বাংলাদেশের জন্য খুবই সেনসেটিভ ইস্যু। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ খুব ইমোশোনাল এবং বাংলাদেশ বলয়ের বাহিরে তেমন অভিজ্ঞতা রাখেন না। তাই আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা এই বিষয়ে শেয়ার করলাম। যে কেউ আমার সাথে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন। কিন্তু মাথায় রাখবেন, এইখানে আমি আমার নিজের কোন মতামত দেইনি। শুধুমাত্র, আমার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছি। যারা শুধুমাত্র বাংলাদেশ বলয়ের ভিতরে থাকেন, তাদের মতের সাথে পুরোপুরি না মিললেও নতুন চিন্তার খোরাক পেতে পারেন।
১/
মালয়শিয়ায় থাকার প্রথমদিককার সময়ে সেই ২০০৮ সালে আমাদের বাধ্যতামূলকভাবে মালয়শিয়া ভাষাশিক্ষা কোর্স করতে হত। ইউনিভার্সিটি সেই কোর্সটা ফ্রি অফার করত। ইউনিভার্সিটির যুক্তি এমন ছিল যে আমি মালয়শিয়াতে লেখাপড়া করলাম, কিন্তু মালয়শিয়ার কৃষ্টি-কালচার সম্পর্কে কিছুই জানলাম না তাহলে তো ব্যাপারটা কেমন যেন বেখাপ্পা হয়ে যায়। আমার যদি মালয়শিয়াতে দুই-চারটা বন্ধু-বান্ধব না থাকে তাহলে দেশে গিয়ে আমি কি গল্প করব? অথবা আমি যদি অন্য কোন দেশে গিয়ে থিতু হই, তাহলে আমি যেন একটু হলেও মালয়শিয়াকে রিপ্রেজেন্ট করতে পারি।
আমার মত অনেক বিদেশীরা মালয়শিয়ায় এসে ফ্রি পড়ালেখা করে, থাকা-খাওয়ার জন্য একটা ভালো অংকের টাকা মাস শেষে ব্যাংকের একাউন্টে চলে আসে। এর বিনিময়ে মালয়শিয়া কি পাবে? মালয়শিয়া যেটা পাবে সেটা হল একটা ‘গুড ইমেজ’। এটা আসলে মালয়শিয়ার নিজের দেশের ব্রান্ডিং তৈরি করার এক প্রকার ইনভেস্ট। মালয়শিয়া চায় এইসব বিদেশীরা একদিন নিজ দেশ অথবা অন্য কোথাও চলে গেলেও যেন মালয়শিয়ার জন্য একটা সফট-কর্নার নিজের ভিতর রেখে দেয়। সুদে-আসলে এই ইনভেস্ট একদিন বিশাল পরিমাণে মালয়শিয়ায় ফিরে আসবে – এটাই ওদের আশা। এই জন্যই ভাষাশিক্ষা কোর্সটা সব বিদেশীকে করতে হত যাতে তারা মালয়শিয়ার মূল-স্রোত কিছুটা হলেও ধরতে পারে।
আমাদের ভাষাশিক্ষা ক্লাসে হরেক রকমের ছেলে-মেয়ে ছিল। সবার কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড আলাদা। একেকজন এক ডিসিপ্লিন থেকে এসেছে। এক কোর্সের শিক্ষক ছাড়া কোন মালয়শিয়ান ক্লাসে ছিল না।
আমাদের ক্লাসে জ্যাকব নামে জার্মানির একটা ছেলে ছিল। সে উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে মাস্টার্স করতে মালয়শিয়া এসেছিল। তাকে একবার বলছিলাম, জার্মানির মত একটা উন্নত দেশের শিক্ষা ছেড়ে সে কেন মালয়শিয়া এসেছে? তার উত্তর ছিল, জার্মানীর অর্থনীতি অলরেডি অনেক উন্নত এবং সাসটেইনেবল। সেখানে আসলে শেখার তেমন কিছুই নাই। অন্যদিকে মালয়শিয়ার মত দেশগুলো তখন তরতর করে উন্নতি করছিল। এই অর্থনৈতিক ট্রানজিশনটা ছিল জ্যাকবের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। সেই কারণেই সে মালয়শিয়ায় পড়তে এসেছিল। তার আগ্রহের কারণেই সে মালয়শিয়া ছাড়াও সে অনান্য মধ্যম আয়ের দেশ ভ্রমণ করেছে। এমনকি, সে নাকি একবার বাংলাদেশে এসেও কয়েক মাস ছিল।
আমি জানতাম জ্যাকব একজন ইহুদী। সেই সময়ে বাংলাদেশের পাসপোর্টে পরিস্কারভাবে লেখা ছিল যে, ইসরাইলের দরজা আমাদের জন্য এবং বাংলাদেশিদের দরজা ইসরাইলিদের জন্য বন্ধ। কেন জানি ২০০৮ সালের আগে আমার মাথাতে কখনো আসেনি যে ইসরাইলের জন্য বাংলাদেশের দরজা বন্ধ হলেও ইহুদীদের জন্য দরজা আসলে বন্ধ না। ইহুদীরা তো পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে এবং তাদের পাসপোর্ট ইসরাইলি না। সেই দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে তো তারা চাইলেই বাংলাদেশে আসতে পারে। জ্যাকব তার জার্মানির পাসপোর্ট ব্যাবহার করে বাংলাদেশে এসেছিল এবং কোন সমস্যা ছাড়াই বাংলাদেশে অবস্থান করেছিল। পরে জেনেছিলাম, আমাদের দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাওয়া ডেভিড বার্গম্যানও একজন ইহুদী ছিলেন। উনার বৃটিশ পাসপোর্টের কারণে বাংলাদেশে আসতে এবং উনার গাওয়া সাফাই নিতে বাংলাদেশের তথাকথিত ইসলামিক দলগুলোর তো কখনো কোন সমস্যা হয়নি।
আরো অবাক হয়ে পরে জেনেছিলাম যে ইসরাইলে অনেক মুসলিম আছে, অনেকে সেখানে চাকরিও করে। কিন্তু ইসরাইলি মুসলিমরা চাইলেও বাংলাদেশে আসতে পারে না শুধুমাত্র ইসরাইলি পাসপোর্ট থাকার কারণে। বাংলাদেশে ইসরাইলি পার্সপোর্ট ব্যান থাকার কারণে আসলে অনেক মুসলিমও বাংলাদেশে চাইলেও আসতে পারত না। সম্ভবত, ‘নাস ডেইলি’ বাংলাদেশে আসতে চেয়েও আসতে পারে নাই ওর ইসরাইলি পাসপোর্টের কারণে। আদতে সে কিন্তু জন্মসূত্রে একজন মুসলিম।
অন্যদিকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ইহুদী কিন্তু ইসরাইলে থাকে না। সবচেয়ে বেশি ইহুদী থাকে আমেরিকাতে। পরিসখ্যান দেখতে চাইলে উইকিপিডিয়া ঘাটতে পারেন। আর ইসরাইল-প্যালেস্টাইন ইস্যুর মূল কারিগর কিন্তু আমেরিকাই। পারবেন আমেরিকার ভিসা ঠেকাইতে?
নাকি উল্টো ভিসা স্যাংশন খেয়ে নিজেই ভিসার জন্য কান্নাকাটি করছেন।
২/
একবার এক প্যালেস্টাইনি পরিবারের সাথে পরিচয় হয়েছিল। ওরা মালয়শিয়াতে থাকত। প্রথমবার যখন ওদের বাসাতে গিয়েছিলাম তখন তাদের বাসার চাকচিক্য দেখে আমি রীতিমত থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। এর ঘটনার আগ পর্যন্ত আমার মনে ফিলিস্তীনি মানুষ সম্পর্কে ধারণা এমন ছিল যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত হবার কারণে ফিলিস্তিনের সবাই বেশ গরীব। কিন্তু সেই বাড়ির কর্তা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলেছিল, ইসরাইলিরা নাকি অতটা বর্বর না যতটা মিডিয়াতে আসে। উনি আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে মিডিয়াতে যা আসে তার সব বিশ্বাস না করতে।
তখন প্রথম জেনেছিলাম যে, প্যালেস্টাইন আসলে দুইটা ভাগে বিভক্ত। একটা পশ্চিম তীর আর আরেকটা গাজা। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা বেশ স্বাধীণতা উপভোগ করে এবং সেখানে কিন্তু এইসব হামলা-মামলা হয় না। মূলত ফিলিস্তিনে সকল হামলা হয় গাজাতে, যেটা মূলত হামাসের আস্তানা। খুব অবাক হয়ে জেনেছিলাম যে পশ্চিম তীরে বসবাস করা ফিলিস্তিনিদের এক বিশাল অংশ এবং ইসরাইলে থাকা অনেক মুসলিম আসলে মনে-প্রাণে ইসরাইলের পক্ষে।
সেই মনে-প্রাণে আসলে কতটা পক্ষে সেটা বাংলাদেশে বসে আপনার পক্ষে চিন্তা করার ধারণারও বাহিরে। জানি কথাটা হজম করা অনেক কষ্টের। আমার কথা বিশ্বাস না হলে পশ্চিম তীরে বসবাস করা বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনির সাথে কথা বলে দেখেন। দেখবেন, বেশিরভাগের কথার ধরণ আপনার মতের সাথে মিলবে না। মানতে কষ্ট হলেও এটা সত্য। এটা বুঝতে হলে আপনাকে বাংলাদেশের বলয়ের বাহিরে এসে মানুষের সাথে কথা বলতে হবে।
৩/
২০১২ সালের দিকে ইউনিভার্সিটি অব মালায়ায় একটা কোর্সের কো-অর্ডিনেটর ছিলাম। সেখানে আমার এক ফিলিস্তীনি ছাত্র ছিল যে কিনা গাজা থেকে এসেছিল। খুবই অমায়িক এবং মোটাসোটা সেই ছেলেটাকে দেখলে খুবই ভালো মানুষ মনে হত। সে আমাকে খুব পছন্দ করত, এমনকি সে এখনো আমার ফেসবুকে ফ্রেন্ড হিসাবে আছে। ওর সাথে আমার কিছু ছবিও আছে। সংগত কারণেই তার নাম বলছি না। নিজের নিরাপত্তার কারণে সেই ছবিও পাবলিশ করছি না।
২০১৮ সালে যখন দেশে ছিলাম তখন হঠাৎ বাংলাদেশের এক পত্রিকায় ওর ছবি দেখি। কুয়ালালামপুরে তার নিজের বাসার কাছের এক মসজিদে ফজরের নামায পড়তে যাবার সময় দুইজন লোক মোটরসাইকেলে চেপে এসে তাকে গুলি করে ঝাঁঝড়া করে দিয়েছিল। সে সেখানেই মারা যায়। আমি এই খবর পড়ে এতটাই হতভম্ব ও বিচলিত হয়ে গিয়েছিলাম যে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পরে ওর ফেসবুকে গিয়ে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হই।
পরে বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি যে আমার ছাত্রটি নাকি হামাসের এক বড় নেতা ছিল যেটা ওর চালচলন আর কথাবার্তায় আমি ঘূর্ণাক্ষরেও কল্পনা করি নাই। সে ড্রোন বিষয়ক টেকনোলজিতে বিশেষ পারদর্শী ছিল। কোন কারণে কোন এক বিশেষ মহল তাকে বিপদজনক মনে করায় তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হয়েছিল। মালয়শিয়ান সরকার চাইলেও এই খুনের কোন সুরাহা করতে পারে নাই। তারা শুধুমাত্র ‘বিশেষ বিদেশী শক্তির কাজ’ বলে বিবৃতি দিয়েছিল।
ব্যাপারটা বুঝতে হবে। আশাকরি, আপনারাও বুঝতে পারছেন।
৪/
২০১৯ সালে যখন আবার মালয়শিয়ার ফিরে আসি তখন আবার একই কোর্সের টিউটর ছিলাম। সেই সময় আরেক ফিলিস্তীনি ছেলে আমার ছাত্র ছিল। একদিন ক্লাশ শেষে কথা প্রসঙ্গে সে বলে যে তার কোন পাসপোর্ট নাই। মালয়শিয়ায় তারা একটা বিশেষ ডকুমেন্ট দেখিয়ে অবস্থান করে। মালয়শিয়ান সরকার ফিলিস্তীনিদের জন্য এই সুবিধা বহাল রেখেছে যাতে তারা এই দেশে এসে পড়াশোনা করতে পারে।
সেই ছেলের পরিবারসহ সবাই সৌদি আরবে শরনার্থী। সে কোনদিন ফিলিস্তীনে যায় নি। আমার পাসপোর্টে ‘ইসরাইলের জন্য দরজা বন্ধ’ লেখা দেখে সে একেবারে কেঁদে দিয়েছিল। সে নাকি বাংলাদেশের এই উদারতার ব্যাপারটা জানত না। এবং এটা জানার পর বাংলাদেশ নাকি তার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশে পরিণত হয়েছিল।
অবশ্য শুনলাম, আমাদের নতুন পাসপোর্টে এই লেখাটি নাকি পরিমার্জন করা হয়েছে।
৫/
এবার একটু অন্য কয়েকটা দেশ নিয়ে কথা বলি।
আমার একেবারে কাছের এক লিবিয়ান বন্ধুর নাম মাহের। মাহেরের আর তার এক সিরিয়ান বন্ধুর সাথে একদিন কথা প্রসংগে আমি বলছিলাম, “গাদ্দাফিতো লিবিয়ার মানুষের জন্য অনেক কিছু করেছে।”
সাথে সাথে মাহের আর তার সিরিয়ান বন্ধু “রা-রা” করে উঠে। সে বলেছিল, লিবিয়াতে অথবা লিবিয়ার বাহিরেরও গাদ্দাফির বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। চারিদিকে নাকি গাদ্দাফির চর বসে থাকে। এমনকি নিজের একান্ত বন্ধুর সাথেও গাদ্দাফির বিরুদ্ধে কিছু বললে পরেরদিন তাকে আর তার পরিবারের কাউকে খুঁজে না পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সেই সময় গাদ্দাফি বেঁচে ছিলেন।
মাহের আর তার সিরিয়ান বন্ধু আমাকে আরো বলেছিল, গাদ্দাফি আর আব্বাসী লিবিয়া ও সিরিয়ার এমন অবস্থা করেছিল যে ওদের বিরুদ্ধে যদি খোদ শয়তানও ভোটে দাঁড়াত, তাহলে মানুষ শয়তানকে ভোট দিত। আমেরিকা কেন সুযোগ নিতে পারছিল ব্যাপারটা হয়ত এখানে থেকে আঁচ করা যেতে পারে। আর লিবিয়া অথবা সিরিয়ার কেউ এমন কথা বলতে পারে সেটা অনেকের জন্য অবাক হবার কারণ হলেও এটাই বাস্তবতা। বাংলাদেশে বসে ফেসবুকের আবেগী পোস্ট দেখে চোখ ভাসালে হবে না।
এদিকে আরেকবার এক ইরাকি ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছিল। কোন কারনে সে আমার সাথে অনেক খাতির করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু যখনই শুনল আমি “সুন্নি মুসলিম” ওর চেহারাটা দেখার মত হয়েছিল। চোখ মুখ কাল করে সে আমার সাথে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলা শুরু করেছিল। এবং এর পরে যতদিনই ওর সাথে দেখা হত ততবারই তার চোখে-মুখে আমি ঘৃণার পাহাড় দেখতে পেতাম।
মাহের না বললে আমি কোনদিনও জানতাম না যে আমার ‘সুন্নী’ পরিচয়টাই ওর এই পাহাড়সম ঘৃণা ও বিদ্বেষের কারণ।
অবাক হলেও এটাও বাস্তবতা যে বেশিরভাগ বাংলাদেশির ‘সুন্নী’ পরিচয়ের কারণে অনেক মুসলিম ভাইয়ের চোখে ঘৃণার পাহাড় দেখতে পারেন। সে এমন ঘৃণা আপনি কম্পনাও করতে পারবেন না।
(চাইলে চলতে পারে।)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০২৩ রাত ১১:২৪