুলে পড়ার সময় পাশের বাসার এক মেয়েকে অসম্ভব ভালো লাগত আরিফের, সেই মেয়েটিও হিন্দু ছিলো। সে ভালোলাগা শুধুই জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকার বাইরে যেতে পারে নি। অতসীর সাথে অবশ্য এমন কিছু হয় নি। অতসীকে আরিফের কখনও `আমি তোমাকে ভালোবাসি` কথাটি বলতে হয় নি। অতসী নিজেও কোনদিন বলে নি। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া দুজন ছেলেমেয়ের মাঝে যেখানে বিদ্যুৎ গতিতে ভাবাবেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে আসলে `ভালোবাসি` শব্দটা কোন না কোনভাবে ফিকে হয়ে আসে। উজ্জ্বল হয়ে যায় শুধু আবেগগুলো। মুঠোবন্দি আঙুলেরা তখন নীরবে কথা বলে, তখন যেন নিশ্চুপ হয়ে যায় মানুষদুটো। অতসীর চোখগুলো ছিলো জন্মকাজল পরানো। টানাটানা, পাখির নীড়ের মত চোখ। এমন জন্মকাজল পরা চোখের দিকে তাকালে ভ্রম হত আরিফের। অদ্ভুত কাজলকালো দুটো চোখ তাকে কেবল যেন আপন করে টানতো আর টানতো।

অতসী কবিতা লিখত। আহামরি, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কোন কবিতা হয়ত না কিন্তু অতসীর কবিতা পড়লে ভালো লাগতো আরিফের। বিচ্ছিন্নভাবে, অবচেতনভাবে আরিফের চোখদুটো গ্রামের মাঠে ভর দুপুরে খেলতে থাকা দুরন্ত বালকের মতই কবিতার প্রতিটি বাক্যে, শব্দে নিজের ছায়া খুঁজত। অতসী ছেলেমানুষি কিছু আমি `তুমি-মার্কা` অনুকাব্য লিখত। যেমন-

`হাত বাড়িয়ে রোদ্দুর ছুঁই
তুমি আমার হও বা না হও আমি শুধুই তোমার হই`

আর, মাঝে মাঝে ভীষণ শক্ত করে হাত ধরে আরিফের দিকে পাখির নীড়ের মত চোখ দিয়ে গভীরভাবে তাকিয়ে বলতো, আরিফ তুমি `পিগম্যালিয়ন এফেক্ট` এর কথা জানো? আরিফ জানত না, অতসী তখন আরিফকে জানাতো প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি বা ভেনাসের চক্রের পিগম্যালিয়ন এবং গ্যালাতিয়ার প্রেম কাহিনী। প্রায় ৪০০ বছরের পুরানো কাহিনী।

`সাইপ্রাস দ্বীপে পিগম্যালিয়ন নামের এক বিখ্যাত ভাস্কর বাস করতেন। কেউ বলতো তিনিই ছিলেন সাইপ্রাসের রাজা, কেউ বা বলত তিনি ছিলেন একজন ভাস্কর শিল্পী। নারীদের প্রতি ছিলো প্রবল বিতৃষ্ণা, ছিলেন ভয়ংকর নারী বিদ্বেষী। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন জীবনে কখনো বিয়ে করবেন না। প্রচুর মূর্তি তৈরী করতেন তিনি। এক সময় তিনি নারীদের কদর্যরুপে দেখানোর জন্যই একটি নারী মূর্তি বানানো শুরু করলেন। কিন্তু যতই দিন গেলো ততই হাতির দাঁত কেটে কেটে এক অপরুপ সৃষ্টি তৈরী হতে লাগলো। পিগম্যালিয়ন প্রতিদিনই নতুন নতুন সৌন্দর্য্যের পরিস্ফুটন ঘটাচ্ছিলেন মূর্তিটিতে। এক পর্যায়ে এমন হলো কোনো জীবন্ত নারীর সাথে মূর্তিটির তুলনা চলে না! মূর্তিটি তৈরী শেষ্ করে পিগম্যালিয়ন ভয়ংকরভাবে প্রেমে পড়ে গেলেন মূর্তিটির। তার মনোজগতেও এক বিশাল পরিবর্তন এলো। মূর্তিটির প্রাণ নেই বলে দিন দিন পিগম্যালিয়ন যেন আরও দিশাহারা এবং বেদনাতুর হয়ে যাচ্ছিলেন। তখন একদিন পিগম্যালিয়ন এলেন প্রেমের দেবী ভেনাসের মন্দিরে। তিনি দেবীর কাছে প্রার্থনা করলেন, `হে দেবী! আমি যেনো আমার হাতে গড়া মূর্তির মতো কাউকে আমার স্ত্রী হিসেবে পাই`। দেবী এসে দেখলেন এ যেন তার আদলে গড়া মূর্তি। তিনি পিগম্যালিয়নের প্রার্থনা সত্য করলেন। নারী মূর্তিটির নাম দেওয়া হয়েছিলো গ্যালাতিয়া। এই হল পিগম্যালিয়ন আর গ্যালিতিয়ার প্রেম কাহিনী।

পিগম্যালিয়ন খুব বেশি আশা করেছিলেন, এবং তিনি বেশিই পেয়েছিলেন- তাই এই বিষয়টির নামকরন করা হয়েছে `পিগম্যালিয়ন এফেক্ট`। কারণ, পিগম্যালিয়ন এফেক্ট` এ বিশ্বাস করা হয়, মানুষের উপর বেশি আশা করলে, সেই রকম ফলাফলও তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়। তাদের কাছে কম আশা করলে, প্রাপ্তিটাও হয়ে যায় কম।`

আরিফ, তোমাকে আমার জীবনে পাওয়ার পর আমার মনে হয় আমার জীবনে `পিগম্যালিয়ন এফেক্ট` সত্য হয়েছে। ভার্সিটিতে উঠে প্রথম থেকেই আমি যেই ছেলেটিকে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম সেই ছেলেটির সান্নিধ্য আমি পেয়েছি। সেই মানুষটির আপন মানুষ হয়েছি, যে মানুষটি আমার পাশে বসলেই আমার মনে হয় আমার পৃথিবী আনন্দে দুলে উঠেছে। অতসীর কন্ঠ আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসে। আরিফ আলতো করে অতসীর হাত ধরে বসে থাকে। নিজেকে ওর পিগম্যালিয়ন না মনে হলেও ওর চোখে অতসী যেন গ্যালিতিয়া হয়ে উঠে। চঞ্চল অতসী দিন দিন যেন আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে। ভর সন্ধ্যায় হুট করে আরিফের হলের সামনে এসে ফোন দিয়ে বলবে, `বাইরে এসো তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে`। ভোররাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে নরম স্বরে বলবে, আমার দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছে। ফোনের লাইনটা কেটো না প্লিজ। তুমি বরং ঘুমাও আমি তোমার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনি। কিংবা টঙের দোকানে চা খাওয়ার সময় বলবে, `আরিফ, আমার চায়ের কাপে ছোট্ট করে একটা চুমুক দিয়ে দিবে? তুমি প্রথমে খেয়ে দিলে, আমার এই চা খেতে একটু বেশিই ভালো লাগবে`।

আরিফকে নিয়ে পাগলাটে অতসীর আবেগ দিন দিন বেয়াড়া হতে থাকে। ক্যাম্পাসে বন্ধুদের চোখে আরিফ হিংসার পাত্র হয়ে যায়। কারও প্রেমিকা এমন আবেগী বা দুঃসাহসী না। অন্যদের যেখানে প্রেমিকার পেছনে টাকা খরচ করতেই দিন যায় সেখানে অতসী খুলনায় নিজের বাড়ি গেলেই আরিফের মুঠোফোন টেক্সট আর ভয়েস মেসেজে ভরিয়ে রাখে। খুলনা থেকে ঢাকায় পা রাখামাত্রই সে আগে আরিফের সাথে দেখা করবে, আরিফের মুখ দর্শন না করে সে হলে ফিরবেই না।

ফাইনাল ইয়ারে ব্যাচের সবাই মিলে নেত্রকোনা বিরিশিরি বেড়াতে যায়। যাওয়ার আগের দিন জ্বরগ্রস্থ হয় আরিফ। তাও সে অতসীর জন্য বিরিশিরির পথে রওনা দেয়। প্রায় ৮ ঘন্টার ক্লান্তিকর যাত্রা, আরিফের গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে। সেই জ্বরে অতসীর হাতের কোমল স্পর্শ বড় মায়াময় মনে হয়। বিরিশিরি পৌছে ওয়াই এম সি এ রেস্ট হাউজে ওঠে সবাই। বাক্স প্যাঁটরা রেখেই সবাই চলে যাবে সোমেশ্বরী নদীতে ক্লান্তি ভুলে স্নান করতে। আরিফের অবস্থা দেখে সবাই ওকে দুটো নাপা এক্সট্রা খাইয়ে বের হয়ে যায়। চলে যায় অতসী নিজেও। রেস্ট হাউজের দোতলা ঘরে লাইট নিভিয়ে, কাঁথামুড়ি দিয়ে একলা শুয়ে থাকে আরিফ। অচেনা একটি স্থানে অসুস্থ হয়ে একা একা শুয়ে থাকতে তার মন খারাপ্ লাগে। দুর্বল শরীর ও জ্বরের প্রকোপে সবকিছু ঘোলাটে মনে হয়। সেই ঘোলাটে সময়ে হঠাৎ করে আরিফ দেখে অন্ধকার ঘরের খোলা দরজায় এক দেবীর তির্যক ছায়া পড়েছে। দেবী আলতো পায়ে আরিফের কাছে চলে আসে, দেবী হালকাভাবে আরিফের মুখের কাছে ঝুঁকে আরিফের কপালে উষ্ণ একজোড়া ঠোঁট দিয়ে তিলক লাগিয়ে দেয়। আরিফ ঘোরগ্রস্ত হয়, আরিফ মোহগ্রস্থ হয়। উলট-পালট শুয়ে থাকে সারা বিছানা। আশ্রয় খুঁজে। আধ খোলা চোখে বিছানায় কাঁথা-কম্বলের রাজ্য বিস্তার দেখে! জানালা গলে বুনো ফুল আর সন্ধ্যার ঘ্রাণে ভরে যায় ঘরটুকু, আরিফ জ্বরের সংস্পর্শে বিভ্রমে হারিয়ে যায়। তখন গাছের পাতায় পাতায় গোপন মায়ার গল্প জমা হয়। অদূরে কোথাও থেকে থেকে ঝিঁঝিঁ পোকারা গান গায়। আরিফের প্রচ্ছন্ন ছায়া অন্ধকারে হারিয়ে যায়। আরিফ হারিয়ে যায় এক ছায়ায়, যে ছায়ার আদি নিবাস মানুষের সুখের ছোট দিনগুলিতে। চোখ মুদেই অনুভব করতে পারে আকাশে বিশাল বড় একটা চাঁদ উঠেছে। সোমেশ্বরী নদীতে সেই চাঁদ নিজের সব সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিয়ে চিক চিক করে জ্বলছে। সেই চাঁদকেও আরিফের দেবী মনে হয়।


আরিফের স্বল্প শিক্ষিত মা সব সময় বলতেন- `বিয়ের আগ পর্যন্ত সব মেয়েদের কাছে থেকে দূরে থাকবি। মেয়েরা বড় ছিনাল হয়। ঢাকার মেয়েরা তো আরও খারাপ। দেখবি কেমন যেন পর করে দিবে তোকে আমার থেকে`।


আরিফ মায়ের কথার সাথে অতসীকে মেলাতে পারে না। বিরিশিরি থেকে ফিরে এসে অতসী যেন আরও নম্র আরও মায়াবতী হয়ে ওঠে। আরিফের মায়ের সাথে দেখা করার আকুলতা জাগে অতসীর চোখে। আরিফ মনে মনে স্বপ্ন বুনে চলে। বসন্তের ওমভরা রোদে ভীষণ সবুজ কোন মাঠে অতসীকে নিয়ে একটা গাছতলায় বসে থাকার স্বপ্ন। তার গ্রামের বাড়িতে প্রচণ্ড শীতের ভোরে অতসীকে নিয়ে তার সেই ছেলেবেলার চিরচেনা মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার স্বপ্ন। স্বাপ্নিক ভাবালুতা আরিফের দু চোখে মেঘ জমা করে। একটা চাকরী বড় প্রয়োজন। মা, বাবা, বড় ভাইকে রাজি করাতে হবে। এই ভাবনার ভিড়ে টের পায় অতসী আরিফের গা ঘেঁষে কাঁধে মুখ রেখে নিরন্তর স্বপ্ন সাজাচ্ছে।

ফাইনাল পরীক্ষার পর খুলনা ফিরে যায় অতসী। কিছুদিন পর ঢাকায় ফিরে এসে আবার চাকরী খোঁজা শুরু করবে। মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্তদের যেমন কিছু আটপৌরে ছোট ছোট লক্ষ্য থাকে আরিফ আর অতসীর লক্ষ্যগুলোও তেমন থাকে। আরিফের মনে হয় সেও এবার প্রার্থনা করবে, `অতসীর মত দেবীকে যেন সে স্ত্রী হিসেবে পায়`। কিন্তু প্রেমের দেবী এবার আর আরিফ নামক পিগম্যালিয়নের ইচ্ছা পূরণ করেন না। খুলনা থেকে অতসী ফিরে আসে না। মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে হিন্দু সম্প্রদায়ের আরেক ছেলের সাথে অতসীর বিয়ের কথাবার্তা চলে। অতসী প্রতিবাদ জানায়, আরিফের কথা বলে পরিবারকে রাজি করাতে যায়। এর ফলাফল হয় আরও কঠিন। অন্য ধর্মের ছেলের সাথে ভালোবাসা আর বিয়ের স্বপ্ন বোনার অপরাধে অতসীকে বাসায় আটকে ফেলা হয়। মুঠোফোন কেড়ে নেওয়া হয়। তারপর প্রায় জোর করে একদিন লগ্ন মিলিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় অতসীকে। ঢাকায় থাকা আরিফ সহস্রবার ফোন করেও অতসীর মুঠোফোন বন্ধ পায়। অবুঝ শিশুর মত ডুকরে কেঁদে ওঠে আরিফের পৃথিবী। কাঁদতে কাঁদতে আরিফের খুব জানতে ইচ্ছে হয় শঙ্খ কঙ্কন হাতে পরে ভেতরে ভেতরে ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছিলো অতসী? কী পরিমাণে বেদনার পাহাড় জমিয়ে সেই সময় অতসী নিজেকে শান্ত করে বসেছিলো মণ্ডপে? রক্তিম সিঁদুর পরানোর সময় ওর জন্মকাজল পরানো চোখদুটো কি ভিজে উঠেছিলো? কেমন লাগছিলো তখন ওর?

ঘরের পাশের বারান্দায় খুটখুট করে শব্দ হচ্ছে। হয়ত কোন ধেড়ে ইঁদুর। ঝড়-বৃষ্টির প্রকোপে ভয় পেয়ে কাঠের দরজার কোনায় আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। বেচারা। আশ্রয়হীন আরিফের মতই। আরিফ আপনমনে হেসে ওঠে। ফ্যাকাশে-বিষণ্ণ হাসি। যে হাসি চৈত্রমাসের ধানি জমির মত, পাকাপাকিভাবে ফাটা। যে হাসি শোনার জন্য এই ঘরে আর কেউ নেই।

বছর দুয়েক আগে আরিফ একটা এনজিওতে কাজ করতো। সেখানে হাসান আহমেদ নামের একজন চমৎকার ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়েছিলো ওর। পৃথিবীর সব সমস্যার কোন না কোন সমাধান থাকতো সেই মানুষটার কাছে। নানা ঘাত সংঘাতেও যিনি আনন্দের সন্ধান দিতে পারতেন। মানুষটা এখন চাকুরী নিয়ে কানাডা চলে গেছে।

হাসান ভাই বলতেন, `দেখো দেখি মিয়া আমার নামটা ক্যামন অদ্ভুত! হাসান আর আহমেদ দুইটাই হইল সারনেম। সারাজীবন সারনেম নিয়াই কাটায় দিলাম। নিজের আসল নাম আর হইল না। অবশ্যই আমার একটা ডাক নাম ছিলো। সেই নামে একজনই ডাকতো। সে আর নাই, নামটাও তাই হারায় গেসে। তারপর কিছুটা দুলে দুলে হেসে বলতেন, আমার নামটা শুনবা? আমার ডাক নামটা ছিলো `বুড়া`। নামটা বলেই তিনি আবার অনেকক্ষণ দুলে দুলে হাসতেন তারপর একসময় হাসতে হাসতে উনার চোখে পানি চলে আসত।

হাসান ভাই তিয়ানা নামের এক নেপালি মেয়েকে ভালোবাসতেন। বছরখানেকের বেশি সম্পর্ক ছিলো। একটা সড়ক দুর্ঘটনায় তিয়ানা তার একটা পা হারায় এবং অন্য পা`টিও দিন দিন অবশ হতে থাকে। হাসান ভাই সারাজীবন তিয়ানার পাশে থাকতে চেয়েছিলেন। এই পাশে থাকার বিষয়টি পারতপক্ষে যত না শক্তির তার চেয়েও বেশি সাহসের। হাসান ভাইয়ের সাহস এবং ভালোবাসা কোনটারই অভাব ছিল না। কিন্তু তিয়ানা একদিন হুট করেই নিজের বোনের সাথে বাসা বদল করে হাসান ভাইয়ের সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। হাসান ভাই তিয়ানাকে এরপর আর খুঁজে পান নি। তিয়ানার বন্ধুবান্ধবেরাও ওর কোন খোঁজ দিতে পারে নি। তবে হাসান ভাইয়ের দৃঢ় বিশ্বাস সবাই মিথ্যে বলছে। তিয়ানা সবাইকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছে কেউ যেন হাসান ভাইকে তিয়ানার কথা না জানায়। হাসান ভাইয়ের যেন কোন ঠিকঠাক সুস্থ সবল মেয়ের সাথে সুন্দর জীবন গড়তে পারে। সংসারী হতে পারে। অথচ হাসান ভাই আর বিয়ে করেন নি।

কফিশপে বসে বসে তিনি মাঝে মাঝেই বলতেন, `বুঝলা আরিফ, নেপালের মানুষ, হিমালয়ের কাছে যাদের বসবাস তাঁরা হবে সাহসী, উদ্যমী, স্বপ্নবাজ। কিন্তু ওরা তা না, আমার মত সাধারণ একজন পোলা যেখানে তিয়ানার সাথে জীবন কাটাইতে ভয় পায় নাই সেখানে কিনা ওরা ভাবসে আমি করুণা করতেসি। কোন মানে হয়? কোথায় লুকাবে ও? আমার পরিচিত দুজন বন্ধু আছে নেপালে। একজন নেপালি অন্যজন বাঙালি। হাতে পায়ে ধরে ওদের দুইজনকে দায়িত্ব দিয়ে আসছি। নেপালের চাপ্পা চাপ্পা খুঁজে তিয়ানাকে খুঁজে বের করে আনবে ওরা। হারায় যাওয়া এত সহজ নাকি? এত্তো সহজ না।

তিয়ানা আমাকে `বুড়া` ডাকতো। ওকে এই নামটা আমিই শিখায়সিলাম। আমিও পণ করসি বুড়া হয়ে ফুরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তিয়ানাকে খুঁজে যাব। ঘষা কাঁচের মত আমার দুই চোক্ষের মণি যখন ঘোলা হবে তখনও আমি ওরে খুঁজে যাব। আর যে সব শালারা বলে, একটা মানুষের জীবনে বার বার ভালোবাসা আসে তাদেরকে আমি ধরে ধরে চটকানা মারবো। আমি আমার জীবনে একবারই ভালোবাসছি। আর পারি নাই। পারব বলেও মনে হয় না। কাউকে কাউকে দেখে ভালো লাগতে পারে কিন্তু কাছে গেলেই ফিনিশ! ওভার এন্ড আউট! সবাইরে আমি তিয়ানা সাথে তুলনা কইরা ফেলি। তারপর আর নতুন কোন অনুভূতি বাকি থাকে না। নাহ, হবে না। এইভাবে কিছুই হবে না। শুঁয়োপোকার মত ভালোলাগা কখনই প্রজাপতি মত ভালোবাসা হয়ে উড়বে না। মুখ থুবড়ে পড়বে। জাস্ট মুখ থুবড়ে।

যাউজ্ঞা, অনেক বকবক করলাম। বলতো এখন- `ওয়ার্শা হুনছা` মানে কী? বলতে পারবা? এইটা মানে হলো, বৃষ্টি পড়ছে। নেপালি ভাষা কি মধুর না বলো? বাংলা ভাষার সাথে মিল আছে বলেই মনে হয় এত মধুর। `ম্য তিমিলাই মায়া গ্যসু` মানে কী জানো নাকি? তিয়ানা বলেসিলো আমাকে। হাসান ভাইয়ের গলার স্বর ধরে আসে। `ম্য তিমিলাই মায়া গ্যসু` মানে হল `আমি তোমাকে ভালোবাসি...`

হাসান ভাইকে আরিফ বলেছিলো, তিনি যদি কখনও তিয়ানাকে খুঁজে পান তাহলে পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকেই হোক না কেন আরিফকে যেন জানান। হাসান ভাই হাসতে হাসতে কথা দিয়েছেন। আরিফ জানে হাসান ভাই কোনদিন এই কথা ভুলবেন না। মাঝে মাঝে আরিফের কল্পনা করতে ভালো লাগে তিয়ানা নিজ থেকেই একদিন হাসান ভাইয়ের কাছে ফিরে আসবে। নিজের সাথে হাসান ভাইয়ের কোন অদৃশ্য মিল পায় কি আরিফ? নয়ত সেও কেন এত আলোড়িত হয়েছিলো হাসান ভাই আর তিয়ানার কাহিনী শুনে? এতগুলো বছর হয়ে গেলো আরিফ নিজেও কী সবার মাঝে নিজের অলক্ষ্যেই অতসীর ছায়া খুঁজে বেড়ায় না? আসলেও কি তবে মানুষের জীবনে সত্যিকারভাবে ভালোবাসার ক্ষমতা একবার? মানুষ পঞ্চাশ বছর, ষাট বছর যতই দিনই বাঁচুক না কেন, হয়ত সে অন্য কারও সাথে ঘরও বাঁধবে কিন্তু সত্যিকারভাবে ভালোবাসবে কেবল একবার? নাহ! জীবনের গোলমেলে হিসাব আর মেলে না।

হঠাৎ করেই আরিফের বড় ক্লান্ত লাগে। নিজের ভিতর দ্বন্দের সৃষ্টি হয়। সে কি করবে? তাছাড়া চাইলেই কি সবকিছু ভোলা যায়? বিধ্বস্ত আরিফ চোখ বন্ধ করে এখনও মাঝে মাঝে বেশ অনেক বছর আগের সময়ে চলে যেতে পারে। দেখতে পায় পড়ন্ত বিকেলে সোমেশ্বরী নদীর তীড়ে অতসী আরিফকে গাঢ় করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। অতসীর চোখে ঘন কাজল, অতসীর কানে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল। অতসী যেন আসলেও রাণী ছিলো। অতসী যেন দেবীই ছিলো। যে দেবীর কথা ভেবে আজও আরিফের আর জীবনের কাছে কোন নির্দিষ্ট আকুতি থাকে না।

বন্ধ জানালার বাইরে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে জলডাকাতের ছন্দে। আরিফের আবারও রাস্তায় হাঁটতে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আরিফের যে কোথাও যাওয়ার নেই। তার যাবার জায়গা খুব দ্রুত কমে আসছে। জীবনের কাছে কিছুই আর নতুন করে চাওয়ার নেই, কারণ `পিগম্যালিয়ন এফেক্ট` সব মানুষের ক্ষেত্রে কাজ করে না। কারো কারো জীবন সমান্তরাল রেখার ওপার থেকে কেবল প্রতিশ্রুতির নীল ঘুড়ি ওড়ায় । চেয়ে থেকে থেকে কেটে যায় রক্তপাতহীন চুলোহীন ধূসরে ।

কিছু মানুষ নিতান্তই বেঁচে থাকে অপ্রয়োজনীয় হয়ে। কিছু মানুষ এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকে অহেতুক।
২২টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×